ধবলি
খড়ের গাদায় সোনামুখি সুঁই হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটি শোনার পর থেকেই ধবলি
নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেল।
সর্বনাশ!
খড় খেতে খেতে যদি আচমকা সুঁই গলায় আটকে যায়—সেই ভয়েই দিনরাত অস্থির হয়ে থাকে সে। অন্য আথালের গরুরা শুনলে বলবে—ন্যাকা! খড়ই খায় নাকি শুধু?— একথা ঠিক শুধু খড়ই খায় না সে। ভুষি আর খৈলও খায় সকাল বিকাল। কিন্তু মুশকিল হল এ-বাড়ির কামলা হাকি ভুষি আর খৈলের গোলার সাথে একগাদা খড়ও দিয়ে দেয়। ভয়টা এখানেই। এই খড়ের মধ্যে ত সোনামুখি সুঁই চলে আসতে পারে—তখন?
সর্বনাশ!
খড় খেতে খেতে যদি আচমকা সুঁই গলায় আটকে যায়—সেই ভয়েই দিনরাত অস্থির হয়ে থাকে সে। অন্য আথালের গরুরা শুনলে বলবে—ন্যাকা! খড়ই খায় নাকি শুধু?— একথা ঠিক শুধু খড়ই খায় না সে। ভুষি আর খৈলও খায় সকাল বিকাল। কিন্তু মুশকিল হল এ-বাড়ির কামলা হাকি ভুষি আর খৈলের গোলার সাথে একগাদা খড়ও দিয়ে দেয়। ভয়টা এখানেই। এই খড়ের মধ্যে ত সোনামুখি সুঁই চলে আসতে পারে—তখন?
এই ত ধবলির সামনেই সিমেন্টে
বানানো বিশাল এক টাগারি। ভুষি খৈল আর লবনগোলা পানি। মাঝে মধ্যে চিটাগুড়ও থাকে—ভাগ্য ভাল
থাকলে। টাগারি কানায় কানায় ভরা। কাজলি নাক-মুখ লাগিয়ে কেমন
শুষে শুষে খাচ্ছে । মাঝেমধ্যে খড়ে কামড় দিয়ে গলার ভেতরে ঢুকিয়ে আকাশের দিকে মুখ
তুলে চাবাচ্ছে। আরামে দু’চোখের পাতা পিট পিট করছে । গলা ঝাঁকি দিয়ে পুরো শরীর জুরিয়ে নিচ্ছে। গর গর
শব্দ করেছে।
আহা রে, বেচারা এখনও
জানে না—কী ভয়ানক বিপদ হতে পারে তার।
ধবলি একবার ভাবে—কাজলিকে বলে
দিবে কি না ! কিন্তু খাওয়া দেখে মায়া লাগল । কিছু বলল না—খাক।
আচ্ছা,
ধরে নিলাম সুঁইটা গলায় আটকাল—ধবলি মনোযোগ দিয়ে
চিন্তা করে—তাহলে কি সুঁইটা বের করতে সরা ডাক্তার আসবে?
উফ, তাহলে সেরেছে! অই বেটা ডাক্তারির কিছু
জানে না। জানে শুধু ইয়া বড় সুঁই লাগাতে । কিছু হলেই ঊরুতে সুঁই দিয়ে দেয়। সুঁই
দিতে দিতে উরু দু’টো ব্যথা বানিয়ে দিয়েছে। সরা
ডাক্টার আস্ত একটা বজ্জাত। ধবলি দু’চক্ষে দেখতে পারে না।
সেবার আশ্বিন মাসে কয়েকদিন সে খেতে পারেনি। তেমন কিছু না—শরীরটা একটু ম্যাজম্যাজ
করছিল। জিবটা একটু শুকিয়ে শুকিয়ে আসছিল। মন চাইছিল না— কিছু খেতে
। অথচ আথালে ‘কাইশা’ কেটে জমা করছিল হাকি।
কাইশা খেতে ভারি মজা। অনেক পছন্দের খাবারটিও খেতে ইচ্ছে করছিল না। কাজলি খেয়াল
করেছিল । কিন্তু কিছু না বলে মুখ ভেংচে দিয়েছিল—ঢং! কয়দিন পর
পর সিনক্রিয়েট!
হাকি হারামজাদার চোখে কিছুই
এড়ায় না। সে ফট করে সরা ডাক্তারকে খবর দিয়ে বসল । পরদিন সকালে চোখ দেখে কান দেখে
মুখের ভেতর ময়লা হাত ঢুকিয়ে জিব দেখে আর দাঁতও দেখে, তারপর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে
‘বুঝতে পেরেছি’—ভাব নিয়ে উরুতে বিশাল এক সুঁই
ঢুকিয়ে দিল। ধবলির ইচ্ছে করছিল এক লাথি মেরে চোয়াল ভেঙে দিতে। পারেনি। পাশের আথাল
থেকে ষাঁড়টা দেখছিল চেয়ে চেয়ে—কী লজ্জা !
সেবার ত সেবার। এবার কি হবে কে
জানে । হাকি ইতোমধ্যে লক্ষ্য করেছে—ধবলি টাগারিতে মুখ ডোবাচ্ছে না।
দুশ্চিন্তায় রাতে ঘুম এল না ধবলির।
খুর দিয়ে মাটিতে ধপাস ধপাস লাথি মারতে লাগল। কাজলি বিরক্ত হয়ে বলল—কি রে এত
উশখুশের কি হল?
ধবলি তবু কিছু বলল না। মাথা
দিয়ে একটা বাঁশে গুতো দিল। বাঁশে ২টি ছাগল বাঁধা ছিল তারা ম্যা ম্যা করতে করতে
একটা আরেকটার ওপর গিয়ে হুড়মুরিয়ে পড়ল।
-ধবলি, তুই এসব কি
শুরু করলি বল ত? ঘুমাতে দে।
কাজলি ঘুমায়, ধবলি ঘুমাতে
পারে না। ইশ, ছাগল হয়ে কেন জন্মাল না— ভাবতে
লাগল। ছাগল হলে খড় খেতে হত না। অতবড় সুঁইও ঊরুতে নিতে হত না। ধবলির
বাকি রাতটুকু সরা ডাক্তারের মুখ মনে করতে করতে কেটে গেল ।
হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে শেফালি
বলল—যাও, বাজার নিয়ে এসো। পারলে বড় দেখে
তেলাপিয়া আনবে। ও হ্যাঁ, দেখো
বাইন মাছ পাও কিনা। নায়লার খুব পছন্দ।
মাজেদ
মুখ ভোঁতা করে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। গলির মোড়ে চায়ের দোকান । ভাবল একটু
চা খাওয়া
যাক। বাসার চা বিস্বাদ লাগে মাজেদের। শুধু চা না—বাসার সবকিছুই বিস্বাদ।
-মাজেদ ভাই, চা নেন। অনেকদিনের চেনা গুল্টু চা বাড়িয়ে দেয়। সাথে বেনসন। বলতে হয় না।
গুল্টু কাস্টমার সামলাতে সামলাতেই এক ফাঁকে বলল—খবর শুনছেননি মাজেদভাই? চুমুক দিতে দিতে মাথা নাড়ানো যায় না। কথাও বলা যায় না। অবশ্য তার আগেই গুল্টু বলল—সত্যপুরের ঘাট থন চিন্তামণিকে গেরেফতার করছে উড়ুক্কু বাহিনী। বলছে—সে নাকি কোন কামের না। সিগারেটে টান দিতে দিতে মাজেদের কেমন উদাস লাগে খবরটা শুনে।
-মাজেদ ভাই, চা নেন। অনেকদিনের চেনা গুল্টু চা বাড়িয়ে দেয়। সাথে বেনসন। বলতে হয় না।
গুল্টু কাস্টমার সামলাতে সামলাতেই এক ফাঁকে বলল—খবর শুনছেননি মাজেদভাই? চুমুক দিতে দিতে মাথা নাড়ানো যায় না। কথাও বলা যায় না। অবশ্য তার আগেই গুল্টু বলল—সত্যপুরের ঘাট থন চিন্তামণিকে গেরেফতার করছে উড়ুক্কু বাহিনী। বলছে—সে নাকি কোন কামের না। সিগারেটে টান দিতে দিতে মাজেদের কেমন উদাস লাগে খবরটা শুনে।
-এক হিসেবে ভালোই হইছে । বেডায় ঘাটে বইয়া বইয়া কি ছিঁড়ত সেটাই বুঝতাম না। এই যে আপনার বাইন মাছ কেনার টাকা নাই—সেটা কি হে জানত না? মাসের শেষ দিকে নায়লা আপার আসার সময় হইল—সে ইচ্ছা করলে সময়টা ঘুরাই দিতে পারত না? আমরা আমরাই ত।
-বেডায় জগতপাড়ের নদীতে ডুইব্বা
মরলে আরো খুশি হইতাম। হালার মরণ ত হের কপালে নাই—আফসোস। আরেক কাপ চা দেই মাজেদভাই?
মাজেদ কিছু বলল না। সে দেখল তীব্র
রোদের তাপ কমে আসছে। একটা শীতল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। শরীরের ঘাম শুকিয়ে
যাচ্ছে ।
সে গুল্টুর চোখে চোখ রেখে সত্যপুরের ঘাটে চলে এল। ঘাটের পাড় লাগোয়া অশত্থ গাছের বেদী। চিন্তামণির আসনটি শূন্য পড়ে আছে। মাজেদ তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলে হাওয়ার ভেতরে হাত চালান করে দিল। তারপর বাইন মাছ, তেলাপিয়া সহ আরও অনেক জাতের মাছ ব্যাগে ভরল। অনেকদিন মাংস খাওয়া হয়নি—প্রচুর মাংস ভরল।নিতুর জন্যে দুধ, মাখন, চকোলেট ভরে ফেলল চটপট। মাঝেমধ্যেই শেফালি চিকেন ফ্রাই খেতে চায়—তাও ভরল। তারপর তরিতকারি। ফলমুল। কাপড়চোপড়। তৈজসপত্র। মেয়েটা বড় হচ্ছে—একটা ড্রেসিং টেবিলের দরকার। সেইদিকে চিন্তা করে ব্যাগে একটা ড্রেসিং টেবিল তুলে নিল। তারপর ওয়ারড্রপ, মিটশেলফ, সোফা—সবই নিল। আকাশে উড়ছিল শাদা মেঘ। একটা ছোট লাফ মেরে খামচি দিয়ে কিছু মেঘকে মুড়িয়ে নিল—হাওয়াই মিঠাই হিসেবে দারুন লাগবে খেতে। ছোট মেয়েটি খুশি হবে।
মনটা ভরে যাচ্ছে মাজেদের। বাজারের ব্যাগের মুখটা বাঁধা ছাঁদা করতে
যাবে মনে পড়ল— চাটগাঁ শহরে তার বাপদাদার জন্ম, একটা বাড়ি নেই
তার—এটা কোন কথা হল? সে একটা পাঁচতলা
বিল্ডিং ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল।
আহ বড় তৃপ্তি!
আহ বড় তৃপ্তি!
শেফালি দরজা খুলতেই মাজেদ কাঁধ থেকে ব্যাগটি নামিয়ে বলল—এই নাও । তোমার
জন্যে আজ সব কিছুই নিয়ে এসেছি। শেফালি মাজেদের দিকে
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
No comments:
Post a Comment