প্রায় সবাই চোখ গোল করে খবর দেখল।
পড়ল নিঃশ্বাস টান টান করে। ওদিকে টিভিতে দুমদুম করে ‘তু চিজ বড়ি মাস্ত মাস্ত হচ্ছে’। শিহাব একদিকে গার্ডেন চেয়ারে বসে মানুষ দেখছিল। কত বর্ণিল মানুষ। ধনী দরিদ্র, লম্বা খাটো, জমকালো সাধারণ, পূর্ণ
উদর ক্ষুধার্ত। মানুষ দেখতে বেশ মজার। প্রত্যেকের চেহারা আলাদা। সেই চেহারায় কাউকে
চেনা যায় না। কে সুখী আর কে দুঃখী। কে খেয়েছে আর কে এখনও কিছু খায়নি। সে ধরতে গেলে
এখন বেশ ক্ষুধার্ত। সকালে দুটো মিনি সাইজ লুচি আর এককাপ লাল চা খেয়েছে। লাল চা তার
পছন্দ নয়। কিন্তু উপায় নেই, দুধ জোগাড়
করা দায়। মধ্যদুপুরে কয়েক গ্লাস পানি খেয়েছিল। ধরতে গেলে সারাদিন উপোস। রমিজ একটু আগে
শুধু এক কাপ লাল চা খাইয়েছে। কলেজ জীবনের বন্ধু। সরকারি চাকুরি করছে। চেহারায় সুখী
মানুষের জেল্লা। যখন প্রেসক্লাবের দিকে আসছিল দেখা হয়ে গেল। মটরসাইকেলে কোথাও যাচ্ছে।
তাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ গল্প হয়। তখন তার পালাতে পারলেই বাঁচে অবস্থা। কষ্ট
হোক কারও সমবেদনা অসহ্য লাগে।
প্রেসক্লাবের আঙিনায় বসলে পায়ে
সবুজ ঘাসের স্পর্শ লাগে। সে স্যান্ডেল থেকে দুটো পা বের করে ঘাসের শীতলতা মেখে নেয়।
সামনের দোকানগুলোয় দিনের সূর্যের শেষ আলো ধীরে ধীরে নিভতে বসেছে। সন্ধে নেমে আসছে।
সারাদিন এদিক-ওদিক ছোটাছুটি হলো। প্রায় অভুক্ত থাকার কারণে শুকনো মুখে বিস্বাদের গন্ধ
জেগে উঠেছে। সে যথাসম্ভব মুখ দূরে রেখে কথা বলছে যাতে সে দুর্গন্ধ না ছড়ায়। কারও মুখে
থুতু না ওঠায়। আর এরমধ্যে ওই খবর ধরে টানাটানি। শাহিন তাকে শুধোয়, -
‘শিহাব ভারতীয় ফিল্ম আর্টিস্ট ঢাকায়
এসেছে, খবরটা পড়েছিস?’
‘পড়লাম। এক ব্যাটার জন্মস্থান নাকি
পাবনায়। প্রেসকে জানিয়েছে সময় পেলে বাবার ভিটা দেখতে যাবে। তা সুচিত্রা সেনের বাড়িও
তো ওখানে তাই না?’
‘হ্যাঁ ওদের দিন এখন শেষ। এখন হিন্দি
ছবির যুগ। এরা এসেছে একটা সাবান কোম্পানির সুন্দরী প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরনি অনুষ্ঠানে
পারফর্ম করার জন্য। ঢাকার পাঁচতারা এক হোটেলে হবে। সঙ্গে ফ্যাশন শো থাকছে। যাবি না
কি? টিকিট দুই হাজার টাকা। আশ্বিন কার্তিকে
কি হচ্ছে ভেবেছিস? ধনধান্যে
পুষ্পে ভরা দেশ!’
‘খুব লেকচার দিলি। আরে তাও টিকিট
মিলছে না।’
ছবিলাল চা দিয়ে গেল। শাহিন খাওয়াচ্ছে।
সকালে চিরিরবন্দরে এক ভালো স্কুপ ফিট করে এসেছে। নারীঘটিত কেস। ইউপি চেয়ারম্যান নাকি
এক মহিলাকে ধর্ষণ করেছে। মহিলাটি স্বামীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে সালিশের আবেদন নিয়ে গিয়েছিল।
গতরাতে মফস্বল সংবাদদাতা ফোন করে ওই খবর দেয়। শাহিন নাম ঠিকানা সব তথ্য লিখে রাখে।
আজ সকালে গিয়ে ধমকে ধামকে হাজার পাঁচেক বাগিয়েছে। সেই টাকায় এখন সবাইকে শিঙাড়া আর চা
খাওয়াচ্ছে। শিহাব এতকিছু ভাবে না। সে শিঙাড়া জমিয়ে খায়। নিজে উঠে গিয়ে উত্তর-পুব কোণার
টিউবওয়েল চেপে দু-গ্লাস পানি খায়। মনে মনে ভাবে, ক্ষুধা কোনোকিছু মানে না। নীতি আদর্শ নারী পুরুষ...কিছু না। এখন তার নিজেরও
কোনো আদর্শ ধরে রাখার ইচ্ছে হয় না। বুঝে গেছে, এ জামানায় যুধিষ্ঠির হয়ে কোনো লাভ নেই। পুরো লোকসান। সে শাহিনের লেকচার শুনে
তার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব মনোযোগের সঙ্গে নিউজ ফিচার পড়ছে। ওর চশমার পাওয়ার বোধহয়
এডজাস্ট হচ্ছে না। চোখদুটো ঘনঘন কুচকোয়। সে সবকিছুতে দুর্গন্ধ খোঁজে। নাকি লেখার মধ্যে
ব্যাকরণের ভুল বের করছে? আজকাল
তাকেও এই ব্যাধি ধরেছে। সে ওকে শুধোল, -
‘কি রে ব্যাকরণ খুঁজছিস?’
‘শালাদের দেখ না, ণত্ব বিধান আর ষত্ব বিধান নেই। তার উপর বাক্য গঠনই জানে না, হয়েছে সাংবাদিক লেখক।’
‘সেই তো খাঁটি গরুর দুধ। আরে বাদ
দে জীবন ব্যাকরণ মেনে চলে না। প্রয়োজন বড় জিনিস। কমুনিকেশনই আসল।’
‘তোর সাথে আমি একমত নই। সব জায়গায়
ব্যাকরণ আছে। ব্যাকরণ মানে কী জানিস...নিয়ম। গোটা ব্রহ্মাণ্ড চলছে নিয়মের সূত্রে।’
‘তা হলে এই দুর্দিনে ভারতীয় নর্তকী
এনে মনোরঞ্জনের বিষয়টা কোন্ নিয়মে পড়ে?’
‘এটা হলো অশ্লীলতার নিয়ম।’
‘মানে?’
‘তেহাত্তরের দুর্ভিক্ষে রংপুরের
বাসন্তি মাছধরা জাল দিয়ে লজ্জা ঢাকার প্রয়াস পায়, ক্ষুধার্ত মানুষ ডাস্টবিন থেকে বড়লোকদের ফেলে দেয়া মুর্গির নাড়িভুড়ি খোঁজে, তখন দামি শাড়ি পরা আর চায়নিজ খাওয়া একধরনের অশ্লীলতা।’
‘তুইতো শ্রেণিবৈষম্যের কথা বলছিস।
পুজিবাদী গণতান্ত্রিক দেশে তা থাকবেই, এতে দোষের কী?
শাহিন চশমা খুলে সেটির লেন্স সার্টের
কোণা দিয়ে বারকয়েক মুছল। লেন্স ঘষে ঘষে আরও ঝাপসা করে দেবে। তারপর অনাবশ্যক শ্রাগ করে
বলল, -
‘তোর সাথে তক্কো করতে পারব না। তুই
ভালগারিটির সংজ্ঞা জানিস না। সমরেশ বসুর প্রজাপতি অশ্লীলতার জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিল। বই
পড়েছিস, মানে বুঝিসনি!’
‘কিসের মধ্যে কী আনতে শুরু করলি!
উলোট পালোট বকছিস? বাদ দে।’
‘তা হলে তোকে বলি, তুই এখন বেকার কেন? তুই তো সিনসিরিয়টির সাথে কাজ করতি। তোর কানকথা নির্ভর হাঁদা বস অন্যের হুইসপারিংকে
এম্পেসিস দিয়ে ছ্যাকড করল। শালাকে তো বিষয়টা তলিয়ে দেখতে হবে না কি?’
‘এটার সাথে ওটা মেলাচ্ছিস কেন?’
‘তোর আইকিউ কম। তুই বুঝবি না। গর্দভ
পর্যায়ের বুদ্ধি। সো নো কনভার্সেশন উইথ এ্য ল্যাগার্ড।’
‘হঠাৎ ক্ষেপে গেলি রে শাহিন। গ্লাসটা ভাঙ দোস্ত।’
শাহিন সত্যি সত্যি চায়ের গ্লাস
ছুঁড়ে দিল। সেটি ড্রেনের কোণায় গিয়ে ঠুস্ করে ভেঙে নিচে গড়িয়ে গেল। শিহাবের মনে হলো, তাকে কেন যে ক্ষ্যাপাতে গেল? অনেককিছুই তো বলা যায়। তুমি বাছা সাংবাদিক। সত্য কথা লিখবে। সত্যের আলো দেখাবে।
তা না করে ফিটিং করে পয়সা কামাচ্ছো। ওতে নিয়মনীতি কোথায়? সে জানে পত্রিকাওয়ালারা বেতন ঠিকমতো দেয় না। একজন মানুষ তার কাজের যথাযথ পারিশ্রমিক
পেলে দু-নম্বরি করে না। মানুষ অমৃতের সন্তান...সহজে কুপথে যেতে চায় না। শাহিন খুব ভালো
বন্ধু। একসময় চরম নীতিবান ছিল। মচকাবে, ভাঙা যাবে না। সহজে কাত্ হওয়ার মতো লোক নয়। সে তাকে শান্ত করার জন্য কিছু বলতে
চাইল। সেজন্য মুখ খুলতে দেখে শাহিন তার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। না কি কোন্
ভাবনার দিগন্তে ভেসে গেছে? কিছুক্ষণ।
তারপর চেয়ার থেকে উঠে রাস্তায় নেমে গেল। শিহাব কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার পুরো বিষয়
খারাপ লাগতে শুরু করল। সারাদিনের মতো এই সন্ধ্যেও মাটি হবে ভাবেনি।
সমাজে হাজার বৈসাদৃশ্য থাকে। সেটিই
স্বাভাবিক। সেখানে নিয়ম আর ঈশ্বর খোঁজা অর্থহীন। কেননা, সুবিধাবাদীরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে ঈশ্বর তৈরি করেছে। সেই মূর্ত-বিমূর্তকে
দিয়ে পছন্দ মতো নিয়ম বানিয়েছে। তাদের সুচতুর মাথা থেকে উৎসারিত নানান কৌশল কালে কালে সংখ্যাগরিষ্ঠদের চাকা দেখিয়ে গেছে। তারা ক্ষমতা
কাঠামোয় বসে নিজেদের সকল সুবিধার মজা লুটেছে। সেজন্য বোকাদের ব্যবহার করেছে। যারা একে
মেনে নিল, সুবিধা পেল; যারা নিজেদের নিয়মে চলে তাদের কিছু হয় না। তার কিছুই হয়নি।
কেননা তার নিজের নিয়মে ত্রুটি আছে।
শিহাবের মন খারাপ হয়ে গেল। এতকিছু
ভাবনার মধ্যেও বুকের ভেতরে কে যেন সন্তুষ্ট হতে পারছে না। সেখানে হাতুড়ি পিটছে। সে
নিজের কথা ভাবে। চল্লিশেও তার কিছু হলো না। বাবা বলতেন, বিশে বিদ্যা ত্রিশে ধন না হলে ঠন ঠন। সে ঠনঠন হয়ে থাকল। কেউ কোনো দাম দিল না।
কোনো ছাদের নিচে ঠাই হলো না। সে বুঝতে পারে, এ সময়ে অনিয়মের নিয়মে অভ্যস্ত হতে না পারার কারণে তার এই অবস্থা। অথচ এ সমস্যা
থেকে উত্তরণের কোনো পথ সে বের করতে পারছে না। সে নিজেকে প্রচণ্ড এক গালাগাল দেয়, ‘শালা তুমি একটা মাকাল। এ যুগে যুধিষ্ঠির সেজে বসে আছো। চোরের
দেশে চোর না হলে কী করে চলবে? তুমি চুরি
করতে পারলে না...গৃহস্থ হতে পারলে না। ব্যাকডেটেড এ্যন্ড আউটরিচ বুরবাক।‘
সে শাহিনের পরপর উঠে পড়ল। প্রেসক্লাবে
এখন আতিপাতি নেতারা আসতে শুরু করেছে। কেউ কেউ ভেতর থেকে প্লাস্টিকের চেয়ার বাইরে এনে
বসছে। সবুজ ঘাসের বুকে পা দোলাতে দোলাতে দেশপ্রেমের গল্প করছে। চলমান সরকার কী করছে, কী করা উচিত, অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, বাজারদর ইত্যাদি নানান আলোচনার কথা চলছে। ভিড় আরও বাড়ল। হয়তো
কোনো কনফারেন্স হতে যাচ্ছে। শিহাব আজকাল মাঝে মধ্যে আকস্মিক প্রেসক্লাবে আসে। তেমন
খবরাখবর রাখে না...জানে না। একসময় মোবাইল রিপোর্টার হিসেবে স্থানীয় পত্রিকায় কাজ করেছিল।
সবার সঙ্গে একটু জানাশোনা আছে। তাদের সাহচর্য ভালো লাগে বলে সদস্যপদ হারিয়েও এখানে
এসে পড়ে। এখন অনেক নতুন নতুন লোক সাংবাদিকতায় এসেছে। তাদের অনেকের সঙ্গে তেমন আলাপ
পরিচয় নেই। রিপোর্টার হয়ে কাজ করার সময় অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কেউ কেউ তার রিপোর্টকে
স্কুপ আইটেম বলে বাড়িয়ে কথা বলত। স্বস্তি পেলেও কাজের বিনিময়ে পয়সা তেমন নেই। তাই টিকে
থাকতে পারল না। তবে মনের কোণায় লেখালেখির ইচ্ছে থেকে গেল। যোগ দিল এনজিও অর্থাৎ উন্নয়ন সংস্থার কাজে। সেখানেও তিক্ত অভিজ্ঞতা আর বঞ্চনার
কাহিনী।
শিহাব একদলা থুতু ফেলে নিমতলা মন্দিরের
রাস্তা পেরোয়। আজকাল সে খুব সহজে কোনোকিছুতে ঘৃণায় থুতু ছিটোতে পারে। রিকশাওয়ালাকে
তুই-তোকারি করতে পারে। অথচ আগে তেমন ছিল না। সবাইকে সম্মান করত। প্রত্যেক মানুষ একটি
জীবন আর তা মহামূল্যবান। বুকের মধ্যে সবার জন্য সমীহের বড় জায়গা ছিল। যেমন শাহ ইমাম
রেজা, তার পুর্বতন অফিসের পরিচালক সম্পর্কেও
বিশাল ধারনা ছিল। ভাবত, তার মতো
মহৎ আর ফেরেস্তা মানুষ ক’জন আছে! ছোট এক চালাঘরে হ্যারিকেনের আলোয় প্রচুর শ্রম দিয়ে উন্নয়ন সংস্থার যাত্রা
শুরু করেছিলেন। সমাজের গরিব মানুষের দারিদ্র বিমোচন, স্ব-কর্মসংস্থান, নারীর
ক্ষমতায়ন, শিক্ষার সম্প্রসারণ কত কাজ! সে
পরিচালকের কথা বেদবাক্যের মতো মেনে চলে। কত দিন খেয়ে না খেয়ে বিশ্রামহীন নিরলস কাজ
করেছে। বাড়িতে একটু সময় দিতে পারেনি। ছুটে গেছে গ্রাম থেকে গ্রামে। অজানা এলাকার অপরিচিত
মানুষের সঙ্গে রোদে বৃষ্টিতে ঘেমে ভিজে কাজ
করেছে। এ কাজে কোনো ক্লান্তি নেই। কাজের কোনো শেষ নেই।
সেই মহৎ ব্যক্তি দু-বছর সাত মাস পর বদলে গেল। ইতোমধ্যে তার কাচাপাকা
চুলে বিদেশি কালার লেগেছে। পোশাক থেকে বেরোয় স্বর্গীয় কোনো ফুলের মিঠেল সুবাস। সে সৌরভ
ভেসে ভেসে দিগন্তরেখা বরাবর ছড়িয়ে যায়। ছোট চালাঘর বদলে অফিস হলো দোতালা ভবনে। তার
একটি কোণায় শিহাব বসতে পেল। সেও ঠিক বসার সুযোগ নয়। কাজের জায়গা। কেননা সে তো প্রায়
সারাদিন গ্রামে গ্রামে ছুটে বেরোয়। মানুষের সঙ্গে কথা বলে। মটিভেশন দেয়। প্রশিক্ষণ
দেয়। ঋণ দিয়ে কিস্তি আদায়ের ব্যবস্থা করে। বিনিময়ে মাস শেষ হলে কিছু টাকা পায়। ওই কয়েকটি
মুদ্রা দিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে অঞ্জলি আর দুটো মেয়ের জীবন চলে। আকাঙ্ক্ষিত প্রশান্তি
না পেলেও বেঁচে ছিল। কিন্তু সেই আকণ্ঠ পরিশ্রম আর কষ্টের কাজও একদিন মুখ থুবড়ে উপড়ে
যাবে এমন দুঃস্বপ্ন দেখেনি। আকস্মিক একদিন তার মুখোমুখি হতে হলো।
ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের কোনো একদিন।
সে খুব সকালে অফিসে এসে বসেছে। ফুরফুরে মেজাজ। টানা চারদিন ফিল্ড করার পর একটু স্বস্তি।
আজ টিএডিএ ফরম পূরণ করে জমা দেবে। সঙ্গে যুক্ত করতে হবে পরিদর্শন প্রতিবেদন। সেটিই
লিখছিল। পরিচালকের পিএ রূপবানু এসে জানাল, সাহেব ডাকছেন। শিহাব ফিল্ডে কী কাজ করেছে সে-সব মনে মনে গুছিয়ে নেয়। এগুলোই
হয়তো জিজ্ঞেস করবে।
না, তেমন কোনো প্রসঙ্গ নয়। পরিচালক এটা ওটা কথা শেষে মিষ্টি করে হাসলেন। স্বচ্ছ
কণ্ঠে জানালেন, শিহাবের বয়স হয়েছে। অন্যমনষ্ক হয়ে
যায়। ইনডিসিশনে ভোগে। এসব নিয়ে চাকুরি করবে কীভাবে? তারপর বেশ মোলায়েম স্বরে বলেন, -
‘মিঃ শিহাব নেক্সট ফেজে ডনর আপনার
পোস্টটা তুলে দিচ্ছে। সো আই এ্যাম ভেরি সরি টু সে গুডবাই। প্লিজ হ্যান্ডঅভার দি চার্জেস
টু রূপবানু বাই ফিফটিনথ্।’
‘ভাই এতবড় একটি সংস্থা, আমাকে অন্যকোনো পোস্টে এবজরভ করা যায় না? চাকুরি চলে গেলে কী করে চলব?’
‘শোনেন কাজ জানা লোকের কাজের অভাব
হয় না। চেষ্টা করুন কোনো জায়গায় হয়ে যাবে। যেখানে বায়োডাটা দেবেন আমাকে জানাবেন।’
‘ওকে ভাই।’
এরপর আর কোনো কথা থাকে না। বিমর্ষ
মুখে বিষাদিত মনের কথা আসে না। সে চেম্বার থেকে কখন বেরিয়ে এলো বলতে পারে না। কানে বাজতে থাকে, ‘যেখানে বায়োডাটা দেবেন আমাকে জানাবেন।’ যিনি নিজে থেকে তার জন্য অন্য সংস্থায় কথা বলতে বা সুপারিশ করতে আগ্রহী
সেখানে অন্যকথা চলে না। শিহাব এমনিতে নরম মানুষ। চিরাচরিত অমায়িক আর বিনয় বিগলিত। নিজের
ভেতর শত কষ্ট লুকিয়ে রেখে সহজে হেসে যেতে পারে। সেদিনও নিজেকে গর্ধব বলে গালাগাল দিতে
দিতে ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাস বুকে পিষে মারল। সবকিছু নিয়তি মেনে নিয়ে আরও একবার রাস্তায়
নেমে গেল। উদ্বাস্তু ক্ষুধায় মানুষের পায়ে পায়ে শুরু হলো আরও একবার ঘোরা। একবার বার-বার।
অস্তিত্বের প্রশ্নে।
আজ নিয়ে সে পৌনে সাত মাস বেকার।
বেঁচে থাকার জন্য মুখে দু-মুঠো আহার জোগাতে শখের জিনিসগুলো একে একে পানির দরে বিকোল।
বড় মেয়ের প্রাইভেট টিউশানি ছাড়িয়ে নিল। মেয়েটি মেধাবী...মনোযোগী ছাত্রী। কত স্বপ্ন
দেখে! শিহাবও কি কম? আধপোড়া
নসিবের মুখে লাথি মেরে সেও স্বপ্ন দেখে। মেয়ে তার নিজের পায়ে দাঁড়াবে। তার মতো সামান্য
কয়েক টাকার চাকুরির জন্য ধরনা দেবে না। অফিসারদের সামনে বংশবদ ভৃত্যের মতো বিগলিত উচ্চারণ
করবে না, স্যার একটি কাজ পাওয়া যাবে? অথচ সেই স্বপ্নগুলো রং বদলালো! বাস্তবের কঠিন পাথুরে রাস্তায়
মুখ থুবড়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
শিহাব সাইকেলে উঠে আবার নেমে পড়ে।
নড়বড়ে ফ্রি-হুইল আর লুজ চেইনের কারণে থামতে হয়। চেইন বারবার পড়ে যায়। সারানোর জন্য
তেমন পয়সা নেই। সে আধভাঙা বুড়ো সাইকেলের হ্যান্ডেল দুহাতে চেপে ধীরে ধীরে এগোয়। নিমতলার
মন্দির দুর্গোৎসবের সাজে রাঙানো হচ্ছে। সে এলোম্যানিয়াম
ডেকচি-পাতিলের দোকানগুলোর সামনে এসে পড়ে। পাশের দোকানে মালামাল এসেছে। কর্মচারীরা সেগুলো
ভেতর নিয়ে রাখছে। রাস্তায় পড়ে আছে বিবিধ কার্টুন আর পুরোনো খড়। সেগুলোর মধ্যে মুখ গুঁজেছে
মহারাজ। সেই সরকারি বিশাল ষাঁড়। মালিকবিহীন স্বাধীন মহারাজ হেলেদুলে রাস্তায় চলে। যেখানে
খুশি সেখানে মুখ দেয়। যাকে ইচ্ছে তাকে হুড়োয়। তার মতো সুখী আর কেউ নেই। শিহাব দাঁড়িয়ে
দেখে। আর সে-সময় দোকান থেকে কেউ একজন এক মগ পানি এনে গরুটির গায়ে ছুঁড়ে দেয়। মহারাজ
সে রাগ ঝাড়ে শিহাবের উপর। সবল বেগে কয়েক লিটার উষ্ণ হলুদ ঝাঁঝালো দুর্গন্ধময় পানি শরীর
থেকে বের করে দেয়। সে-সবের ছিটেফোঁটা তার শরীরে এসে পড়ে। বিবমিষার উদ্রেগ করে। তার
মনে হয়, রাস্তাতেই বুঝি বমি করে ফেলবে।
সে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ চেপে কিছু দূরে সরে যায়। সাইকেল স্ট্যান্ড করে বসে পড়ে।
চেইন ঠিক করতে লেগে যায়। এখন তাকে যেতে হবে জামানের দোকানে। দিন কয়েক আগে কতগুলো ক্যাসেট
দিয়ে এসেছিল। বিক্রির জন্য। ক্যাসেট প্লেয়ার তো বেচে দিয়েছে। এখন ওগুলো রেখে কী হবে? অনেক শখ করে নানান দোকান থেকে বেছে বেছে কিনেছিল। জীবনে ওই
দুটো দুর্বলতা, গান আর গল্পের বই। যা তাকে শিখিয়েছে
অন্যকে সম্মান করতে। ভালবাসতে। এখন হয়তো ওসবের কোনো মূল্য নেই।
তার কানে ক্যাসেটের খুব প্রিয় দু-একটি
গান অডিও হেলুসিনেশনের মতো বেজে ওঠে। যেগুলো কোনো গভীর রাতে শুনতে শুনতে অলীক ভুবনে
হারিয়ে যেত। সেগুলো জীবনের ছোট ছোট কথামালা দিয়ে নিবিড় কোনো ভাবনার সুর। সেভাবে হতাশা
আর ব্যর্থতার জীবনে নতুন করে উজ্জীবিত হতো। প্রতিদিন নতুন একটি সকাল দেখে বেঁচে উঠবার
উদগ্র বাসনায় কাজে নেমে যেত। কষ্টকে কোনো কষ্ট মনে হয়নি। এখন সে গানগুলো দূরে সরিয়ে
রাখতে হচ্ছে। এমন কোনো সঞ্চয় নেই যে তা রক্ষা করে। সে সাইকেল থেকে নেমে সন্ধের আলোছায়ায়
স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে উঠতে চায়। তখনই লোডশেডিং।
নিজের কষ্টগুলো আরও একবার নগ্নভাবে দেখার হাত থেকে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তার অশ্রুসজল
বিকৃত চেহারা কেউ দেখেনি। দেখলেই বা কি? পৃথিবীর কোন্ প্রান্তে কে কখন বেঁচে থাকে বা মরে যায় কে তা দেখে? লাভ ক্ষতি কী? কোনো যায় আসে না।
একজন অর্ধ-উলঙ্গ পাগল তার সামনে
এসে দাঁড়ায়। বাঁ-হাত দিয়ে ডান হাতের কনুই চেপে সেটি তার সামনে তুলে ধরে। দুচোখে আকুতি।
মুখে অস্ফুট শব্দ। কিছু খাবে...তাই কিছু চায়। শিহাব সেখান থেকে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে
নেয়। পাগলের সঙ্গে নিজের কোনো তফাৎ খুঁজে
পায় না। এসময় বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠে। সবকিছু আলোকিত
করে দেয়। শুধু তার মনের গহীনে কষ্ট। অন্ধকার। সে সাইকেলটি জামানের দোকানের সামনে স্ট্যান্ড
করে। পায়ে পায়ে বারান্দায় ওঠে। তখন জামান দুই কিশোরী গ্রাহককে ক্যাসেটের গান শোনাচ্ছে।
বেশ ব্যস্ত। তার দিকে একপলক তাকাল মাত্র। শিহাব সেখানে দাঁড়িয়ে গানের কিছু শোনে। তার
পছন্দের এক গান। কিন্তু এখন ওসব থাক। তার দেয়া ক্যাসেটগুলো বিক্রি হলে কিছু টাকা নেয়া
যায়। সে দৃষ্টি উঁচু করে সাজানো র্যা কে তাকায়। দেখে সবগুলো সাজানো আছে। কোনো ক্যাসেট
বিক্রি হয়নি। তার মনে জেগে ওঠা সামান্য প্রত্যাশাটুকু দপ্ করে নিভে গেল। ভেবেছিল পঞ্চাশ
একশ যা হোক, টাকা পেলে মেয়েদের জন্য বিস্কুট
নিয়ে যাবে। অথচ...।
দোকানের লাউডস্পিকারে মন খুব খারাপ
করা অন্য এক গান বাজছে। সলজ্জ মায়াবি চেহারার মেয়েটি ক্যাসেট কিনছে। শিহাবের কেন জানি
তাকে চেনা চেনা মনে হলো। অদ্ভুত সুন্দর সেজেছে। তার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে হর্স টেইল
স্টাইলে বাঁধা চুলগুলো কেমন সুন্দর করে নাচছে। শিহাব অভিভূত হয়ে গেল। অঞ্জলির মুখ ভেসে
উঠল চোখে। তার চেহারাও এমন মায়াভরা। সেখানে সলজ্জ আলোছায়া খেলা করে। যা দেখে মুগ্ধ
না হয়ে উপায় নেই। অথচ তার জন্য তেমন কোনোকিছু করতে পারছে না। শুধু কষ্ট দেয়া ছাড়া।
আর সেও কেমন সবকিছুকে অসহায়ভাবে মেনে নিয়েছে। শিহাবের কষ্টের পাঁকে পড়া অস্থির মন উদাস
আর টলমল করে উঠল। কি করছে অঞ্জলি? আজও কি
শুকনো মরিচ ভর্তা? আর তা
করতে গিয়ে তার হাত জ্বলে উঠে। যেভাবে দু-মেয়ে খেতে বসে চোখ দিয়ে পানি ঝরাতে থাকে। শিহাব
এই ভাবনায় দোকান থেকে আস্তে করে বের হয়। তারপর রাস্তায় সাইকেল ধরে হেঁটে চলে। ভাবে
এই পৃথিবী মানুষজন কেউ তার নয়।
সকালে অঞ্জলির সঙ্গে কিছু কথা হয়েছিল।
তা শুধু মেয়েদের আগলে রাখার বিষয়। আশেপাশের বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা করে। গলিতে অনেক
ফেরিওয়ালা আসে। ছেলেমেয়েরা এটা ওটা কিনে খায়। তার মেয়ে দুটো জুলজুল করে দেখে আর ঘরে
ফিরে মাকে জড়িয়ে ধরে। অঞ্জলি তার মানে বোঝে। সে সহ্য করতে পারে না। তার কাতর জিজ্ঞাসা, শিহাবের আর কতদিন লাগবে একটি কাজ পেতে?
শিহাব এ প্রশ্নের উত্তর জানে না।
জানার কথাও নয়। সে তবু বিশ্বাস করে, হয়তো সামনে
কোনো এক কাজ জুটে যাবে। কষ্ট সবসময় থাকে না। রাত হলে দিন আসে। আপাতত এ কয়েকটি কষ্টের
দিন পেরিয়ে গেলে হয়। তার বিগত চাকুরি আর কাজের কথা মনে পড়ে। হাতে গোণা যে ক-জন বন্ধু, তারা কেমন তরতরিয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। সে তখন দারিদ্র্য বিমোচনের
প্রকল্পে লক্ষ্যভুক্ত জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। লোন এপ্লিকেশন ফরম পুরণ করার নিয়ম
শেখাচ্ছে। আবার প্রতি সপ্তাহে ঋণ রিকভারি ঠিকমতো হচ্ছে কি না মনিটরিং করছে। হাতে ধরা
একগাদা মনিটরিং চেক লিস্টস। তার বত্রিশটি ছক। আবেদনকারীর নাম কি, বয়স কত? নিজের
বসতভিটা পুকুর আছে কি? ঋণের টাকায়
কোন্ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে? নাকি মাছ
গোস্ত খেয়ে শেষ করেছে ইত্যাদি সব জিজ্ঞাসা। এসব প্রশ্ন করতে গিয়ে মনে হয় তার নিজের
উত্তর কী হবে? নৈবচ! তার কোনো জায়গা-জমি নেই।
পুকুর নেই। সবজি বাগান নেই। যা আছে...সামান্য এক একাডেমিক ডিগ্রি। দু-নম্বর এ সমাজে
যার কোনো মূল্য নেই। কাজে কাজে সে আনমনা হয়ে যায়।
পরিচালক রেজা সাহেব বলেন, We are working for the development of the poor
community as a vital task of poverty alleviation. Credit support is one of the
core tools aiming to uplift their condition. First we should provide training
among them basically like human resource development and skill development
both. Afterwards the credit will disburse. A strong monitoring should be
exercised to attain at least ninety nine percent loan recovery including fifteen
percent service charges. We must keep in mind that there is an option about
sustainability of the organization. As such we should contributes four percent
amount of our salary basics in this regard.
শিহাব তা বেদবাক্য বিশ্বাস করে
মাঠে মাঠে ঘুরে ঘুরে কাজ করে। গ্রামের রাস্তার ধুলো তার চোখে-মুখে ছড়িয়ে যায়। লোকে
বলে, ডেভলপমেন্ট ওয়ার্কার। এসব শুনতে
ভালোই লাগে। দেশ ও সমাজের উন্নয়ন করতে কে না চায়! অনেকে মুখে বড় বড় কথা বলে, মাঠের কাজে নেই। সে কাজ করেছে নিবেদিত প্রাণ কর্মীর মতো।
না কি শুধু চাকুরি করেছে? হয়তো চাকুরি
করেছে। তবে আর যাই হোক ফাঁকিবাজি দেয়নি। তার সততা আর কর্মতৎপরতার পুরস্কারও পায় যথারীতি একদিন। সে কথা আবার মনে এসে
সবকিছু বিষণ্ন করে দিতে চায়।
রাতের শহর অদ্ভুত আলোছায়ায় ডুবে
থাকে। কত মানুষ। কেউ দ্রুতবেগে ছুটছে। কোথায় তিন চারজন দাঁড়িয়ে জমে তুলেছে আড্ডা। সিগারেটের
ধোঁয়ায় চারপাশ স্বপ্নীল হয়ে উঠেছে। যেতে যেতে গার্লস স্কুলের সামনে ইলেকট্রিক এক পোলের
অন্ধকার ছায়ায় সেই ভিখিরিনীকে দেখে। অন্ধ মহিলাটি তারস্বরে চিৎকার করে সাহায্য চায়। সে স্তম্ভিত হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ে।
এ রাস্তায় অনেকদিন পর এলো আজ। এখানেও ঈশ্বর বসে আছে। সাহায্য চাইছে। তার ঘরে ঘরে থাকার
কথা। মানুষের মনে মনে থাকার কথা। অন্ধকার এক গলির মাথায় সে বসে আছে। সে ভিখিরিনীকে
সাহায্য করতে ব্যাকুল হয়ে হয়ে উঠে। পেছনের পকেট হাতড়ে একটি কয়েন বের করে আনে। কবে থেকে
পড়েছিল জানত না। হঠাৎ করে আবিষ্কার করে একটি
টাকা তার পকেটে আছে। সে খুব লজ্জিতভাবে সেই কয়েনটি মহিলার শুকনো শানকিতে রেখে দেয়।
তখন গুনগুন স্বরে তার দোয়া শোনে। পুরোটা শোনা হয় না। সে ততক্ষণে সামনে এগিয়ে গেছে।
সেখান থেকে দূরাগত স্তবের মতো কোনো প্রার্থনায় সে আকাশে তাকায়। দেখে সেখানে কোনো চাঁদ
নেই। কোনো তারা নেই। শুধুই তেপান্তর অন্ধকার...ফাঁকা...শূন্য...রহস্যময়। সেখানে কোথায়
ঈশ্বর বসে আছে? তার খুব সাধ হয়, একবার ঈশ্বরের চেহারা দেখে। কেমন দেখতে তিনি? তার কি কোনো ঘর আছে? মানুষের মনে তার কোনো ঘর নেই। সে অবিমিশ্র উপলব্ধিতে পরিশুদ্ধ হতে চায়। পারে
না। কোথায় কোনো শূন্যতার বিক্ষোভ মনকে আলোড়িত করে চলেছে।
শিহাব ঘরে ফেরে। বারান্দায় ছোটখাটো
ভিড়। আশেপাশের বাড়ি থেকে কয়েকজন মহিলা আর ছেলেমেয়ে এসে বসেছে। টেলিভিশন চলছে। খুব শখ
করে অনেক দাম দিয়ে কিনেছিল। তার আয়ের সঙ্গে মানায় না। চাকুরি চলে যাবার পর কতকিছু বিক্রি
হয়ে গেলেও এটি ছাড়তে পারেনি। নিজের টিভি প্রীতির সঙ্গে মেয়ে দুটোর আগ্রহের কথাও মনে
বাজে। বিকেলে দুজনে একসঙ্গে বসে কার্টুন দেখে। তাদের চোখে-মুখে উচ্ছল আনন্দ আর হাসি
দেখে তার মন ভরে যায়। সে আনন্দ হয়তো স্বর্গ থেকে নেমে আসে। সেখানে বাঁধা দিতে মন চায়
না। সে বাহির থেকে বুঝতে পারে টিভিতে বিজ্ঞাপনের নানান চটুল আর প্রভাববিস্তারকারী কথা
চলছে। একটু পর সাপ্তাহিক নাটক আরম্ভ হবে। আজ মনে হলো সে অনেকদিন নাটক দেখে না। সকালে
খবর শুনে বেরিয়ে যায়। যখন ফেরে তখন আর কিছু মনে থাকে না।
সে নিম গাছের একধারে সাইকেলটি রেখে
টিউবওয়েলের দিকে এগিয়ে যায়। অঞ্জলি তাকে দেখে সাবান কেস আর গামছা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে।
কাপড় কাচা সাবানের একটি টুকরো আলোছায়ায় চকচক করে উঠে। যেভাবে তার চোখে কিছু জিজ্ঞাসা
তীব্র হয়ে আঘাত হানতে চায়। শিহাব টিউবওয়েল পাড়ের অন্ধকারকে অনেক নিরাপদ মনে করে মুখ
ওদিকে সরিয়ে নেয়। অঞ্জলির জিজ্ঞাসার কী জবাব দেবে সে? আজও তেমন কোনো সুখবর বয়ে আনতে পারেনি। যে সংস্থাগুলোয় বায়োডাটা দিয়ে রেখেছিল, কয়েকটিতে গিয়েছে। তার বিব্রত অসহায় মুখের উপর শুকনো জবাব, খোঁজ নেয়ার প্রয়োজন নেই, খবর হলে জানানো হবে। সে অঞ্জলির বিষণ্ন চোখের দিকে তাকাতে সাহস পায় না। তার
সকল চেষ্টার বিপরীতে এই কালবেলা গোলকধাঁধা মনে হতে থাকে। সেখান থেকে বেরোবার পথ খুঁজে
পায় না। অঞ্জলি সাবান কেস আর গামছা রেখে চলে যায়। তার ছোট দীর্ঘশ্বাস শিহাবের বুকে
সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ে। টিউবওয়েলের হ্যান্ডেলে হাত রাখতে রাখতে ভেবে বসে, মেয়েরা এত সহজে কী করে যে সব বুঝে ফেলে!
সে ঘরে এসে খুব চমকে যায়। মেয়ে
দুটো ভাতের থালা হাতে বসে আছে। দুপুরে রান্না করা ভাত গরম থাকার কথা নয়। ঠাণ্ডা আর
শক্ত হয়ে গেছে। কোনো তরকারি নেই। শুকনো মরিচ ভর্তা। তার আদরের মেয়ে দুটো তা দিয়ে খেতে
খেতে চোখ-মুখ লাল করে ফেলেছে। সে-সময় টিভিতে অনেক দামি খাবারের বিজ্ঞাপন চলছে। তার
ভেতর অত্যন্ত নীরবে যন্ত্রণার বিস্ফোরণ হয়ে
যায়। এ সে কী দেখছে? দূরের
বারান্দায় বসে থাকা কয়েকটি ছেলেমেয়ে এসব দেখে না। দেখতে পায় না। সে আকস্মিক ঘর থেকে
বের হয়ে যেতে থাকে। জামান টিভিটি কেনার জন্য কয়েকবার বলেছিল। সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, এবার এটি বিক্রি করে দেবে। হয়তো মেয়ে দুটো কার্টুন দেখতে
পাবে না। দু-একটি দিন বা সপ্তাহ...তারপর ভুলে যাবে। নয়তো অন্য কারও বাসায় দেখবে। সেও
ভালো। তবু সে এই ভয়ংকর অশ্লীল দৃশ্য আর দেখতে চায় না।
No comments:
Post a Comment