কোথায় কি!

01 December 2015

সাব্বির জাদিদ


সিদ্দিক ঘুমিয়ে আছে। নটার ট্রেনে তার ঢাকা ফেরার কথা। এখন বাজে সাড়ে সাতটা। মা মাথার কাছে বসে চুলে বিলি কাটতে লাগলেন। -এই সিদ্দিক এই, উঠবি না? নটা বেজে গেল তো!
জাগার বদলে সিদ্দিক আরাম পেয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। মায়ের বড় মায়া হল। আহা কী আরামের ঘুম! আজ আর ঢাকা গিয়ে কাজ নেই। ঘুমাক বাছা।

সিদ্দিক গ্রামে মায়ের কাছে এসেছে গত মঙ্গলবার। সে ঈদের মত বড় আকারের কোন ছুটি ছাড়া গ্রামে আসে না। সে নতুন দাঁড়ানো একটা এ্যাড ফার্মের পদস্থ কর্মকর্তা। মতিঝিলে অফিস। মালিবাগের দিকে একটা ফ্ল্যাটে একা একা থাকে। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়েও সে মাকে ঢাকায় আনতে পারেনি। মা বড় সেকেলে। বাবার স্মৃতি ছাড়া কিছুই বোঝেন না। সিদ্দিক নিজে নিজে আটটায় উঠল। উঠেই হইচই শুরু করে দিল মা তুমি একটা কী! আমাকে ডাকার কথা সাড়ে সাতটায়। এখন বাজে আটটা পাঁচ। এই এক ঘণ্টায় কিভাবে গোছাব। শিগগির কামরুলকে একটা রিকশা দেখতে বল। সিদ্দিক নটার ট্রেন ধরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সিদ্দিকের এবারের বাড়ি আসার একটা কারণ আছে। কারণটা সে কাউকে বলতে পারছে না। এমনকি মাকেও না। ঘটনা কিছুটা মাকে নিয়ে। কিছুদিন ধরে সে একটা স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নে অতি আপনজন কেউ মারা গেছে। মৃতকে খাটিয়ায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। মৃতের সারা শরীর ধবধবে শাদা কাফনে মোড়ানো। কাফন থেকে ভুরভুর করে কর্পূরের গন্ধ আসছে। সিদ্দিক মৃতকে চিনতে পারছে না। তবে বুকের তলটায় গভীর বেদনাবোধ হওয়ায় সে বুঝতে পারছে মৃত ব্যক্তি তার আপন জন। সে খাটিয়ার কাছাকাছি গিয়ে কাফন সরিয়ে মৃতকে দেখার চেষ্টা করছে। পারছে না। কাছাকাছি গেলেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। এই একই স্বপ্ন সে পরপর তিন রাত দেখেছে। প্রথম দিন 'ধুরো' বলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দিনে উড়াতে পারেনি। তার অস্থিরতা ক্রমেই বেড়েছে এবং মায়ের মুখটা সামনে এসেছে।
জগতে আপন জন বলতে সিদ্দিকের এই বুড়ি হয়ে যাওয়া মা। বাবা তো সেই কবেই চলে গেছেন। ছোট বোনের বিয়ের পরপর। সারাটা জীবন বাবা শুধু কষ্টই করে গেছেন। কিছু কিছু মানুষ পৃথিবীতে আসে শুধু কষ্ট পাওয়ার জন্য। বাবা তেমন ছিলেন।স্বপ্নটা দেখার পর থেকে সিদ্দিকের মনে কেবলই কু ডাকছে। আল্লাহ না করুন মায়ের কিছু হয়। এই দুঃস্বপ্নটাই সিদ্দিককে অসময়ে বাড়ি এনেছে।

খাবার পাটিতে স্বপ্নের কথা বলতে গেল সিদ্দিক। পারল না। এইসব স্বপ্নের কথা কি বলা যায়! মা বললেন,আমাকে আর কতকাল একা ফেলে রাখবি?
সিদ্দিক খুশি খুশি গলায় বলল, এবারই তাহলে আমার সাথে ঢাকা চল।
বোকা ছেলে। এই গ্রাম ছেড়ে আমি কোথায় যাব? তুই বরং একটা বউ এনে দে। আমার সময়টা ভাল কাটবে।
সিদ্দিক কৃত্রিম চোখ রাঙিয়ে বলল, আবার সেই কথা মা? বলেছি না সময় হলে আমি নিজেই তোমাকে বলব!
আর কবে হবে তোর সময়? আমি মরে গেলে?
মায়ের কথায় জিভে কামড় পড়ল সিদ্দিকের। সে তাড়াতাড়ি করে বলল, আর কখনো ওইসব কুকথা মুখে আনবে না।
এইবার বাড়ি এসে সিদ্দিক মায়ের অনেক সেবা করল। গোসলের পানি তুলে দিল। খাওয়ার পর ওষুধের কথা মনে করে দিল। বিকেলে নদীর ধারে বেড়াতে নিয়ে গেল। ছেলেরা মায়ের কাছে বড় হয় না। কিন্তু সিদ্দিকের মায়ের মনে হল তার ছেলেটা অনেক বড় হয়ে গেছে।
ঢাকায় ফিরেই সিদ্দিক দুঃসংবাদটা শুনল। তাদের অফিসের কেরানি হায়দার হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। কিসের ভেতর কি! এই কি তার আপন জন! এই কি তার স্বপ্নের ব্যাখ্যা? সিদ্দিক বড় একটা দুশ্চিন্তা থেকে রেহাই পেল যেন। অফিসে গিয়ে সিদ্দিক কোন পরিবর্তন দেখল না। যেমন ছিল তেমন। চারদিন আগে একজন বয়স্ক কর্মচারী মারা গেছে তার কোন ছাপ নেই। থাকার কথাও না। কেরানিদের মৃত্যুর ছাপ চারদিন থাকে না।

দিনতিনেক পর সিদ্দিক তার রুমে কাজ করছিল। পিয়ন এসে জানাল একটা মেয়ে দেখা করতে চায়।
ফাইলে মাথা গুঁজে রেখেই সিদ্দিক মেয়েটাকে আসতে বলল সিদ্দিক। একটু পর যে মেয়েটা পা গুণে গুণে রুমে ঢুকল তাকে এই কাচঢাকা টাইলস মোড়া ঝক্‌ঝকে অফিসে ঠিক মানায় না। রোগা পাটকাঠি শ্যামলা বর্ণের মেয়ে। গায়ে ফিরোজা রঙের বেশ পুরনো একটা জামা। রং ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। জামাটা শরীরের সাথে ফিটিং হয়নি। ঢলঢল করছে।
হঠাৎ করে মেয়েটা যেন চিকন হয়ে গেছে। তার চিকন হওয়ার সাথে সাথে জামাটা চিকন হতে পারেনি। মেয়েটার বয়স বড় জোর উনিশ হবে। চোখে কাজল দিয়েছে। কাজল পরা চোখ সুন্দর দেখায়। কিন্তু এই মেয়ের চোখে কাজল মানাচ্ছে না। সিদ্দিক খেয়াল করল মেয়েটার কাঁধে একটা ভ্যানিটি ব্যাগ। ব্যাগের মুখ খোলা। সম্ভবত চেন নষ্ট। মেয়েটা খুব কৌশলে ব্যাগের মুখে হাত দিয়ে রেখেছে। মেয়েটা ঢুকেই সালাম দিল।
মেয়েটার ড্রেসআপ দেখে সিদ্দিকের ভেতর এক ধরণের অবহেলা জন্মেছিল। কিন্তু কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল। কোন রূপসীর স্বর যেন চুরি করে এই মেয়ের গলায় বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বেশ মিষ্টি গলা। সিদ্দিক সালামের জবাব দিলো না অথবা দিতে ভুলে গেল।
মেয়েটা বলল, আমি কি এই চেয়ারটায় বসব?
সিদ্দিক সামলে নিয়ে বলল হ্যা, অবশ্যই।
মেয়েটা নিঃসংকোচে চেয়ারে বসল। সিদ্দিক স্বাভাবিক হয়ে বলল, তারপর বলুন, কেন এসেছেন আমার কাছে? মেয়েটা জড়তাহীন গলায় বলল, আমি হায়দার আলির মেয়ে। আপনাদের অফিসের সাবেক কেরানি মৃত হায়দার আলি। সিদ্দিক একমুহূর্ত কিছু একটা ভাবল। সাহায্য-টাহায্যর ব্যাপার না তো?
আপনার নাম?
গোধূলি।
নামটা তো সুন্দর।
আমরা পাঁচ ভাইবোন। সবার নামই সুন্দর। সবার নামের ভেতর প্রকৃতির গন্ধ আছে। আমাদের বাবা প্রকৃতি পাগল ছিলেন। গোধূলি শুঁকনো ঠোঁটে অল্প হাসল।
আপনার অন্য ভাইবোনের নাম জানতে পারি? সিদ্দিকের নাম জানার কোন আগ্রহ নেই। ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করা।
আমার বড় দুই বোন। বাবা দুই বোনকে বিয়ে দিয়ে যেতে পেরেছেন। বড় বোনের নাম জোসনা। মেজো, পূর্ণিমা। তারপর আমি।
আমার পরের বোনের নাম ঝিনুক। সবার ছোট ভাই। ভাইয়ের নাম নক্ষত্র।
এইসব নাম আপনার বাবার রাখা?
জি।
উনি বড় ভালো মানুষ ছিলেন। আচ্ছা দুর্ঘটনাটা কিভাবে ঘটল? তার আগে বলুন কী খাবেন?
আমি রোজা রেখেছি।
এখন কিসের রোজা?
মান্নতের রোজা।
আচ্ছা ঘটনা বলুন।
ঘটনা তেমন কিছুই না। প্রতিদিনের মত বাবা সেদিনও অফিস করে বাসায় ফিরছিলেন। রাস্তায় কারা যেন ককটেল ফোটায়। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাবা খুব ভয় পেয়ে যান। বাসার দিকে দৌড় শুরু করেন। এমনিতে বাবা হার্টের রোগি। সেদিনের সেই আতঙ্কের ধকল আর নিতে পারলেন না। বাসায় পৌঁছে শাটপাট শুয়ে পড়লেন। হাসপাতালেও নিতে পারিনি। প্রথম ধাক্কাতেই শেষ। সিদ্দিক খেয়াল করে দেখল গোধূলির চোখের কোণে পানি। তবে পাতলা ঠোঁটের ভাজে রুক্ষ হাসি। ভেজা চোখে হাসলে করুণ দেখায়। সিদ্দিকের কেমন যেন লাগতে লাগল।

গোধূলি অল্পক্ষণে সামলে নিয়ে বলল, সেই কখন থেকে বকবক করছি। আপনি বোধহয় বিরক্ত হচ্ছেন। আপনি অফিসার মানুষ। অফিসারদের সময়ের অনেক দাম। সিদ্দিক বলল, আমি বিরক্ত হচ্ছি না। সেদিন আপনাদের বাসায় যাওয়া উচিত ছিল। ঢাকার বাইরে ছিলাম বলে যেতে পারিনি। আর অফিসের কেউ ফোন করে খবরটা জানায়নি। সবগুলো গাধা।

মৃত্যুর আগে বাবা আপনাকে দুটো জিনিস দিতে বলেছিলেন। সেই জিনিস দুটো দেবার জন্যই এসেছি। আর কোন কারণ নেই। সিদ্দিক বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠল। মৃত্যুপূর্ব অসিয়ত মানেই অন্যরকম কিছু। সিদ্দিক প্রচন্ড কৌতূহল নিয়ে গোধূলির চেনকাটা ব্যাগের দিকে তাকাল। গোধূলি ব্যাগ থেকে একটা ডায়রি আর খাম আটা একটা চিঠি বের করে টেবিলে রাখল।এই হল সেই জিনিস। আপনি রাখুন আমি যাই।
এখুনি যাবেন কেন? আরেকটু বসুন।
বসব না। অনেক কাজ ফেলে এসেছি।
চিঠিটা মৃত্যুর আগে তাড়াহুড়ো করে আমাকে দিয়ে লেখানো। আপনার পড়তে হয়ত কষ্ট হবে। এইটুকু বলে সিদ্দিককে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল গোধূলি। সিদ্দিক কতক্ষণ অবাক হয়ে গোধূলির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর পুরনো হয়ে যাওয়া সবুজ রঙ ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখল। কবিতা লেখা ডায়রি। শুরুতে হায়দার আলির নাম ঠিকানা। তবে নামের আগে কবি শব্দটা যুক্ত করা। কবি হায়দার আলি। পরের পৃষ্ঠায় কবিতা বিষয়ক ছোটখাটো একটা ভূমিকা। ভূমিকা না পড়ে সিদ্দিক ভেতরে চলে গেল। পঞ্চাশের উপর কবিতা আছে ডায়রিটায়। সিদ্দিক কিছুটা বিরক্তই হল। মরার আগে তাকে কবিতার ডায়রি দেয়ার মানে কি? সে কি কবিতার কিছু বোঝে নাকি কোনকালে কবিতা পড়েছে? বিরক্ত হয়ে সিদ্দিক খাম আটা চিঠি হাতে নিল। খাম ছিঁড়ে চিঠি বের করল। সংক্ষিপ্ত চিঠি। মৃত্যুর আগে মেয়ের হাতে তাড়াহুড়ো করে লেখানো।

বাবা, সিদ্দিক-
আমার সময় তো শেষ। এক বিশেষ কথা কহিবার জন্য এই পত্রখানার অবতারণা। অনেক আগে থেকেই অফিসে আপনার বিরুদ্ধে চক্রান্ত চলিয়া আসিতেছে। আপনি সৎ, উৎকোচ গ্রহণ করেন না। এতে অন্যদের বেজায় অসুবিধা। লাল পিপীলিকার লাইনে হঠাৎ করিয়া একটা কালো পিপীলিকা ঢুকিয়া পড়িলে যেমন অসুবিধা তেমন। একবার তো আপনাকে ফাঁসাইবার জন্য সব প্লান প্রোগ্রাম চূড়ান্ত হইয়া গিয়াছিল। সকলে একযোগে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছ আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনিয়া আপনার চাকরি খতম করিবে। আমি বাঁকিয়া বসিলাম। বলিলাম, এমনটি হইলে আমি সব কথা চেয়ারম্যানকে বলিয়া দিব। তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। তিনি আমার কথা বিশ্বাস করিবেন। এতে তারা খামোশ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু পুরোপুরি নিবৃত্ত হয় নাই। সুযোগের অপেক্ষায় আছে। এখন আমি তো চলিলাম। আপনি একা সামলাইয়া চলিবেন।

লেখাটা পড়ে সিদ্দিক কতক্ষণ মূর্তির মত বসে রইল। এসি রুমেও অল্প অল্প ঘামতে লাগল। এই মানুষটিকে কোনদিন সে চিনতে পারল না। কত উপকারি আপন মানুষ! তার কেবলই অনুশোচনা হতে লাগল। হঠাৎ সে চিঠির উল্টোপাশে পুনশ্চ লেখা দেখতে পেল। সে তাড়াতাড়ি পড়া শুরু করল।

পুনশ্চ: যৌবনে কবিতা লিখিবার ভয়াবহ বাতিক ছিল। নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়া সারাক্ষণ কাগজ কলম লইয়া পড়িয়া থাকিতাম। এই নিয়া আপনার চাচির সাথে কত বচসা। কবিতাগুলি ডায়েরি বন্দি করিয়া অসংখ্য প্রকাশকের দুয়ারে ঘুরিয়াছি। কেহ ছাপতে রাজি হয় নাই। শেষমেশ আশা ছাড়িয়া দিয়াছি। সাধারণত কবির পরিবার ভয়ানক কবিতা বিদ্বেষী হয়। আমার পরিবারও তাই। এদের কাছে কবিতা পড়িবার চেয়ে কাথা সেলাই করা অধিক আনন্দের (মা গোধূলি ব্যতীত)। কেন জানি মনে হইতেছে আপনি কবিতার ভাল সমঝদার। আপনি উহার মূল্য বুঝিবেন। তাই যৌবনের সকল স্বপ্ন,-আশা আর শ্রমের নির্যাসটুকু আপনার হাতে তুলিয়া দিলাম। চাহিলে যত্ন করিয়া রাখিবেন। না চাহিলে ফেলিয়া দিবেন সে আপনার মর্জি।

ইতি
হায়দার আলি।

চিঠি শেষ করে সিদ্দিকের চোখ ঝাপসা হয়ে এল। একজন মানুষ একই সাথে দুঃখী কবি এবং দুঃখী কেরানি হতে পারে তার জানা ছিল না।



সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment