কোথায় কি!

01 December 2015

জাকিয়া জেসমিন যূথী



বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও নিসর্গের কবি-কথাসাহিত্যিক রাশেদ রেহমান এর নব প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের পাঠ আলোচনা ও পাঠক অভিব্যক্তিঃ

এক নজরে বইটি সম্পর্কে তথ্যঃ
বইয়ের নামঃ
আধ ভাঙা চাঁদ
লেখকের নামঃ
রাশেদ রেহমান
ক্যাটাগরীঃ
গল্প সংকলন
প্রকাশকালঃ
জুন ২০১৫ ইং
প্রকাশকঃ
সুলতান মাহমুদ রনি
ধানসিড়ি প্রকাশন, শেরপুর, বগুড়া
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ৫৬
মূল্যঃ একশত টাকা মাত্র

অনলাইন অর্ডার পেজঃ
রেটিং: ৯.৫/১০


বই আলোচনাঃ
বহুদিন ধরে বহু পথ ও অলিগলি পেরিয়ে শখের জায়গাটা একটা বিশেষ জায়গায় স্থির হয়েছে। কথাসাহিত্যিক হবো! সেই শখের দৃষ্টিকোণই এই সময়ের নবীন-প্রবীণের লেখায় দৃষ্টিপাত। কে কেমন লিখছে, কার ভেতরে কতটা সম্ভাবনা উঁকি দিয়ে তা দিগন্ত পেরিয়ে যাচ্ছে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের এই আলোচনা কোথায় নেই? পারস্পরিক এই দৃষ্টিপাত, সতীর্থ লেখক-কবির লেখার প্রতি ভালোবাসা থেকেই অঞ্চল-দেশ-কাল ভেদে লেখা ডানা মেলছে দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। ইচ্ছের রঙিন আকাশে ডানা মেলে আমরা এক ঝাঁক শান্তির পায়রা উড়ে বেড়াচ্ছি। এভাবেই এক সময় হাতে চলে এলো আধ ভাঙা চাঁদবইটি। আমাকে বই পড়ুয়া বা বই খাদক বলা যেতে পারে। একদিকে যেমন শিডনি শেলডন এর অনুবাদ, সমরেশ মজুমদার কিংবা শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখায় আমি বুঁদ হয়ে থাকি, তেমনি এই সময়ের নবীনের কোন লেখকের বই পেলেও সেটি সমান আগ্রহেই তার রসাস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে যাই। বইটি হাতে আসার পরে প্রচ্ছদ আর বইয়ের গেটাপের দিকেই চেয়ে থেকেছি সিংহভাগ সময়ে। জানি না, রঙের শিল্পী বলেই কিনা, কভারের নানা রঙের সম্মিলন আমায় মুগ্ধতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছিলো। আমি শুধু দেখছিলাম আর দেখছিলাম।

এর পরে বইটি খুলে ভেতরে ফ্ল্যাপে আঁধারের মাঝে আলোর মত উঁকি দিয়ে চেয়ে থাকা লেখকের মুখচ্ছবির নিচেই লেখক-পরিচিতি অংশে চোখ বুলিয়ে আমি থ বনে গেলাম। থমকে থাকা কয়েক মুহুর্ত পেরিয়ে আমি পরের পৃষ্ঠাগুলো উলটাতে শুরু করলাম। কি যেন একটা অসংগতি চোখে পড়েও পড়লো না। আমি সামনে এগোলাম। উসর্গ পেরিয়ে সূচিপত্র। গল্পের নামগুলো আগ্রহ ধরিয়ে দিয়ে আমায় ডাকতে লাগলো-আয়! আয়! আয়! ...

ধারাবাহিকভাবে গল্পগুলো...
বজ্রপাত
সবুজ পাঞ্জাবী
কোমক
উকিল নোটিশ
মিথ্যে তিলক
অতঃপর মৃত্যু
আধ ভাঙা চাঁদ
সেদিন ভোরে
কদম আলীর অদ্ভূত ভুত
জীবনের মাঝ পথে
মেহেদীর রঙ
শেষ সম্বল
জীবন ডায়েরী

...মোট ১৩ টি গল্পের সমাহার। কিন্তু কোনটা আগে পড়বো? আমি পাঠ শুরু করলাম, শেষের দিক থেকে ৪র্থ গল্পটা দিয়ে। পড়তে পড়তে কখন যে আমি মকিম মল্লিকের পরিবারে মিশে গেছি, টেরই পাইনি। থমকে গেলাম একটি লাইনে এসে-একটি মানুষের জাগতিক পরিবর্তনের জন্য একটি মেয়েই কি যথেষ্ট?’
ঘটনা কি? কি হবে শেষ পর্যন্ত? এই বোধ তাড়িয়ে নিয়ে গেলো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু গল্পকার তার জীবনের মাঝ পথে গল্পে পাঠকের ভাবনাকেও শেষ হতে না দিয়ে মাঝ পথে নামিয়ে রেখেই চলে গেলেন পরবর্তী গল্পে। আমি কষ্টবোধে আচ্ছন্ন হলাম। এবং সেদিনের মত বইটা রেখে দিলাম।

কদিন পরে আবার তুলে নিলাম বইটা পড়ার জন্য। প্রচ্ছদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে লেখক পরিচিতি অংশ পেরিয়ে সূচিপত্র দেখে বেছে নিলাম প্রথম গল্পটা। পড়া শুরু হলো...
শিরোনামে আবহাওয়া ও প্রকৃতি বর্ণনা বিষয়ক প্রবন্ধের সুর টেনে গল্পের সূচনা। আমি পাঠ শুরু করলাম। শেষ ফাগুনের বাসন্তী সন্ধ্যায় ছোট মামার সাথে ট্রেন ভ্রমণের সেই কাহিনী বর্ণনায় পাঠক আমি কখন গল্প চরিত্রের ভেতরে একাত্মা হয়ে গেলাম, জানি না। কাহিনীর ভেতরে, আচমকা কালবৈশাখী ঝড়ের সূচনায় রেলপথের পরিবেশ পালটে যেতে লাগলো, আমি মানসচক্ষে উপলব্ধি করতে থাকলাম। ছোট মামার ভাগ্নে আমি, মনে পরে গেল ভালোবাসার মানুষ অধরার কথা, যাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে এই যাত্রায় ফোন অফ করে রেখেছি। কিন্তু সে যে ভীষণ জেদী ও অভিমানী, এতটা সময় ফোন বন্ধ রাখা কি ঠিক হচ্ছে? বাস্তব দৃশ্যে যে প্রলয়ংকরী ঝড় মুহুর্তের মধ্যে ট্রেন যাত্রায় আশেপাশের বাড়িঘর সবকিছু দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে, যে দৃশ্য অবলোকন করে চলেছি, আরও বড় এক বিস্ময় অপেক্ষা করছে নাটকের শেষ চিত্রে, তা তো জানা ছিলো না!
গল্পের রেশ আমায় আচ্ছন্ন করে রাখলো অনেকটা সময়। তারপরে ঝটকা দিয়ে বাস্তবতায় ফিরে এলাম। মনে পড়লো, এ তো আমি নই, এ যে গল্পকাহিনী! শেষ হয়েও হলো না শেষ, রেখে গেলো পাঠক মনে তার রেশ! গল্পের নামটি বজ্রপাত!


এর পরের গল্পটি বাদ দিয়ে ৩য় গল্পে ঢুকে পড়লাম_
ঢেঁক কুর কুর ঢেঁক, রাত্রী নিস্তব্ধ শেষ প্রহরে ঢেঁকিতে ধামাল তুলেছে মন্টু মাতবরের ছোট বউ ময়না। ...
এভাবেই কোমক গল্পের কাহিনী শুরু। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র ভূখণ্ড হলেও এর প্রত্যেকটি জেলা-থানা-গ্রামে রয়েছে জীবনযাত্রায় বৈচিত্র্য। সাদা চোখে জমিজমার বিবাদ সংক্রান্ত কাহিনীচিত্র মনে হলেও লেখক ছদ্ম চরিত্রের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার চর অঞ্চলের জীবনযাত্রা সহ তুলে এনেছেন সামাজিক প্রতিপত্তি ও ন্যায় অন্যায়ের বাস্তব মানচিত্র।

এরপরে বইটা বেশ নেশা ধরিয়ে দিলো। একাধারে পড়তে থাকলাম একের পরে এক গল্প। পরের গল্পটি পাঠে নিবিষ্ট হোলাম।
পরিচয়, জানাশোনা, বিয়ে। অতঃপর জীবনের ভুল বোঝাবুঝির পরিণাম। উকিল নোটিশ নামে বইয়ের চতুর্থ গল্পটি জীবন বাস্তবতার সাধারণ কাহিনী হলেও লেখকের লেখনী প্রতিভায় পাঠকের মনে রেশ রেখে যায়, গল্প নায়কের মত অপেক্ষায় জড়িয়ে পড়ে পাঠক মনও। তবে, গল্পটির কথোপকথনগুলোও ইনভার্টেড কমা সহ আলাদা প্যারায় বিভক্ত করলে আরও পূর্ণতা পেতো।

এরপরে-পঞ্চম গল্পটি। নাম-মিথ্যে তিলক! পড়া শুরু করার আগে আমি নামটি নিয়েই বেশ কিছুক্ষণ ভাবতে থাকি। কেন এই নাম? হিন্দুদের গল্প নাকি? মাথায় কি ব্রাক্ষণের সাদা ফোঁটা দেয়া বিষয়ক কোন কাহিনী? পড়ার আগেই কত ভাবনা রে! যা হোক, পড়া শুরু করে দ্বিতীয় প্যারায় গিয়েই একটি শব্দের বানান ভুল চোখে পড়লে প্রকাশককে খুব এক চোট মনে মনে বকলাম! পলাশ ও হরিপদ দুজনে একই অফিসে চাকরি করে বিধায় তারা পরস্পরের কলিক! শব্দটা হবে কলিগ! প্রকাশকের এইসব বানান ভুলের কারণে লেখকের বদনাম হয়। যা হোক রাগটা দ্রুতই মিলিয়ে গেলো গল্পের ভেতরের বাস্তবতাময় গতিশীল কাহিনী বর্ণনায়। লেখকের সাথে সাথে কখনো ঘুরে এলাম লঞ্চ জার্নিতে, সেখানে এক নবজাতকের পৃথিবী দেখার সাক্ষীও হয়ে রইলাম। এর পরে বিয়ে বাড়িতে নতুন পরিচয়, প্রণয় এবং বিচ্ছিন্নতা! প্রেমের উষ্ণ তিলক এঁকে দিয়েও যে হারিয়ে যায় বা যেতে চায়, তাকে মিথ্যেনা ভেবে আর কি ভাবা যায়!

এর পর অতঃপর মৃত্যু! গল্প নং ছয়। কাহিনীর শুরু হলো____
অনেকদিন আগের কথা...। রূপকথার আলোকে জীবনের নীতিশিক্ষামূলক একটি গল্প।

এর পরের গল্পটা জীবনের কঠিনতম পরিস্থিতির নির্মম বাস্তবতার কাহিনী। কোমকে সর্বশান্ত স্বামীর মৃত্যুর পরে সংসার ছেড়ে সোমত্ত মেয়েকে নিয়ে বৃদ্ধ বাবার ঘরে আশ্রিতা আয়া পদে চাকরিজীবী জামিলার সংসার। গল্পটায় প্রেমহীন শারিরীক সম্পর্কের ভুল থেকে গল্পের মূল নারী চরিত্রের বার বার জীবনের গতিপথের দিক বদলাতে বদলাতে শেষ সীমানায় চাঁদের হাট বসিয়ে পাঠককে করে দেয় মন্ত্রমুগ্ধ। গল্পের নামটি কি? হ্যাঁ, নামটি-‘আধ ভাঙা চাঁদ’ই! অসাধারণ লিখেছেন লেখক। কাহিনী ও চরিত্র রূপায়ণে তিনি সুনীল, বঙ্কিম কিংবা শরচন্দ্রের সমতুল্য!
কিন্তু গল্পে ব্যবহৃত একটি লাইনের একটি শব্দে আমার একটু আপত্তি; লেখক লিখেছেন_ 
‘...সুফিয়ার শরীরের উষ্ণ স্পর্শে জেগে ওঠে আবিরের বিশেষ অঙ্গ! ...উরু সন্ধির ঝর্ণাধারায় বিশেষ অংগ দ্বারা মৃদু আঘাত করতে থাকে সুফিয়াকে!
বিশেষ অঙ্গের পরিবর্তে লেখক অন্য কোন শব্দ কি ব্যবহার করতে পারতেন না? কে জানে, তা হয়তো তার ভাবনাতেই আসেনি!
 

তারপরে পুনরায় একটি গল্পকে ডিঙিয়ে চলে গেলাম পরের গল্পে। নামটি-কদম আলীর অদ্ভূত ভুত। নামের মধ্যে ভুত থাকলেও গল্পটি অন্যরকম ভুতের গল্প। পড়ে মজা পেয়েছি। কাহিনীর ভেতরেও নতুনত্ব ছিলো। শিক্ষণীয়ও বটে। এজন্যে লেখকের প্রতি জানাই শুভেচ্ছা।


মেহেদির রঙ গল্পটা কিছুটা সিনেমাটিক। এবং একই সাথে খুবই কষ্টের! এরকম কাহিনী হরদম ঘটছে। মর্মান্তিক এই ঘটনাগুলোকে কিছুতেই মেনে নেয়া যায় না। কিন্তু কারও কারও ভাগ্য কেন এমন ভাঙা হয়! লেখক অতি বাস্তবতাকে যেন সিনেমার অনুষঙ্গে পাঠকের মনকে আলোড়িত করে দেখিয়ে দিলেন তার অসাধারণ লেখনীর মাধ্যমে। ক্ষুদ্র একটি টেলিফিল্মের মত উপভোগ্য বিয়োগাত্মক গল্প ছিলো।

এর পরের গল্পটা গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন নিয়ে শুরু হলেও নানারকম ট্যুইস্টে ভরা নতুনত্বময় কাহিনীতে মোড়ানো চমকার জীবন বাস্তবতার চিত্রে সাজানো লেখকের গল্প- শেষ সম্বল মুগ্ধতায় ভরিয়েছে।


বইটির শেষ গল্পটির নাম জীবন ডায়েরি
এতক্ষণ যেন গল্প নয়, লেখকেরই জীবনের নানান কাহিনী তার ডায়েরিতে পড়তে পড়তে আসছিলাম। এখন শেষে এসে কি পাঠক আমি সম্বি ফিরে পেলাম? প্রেম-পিরিতি, আশা-বেদনার সাধারণ জীবন গল্প। কিন্তু লেখকের লেখার ধরনেই সেটি ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে।

এর পরে বইটি রেখে দিলাম। আজকের মত যথেষ্ট হয়েছে। বাকী রয়েছে আরও দুটি গল্প। আরেকদিন পাঠ করা যাবে।

বেশ কদিন পরে আবার হাতে তুলে নিলাম বইটি। পড়তে শুরু করলাম, সবুজ পাঞ্জাবী নামের গল্পটি।
রাত্রীর গাম্ভীর্যময় ঘোর অমানিশা নিয়ে গল্পের শুরু। ধীরে ধীরে দেশের কালোতম অধ্যায়ের সূত্রপাত। তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সময়টা ১৯৭১। স্মৃতিবিজড়িত সেই ভয়াল দিনগুলোর পারিপার্শ্বিক বর্ণনা লেখকের সুদক্ষ লেখনীতে সাবলিল গতিময়তা পেয়েছে। গল্পের চরিত্র মুক্তিযোদ্ধা মেজ কাকা, তার প্রেম, পরিবার এবং প্রিয় দাদীমা খুব স্বাভাবিকভাবেই গল্পে উঠে এসেছে। গল্পটা পড়তে পড়তে আবারও কাহিনীর ভেতরে ডুবে গিয়ে আমি কখনো হয়ে উঠলাম কাহিনীকার, কখনো মুক্তিযোদ্ধা আছাদ, কখনো পাশের বাসার সম্ভ্রমহারা অর্ধ পাগলিনী কাজের মেয়ে। কখনো দেশপ্রেমের উদ্দীপনায় আমার রক্ত টগবগ করে ফুটছে। কখনো চোখে সোনালী স্বপ্নের বীজ বুনে আমি যুদ্ধে চলে গেলাম। আর দেশ মাতার মুক্তির পতাকা হাতে আমার ফেরার অপেক্ষায় আমার দাদীমার কষ্টার্জিত এক অনুভূতির নাম হয়ে গল্পের নামকরণ সবুজ পাঞ্জাবী ভালোই সার্থকতা পেয়েছে।

বাকী রইলো আর মাত্র একটি গল্প। সেটি আরেকদিন পড়বো ভেবে সেদিনের মত পুনরায় রেখে দিলাম বইটা। তারপরে সপ্তাহখানেক পরে তুলে নিলাম বইটা। পড়তে শুরু করলাম, সেদিন ভোরে নামের গল্পটা।
প্রথম প্যারার পরে দ্বিতীয় প্যারায় ঢুকতেই একটা ভুল চোখে পড়লো___
‘...তুষার সাহেব সরকারি ফরেস্ট অডিটর। তিনি সুইজারল্যাণ্ড থেকে ফরেস্ট বিষয়ে পিএইচডি করে দেশে ফিরেছেন এবং... এই লাইনের ফরেস্ট বিষয়েনা হয়ে শব্দটা হবে ফরেস্ট্রিবিষয়ে। ফরেস্ট অর্থ বন; আর এ বিষয়ে পড়াশুনার বিষয়ের নাম হচ্ছে ফরেস্ট্রি’!
ছয় পাতার গল্পটা পড়তে গিয়ে বার বার একই ব্যক্তির বিষয়ে কখনো সে, কখনো তিনিএর বিভ্রাটে মন বিদ্রুপ করে উঠছিলো। গল্পের লাইন___
‘...পরিদর্শন শেষে তিনি প্রথম যে বাংলোতে এসে উঠেছেন সেখানে থেকে প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। পরদিন সকালে নাস্তা সেরে বাংলোর বারান্দার অদূরে গাছের ছায়ায় বসে বাগানের দলিলপত্রাদি ঘাটাঘাটি করতেছিলো,...’ এখানে আগের লাইনে তিনিশব্দটি ব্যবহার করায়, পরের লাইনে ঘাটাঘাটি করতেছিলেনহবে। ...অলসের দুপুরে বিছানায় গা এলিয়ে ভাবতে থাকে তুষার... এই লাইনেও সামান্য মিসটেক মনযোগী পাঠক হিসাবে আমার দৃষ্টিতে ধরা পরে গেলো। লাইনটা- অলসদুপুরে বিছানায় গা এলিয়ে ভাবতে থাকেনতুষার হবে।
এর পরে গল্পটায় কাহিনীর গতিময়তায় পাঠক আমি এতটাই ডুবে গেলাম যে, গ্যাসের চুলায় ভাত ফুঁটোতে দিয়ে এসে গল্পটায় এতটাই নিমগ্ন হয়ে গিয়েছি যে, ভাত ফুঁটে কখন তা ভর্তা-ভাতে রূপ নিচ্ছে, আমার হুঁশই নেই! পাওয়া না পাওয়ার বেদনা ও হর্ষ মেশানো নানান চড়াই উরাই পেরিয়ে গল্পের নায়ক-নায়িকার হ্যাপী-এণ্ডিং দেখতে ভালোই লাগে। গল্পের নিমগ্নতার গভীর আচ্ছন্নতা কাটলো আমার, চুলায় দেয়া ভাতের হাড়ির পোড়া গন্ধে!    

অবশেষে বইটা পড়া সমাপ্ত হলো। আসলেই হলো কি? আমি উলটে পালটে পুনরায় দেখতে থাকলাম; সবগুলো গল্পের নাম সহ বের করে দেখে নিশ্চিত হলাম, হ্যাঁ শেষ! এখন লেখককে জানাতে হয়! কিভাবে? কলম তুলে নিলাম। বসে গেলাম বইটির চুলচেরা বিশ্লেষণে।

২য় সংস্করণের পথে ধাবিত হওয়া চমকার প্রচ্ছদের স্বল্পমূল্যের গল্পগ্রন্থ "আধ ভাঙা চাঁদ" ইতোমধ্যেই সারা বাংলাদেশের পাঠকদের মন জয় করে নিয়েছে। সৃজনশীল সাহিত্য কাগজ “ক্যাপটেন” এর সম্পাদক এবং আধ ভাঙা চাঁদ গল্পগ্রন্থের লেখক রাশেদ রেহমান; যিনি নিজেই দুই বাংলা থেকে লেখক-কবি-প্রবন্ধকার খুঁজে বেড়ান, তার লেখালেখির জন্য অসংখ্য পদক প্রাপ্তিটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সাথে যুক্ত থেকে তিনি সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য অর্জন করেছেন ছোট বড় পুরস্কার সহ অনেক পদক। সম্প্রতি তিনি অর্জন করেছেন উত্তরণ দুই বাংলা লেখক সম্মেলন ২০১৫ তে কবি বন্দে আলী মিয়া বাংলার সেরা তরুণ সাহিত্য সংগঠকপদক। এছাড়াও অন্যতম-শাহজালাল স্মৃতি ফাউন্ডেশন সাহিত্য পদক; নবম দৈনিক সিনসা সাহিত্য পদক, ছোটগল্পে অরুণিমা, সাহিত্য পদক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাডেমিক সাহিত্য পদক ইত্যাদি।
তাঁর গল্পগ্রন্থ সম্পর্কে যা বলার আগেই বলে দিয়েছি। এই বই আলোচনা শেষ করার আগে দুটি উদ্ধৃতি উল্লেখ না করলেই নয়!

লেখক রাশেদ রেহমান সম্পর্কিত তার নিজ জেলা সিরাজগঞ্জবাসী একজনের বক্তব্যঃ
রাশেদ রেহমান, তাকে সবাই লেখক হিসাবেই চিনি। তিনি নাটুয়ার পাড়ার অহংকার! গর্ব! একাধিক বার পুরস্কার প্রাপ্ত! লেখক ক্যাপ্টেন সম্পাদক রাশেদ রেহমানের লেখার মধ্যে মূলত লক্ষণীয় হলো দেশ, জাতি, নিসর্গ ও মানবতা। আপনারা সবাই তার জন্য দোআ করবেন। তিনি যেন আরও এগিয়ে যান আমাদের নাটুয়ার পাড়াবাসীর মুখ উজ্জল করুন।
বগুড়া ধানসিড়ি প্রকাশনের কর্ণধার সুলতান মাহমুদ রনি’র বক্তব্যঃ
“স্বকীয় ভাবনা, স্বপ্ন প্রসূত মানব মনের বিচিত্র অনুভূতি এবং জীবনের নানা অভিজ্ঞতাকে গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপনের প্রত্যয় নিয়ে গল্প লিখছেন কবি ও সাহিত্যিক ক্যাপটেন সম্পাদক কবি ও কথাসাহিত্যিক রাশেদ রেহমান। লেখকের গল্পগ্রন্থ আধ ভাঙা চাঁদতাঁর পুঞ্জীভূত ইচ্ছের বহিঃপ্রকাশে মানব জীবনের হাসি-কান্না, দ্রোহ, প্রেম-বিরহের চিত্রে বিদ্যমান।
তাঁর লেখায় মূলতঃ দেশ, জাতি, নিসর্গ ও মানবতা; বিশেষত বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত। এছাড়াও আরো কিছু বিষয় অলংঘনীয় উপাদান হয়ে মিশে আছে। যেমন লোক-বাস্তবতা, বর্তমান অনাগত দিনের স্বপ্নকল্প, রূপকথা, রাজনৈতিক ইতিহাস; রয়েছে সত্য-সুন্দরকে গ্রহণ এবং অসত্য-অসুন্দরকে বর্জন করার শিক্ষা। বর্তমান সময়ের তরূণ লেখকদের মধ্যে তাঁর গল্প ও কবিতা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। লেখকের লেখনী বলে দেয়, সফলতার যাত্রা কতটা এগিয়ে যাচ্ছে...!

লেখকের ২০১৬ একুশে বইমেলায় প্রকাশিতব্য তিনটি গ্রন্থের নামঃ___
১। আজিরণ বেওয়া (উপন্যাস)- এক মলাটে বাংলা ও ইংরেজী ভার্সন
২। দুঃখ-সুখের যমুনা (কাব্য গ্রন্হ)
৩। ভ্রমণ বাংলাদেশ (ভ্রমণ কাহিনী)
তরুণ লেখক-কবি ও কথাসাহিত্যিক রাশেদ রেহমান একই সাথে সৃজনশীল কাগজ “ক্যাপটেন” এ নবীণ-প্রবীণ লেখক-কবি-প্রবন্ধাকার এর সম্মীলন ঘটাতে বর্তমানের চেয়েও আরও বেশি বেগবান ও সফলতার শীর্ষে আরোহণ করুন, সেই শুভকামনা ব্যক্ত করে আমার বই পাঠ আলোচনার ইতি টানছি। 

_________________________________
বই পাঠের অনুভূতি ব্যক্তকারীনি;___
জাকিয়া জেসমিন যূথী
কথাসাহিত্যিক,
চিত্রশিল্পী এবং
সহ-সম্পাদক (সংকাশ ও সংবেদ্য)

No comments:

Post a Comment