কোথায় কি!

03 March 2016

সাব্বির জাদিদ


বউপরায়ণ স্বামী

কী ব্যাপার জোবায়ের সাহেব? এত ঘামছেন কেন? ও.. আপনি তো আবার লজ্জা পেলে ঘামেন। তা লজ্জাটা কিসের শুনি! বউকে মিথ্যা বলে এসেছেনসে জন্য লজ্জা? না না আপনি তো তেমন মানুষ না। বউকে মিথ্যা বলে লজ্জা পাওয়ার মত 'বউপরায়ণ' স্বামী তো আপনি না।
তাহলে সমস্যাটা কী? আচ্ছা সমস্যা যা-ই হোক, সেটা পরে ভাবা যাবেরুমাল দিয়ে ঘামটা আগে মুছুন তো। দেখছেন না সবাই কেমন করে আপনার ঘামা দেখছে! এ-বড় অস্বস্তি। আপনি ঘাম মুছুন, প্লিজ। বারে! তবু বসে আছেন ঘাড় গুঁজে! না মুছলে না মুছুন গে, তাতে কার কী! প্রবলেম আপনারই। এবার আপনার ঘামের রহস্যে ফেরা যাক। আপনার জড়োসড়ো ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে এই রেস্টুরেন্টে এসে আপনি লজ্জায় পড়েছেন। আর সে জন্যই এই দরদরানি ঘাম। তা লজ্জা তো একটু লাগবেই। এই রেস্টুরেন্টে যারা আসে সবাই কলেজ-ভার্সিটি পড়া ছেলেমেয়ে। তারা তো আর খেতে আসে না, আসে প্রেম করতে। এই যেমন আপনার ডানপাশের টেবিলের কপোত কপোতিহাত ধরে কিভাবে বসে আছে মুখোমুখি। ইশ! মেয়েটার বাঁ হাত ঠোঁটের কছে টেনে এনে একটা চুমুও খেল ছেলেটা।
একটু খেয়াল করলে আপনিও দেখতে পেতেন। কিন্তু দেখতে পাননি। কারণ আপনি ঘাড়গুঁজে বসে আছেন। আশপাশের কপোত-কপোতিগুলো আপনার উপর বিরক্ত হচ্ছেআপনি কি তা বুঝতে পারছেন? আপনি কেন এদের ভেতর এসেছেন? আপনি ওদের বাবার বয়সী। আপনার মেয়েটা সামনের বার মেট্রিক দেবে। এখন যদি আপনার মেয়েটাই কোন ছেলের হাত ধরে এখানে চলে আসে! ভয়টা পাবে কে? আপনি, না আপনার মেয়ে? নাকি দুজনেই? আপনি ঘড়ি দেখছেন। আপনার এই ঘড়ি দেখা বলে দিচ্ছে আপনি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। কার জন্য অপেক্ষা করছেন? ওই যে ওই মেয়েটা, কী যেন নামও মনে পড়েছে মিমি। আপনি আদর করে যাকে তিমি মাছ বলে ডাকেন।

মিমি আপনার কবিতার ভক্ত। আর সচারচর যা হয়কবিতার ভক্ত এক সময় কবিরও ভক্ত হয়ে যায়। মিমিও আপনার ভক্ত হয়ে গেছে। ভক্ত হয়ে সে কিন্তু আড়ালে থাকেনি। আর অনেকেই যেমন আড়ালে থাকে। মিমি একটু অন্যরকম। সবার থেকে আলাদা। আপনি কয়েকবার এই কথাটা তাকে শুনিয়েছেন তিমি, তুমি সবার থেকে আলাদা। আপনার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ বের হওয়ার পর মিমি আপনার ফোন নাম্বার যোগাড় করেছিল। তারপর করেছিল ফোন। ছয়মাস ধরে আপনি মিমির সাথে কথা বলছেন। বউয়ের, মেয়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে। আপনি আসলেই চালাক। চালাক না হলে বউকে ফাঁকি দেয়া কাজটা আপনি এত সহজে পারতেন না। আর আপনি কোনদিন মিমিকে জিজ্ঞেস করেননিসে কোথায় পেয়েছে আপনার নাম্বার। এখানেও আপনার চালাক-মস্তিষ্কের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। আপনি শুরু থেকেই মিমির উপর কিছুটা দূরত্ব রেখে চলেছেন। যেন সে আপনার দ্বারা প্রভাবিত হয়।

আপনি দ্বিতীয়বার ঘড়ি দেখলেন। আরে ভাই এত ঘড়ি দেখাদেখির কী হল? ও.. সরি সরি। আপনাকে ভাই বলা হয়ে গেল। আপনি তো ভাই ডাক পছন্দ করেন না। আপনি কবি। কবি ডাকলে আপনি কৃতার্থ হন। তা কবি সাহেব, এত ঘড়ি দেখাদেখির কী হল? মিমির আসার কথা কয়টায়? সাড়ে চারটায়। এখন বাজে চারটা সাতচল্লিশ। সতেরো মিনিটেই অধৈর্য হয়ে গেলেন? কবিদের তো এত অধৈর্য হলে চলে না! আরেটকু অপেক্ষা করুন। নিশ্চয় এসে পড়বে। ঢাকা শহরের জ্যামের কথা একটু ভাববেন না! এই শহরে কে কবে কথা দিয়ে সঠিক সময়ে এসেছে! তার উপর মিমি আবার মেয়ে। কুড়ি না পেরোনো মেয়ে। এই বয়সী মেয়েদের কত প্রতিবন্ধকতা! দেখা গেল অর্ধেক পথ এসে মনে পড়েছে মেকআপ বক্স ফেলে এসেছে বাসায়। তখন আবার ফেরত যাওয়া। আজ আপনাদের প্রথম দেখা হওয়ার দিন। সাজুগুজু করতেও তো একটু দেরি হতে পারে। হতে পারে আপনার জন্য কিছু কিনতে গিয়ে আটকে গেছে দামি কোন দোকানের গোলকধাঁধায়। হয়ত কোনটাই পছন্দ হচ্ছে না। অথবা সবই পছন্দ হচ্ছেনেবে কোনটাএই নিয়ে ঝামেলায় পড়েছে। মেয়েরা কেমন খুঁতখুঁতে হয় আপনি তা ভাল করেই জানেন। রেহানার সাথে আপনার একুশ বছরের সংসার। এই একুশ বছরে তো আপনি কম আলুভাজি হননি। কপালের ঘাম মুছে আপনি পথের দিকে তাকালেন। মিমিকে আপনি
দেখেননি কোনদিন। কিন্তু সে আপনাকে দেখেছে। আপনি মোটামুটি বিখ্যাত মানুষ। আপনাকে চেনা তো কারো অসাধ্য নয়। মিমির
ফেসবুক একাউন্ট আছে। সে কতবার আপনাকে বলেছেএকটা একাউন্ট খোলেন, একটা একাউন্ট খোলেন। নির্মলেন্দু গুণের যদি একাউন্ট থাকতে পারে, আপনার থাকতে দোষ কী? ফেসবুক তো আর আপনার কবিতা দূষিত করে দিচ্ছে না। আপনি কথা শোনেননি। আসলে ফেসবুক জিনিসটার প্রতি আপনি কোন আকর্ষণ বোধ করেননি। আপনি সেকালের মানুষ। একালের ফেসবুক
আপনাকে টানবে কেন। সবাই যেখানে কম্পিউটারে লেখালেখি শুরু করে দিয়েছে, আপনি লেখেন কাগজেকলমে। আসলে প্রযুক্তি জিনিসটাই আপনি বোঝেন না। মিমি আসবে নীল শাড়ি পরে। আপনিই বলেছেন নীল শাড়ির কথা। সব কবি-সাহিত্যিকের মত নীল আপনারও পছন্দ কিনা। আপনি দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন নীলের অপেক্ষায়। এই মুহূর্তে একটা নীল শাড়ি আপনার অস্থিরতা কমাতে পারে। নীল শাড়ির এত ক্ষমতা! দরজা ঠেলে নীল ঢুকল। তবে শাড়ি নয়, জামা। মিমি কি তবে শাড়ির বদলে জামা পরে এলো? নীল জামার সাথে একটা ছেলেও আছে। ঘাবড়াবেন না কবি সাহেব। এ মিমি নয়। মিমি একাই আসবে আপনার
কাছে। মিমি, আপনার তিমি মাছ, অত বোকা নয়। আবার অপেক্ষা। এবার আর বেশি অপেক্ষা করতে হল না আপনাকে। মিনিট পাঁচেক পরেই কাঁচের দরজা ঠেলে ঢুকল নীল শাড়ি মিমি। আপনার আদরের তিমি মাছ। আপনি ভেবেছিলেন মিমি ঢোকার পর দোকানের সব বিজলিবাতি ম্লান হয়ে যাবে। গত ছয়মাসে মিমির মিষ্টি গলার 'কবি' ডাক শুনে শুনে এমনই প্রতীতি জন্মেছে আপনার। আপনার ধারণা ভুল হলেও আপনি হতাশ হলেন না। প্রথম দর্শনেই আপনি বুঝতে পারলেনমিমির আলগা রূপ নেই। তার সৌন্দর্য হুট করে ধরা পড়ে না। আবিষ্কার করতে হয়। আপনি অপলক চোখে মিমির সৌন্দর্য আবিষ্কারে মগ্ন হয়ে পড়লেন।
মিমির হাতে একগোছা রজনীগন্ধা। আপনি একদিন বলেছিলেন রজনীগন্ধা-প্রেমের কথা। মিমি ভোলেনি সে-কথা। নিয়ে এসেছে
উপহারস্বরূপ। মিমি আপনার সামনের চেয়ারে বসল। বসতে বসতে কানের পাশের চুল সরাল। তারপর হাসি মুখে বলল, দেরি
করে ফেললাম, সরিটরি বলছিনে। তা কেমন আছেন, কবি? বরাবরের মতোই মিমির কথার মাদকতায় আপনি মাতাল হয়ে
গেলেন। আপনি বুঝেতেও পারলেন নাআপনার উদ্দেশ্য মিমি একটা প্রশ্ন ছুঁড়েছে। অথবা বুঝতে পেরেছেন, কিন্তু উত্তর দেয়ার ক্ষমতা হরিয়ে ফেলেছেন। হা হাহ! এদেশের মানুষ দিনে দিনে ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছে আর আপনি হারাচ্ছেন উত্তর দেয়ার ক্ষমতা। হা
হাহ! মিমি আপনার দিকে রজনীগন্ধার স্টিক বাড়িয়ে ধরল। তার এই বাড়িয়ে ধরার ভঙ্গি দেখে আপনা মনে উদয় হল এক উপমা। আপনি যেন স্বর্ণে মুড়ানো কোন মন্দিরের পুরোহিত আর মিমি আপনার দেবি। দেবি আপনার চরণে অর্ঘ্য নিবেদন
করতে এসেছে। উপমাটা মনে হওয়াতে আপনার বেশ আনন্দ লাগল। আনন্দটা এ-জন্য যে আপনি যেভাবে মিমির সামনে সম্মোহনের জাল ছড়িয়ে রেখেছেন, তাতে আপনি যেন সত্যিকারের পুরোহিত। আর মিমি আপনার সত্যিকারের দেবি। আপনি দেবির অর্ঘ্য সানন্দে গ্রহণ করলেন। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললেনমিমি, তুমি পাহাড়ের মতো সুন্দর। আপনার কথা শুনে মিমি চোখ বড় বড় করে তাকাল। শিশুর মত অবাক গলায় বলল, পাহাড়ের মতো সুন্দর! মিমির পুনরাবৃত্তি আপনি উপভোগ করলেনহ্যাঁ মিমি, পাহাড়ের সৌন্দর্য সবাই বুঝতে পারে না। পাহাড়ের সৌন্দর্য সব চোখে ধরা পড়ে না। এভাবেই আপনি একটু একটু করে কথার জাল ছড়াতে লাগলেন এক অপরিপক্ব তরুণীর সামনে। ইতোমধ্যে ওয়েটার আপনাদের সামনে খাবার-পানীয়
রেখে গেছে অর্ডার মোতাবেক। মিমি খাবারে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে আর আপনি গতকাল রাতের লেখা কবিতাটা নিচুস্বরে আবৃত্তি করে
শোনাচ্ছেন। গল্পে-কথায় কখন যেন সন্ধ্যা নেমেছে। রাস্তার মাঝখানের ল্যাম্পপোস্টে আলো ফুটে উঠেছে। হঠা রেহানা আর
তিতলির কথা মনে পড়ে গেল আপনার। এবং এটাও মনে পড়ে গেল, আপনাকে এখন বাসায় ফিরতে হবে। কারণ ঘরসংসারের দায়িত্ব এড়ানোর মত মনোবল আপনার কলিজায় নেই। বাইরে আপনি যতই তিমি মাছ নিয়ে ঘোরেন, ফেরার জায়গা আপনার একটাই। ছায়ানীড় কটেজ। আপনার যেমন রেহানা আছে, তিতলি আছে, মিমিরও সম্ভবত অমন কেউ আছে। আর সে-জন্য মিমিও
হঠা ওঠার কথা বলল। তাকেও ফিরতে হবে বাসায়। আপনারা উঠলেন। আপনাদের নিতম্বের ছোঁয়ায় উষ্ণ চেয়ারদুটো পড়ে রইল
পেছনে। বিদায়ী কথাবার্তা বলে আপনি দায়িত্ববান প্রেমিকের মতো মিমিকে একটা হলুদ ক্যাবে তুলে দিলেন। জানালার ওপাশ থেকে মিমি আপনার উদ্দেশ্যে হাত নাড়ল। আপনিও নাড়লেন হাত। কিন্তু আপনার হাত দোলানো মিমির হাত দোলানোর মতো ছান্দিক হল না। আপনি সেটা স্পষ্ট ধরতে পারলেন। আপনার মনে হলএই হাত শুধু কবিতা লেখার জন্য; কোন তরুণীর বিদায়সম্ভাষণ জানানোর জন্য নয়। আপনি ধুর ছাই বলে একটা রিকশায় উঠলেন। রিকশা চলছে মহাখালীর দিকে। সন্ধ্যা নেমে গেছে পুরোপুরি। আপনি কবি বলেই ব্যাপারটা অনুভব করলেন। আর সামনের ছিটে বসা লোকটা রিকশাওয়ালা বলে অনুভব করতে পারল না। সন্ধ্যা নামতে দেখলে আপনার মন খারাপ হয়। ভাবেনযাহ! ফুরিয়ে গেল আরো একটা অসমাপ্ত দিন! কত কাজ জমে থাকল জীবনে! কিন্তু আশ্চর্য! আজ আপনার একটুও মন খারাপ হল না। কারণটা সহজেই অনুমেয়। আপনার ভেতর এখন ছড়িয়ে আছে মিমির সান্নিধ্যের রেশ। ছড়িয়ে আছে আরো একটা জিনিস মিমির পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ। রিকশাওয়ালা একবার পেছন ফিরে
আচমকা বলে উঠলআহ! সেন্টডা তো ফাইন। আপনার তখন খেয়াল হলআপনি নিজের অজান্তেই মিমির পারফিউমের গন্ধ বহন করে চলেছেন। গন্ধটা এত মিষ্টি আর কোমল যে আপনার মায়া লেগে গেল। সাবান দিয়ে কাচলে এই গন্ধ চলে যাবে পাঞ্জাবি থেকে। আপনি সিদ্ধান্ত নিলেনএই পাঞ্জাবিটা কোনদিন কাচবেন না। ভাঁজ করে ওয়ার্ডরোবের নিচের ড্রয়ারে তুলে রাখবেন। ভাঁজের ভেতর যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে গন্ধ। আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে সেই গন্ধ শুকবেন। কল্পনার এই জায়গায় এসে হঠা আপনার
সন্দেহবাতিকগ্রস্ত স্ত্রীর কথা মনে পড়ে গেল। একবার আপনি যাত্রাবাড়ি এক চিত্রকর বন্ধুর স্টুডিও দেখতে গিয়েছিলেন শখের বশে।
স্টুডিও থেকে আপনার সাদা পাঞ্জাবিতে লেগে গিয়েছিল লাল রঙের ছোপ। এই রঙকে আপনার স্ত্রী লিপিস্টিক ভেবে প্রচুর জলঘোলা করেছিল। এবার এই মিষ্টি গন্ধ নিয়ে বাসায় উঠলে নিশ্চিত পুলিশি জেরার মুখে পড়তে হবে আপনাকে। আপনি মাঝপথে রিকশা
ছেড়ে দিয়ে এক পারফিউমের দোকানে ঢুকলেন। আপনার গায়ের ব্রান্ড খুব সহজেই ধরতে পারল দোকানি। ধরতে তো পারবেই।
পারফিউম নিয়ে তাদের সার্বক্ষণিক কারবার। কসাই যেমন চলন্ত গরু দেখে বলে দেয়, কত কেজি মাংস হবে, তেমনি এই দোকানিরা
দূর থেকে গন্ধ নিয়েই ব্রাণ্ড চিনতে পারে নির্ভুল। আপনি মিমির ইউজ করা ব্রাণ্ড নিয়ে বাসায় ফিরলেন। দরজা খুলেই আপনার স্ত্রী নাক কুঁচকালেনকী ব্যাপার, তোমার গায়ে এই মেয়েলি গন্ধ কেন? কার সাথে জড়াজড়ি করে আসলে শুনি? আপনি কোন কথা না বলে পারফিউমের প্যাকেট স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। মেয়েদের অনেকরকম হবি থাকে। কেউ নতুন পদের খাবার রেঁধে স্বামীকে
চমকে দিতে ভালবাসে। কারো হবিনতুন নতুন সেলাইয়ের কাজ। আপনার স্ত্রীর হবিদেশি- বিদেশি পারফিউম কালেকশন।
বিয়ের প্রথমদিকে প্রায়ই আপনি অফিস থেকে ফিরে স্ত্রীকে নতুন নতুন পারফিউম গিফট করে চমকে দিতেন। তখন ছিল মাতাল হাওয়ার দিন। আপনারা দুজনেই খুব এক্টিভ স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। এখন আপনারা পুরনো হয়ে গেছেন। পুরনো হয়েছে শরীর। পুরনো হয়েছে মন। পরস্পরকে চমকে দেবার তাগিদ অনেক আগেই আপনার বিস্মৃত হয়েছেন। এত বছর পর বাইরে থেকে ফিরে
স্ত্রীর হাতে নতুন ব্রান্ডের পারফিউম তুলে দিতেই আপনার স্ত্রীর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল উত্তেজনায়। খুশিতে তার চোখে পানিও এসে গেল হয়ত। তিনি ভাবলেন আবার আপনাদের সুদিন ফিরে আসছে। আবার আপনারা লুকিয়ে লুকিয়ে ভালবাসা ভালবাসা খেলবেন। আপনি মাঝে মাঝেই পারফিউম হাতে অফিস থেকে ফিরবেন। আর আপনার স্ত্রী লুকিয়ে আপনার পছন্দের পদটা রান্না করে অপেক্ষা করবে চেয়ারে। এভাবে একটা অপকর্মকে ঢাকতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আপনি স্ত্রীকে খুশি করে ফেললেন। বেচারি জানতেও পারল না পনের বছর পর আপনার পারফিউম হাতে ঘরে ফেরার রহস্য। রাতে খাওয়ার পর আপনি লেখার টেবিলে বসেন। আর আপনার স্ত্রী টিভির সামনে। কোনদিন আপনার লেখা আগে শেষ হয়। কোনদিন স্ত্রীর টিভি দেখা। যে-দিন যে ফার্স্ট হয় সে-দিন সে আগে বিছানায় যায়। এবং সাথে সাথেই ঘুম। এই শহরে আপনারা বেশ যান্ত্রিক মানুষ হয়ে উঠেছেন। কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করেন না। আজ আপনার লিখতে ইচ্ছে করল না। আপনি শুয়ে পড়লেন। চোখ বুজে মিমিকে ভাবতে লাগলেন। মেয়েটা এত সুন্দর! মেয়েটার কথাগুলো এত সুন্দর! মেয়েটার চুল সরানোর ভঙ্গিমা এত সুন্দর! মেয়েটার হাঁটার ছন্দটা এত সুন্দর!
হঠা আপনার যুবক হয়ে যেতে ইচ্ছে করল। মনে হল, ইশ! আর বিশটা বছর পরে যদি আপনি আসতেন! অথবা মিমিই আসত বিশটা বছর আগে! এইসব ভাবতে ভাবতেই আপনি ঘুমিয়ে গেলেন। আপনার ঘুমের পৃথিবীতে হেঁটে বেড়াতে লাগল মিমি। আপনার
তিমি মাছ।
মাঝরাতে ঘুম ভেঙে আপনি মিষ্টি একটা গন্ধ পেলেন। গন্ধটা আসছে আপনার পার্শবর্তিনীর শরীর থেকে। খুবই চেনা এবং মায়া লাগানো গন্ধ। আপনি কিছু না ভেবেই মাতাল করা ওই গন্ধের আকর্ষণে পার্শবর্তিনীর শরীরে উপগত হলেন। পার্শবর্তিনী মানে আপনার স্ত্রী রেহানা হঠা আপনার এই আচরণে খুব অবাক হলেন। আপনি দশদিন আগে একবার স্ত্রীর উপর উপগত হয়েছিলেন।
হিসেব মতে পরবর্তী শারীরিক মিলন এখনো বিশদিন বাকি। আপনারা মাসে একবার ওই কর্মটি করেন। তাও খুব ম্রিয়মাণ আর
দায়সারা গোছের। অথচ একটা সময় আপনারা কত কিই-না করেছেন! আপনার স্ত্রীর ছিল তীব্র শারীরিক ক্ষুধা। ক্ষুধা ছিল আপনারও। বিয়ের পর প্রথম চারটি বছর আপনারা যখন তখন মিলিত হয়েছেন। শুধু রাতেই না, দিনেও। রেহানা আপনাকে
তেজি-ঘোড়া বলে ক্ষ্যাপতো। আর আপনি? থাক সে-কথা। সব কথা বলতে নেই।
তিতলি হওয়ার পর স্ত্রীর শরীরের আকর্ষণ কমে গেল আপনার কাছে। আপনি আর আগের মতো সাড়া পান না ভেতর থেকে। সবকিছু বড় বিবর্ণ আর আটপৌরে লাগতে শুরু করল। প্রতিদিন অফিস করে ক্লান্ত হয়ে একটা মানুষের কাছে ফিরে আসা,
একটা শরীরের কাছে ফিরে আসাআপনার বড় একঘেয়ে লাগত। সেই শুরু। এখনো আছে সেই একঘেয়েমি। এখন মাসে একটিবার আপনি মিলিত হন, কিন্তু একে মিলন বলে নাআপনি মিলনের দায়িত্ব পালন করেন। অথচ আপনার স্ত্রীর সেই ক্ষুধা এখনো
অবশিষ্ট আছে। আগেরই মতো। আপনার চোখে স্ত্রী পুরনো হয়ে গেছে, কিন্তু স্ত্রীর চোখে আপনি হননি। তাইতো আপনার নিঃস্পৃহতা বুঝতে পেরেও আপনাকে জাগানোর অনেক চেষ্টা করেছেন রেহানা। আপনি জাগেননি। রেহানা পারেননি আপনাকে জাগাতে। শেষমেশ নিয়তিকেই মেনে নিয়েছেন রেহানা। তিনিও হয়ে পড়েছেন ঢেউহীন নিথর নদী। কিন্তু আজ, এই এত এত বছর পর, সেই নতুনকালের তীব্রতা নিয়ে উপগত হয়েছেন আপনি, আপনার ঢেউহীন নদী হয়ে যাওয়া স্ত্রীর উপর। আপনার স্ত্রী খুব অবাক হলেন আপনার এই ব্যতিক্রম আচরণে। অবাক হলেন, কিন্তু তিনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না নিজেকে। শরীরের প্রতিটি ভাঁজ খুলে দিতে লাগলেন আপনার সামনে। যেভাবে তিনি পেঁয়াজের অথবা বাঁধাকপির একেকটা আবরণ খোলেন রান্নার আগে। তা এটাও তো এক রান্নাই নাকি! আপনি মাঝে মাঝেই স্ত্রীর বুকে মুখ ডুবাচ্ছেন। নুন-ঝাল সব ঠিক আছে কি না সেটাই কি দেখা উদ্দেশ্য? হয়ত।
আপনার স্ত্রীর বুকে নুন-ঝালের গন্ধ না, বরং ভেসে আসছে সেই মিষ্টি গন্ধ; সন্ধ্যায় রেস্টুরেন্টে মিমির শরীরে পেয়েছিলেন যে গন্ধ। এই গন্ধের কারণেই রেহানাকে আপনার এখন রেহানা মনে হচ্ছে না। রেহানাকে মনে হচ্ছে মিমি। রেহানার শীকারকে মনে হচ্ছে
মিমির শীকার। রেহানাকে মিমি ভেবেই আপনি এখন পূর্ণ তৃপ্তি পাচ্ছেন। এই শুরু। এরপর প্রতিটি রাত আপনি রেহানাকে রিমি ভেবে

রেহানার উপর উপগত হতে লাগলেন। তীব্রমাত্রায়। আপনাকে গের ভূমিকায় দেখতে পেয়ে ভীষণ খুশি আপনার স্ত্রী। লোকে যে-যা-ই বলুক, এইবার আপনি রেহানার কাছে 'বউপরায়ণ' স্বামী হয়ে উঠতে পারলেন।

No comments:

Post a Comment