08 October 2016

দেলোয়ার হোসেন মঞ্জু

 
আমার কবিতা- ১
কয়েকটা ভাঙ্গা দাঁত, আধ-ভাঙ্গা কপালের ওপর অবিন্যস্ত কেশর...নাকের জায়গায় ঠোঁট আর ঠোঁটের জায়গায় চোখ এবং চোখের আয়তক্ষেত্রে ফুটে-থাকা গাঁজাফুল...
এই তো অনেকটা এরকমই আমার কবিতা... অর্ধেক মানুষ অর্ধেক ঘোড়া
ঘোড়া ছোটে... ঘোড়া ছোটে...
অ্যাবুসিনিয়ার আকাশে লটকে-থাকা রুগ্ন চাঁদের নীচে ঘোড়া ছোটে
এই ঘোড়ার ঘর নাই, গন্তব্য নাই
পায়ে পায়ে পাতাবাহার, ঝরা পাতার সংসার ওড়ে...
উড়ন্ত কবিতাগুলো শুধুমাত্র ইতর নয়, অনবদ্য ইতরের মতো হরিণহত্যাকারী, মাংসশিকারী। কবিতাগুলো একদা মহর্ষি হওয়ার কথা ছিল, হয়ে গেছে চামার। হওয়ার কথা ছিল শ্রীকৃষ্ণদেব, হয়েছে মর্ষকামী।
...এরকমই তো
প্রস্ফুটিত
নিগ্রো কারাগারে রক্তমাখা আফ্রিকান গোলাপ
অনেকটা এরকমই- মৃত্যুর দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত জিহ্বাকাটা আসামীর মতো...আর তো দেখি- হাসপাতালের বারান্দায় এইডস আক্রান্ত রোগীটি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রয়েছে ডাহাহীন মাছির দিকে... চোখের মণিতে তৈরী করছে মাছির সাঁতার, দৃশ্যের ডানা...আর আরব্য রজনীর রমনীরা নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে এইসব ক্যান্সার আক্রান্ত কবিতার দিকে। ইতোমধ্যে রূপসীদের নাভী ছিঁড়ে গেছে, তাহাদের পায়ে লেগে আছে অবিন্যস্ত গোলাপের মগজ, লেগে আছে আগুনের খোসা, শিশির ও এসিডের বুদবুদ...
আমার কবিতায় একটা কৃষ্ণ কিশোর পাওয়া যেতে পারে... পূজোর থালায় পাঁচটি রক্তজবা রেখেছিল কোনো এক মধ্যরাতে। প্রভাতবেলা নিদ্রা ভেঙ্গে দেখি- পূজোর থালায় ফুল নেই, পাঁচটি সাপের বাচ্ছা বসে আছে। বাচ্চাগুলো লুকিয়ে রাখি মাথার ভেতরে। বড় করি... বড় করি... মাথা ছিদ্র করে বেরিয়ে আসবে একদিন প্রার্থনার অজগর...
আর প্রাচীন অগ্নি পূজারী মা আমার দুই চোখে পোষে রাখে আগুনের দাগ। মা বসে থাকে সরাইখানার বারান্দায়, তাতানো রোদের মধ্যে শূকর ছানা কোলে নিয়ে। ...আর ঐ কৃষ্ণশূকরীর উলান চুষে চুষে আমরা পান করেছি দুধের মাংস। বড় হয়ে আহার করি- উটের কলিজা, গাছের হৃৎপিণ্ড আর গাভী-নিতম্বের রেজেলা...
আমার কবিতায় কখনোই আমি কবিতা লিখিনি; লিখে রেখেছি- ধুলি ধূসরিত চাঁদ, ময়লা ও কালো কুচকুচে একটা সড়ক। সড়কের দুই পাশে বেগুন বাগানে ফুটে থাকে নিষিদ্ধ আফিম। এমন নিধুয়া প্রান্তরে মাঝে মধ্যে দেবী-দক্ষিণ আসেন। এমন পদ্ম পাতার স্পর্শে ফর্সা হতে থাকে আমাদের কৃষ্ণ পাথর ও কৃষ্ণ আগুন। বলেছি তো- কবিতায় আমি কবিতা লিখি নি; লিখে রেখেছি মৃত মানুষ, মৃত পিপড়ে ও মৃত সিংহের হৃৎপিণ্ড... 




আমার কবিতা-২
মনুষ্য সমাজ জন্ম অপরিষ্কার জানি
বাজারে বাজারে মানুষ শুধু ছায়া ফেলে যায়। আমি চার চাকার ঠেলাগাড়িতে করে সারা দিন ছায়া পরিষ্কার করি। আমার কবিতা তাই কবিতা হয়ে ওঠেনি। আমার কবিতায় বেশি থাকে ছায়ার ওজন...
কবিতার কুড়ে ঘরে হরিণ পোষার কথা ছিল, পোষেছি আমার মত এক আত্মঘাতী রাক্ষস। ক্ষিধে পেলে আপন জিহ্বা আহার করি যে কোনো মধ্যরাতে। তাই হয়তো আমার কবিতা পড়তে পারে না বাঙলার রহিম-রূপবান, বাঙলার বেহুলা সুন্দরী। আমার কবিতা ভীষণ একা এবং একাই। যে ঘরে থাকি, পাঁচ জন প্রাণী আমরা- একটা টিকটিকি, একটা মাকড়সা, এক জোড়া প্রজাপতি আর একটা ঢোঁড়াসাপ। তাদের সঙ্গে বাতাস ভাগাভাগি হয় আমার। রাত জাগি...নবী সুলেমানের মত আয়ত্ত করি তাহাদের ভাষা। আমার কবিতা তাই মানুষের ভাষায় রচিত, ঠিক বলা যাবে না...
আর তুমি তো জানোই দক্ষিণ- আমি জন্মভিখারী, সৌন্দর্য্যশিকারী...
নারী মা মৃত্যু এবং একটি জবাফুলের মালা পরিধান করে এই সৌরভূমে এসেছি আমি। নিজে নিজে ধরতে শিখেছি বাতাসের আঙুল...বয়স কতো ছিল তখন! একদিন সন্ধ্যেবেলা দেখলাম- দূর পাহাড়ের চূড়ায় একপাল ময়ূর পুচ্ছ মেলেছে...কাছে যাই কাছে যাই
ঝাপ দিয়ে দেখি- এতো ময়ূরপুচ্ছ নয়, অগ্নিগিরি। পোড়া মানুষের বৈঠকখানায় আমি তো যাবোই! নরকের নবম কুঠুরী আমার অধিক কে আর ভালবাসবে বলো!
ছেলেদেরে বলেছি- (যাদের নাভীর নীচে এখনো লোম ওঠে নি) মরার জন্য শিলিং ফ্যান ভাল নয়, মরার জন্য মহাসাগর ভাল।...আর মহাসাগরে জল রান্নায় সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকেন প্রাচীন পৌঢ়া (তিনি আমার বিগত জন্মের মা ছিলেন। আমার জ্বর হলে মাটির উনুনে আম্রকাষ্ঠ দিয়ে রান্না করে দিতেন ফণিমনসার হাড়।) আমি চাই আমার মা এরকম রান্না করুক। ফজরের নামাজ পড়ে একটা কাসার পাত্রে চায়ের পানি বসাক। আমার কবিতার বইগুলো পুড়িয়ে পুড়িয়ে আগুনের তেজ বাড়িয়ে দিক। বুদ বুদ জলের মধ্যে চায়ের পাতা মিশ্রনের সামান্য আগে নিভৃতে রেখে আসব আমার ছেড়া-হৃৎপিণ্ড। চায়ের কষের মতো বের হবে এইসব জন্মলজ্জা...
ঠিক এরকমই লজ্জিত এবং পাপিষ্ট আমার কবিতা...
তারপরও উর্বর অগ্নিকাণ্ডের ভেতর ছায়াহরিণীর গান শুনিয়ে শুনিয়ে বড় করেছি তাদের; বড় করেছি গ্রাম গড়রবন্দে নয়, উৎকৃষ্ট ইন্দ্রপুরীতে।
আমার যুবতী কবিতাগুলোর বিয়ে হয় নি কখনো, একদিন সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে দেখি- তারা সবাই বিধবা হয়ে গেছে...আমার মৃত পাণ্ডুলিপিতে ছাইচাপা থাকে মৃত এক বিধবার গ্রাম... তারপরও সৌর সীমান্তে দাঁড়াই। রঙ-করা চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঈশ্বর নিয়ে ক্লান্তি আসে, দেবী দক্ষিণ নিয়ে ক্লান্তি আসে না। অধৈর্য্য দক্ষিণ বলেন- কত আর ধৈর্য্য ধরব হে... ধৈর্য্য ধরে ধরে আমার নাম ধৈর্য্য দেবী হয়ে গেছে...
ঋতু বদল হয়
গ্রীষ্ম, বর্ষা, হেমন্ত আসে....
এতোসব দৃশ্যবদলে আমার চোখের মণিতে লোম গজায়। দেবী দক্ষিণ এসে শেভ করে দিয়ে যান। আমার কবিতায় মাঝে মধ্যে তাই চোখের রক্ত পাওয়া যেতে পারে। আমায় ক্ষমা কর হে নর ও নারীমণ্ডলী। আমি দুঃখিত

______________________________________________________________________

No comments:

Post a Comment