সোনার আংটি বাঁকাও
ভাল
এক
হবু বর ও বরের ভগ্নিপতিরা শিবানীকে পাকা দেখা দেখতে এলে
ইন্দুবালা প্রথম হবু নাতজামাই ব্রজগোপালকে দেখে কেন যেন অস্বস্তি বোধ করে। সাত ক্লাসে
উঠার আগ থেকেই প্রভাত ও তার বউ মিনতি তাদের বড় মেয়ে শিবানীর বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে।
ইন্দুবালা ভাবে এহনকার দিনি এতটুহু মিয়্যার কেউ বিয়ে দেয়? আমাগেরে কালে না হয় এটা ছ্যাল।
মুইর বিয়ে তো হইছেলো এগারো বছর বয়সে। কার্তিক মন্ডলের বাবা মুইকে পণ দিয়ে বেটার বউ
করে ঘরে তুলিছিল।
পরক্ষণেই সে আবার ভাবে- এতটুহু বয়সে বিয়ে না দিয়েই বা করবি
কী পিরভাতে। ছাওয়াল হবি হবি করে পিরভাতের বউ চারডা মিয়্যা বিয়োইছে। পিরভাতে এডা ওডা
করে যা কামাই করে তাতে ওদের সংসারই তো চলে না। একটুহু বয়সে বিয়ে না দিয়ে কীবা করবি
পিরভাতে।
তার সোয়ামী কার্তিক মন্ডল তার বউ ইন্দুবালাকে
বলল- এখন আইন হইছে মাইয়্যার বয়স ১৮ আর ছাওয়ালে বয়স ২১ এর কম হলিপারে বিয়ে দিয়া বেআইনী।
- পিরভাতের মাইয়্যা শিবানী তো মাঘ মাসে বারো
থিকে তের
বছরে পরিছে।
-ঠিকই কইছো পিরভাতের বাপ। হবু নাত জামাই ব্রজগোপালের বয়স
তো শিবানী হতি তিন গুণ বেশি হবেনে। তার মানে ওর বয়স সাইত্রিশ থেকে
উনচল্লিশ বছরের মত হবি মনে হয়।
- তুমার লগে মুইর বিয়ে ন’বছর বয়সে হলিপারেও তুমি কিন্তুক
ছিলে একুশ বছরের জোয়ান ছাওয়াল। পিরভাতের মাসি শাশুড়ি কদমবালা আর তার মাইয়্যা
পরেশের বউ সোন্দরী আধবুড়ো ছাওয়ালের লগে ফুলির কুঁড়ির নাহাল মুইর নাতনিডার সব্বোনাশ
করার জন্যি লাগিছে। সে সময় ইন্দুবালা আধা বয়সী ছাওয়ালে সঙ্গে শিবানী বিয়েতে অমত
করলে পরেশের বউ সোন্দরী তাকে বলেছিল, চাওয়াল হল সোনার
মতো। মাওই মা জানেন না সোনার আংটি বাঁকাও ভাল।
দুই
এতদিন পরেও ইন্দুবালার মনে পড়ে, কয়েক যুগ আগে অজপাড়া গ্রাম
হানুগঞ্জের জোয়ান মরদ কার্তিক মন্ডলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, তখন ইন্দুবালার বয়স আর কতো!
দশ থেকে এগার হবে আর কী! তখনো তার সোয়মীর লগে এক বিছনার শুয়ার বয়স না হওয়ায় কার্তিক
মন্ডল ফিরানি ভাঙতে যেয়ে বউকে বাপের বাড়িতে রেখে একাই হানুগঞ্জে ফিরে যায়।
কার্তিক মন্ডল একা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় সে প্রথমে ঠাকুমাশাশুড়ি
মোক্ষদা ঠাকুরাণীকে প্রণাম করলে সে তার নাত জামাইকে বলল, মুই’র নাতনি ইন্দু এহনো নাবালিকা,
সাবালিকা হলি পারে তোমার লগে দুতিকে বিয়ের পরই তুমি ওরে বাড়ি নিয়ে যাইবা। ঠাকুমা শাশুড়ির
কথা শুনে কার্তিকের মনে পড়ে তার নিজের বোন ললিতেকে সাবালিকা হওয়ার পর দুতিকে বিয়ের
পর শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথা।
সত্যি কথা কইতে দুতিকে বিয়ের আগে ইন্দুবালা তার সোয়ামীর সাথে
তেমন ভাবে মেলামেশা করতে পারেনি। কনে পাকা দেখার আগে দিন ইন্দুবালার
ঠাকুমা মোক্ষদা ঠাকুরাণী নাতনিকে বলেছিলেন, ওলো ইন্দু, আড়ে আবডালে তুই কিন্তুক
নাতজামাইয়ের মুকটা দেহে মুইরে বলবি তোর পছন্দ হইছে কেনা? শুভদৃষ্টির সুময়ও সোয়ামীরে ভাল করে দেখবি কিন্তুক।
ইন্দুবালা এত বছর পরেও ভাবে আমাগেরে আমলে কী আর একালে মত
ছ্যালো। পোলাপান না হওয়ার আগ পর্যন্ত দিনির ব্যালা সোয়ামীর লগে দেহা করার নিষেধ ছ্যালো।রাতির
ব্যালা সোয়ামী শুবার ঘরে গ্যালি পরে শব্দ না করে দরজার খিল দিতি হতো, শব্দ শুনে শ্বশুর-ভাশুররা য্যানো
জানতি না পারে সোয়ামী লগে শুতি যাছে লতুন বউ।
ইন্দুবালা ফোকলা দাঁতে হেসে মুখে হাসি ফুটিয়ে মনে মনে বলে, সে কী দিন
ছ্যলোরে বাবা! সে বয়সের ভাবনার কথা সত্তর বছর বয়সে ভেবে ইন্দুবালার হাসি পায়। এত বড়
বাড়ির কাউকে ছ্যাড়ে সে একা কোথায়ও থাকেনি। শ্বশুরবাড়িতে একপাল মানষের মধ্যি সে একা
ভাবতিই ইন্দুবালার প্রাণটা ছ্যাত করে উঠিছিল।
লোকে বলে, বিয়ের জল গায়ে পড়লি মাইয়্য মানস্যির ডাগর হতি
কয় দিন লাগে। এক বসন্ত ঘুরে আর এক বসন্ত যেয়ে শ্রাবণ আসতি না আসতিই ইন্দুবালার শরীর
স্বাস্থ্য ডাগর হয়ে ওঠে। পঞ্জিকা থেকে দিনক্ষণ স্থির করে অগ্রাণের প্রথম সপ্তাহে কার্তিক
ও ইন্দুবালার দুতিকে বিয়ের পর ইন্দুবালা শ্বশুরবাড়ি হানুগঞ্জে যাওয়ার আগে ঠাকুমা মোক্ষদা
ঠাকুরাণী নাতনিকে বলল, ও লো নাতনি, নাতজামাই তো সত্যি সত্যি
যেন কার্তিক ঠাকুর। ঠাকুমার কথা শুনে তার মনটাতে খুশির
বান ডাকে।
ইন্দুবালা শ্বশুর বাড়িতে এসে বুঝতে পারে হানুগঞ্জ সত্যি
সত্যি অজপাড়া গাঁও। সে যে সময় শ্বশুর বাড়ির আসে সে সময় ছিল না মাটির রাস্তা, ছিল না
স্কুল। তাদের গ্রামের মত অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়েথা হয় ধারে কাছের গ্রামের বয়স্ক ছেলেদের
সঙ্গে। পায়ে হেঁটে, ঘোড়ার গাড়িতে, নৌকোয় না হয় পাল্কিতে চড়ে বর আসতো সে সময়ে।ইন্দুবালার
মনে পড়ে হানুগঞ্জে শ্বশুর বাড়িতে এসেছিল নৌকায় চড়ে।
শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, দেওর-জা আর তাদের ছেলেপেলে নিয়ে তার
সোয়ামী কার্তিক মন্ডলদের বাড়ি। এত বড় একটা এজমালী পবিবারে বউ হয়ে এসে ইন্দুবালা যেন
হাঁপিয়ে ওঠে। তার স্বামী কার্তিক মন্ডল লোকটা ভালই মনে হয় ইন্দুবালার। গ্রামটাতে জলের
খুবই অভাব, জলের জন্যে হানুগাঙের জলই ভরসা। ইন্দুবালার বাপের বাড়িতে জলের কষ্ট থাকলেও
বাজারের পাশে সরকারী ইদারার জল সারা গ্রামের তেষ্টা মেটাতো। গ্রামগুলোতে কলেরা,পক্স
আর ম্যালেরিয়া মহামারীতে কত লোক যে সাবার হয় তার ইয়ত্তা ছিল না।
তিন
সোমত্ত বয়সী বউ হয়ে আসার দুবছর পর ইন্দুবালার কোল আলো করে
ছেলে জন্মাল, মন্ডলবাড়ির সবাই এতে বেজায় খুশি। খুশির একটা কারণও ছিল ইন্দুবালার ছাওয়াল
জন্মাবার আগে ওই বাড়িতে তখন পর্যন্ত তার জাদের কারোই কোল আলো করে ছাওয়ালের জন্মেনি।
সেদিনের কথা ইন্দুবালার স্পষ্ট মনে আছে, শ্বশুর বাড়ি থেকে
সাধ খেয়ে সাত মাসের পেট নিয়ে সে তার বাপের বাড়ি কুসুমপুরে আসে। বাবা মা ও পদ্ম
পিসি এর আনন্দ আর ধরে না। ইন্দুবালা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নি:সন্তান পদ্মপিসিকে
তাদের বাড়ির হর্তাকর্তা হিসাবে দেখে আসছিল।
একদিন পদ্মপিসি বাবাকে বলল-নিত্য, তোর জ্ঞানগম্মি কি দিনকে
দিন নোপ পাতিছে। পদ্মপিসির কথা শুনে বাবা বলল- কী কতা কইছো, পদ্মদি।
- ম্যাইয়ডা আট মাসে পরিছে, ওর গতরডা দেহে বুঝতি পারতিসি
না একডা আঁতুরঘর বানাতি হবি! বলিহারি যাই তোর বউয়ের বুদ্ধিসুদ্ধি দেহে।
বাঞ্চা ঘরামী তার ছাওয়াল ট্যাংরাকে সঙ্গে নিয়ে এসে একদিনের
মধ্যেই আঁতুর ঘর বানায়ে ফেলল। মাস খানেক পরে ইন্দুবালার
মা হওয়ার সময় হল। জলঝড়ের এক রাতে ইন্দুর প্রসব বদনা উঠল মাঝ রাত থেকে, ছোট ভাই ভুবনকে
সঙ্গে নিয়ে হ্যারিকেন হাতে নিত্য ছুটল দাইমার বাড়িতে। আল্লাদী দাইমার নাম ডাক আছে, তা
এলাকার সবাই জানে। আল্লাদী দাইমা এসে পোয়াতির অবস্থা দেখে বলল- পদ্মপিসি, এতডা দেরি
করে মুইকে ডাকলি! পোয়াতির পেসব বেদনা দিনির ব্যালায় উঠিছে, তুমার ছাওয়ালপল না হলিপারেও
তো তুমার এদিকে জ্ঞানগম্মি ছ্যাল বলেই জানতি পারিছিলাম পিয়ারির বেডার বউয়ের পোলা হওয়ার
আগে। এহন দ্যাখতিছি পোয়াতির পেসব করাতি মুইরে জান শ্যাষ করতি হবিনি। যমে মানুষের টানাটানি চলতে লাগল। সে রাত গেল, পরদিনও
গেল। কার্তিক তার মাকে নিয়ে পরদিন কুসুমপুরে এলো। বাড়িতে কান্নারোল পড়ে গেল। আল্লাদী
দাইমা কিন্তু হাল ছাড়লো না। দিন শেষ হয়ে গেল, রাত যেতে প্রভাতের দিকে আঁতুর ঘর থেকে
ট্যা ট্যা শব্দ শোনা গেল। তখন ইন্দুর জ্ঞান ছিল না। এক সময় ইন্দু চোখ মেললো। ইন্দু’র
মা ও শাশুড়ি আঁতুর ঘরেই ছিল। এক সময় তারা পাঁচবার উলুধ্বিনি দিয়ে উঠলে ইন্দু বুঝলো
তার ছেলে হয়েছে।
এতদিন পরেও সে রাতের কথা ইন্দুবালার মনে আছে। বাবা দৌড়ে
এসে আঁতুর ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে আল্লাদির কোলে ফুটফুটে ছোট্ট খোকামণি দেখতে
পেয়ে আনন্দের আত্মহারা হয়ে বলে উঠল- আমার দাদু ভাইয়ের নাম রাখলাম প্রভাত। সকাল
হলে পদ্মপিসি কার্তিককে বলল- কার্তিক বাপ,
বিয়েন তোমারে বলেনি বাপকে ছাওয়ালের মুখ দেখতি হয় পেত্থমে রূপোর টাহা দিয়ে।
– হু,
মা মুইকে কইছে।
-তাহলি পারে তাই করো।
তারপর দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়। ইন্দুবালার তারপর আরো দুটো
ছেলে একটা মেয়ে হল। তার জাদেরও ছেলে মেয়ে হল। এক সময় হানুগঞ্জের মন্ডলবাড়ির একান্নবর্তী
পরিবারে ভাঙন দেখা দিল। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে মন্ডলবাড়ি ছেলেরা যার যার মত হয়ে গেল।
জমিজমা ভাগ হওয়ার পর কার্তিক মন্ডল যা পেল তার আয় থেকে তার পরিবারের ছয় ছয়টা মুখকে
খাওয়ানো পরানো কার্তিক মন্ডলের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ল। মেয়েটার বয়স কয়েক মাস মাত্র।
কার্তিক মন্ডলের ইচ্ছে ছিল তিনটি ছেলেকে লেখা পড়া শেখানোর। শেষ পর্যন্ত হল না। পিঠেপিঠে
জন্মানো তিনটি ছেলে দিনে দিনে বড় হয়ে উঠল।
ওরা প্রাইমারী স্কুলের লেখা পড়াও শেষ করতে পারল না। ওদের বাবার শরীরটাও ভাল
না।
ইন্দুবালা মনে মনে ভাবে- পিরভাতে ছাড়াও তার আর দুই ছাওয়াল
গনসা ও মঙলারও লেহাপড়া হল না। দেখতি দেখতি ছাওয়ালগুলো বড় হয়ে উঠল। তখন ছাওয়ালগুলো
এটাওটা করে দুএক টাহা রোজগার করতি লাগল। পিরভাতের এতটকু বয়সে বিয়ে দিবার দরকার ছ্যাল
না। কিন্তুক ইন্দুবালার শাশুড়িঠাকরোনের ইচ্ছেতে পেত্থমে পিরভাতের বিয়ে দিতি হেলো।
প্রভাতের বিয়ের আড়াই বছর পরে প্রভাতের বউ শিবানীকে জন্ম
দিল। প্রভাতের বাবা কার্তিক মন্ডল বেশদিন থেকেই জ্বর আর কাশিতে ভুগছিল। শোয়ার ঘরের
দাওয়ার থেকে স্বামী কার্তিক মন্ডলের কাশির আওয়াজ শুনে ইন্দুবালা সোয়ামীর বুকে তেল মালিশ
করে দিলে তার কাশির প্রকোপ কিছুটা কমলো। সে ফিসফিস করে বউকে বলল- শরীলডা একডু ভাল হলিপারে
গনসা ও মঙলার জন্যি মাইয়্যা দেখতি বের হতি হবি পরিমল খুড়োর লগে। সোয়ামীর কথা শুনে ইন্দুবালা
রেগে বলল- মুখ টিপলিপারে দুদ বেরোনো ছ্যাওয়াল দুডোর বিয়ের জন্যি তুমার মনে রঙ ধরতিছে–দেখতি
পাচ্ছি! পিরভাতের থিকে বড় ধুমসো মাইয়্যার সাথে বিয়ে দেহি তুমার সাদ এহন মেটেনি। - যুগ
পাল্টে গেছে ওদুডোকে বিয়ে না দিলি কুথায় কী করে বসবিনি তার তা কী তুমার হঠাৎ করে
তার কাশি উঠায় কথা শেষ করতে পারলো না।
গনসা ও মঙলা কাজকর্ম ছেড়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলে
এবার সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পরলো ওদের মা ইন্দুবালা। এক সময় সে ভবলো যে তার সোয়ামীর কথাই
ঠিক। গনসা বয়স আঠারো আর মঙলার বয়স কুড়ি। গনসার চেহারা ফর্সা আর শরীর স্বাস্থ্যে
মঙলার চেয়ে বড় দেখায়। কার্তিক ইন্দুবালাকে বলল- মুই দুটো ছাওয়ালের বিয়ে এক লগে দিব।
সোয়ামীর কথা শুনে ইন্দুবালা বলল,
তুমার যা মোতলব তাই
করো। কার্তিক মন্ডল পরিমল খুড়োর সাথে নিয়ে আগে গনসার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে বের হলো।
দুটো মেয়ে দেখার পর পছন্দ না হওয়ায় পরিমল খুড়ো বলল- কত সুন্দোর ছাওয়াল তুমার গনসা ও
মঙলা। তারা দুজন মিলে গনসা ও মঙলার জন্য মেয়ে দেখেই চলল, কিন্তু মেয়ে পছন্দ
না হওয়ায় তারা চিন্তায় পড়ল।
গনসার
মেয়ে দেখে বেড়ানোর জন্যে গনসার বড় দাদা মঙলা নিজের বিয়ের উদ্দেশে যেন পাগল হয়ে উঠল।
মঙলার বন্ধু মদনা। মদনার ভাল নাম মদনগোপাল। একদিন মদনা তার বন্ধু মঙলাকে বলল- তোর বাপ
আর মা ধাপ্পাবাজ। বড় ছাওয়ালের বিয়ে না দিয়ে তোর ছোট
ভাই গনসার বিয়ের জন্যে পাগল হইছে। মঙলা তোর বিয়ের ভার মুইর ওপর ছ্যাড়ে দে তো দোস্ত।
তোর জন্যি মুই মামাবাড়ির দ্যাশে একডা মাইয়্যা দেহে রাহিছি আমি।
- তুই
মুইর জন্যে মাইয়্যা দেহিছিস, তা আগে তো তুই মুইকে কইসনি!
- এবার
মুই তোগেরে দুটো ভাইকেই বিয়ে দিবোই দিবোই।
মঙলার বন্ধু মদনের কথার মধ্যে মিথ্যা কিছু ছিল না। আসলেই
মদনের কাজ ঘটকালী করা, তার কাছে অনেক মেয়েরই খোঁজ ছিল। কার্তিম মন্ডল আর ইন্দুবালার
বাকী দুই ছেলে গনসা ও মঙলার বিয়ের ব্যবস্থা করে মদন গোপাল তার ঘটকালী পেশার
কেরামতি দেখাতে কসুর করলো না। ইন্দুবালার তিন ছেলের বিয়ে সুসম্পন্ন হওয়ায় সে ও তার
স্বামীকার্তিক মন্ডলের মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গেল।
চার
কয়েক বছর যেতেই বউদের যুক্তি শুনে তিন ছেলেটা যার যার মত
আলাদা হলে গেল। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ইন্দুবালা ও কার্তিক মন্ডল এখন ছেলেদের থেকে
আলাদা। কার্তিকের বয়স হয়েছে, ইন্দুবালার বয়সও আগের মত নেই। তিনটি প্রাণীর সংসার চালাতে
গিয়ে তাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রভাতের মেয়েটা এবার সাত ক্লাসে উঠেছে। সামনের পরীক্ষার
পর আট ক্লাসে উঠবে। গনসা ও মঙলা দুটো করে মেয়ে, তার সবে প্রাইমারী স্কুলে যাচ্ছে। ইন্দুবালা
ভাবলো- তিনটে ছাওয়ালের একটাও ছাওয়াল না হলিপারেও ওরা যদি মাইয়্যাগুলিকে লেহাপড়া শেখায়
তা হলি ভালই হবি। দিনকাল বদলাছে। মাইয়্যা পেলারাও এহন লেহা পড়া শিখতিছে।
ইন্দুবালার ইচ্ছেটা পূরণ হবে না সে কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারলো।
মদন ঘটক মাঝে মধ্যেই তাদের বাড়িতে আসছে দেখে ইন্দুবালার মনে খটকা লাগল।
একদিন ইন্দুবালা বড়বৌমাকে বলল- মদন ঘটক পিরভাতে, আর তুমার
সাথে কী বলতি একদিন পর পরই আসতিছে। ইন্দুবালা প্রভাতের বউয়ের কাছ থেকে জানতে পারল ওদের
বড় মেয়ে শিবানীর জন্যে একটা ছেলের খোঁজ নিয়ে এসেছে। বড়বৌমার মুখ থেকে কথাটা শুনে ইন্দুবালা
অবাক হয়ে বলল- এতটুকু মাইয়্যার বিয়ে! তোমরা কি পাগল হইছো? শ্বাশুড়ির কথা শুনে
শিবানীর মা একটা কথাও বলল না।
কয়েকদিন পরে মদনগোপাল শিবানীর বাবা প্রভাত ও তার ভাইরা ভাই
পরেশকে নিয়ে শিবানীর বিয়ের জন্যে ছেলে দেখতে যাবে এমন কানা ঘুষা ইন্দুবালার কানে গেল।
প্রভাত তার মাসতোত শালিকা সোন্দরীকে নিজের পাড়ার পরেশের লগে বিয়ে দিয়ে গ্রামে একজন
কুটুম করেছে নিজের শক্তি পাকাপোক্ত করার জন্যে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মিল মহব্বত থাকলেও
তিন বউতে মধ্যে মোটেই মিল নেই, প্রায় প্রায়ই তারা চুলোচুলি করে এটাওটা নিয়ে। অন্যদিকে
পাড়ার কারো সঙ্গে ঝগড়া লাগলে তিন জা এক হয়ে তাদের সঙ্গে চুলোচুলি করে মাজায় কাপড় পেঁচিয়ে।
ওদের শাশুড়ি ইন্দুবালাও কিন্তু ঝগড়াটে কম নয়। কারো সাথে ওদের ঝগড়া লাগলে বেটার বৌদের
সাথে ঝগড়ায় ইন্দুবালাও যোগ দেয়। বেটার বৌয়েরা ইন্দুবালাকে
গন্নিমান্নি না করলেও কিন্তু ছেলেরা মাকে ভয় করে, আবার কোন রাগের মাথায় মাকে গালিগালাজও
করে।
ফটকি নদীর ওপারে গোসাইগাঁও এ শিবানীর বিয়ের জন্যে ছেলে দেখতে
যাওয়ার আগে প্রভাত মাকে প্রণাম করে বলল- শিবানীর জন্যি ছাওয়াল দেখতি যাতিছি। প্রভাতের
কথা শুনে প্রতিবাদ করার ইচ্ছে ইন্দুবালার মনে জাগলেও শুভকাজে যাত্রার সময় ব্যাগড়া দিতে
তার মন সায় দিল না। সে শুধু বলল- আচ্ছা, ভালয়-ভালয় আসগে।
ছেলে দেখে ফিরে এসে প্রভাত যতটা ছেলের বাড়ি, ছেলের মা ও বোনের প্রশংসা করল তার চেয়ে
বেশি গুণগান করল প্রভাতের ভায়রা পরেশ আর মনদা ঘটক। প্রভাত তার মাকে শুধু বলল- ছাওয়ালের
বয়স একডু বেশি, তাহলি পারে কিন্তুক জমিজিরেত আর ব্যবসাপাতি অঢেল। বোনডার বিয়ে হয়ে গেলিপারে
সব কিচুরই মালেক সুধা বাবাজি। সেখানে প্রভাতের ভায়রা পরেশ ও পরেশের সোন্দরী ছিল। প্রভাতের
কথা শুনে সোন্দরী তার ভগ্নিপতি প্রভাতকে বলল-
ছাওয়ালের আবার বয়স বোলে কিছু আছে নাকি, সোনার আংটি বাঁকাও ভাল।
এবার ছেলে পক্ষের মেয়ে দেখতে আসার পালা হলেও তার কিন্তু
প্রথমে এলো না। ইন্দুবালার বাড়ির বউরা প্রভাতের শালি পরেশের বউ সোন্দরীরা এবার দলবল
সহ গোসাইগাঁও গেলেও তাদের শ্বশুরশাশুড়ি কার্তিক
ও ইন্দুবালাকে যাওয়ার কথা কিন্তু বলল না। এতে কার্তিক মন্ডল মনে কিছু না নিলেও ইন্দুবালা মনে মনে গোসা করলো
। কিন্তু কিছুই কাউকে বলল না। বউরা ফিরে এসে হবু জামাই ব্রজগোপাল, তার মা ও বোনের প্রশংসায়
পঞ্চমুখ। প্রভাতের ভায়রা পরেশের বউ মানে প্রভাতের
শালি সোন্দরী সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে হবু জামাই ব্রজগোপালদের কত যে প্রশংসা করল! সোন্দরীকে
গ্রামের লোকেরা বিশেষ করে মহিলারা গেজেট বলে ডাকে, সে তার মাজা ব্যাঁকা শাশুড়ি বুড়ির
দিয়ে রান্নাবান্না থেকে যাবতীয় কাজকর্ম করিয়ে নিজে পাড়ায় পাড়ায় গল্প করে বেড়ানোই
তার কাজ।
সোন্দরীর
শাশুড়ি কমলাসুন্দরী তাকে বলল- পরেশরা বলতিছিল ছাওয়ালের বয়স নাহি বেশি, শ্বশুর জামাই
এক জায়গায় দাঁড়ালে জামাইকে শ্বশুর আর শ্বশুরকে জামাই মনে হবি। শাশুড়ির কথা শুনে কথা
শুনে পরেশের বউ সোন্দরীর আবারও বলল- সোনার আংটি বাঁকাও ভাল, পুরুষ মানুষের আবার বয়স!
হবু জামাইয়ের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। তারপর ব্রজগোপাল বন্ধুবান্ধব
নিয়ে শিবানীকে দেখতে এল। শিবানী স্কুলের ইউনিফরম আর জামা পাজামা ছাড়া পরেনি। ওই দিন
তাকে শাড়ি পরে ছেলে পক্ষের সামনে বসতে হল। ছেলের মামা শ্যামসুন্দর ব্রজগোপালের গার্জিয়ান।
শ্যামসুন্দর মনে মনে ভাবল- ভাগনের বিয়ে দেওয়ার জন্য কম চেষ্ট করেনি। এত বয়সী ছেলে সাথে
বিয়ে দিতে কোন বাবা মাই মাইয়্যা দিতি রাজি হয় না। সে এবার ভাবল মেয়েটি বাচ্চা হলেও
বিয়ের জল গায়ে পড়লে বড় হতে কয়দিন। দুই পক্ষ রাজি হওয়ায় শিবানীর বিয়ে দিন ক্ষণ স্থির
হল। ছেলেকে আশীর্বাদ করতে প্রভাত ভায়েরা পরেশ,
পরেশের বউ সোন্দরী এবং শিবানীর মা ও তার জাদের গোসাইগাঁও গেল ।গ্রামের দুএকজন মাতবরকেও
সাথে নিল। শুধু সঙ্গে নিল না তার বাবা ও মাকে।
কয়েক মাস পরে শিবানীর বিয়ে। ছেলে পক্ষ এর মাঝে দশ বার আত্মীয়স্বজন
ও মাতবর সঙ্গে করে এসে শিবানীকে আর্শীবাদ করে গেল। বিয়ের আগ থেকেই বর ও কণে না পক্ষের
মধ্যে আত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠল। দুর্গা পুজোর আগে ব্রজগোপাল পুজোর তত্ত্ব মানে সবার
জন্যে কাপড়চোপড় নিয়ে একরাত হবু শ্বশুর বাড়িতে থেকেও গেল। নিরিবিলিতে হবু বউ শিবানীকে
আদর করতেও ব্রজগোপাল কসুর করলো না। বাচ্চা বয়সী শিবানী এতে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। তারপর
একদিন ঘটা করে শিবানীর বিয়ে ভাল ভাবেই হয়ে
গেল। কিন্তু শিবানীর বিয়ের পর কয়েকদিন যেতে না যেতেই থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়ল।
পাঁচ
ইন্দুবালার মনে সংশয় লেগে ছিল তার নাতনি শিবানীর হবু বরকে
দেখার পর থেকেই। তার একটাই ভাবনা এত বছর বয়সী নাতি জামাই তার নাতনি শিবানীকে মানিয়ে
নিতে পারবে তো! সে মনে মনে ভাবল যে শিবানী সুখী হলেই তাদের সুখ। প্রভাত এক
মাইক্রোবাস ভর্তি করে আত্মীয়স্বজনদের কে নিয়ে শিবানীর বউভাতে গেল। এবারও ইন্দুবালা
ও কার্তিক মন্ডলকে শিবানীর বাড়িতে নিয়ে গেল না প্রভাত। কিন্তু প্রভাত এবারও পরেশের
বউ সোন্দরী, শিবানীর মা, তার জাদের সাথে গ্রামের
মাতবরদের নিয়ে গেল বউভাতে। প্রভাতের ছোট ভাইয়েরা, মদন গোপাল ঘটকও তাদের সাথে গেল। আশীর্বাদের
সময় না যাওয়া সোন্দরীর মাসি কদমবালা মানে প্রভাতের
মাসি শাশুড়ি মহিলাদের মধ্যে এবারই প্রথম শিবানীর শ্বশুড়বাড়ি গোসাইগাঁও এসেছে।
আসলে প্রভাত তার কর্তা নয়, কর্তা তার বউ মানে শিবানীর মা।
শিবানীর মায়ের ইচ্ছে ছিল বউভাতের পর শিবানী ও ব্রজগোপাল জামাইবাবাজীকে নিয়ে আসবে তাদের
ওখানে ফিরানি ভাঙতে। শিবানী বুঝল ব্রজগোপালের বাড়ির আসল কর্তা তার বোন হেমাঙ্গী। হেমাঙ্গীর
হাবভাব দেখে মনে সোন্দরীর মাসি কদমবালা মোটেই ভাল ঠেকল না। হেমাঙ্গী ব্রজগোপালকে বলল-
দাদা,ফিরানি ভাঙার পরে দিনই বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবি কিন্তুক। সে সময় কদম মাসি হেমাঙ্গীর
কথায় প্রতিবাদ করে বলল- নতুন জামাই আবার ফিরানি
ভাঙতে য্যায়ে শ্বশুর বাড়ি একদিন থ্যাকে নোতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফেরে তাতো বাপের জম্মে কহন
শুনিনি।
-এবারে জামাইয়ের দৌলতে শুনে রাখুন ।শিবানীর কলেজে পড়া ননদ হেমাঙ্গী
কদম মাসিকে বলল। কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে কদম মাসিও কিন্তু কম যায় না। নতুন কুটুম বাড়ি
ভেবে সে আর কথা না বাড়াতে চাইলেও তবুও সে হেমাঙ্গী বলল- এ বাড়ির হত্তাকর্তা কি তুমি।
ব্রজগোপালের কলেজে পড়া একডা অবিয়েত্তো বোন আছ বিয়ের আগে জানতি পারলি এত বছর বয়সী ছাওয়ালের
সঙ্গে শিবানী দিদিভাইয়ের বিয়ে দিতে দিতাম না। কদমবালার কথা শুনে হেমাঙ্গী ও তার মা
তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। কদমবালাকে যাচ্ছেতাই বলে গালিগালাজ করতে দ্বিধা করল মা ও মেয়ে।
ব্রজগোপাল ফিরানি ভাঙতে এসে তার বোন হেমাঙ্গীর কথা মত ফিরানি
ভাঙার পর দিনই শিবানীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। কদম মাসি সোন্দরীকে বলল- এত বয়সী ছাওয়ালের
সাথে নাবালিকা শিবানীর বিয়ে দিতে আমার মন সায় দ্যায়নি। তুই গেয়ে বেড়াতে লাগলি ছাওয়ালের
বয়স হইছে তাতে কী! সোনার আংটি বাঁকাও ভাল!
শিবানী ফিরানি ভেঙে শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর থেকেই শিবানীর
উপর আসল খেল শুরু করল। শাশুড়ির চোখে বেটার বউ মন:পুত নয় শিবানী শাশুড়ির কথাবার্তায়
দু’চার দিন গেলেই বুঝতে পারল। ব্রজগোপালে মা ও বোন হেমাঙ্গীকে গুজুরফুসুর করতে দেখে
শিবানী কিছুই বুঝতে পারল না। তার নিজের বাবার বয়সের চাইতে বড় স্বামীকে আসলে শিবানী
ভয় পায়। পরদিন থেকে বাড়িতে হুলুস্থুল কান্ড শুরু হল। হেমাঙ্গী এর গলার সোনার
হার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেটি ও মা সব জায়গায় হারটা খুঁজে খুঁজে হয়রান। তারা শিবানীর
বাক্স পেটরা খুঁজে পেতে দেখতেও তারা কসুর করল না। হেমাঙ্গী প্রথমে কথাটা বলল- কালুখালীর
গদাগুণীনের কাছে গেলে কে আমার সোনার হার নিয়েছে জানতে পারা যাবে, মা। মা বেটি ছাড়াও
অনেকেই জানে গদাগুণীর একজন ধাপ্পাবাজ।
শিবানী দিদিমা কদমবালার ওপর হেমাঙ্গীর রাগ তখনো পড়েনি। সে
ও তার মা যুক্তি করে ঠিক করল শিবানীর কদম দিদিমাকে জব্দ করতেই হবে। কালুখালীর গদাগুণীনকে
কাজে লাগিয়ে কদমবালাকে নাকানী চুবানী খাওয়াতে আর শিবানীর বাবার কাছ থেকে একটা সোনার
হারের টাকা আদায় করতে হবে।
পরদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে হেমাঙ্গী গদাগুণীনের বাড়ি যেয়ে
তার সহকারী বঙ্কাজী সাথে দেখা করে তার সোনার হার চোরের হদিস দেওয়ার কথা বললে বঙ্কাজী
বলল- আপনি কাহাকে সন্দেহ করিতেছেন তাহার তাহার নাম আমাকে লিখিয়া দিন । কে আপনার হার
চুরি করিয়াছে তাহা আপনি প্রকাশ করিতে পারিতেছেন না সেই নামটি গুণীনবাবাজী জনসমক্ষে
প্রকাশ করিয়া দিবেন।
বঙ্কাজী সাধু ভাষায় কথা বলেন আর সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন
করেন। গলায় জবাফুলের মালা। কপালে সিঁদুরের লম্বা টান। ছেলেটির বয়স একুশ থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে। ফর্সা আর সুঠামদেহী
খুব সুন্দর বলে ছেলেটিকে হেমাঙ্গীর মনে হল। এমন সুন্দর চেহারা ছেলেটি ধাপ্পাবাজি কাজের
সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে তা হেমাঙ্গী ভেবে পেলে
না। কলহপ্রিয় হলেও হেমাঙ্গী নিজেও কিন্তু সুন্দরী কম নয়।
ছেলেটি ভেবে অবাক হল গুণীনজীর আখড়ায় এমন সুন্দরী মেয়ে তো
কখনোই আসে না, আসে যত বদখত বুড়োথাড়া মহিলা কিংবা পুরুষেরা। সে উৎসুক দৃষ্টিতে হাসি
হাসি মুখে হেমাঙ্গীর পানে তাকে বলল, আগামীকাল মঙ্গলবার, ভাল দিন। আপনাদের
বাড়িতে যাওয়া আসা করিয়া থাকে কিংবা দুই একদিন অবস্থান করিয়াছে এমন জনা কয়েক লোকের নামের
একটি তালিকা এবং তাহার সাথে একান্নটি টাকা আপনি আগামীকাল দ্বিপ্রহরের আগে আমার মাধ্যমে গুণীনজীর
কাছে জমা দিবেন। তবে একটি কথা হইতেছে যে এখানে
আসিবার সময় গ্রামের অথবা পাড়ার মোড়লমাতুব্বর ,মেম্বার ও পণ্যমান্য লোকজনদেরকে সাথে
নিয়া আনিবেন।
গদাগুণীজীর
সহকারী বঙ্গাজীর হাতে কদমবালার নামটা জমা দিয়ে হেমাঙ্গী বাড়ি দিকে পা বাড়ালে ছেলেটি
পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন- ওই তালিকায় কিন্তু এই নামটি অবশ্যই থাকে।
- ঠিক
আছে।
- এতক্ষণ
আপনার সঙ্গে কথা হইল, কিন্তু আপনার নামটি আমার শোনাই হইল না। হেমাঙ্গী তার নামটি তাকে
বলে ওখান থেকে বাড়ির পথ ধরল।
এর মাঝে শিবানী ফোন করে তার মাকে জানাল আমারে ননদের সোনার
হার হারিয়ে গেছে। তা দিয়ে এখানে গোন্ডগোল পাকিয়ে উঠেছে। পরদিন হেমাঙ্গী, তার মা এবং
ব্রজগোপাল মোড়ল মেম্বার ও গ্রায়ের লোকজনদের কে নিয়ে গদাগুণীনের বাড়ি যেয়ে হাজির হলো।
হেমাঙ্গী গদাগুণীনজী সহকারী বঙ্কাজীর হাতে সন্দেহভাজন চোরদের নামের তালিকার সঙ্গে
একান্ন টাকা জমা দেবার সময় হেমাঙ্গীর মনে হল ছেলেটি যেন একটু বেশিই সাজগোজ করেছে। হেমাঙ্গী তার গা থেকে চন্দনের
গন্ধ পেল।
- গুণীনজী
ভেতরে পুজো করতিছেন। এখনই তিনি বাইরে আসবেন।
একটু পরেই গদাগুণীনজী বাইরে এলেন, হাতে পুজোর ফুল। ঘরের
বারান্দায় আসন পেতে রেখেছে। গদাগুণীজী সেই আসনে বসে বঙ্কা নামের ছেলেটির কাছ থেকে সন্দেহভাজন
চোরদের নামের তালিকার হাতে নিয়ে ধ্যানস্থ হলেন। ঘন্টা খানেক পরে তার ধ্যান ভাঙাল। এক
সময় তিনি হেমাঙ্গীর দেওয়া তালিকার উপর চোখ রেখে বলে উঠলেন। কদমবালা।
হেমাঙ্গীদের সঙ্গে আসা ইউনুস মেম্বার সহ গ্রামের লোকেরা
এক সঙ্গে বলে উঠল- ব্রজগোপাল, কদমবালা আবার কে? ব্রজগোপাল জবাব দেওয়ার আগেই হেমাঙ্গী
কদমবালার পরিচয় দিল। ইউনুস মেম্বার এলাকার খুব প্রভাবশালী,গুণীনজীর বুজুর্কী জানতে
তার বাকি নেই। সামনে ইলেকশন তাই এ সব বুজুর্কীর কথা জেনেও ইউনুস নিশ্চুপ!
বাড়ি ফিরে হেমাঙ্গী ও তার মা প্রচার করে দিল নতুন বউয়ের
দিদিমা কদমবালাই হেমাঙ্গীর সোনার হার চুরি করেছে। শিবানীর বিশ্বাস হল না তার কদম দিদিমা
এটা করতে পারে। শিবানীর শাশুড়ি তার মা ও বাবাকে ফোন করে জানাল হেমাঙ্গীর সোনার হার
তাদের কদম মাসি চুরি করেছে। ভাল ভালয় যেন ওটা ফেরত দিয়ে যায়। খবরটা শুনে কদমবালা তো
হতবাক!
তারপর থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন আসতে লাগল। শিবানীর মা তার
জামাই ব্রজগোপালকে ফোন করে আসল বিষয়টা জানতে চাইলে জামাইবাবাজী ফোনটা রিসিভ করে আমতা
আমতা করে কী যেন বলে ফোনটা তার বোন হেমাঙ্গীর কাছে দিল। হেমাঙ্গী যে ভাষায় যা বলল তা
ভাষায় ব্যক্ত করার নয়।
শিবানী বাবা মা ও পরেশ অনেক চেষ্ট করেও জামাই ব্রজগোপালের
সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে শিবানীর সঙ্গে কথা বললে সে বলল- তোমরা এসে এর ফয়সালা
করে যাও নইলে আমাকে নির্যাতন... এইটুকু বলে সে ফোন কেটে দিল। ওখানকার
ইউনুস মেম্বার প্রভাতের পরিচিত, তাই আসল ঘটনা জানার জন্যে তাকে ফোন করে জানতে পারল
যে এ সব ধাপ্পাবাজী, সামনে ইলেকশন সে নিজে কিছু বলতে পারছে না। তিনি শেষে
বললেন- আপনার আসেন, আমি থেকে একটা ফয়সালা করে দেব। এবার শিবানীর বাবা হেমাঙ্গীর কাছে
ফোন করে জানিয়ে দিল তারা কয়েকজন তাদের ওখানে যে কোনদিন যাবে বিষয়টার ব্যাপারে। প্রভাত
ভাবল জামাই বাড়ির আসল কর্তা জামাই নয়, আসল কর্তা জামাইয়ের সুন্দরী বোন হেমাঙ্গী ও তার
মা। সে ইউনুস মেম্বারকে শুধু ওখানে যাওয়ার তারিখটা জানিয়ে রাখল।
কলেজ থেকে ফেরার পথে গদাগুণীনের বাড়ি কাছাকাছি এলে হেমাঙ্গী
শিবানীর বাবার ফোন পেয়ে একটু অস্বস্তিবোধ করে এগিয়ে যেতেই গদাগুণীনের সাকরেদ বঙ্কা
নামের ছেলেটিকে দেখতে পেল বকুল গাছটার নিচে প্যান্ট পরে বসে আছে। হেমাঙ্গী তার কাছাকাছি
হলেই সে সেখান থেকে উঠে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল- হ্যালো হেমাঙ্গী, কলেজ থেকে ফিরছো?
এভাবে ছেলেটিকে দেখে আর এভাবে কথা বলায় হেমাঙ্গী তো অবাক! –তোমার ফোন নম্বরটা না রেখে ভুল
করেছিলাম। ছেলেটি তার ফোনটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করে বলল, এখন তোমার
নম্বরটা দাও তো দেখি। তোমার ফোনে একটা মিস কল দিয়ে আমার নম্বরটা তোমাকে দিয়ে দেই।
হেমাঙ্গী
ভাবল- ভালই হল ছেলেটির সঙ্গে আলাপ জমানো যাবে। হার চুরির বিষয়ে যে ভাবে ঘোট পাকিয়ে
উঠছে তাতে ওর পরামর্শ নেওয়াও দরকার। হেমাঙ্গী
বাড়ি ফিরে খাতাটা টেবিলের পর তার বিছনায় গা এলিয়ে কেন যেন ওই ছেলেটির কথাই ভাবছিল।
কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে তা তার খেয়াল নেই। হঠাৎ বালিশের পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠতেই
হেমাঙ্গীর চোখ থেকে তন্দ্র ছুটে গেল । কল রিসিভ করতেই ও প্রান্ত থেকে একটা ছেলের
কন্ঠ ভেসে এল- আমাকে চিনতে পারছো। আমি বড় ধাপ্পাবাজের সঙ্গী আর ছোট ধাপ্পাবাজ ।
তোমার সোনার হার...
তা কথা শেষ করার হেমাঙ্গী বলল- ওহ! তুমি, ধাপ্পাবাজ
গুণীনের ধাপ্পাবাজ সাগরেদ। হার চুরি না গেলেও তোমরা আমার সন্দেহের মহিলার নাম বলে
দিলে একান্ন টাকা বিনিময়ে। এখন তো বিষয়টা নিয়ে ঘোট পেকিয়ে উঠবে বলে মনে হচ্ছে।
ওপ্রান্ত
থেকে উত্তর এল- নাজেহাল হতে চাইলে তুমি তোমার চুরি না যাওয়া হারটা আর লুকিয়ে রেখ
না।
ছেলেটার কথা হেমাঙ্গী মনে ধরল। হারটা লুকিয়ে রেখে
কদমবালাকে জব্দ করা যাবে না। সেদিন সন্ধ্যায় কালুখালী বাজারে ইউনুস মেম্বার
ব্রজগোপাল বলল যে তার শ্বশুররা আগামীকাল আসছে।
-তোরা সবাই কিন্তু বাড়ি থাকিস। ব্রজগোপাল বাড়ি ফিরে
ইউনুস মেম্বারের বলা কথাটা মা ও বোনকে বলল। সে তার বউ শিবানীকেও তার বাপমাদের আসার
কথাও বলল। হেমাঙ্গী ও তার মা ঘুজুরঘুজুর ফুসুর ফুসুর করার পর তারা দুজনেই শিবানীকে
গালমন্দ করতে শুরু করল। শিবানী গালমন্দ খেয়ে কাঁদতে শুরু করল।
ব্রজগোপাল ইয়ারবন্ধুদের সাথে তাস খেলতে গেছে বটতলায়।
শিবানী রাতে ভাবল বাপমা এলে এবার সে এখান থেকে তাদের সঙ্গে চলে যাবে। পরদিন
প্রভাত শিবানীর মা, তার মাসি কদমবালা, পরেশ, পরেশের বউ সোন্দরীকে নিয়ে শিবানীর
শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে টেম্পুতে ওঠবার সময় শিবানী শাশুড়ির ফোন পেয়ে প্রভাত তো
অবাক! শিবানীর শাশুড়ি বলল যে হেমাঙ্গীর সোনার হার পাওয়া গেছে তার নিজের আলমারীতে,
ও ভুল করে ওটা রেখেছিল। আপনারা আসেছেন।
প্রভাত রাগের চোটে ফোন কেটে দিয়ে ইউনুসকে মেম্বারকে ফোন
করে সব কথা খুলে প্রভাত। শিবানীর দিদিমা কদমবালাকে চোর অপবাদ দিয়ে জব্দ
করতে না পারায় হেমাঙ্গী ও তার মা শিবানীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকে। আর
তাকে বলে, তোকে আমরা জীবন থাকতে বাপের বাড়ি পাঠাবো না।
কয়েকদিন যেতে না যেতেই শিবানীদের পাড়া প্রতিবেশিরা
কানাঘুষা শুনতে পায় শিবানীর শ্বশুর বাড়ি থেকে মেম্বার মাতুব্বর আসছে শিবানীর বাপের
বাড়িতে কাদের দোষ আর কাদের গুণ যাচাই করার জন্যে তাদের সঙ্গে প্রভাতের জামাই মেয়েও
আসবে। প্রভাতের ভায়রা ভাই পরেশ বলে বেড়াতে থাকে যে ব্রজগোপালের মা ও হেমাঙ্গীও
আসছে। এবার বিচার কাকে বলে দেখতে পাবে বাছাধনরা।
সত্যি সত্যি ইউনুস মেম্বার ব্রজগোপাল, শিবানী ও গ্রামের
মাতুব্বর মোড়লদের নিয়ে এক টেম্পু ভরে প্রভাতদের বাড়িতে আসে, তারা কিন্তু শিবানীর
শাশুড়ি ও হেমাঙ্গীকে সঙ্গে আনতে পারে না। খাওয়া দাওয়ার পরে বিচার বসলে প্রথমে
শিবানীর জবানবন্দী নিলে প্রকাশ পায় ব্রজগোপালের আসকারার তার মা বোন নাবালিকা
শিবানীর ওপর যারপর নেই অত্যাচার চালিয়েছে। এমনকি প্রায় রাতেই শিবানীকে তার স্বামী
বজ্রগোপালের সাথে শুতে দেয়নি। শিবানীর কথা শোনার পর ইউনুস মেম্বার ব্রজগোপালকে
জিজ্ঞেস করে এ সব কথা সত্যি কিনা। ব্রজগোপাল কোন জবাব না দেওয়ায় ব্রজগোপালের
সম্পর্কে মামা গোলক মোড়ল ব্রজগোপালকে একটা চড় কশে দেয়। ওখান থেকে আসা সবাই
ব্রজগোপালকে গালমন্দ করে রায় দিয়ে যায় যে ব্রজগোপালকে শ্বশুর বাড়িতে সাতদিন থেকে
তার বউ শিবানীর সঙ্গে ঠিকঠাক মত মেলামেশা করতে হবে এবং শ্বশুর শাশুড়ির সেবাযত্ন
করার পর তারা খুশি হলে তার সঙ্গে শিবানীকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাবে।
ব্রজগোপাল সালিশের রায় মেনে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থেকে
যায়। কিন্তু ভোর রাতের দিকে ব্রজগোপাল কাউকে এমনকি তার বউ শিবানীকে কিছু না বলেই
পালিয়ে যায়, শিবানীর কাছ থেকে খবর জেনে বাসস্ট্যান্ড থেকে ব্রজগোপলকে প্রভাত ও
পরেশ গিয়ে পাকড়াও করে আনে। কিন্তু ব্রজগোপাল তার মা ও বোনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে
পরদিন আবার চম্পট দেয় । শিবানী ও শিবানী কান্নার শব্দ শুনে এগিয়ে আসে ইন্দুবালা,
কদমবালা, সোন্দরী ও পাড়া প্রতিবেশিরা।
ইন্দুবালা প্রথমে মুখ খোলে- যত দুষ মুইর নাতনি শিবানীর।
সোয়ামীকে বশে রাখতে পারেনি মুইর নাতনি। বউয়ের কোলের মধ্যি থিকে মরদ সোয়মী পালায়
তাতো মুই জীবনে শুনিনি। কদমবালাও নাতনিকে দুষতে থাকে। গ্রামের গেজেট নামে পরিচিত
পরেশের বউ সোন্দরীও মুখ খোলে। ইন্দুবালা দুচোখে সোন্দরীকে দেখতে পারে না।
-থাম সোন্দরী, মুইর বাচ্চা বয়সী নাতনিটার সব্বনাশ তুই
আর তোর সোয়মী পরেশ করিছিস। মুখ টিপলি দুধ বেরায় এমন সোন্দরী নাতনিডার লগে চল্লিশ
বছর বয়সী ধুমসো মিনশের বিয়ে দিলি তোরাই তো। আমি বারণ করলি তুই কইছিলি না -ছাওয়ালের
বয়োস আবার কী! ছাওয়াল বলি কতা, একডু বয়স হইছে তাতে কী। ছাওয়াল হল সোনার মতো, নোকে
কয় শোনেন নি সোনার আংটি বাঁকাও ভাল! সোন্দরী ও পরেশের মুখ থেকে টু
শব্দ বের হল না। সপ্তাহ যেতে না যেতেই পাড়া প্রতিবেশিরা দেখতে পায় নাবালিকা শিবানী
হাতে শাঁখা আর সিঁথিতে সিন্দুর কোনটাই নেই।
লেখক: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক,গল্পকার ও কবি
No comments:
Post a Comment