সাফিয়া খন্দকার রেখার কাব্যগ্রন্থ
‘জোছনার ব্যাকরণ’ : নারী ও সমাজের করুণ চালচিত্র
অমর একুশে গ্রন্থমেলা, ২০১৬ উপলক্ষ্যে
অন্যধারা পাবলিকেশন্স, ঢাকা প্রকাশ করলো কবি সাফিয়া
খন্দকার রেখার (জন্ম-১৯৭৫) পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘জোছনার ব্যাকরণ’। এর আগে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো হলো–‘গণতন্ত্রের
এক পা ও দৃষ্টি’, ‘তৃষ্ণায় ওম নেই’, ‘ধমণীতে তরল রোদ্দুর’ ও ‘কলাপাতায় চড়ুইভাতি’। শেষেরটি শিশুতোষ কাব্যগ্রন্থ।
এ ছাড়া তিনি একটি উপন্যাস, দুটি কিশোর গল্পগ্রন্থ ও একটি
ছড়াগ্রন্থের লেখিকা। তাঁর আর একটি পরিচয় হচ্ছে, –তিনি একজন
স্বনামধন্যা আবৃত্তিশিল্পী ও আবৃত্তি প্রশিক্ষক। ব্যক্তিগত জীবনে কবি সাফিয়া একটি
সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার পাশাপাশি ঢাকার বুলবুল ললিতকলা একাডেমি,
রংধনু শিল্পী সংঘ, থিয়েটার চারণিক,
প্রজন্ম কণ্ঠ ও অনুশীলন সাহিত্য পরিষদের কর্মকাণ্ডের সাথে
ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
‘জোছনার
ব্যাকরণ’ কাব্যে কবি সাফিয়া নারীজীবনে ও সমাজে জট পাকানো
নানা দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন। অবশ্য পুরুষশাসিত সমাজে নারী যে সকল সমস্যা ও সঙ্কটের
মুখোমুখি হচ্ছে সে সবই এ কাব্যের মুখ্য উপজীব্য। নারীর বেদনা, আশা-আকাংক্ষা ও আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে তাঁর কবিতায়। স্বামীশাসিত দাম্পত্য
জীবন, প্রকৃত প্রেমের পরিবর্তে স্বামী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত যৌনবাস্তবতা,
ঘরকন্নার আবর্তে ফেলে একটি গণ্ডির মাঝে নারীকে আবদ্ধ রাখা,
ধর্ষণ সহ বিরাজমান নারীত্বের লাঞ্ছনা, নারীকে
দবিয়ে রাখার পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মান্ধতাশ্রয়ী অবরোধ
ব্যবস্থা, পুরুষের ইচ্ছের দাসীত্ববৃত্তি, নির্যাতিতা নারীর চিরায়ত অসহায়ত্ব ও বন্দীত্ব– বাঙালি সমাজে চলমান এসব দুরবস্থাকে তিনি অকপটে একের পর এক কবিতায় বিবৃত
করেছেন। এ প্রসঙ্গে কিছু উদাহরণ তুলে ধরছি-
১. তোমার
প্রয়োজনে তুমি যখন/ পুরুষ হয়ে ওঠো,/ বুঝে নেই শরীরের জন্য শরীর,/
ভালোবাসা বলে কিছু নেই। (কারাবাস)২. স্বপ্নগুলো শর্তহীনভাবে/ লেখা হয়ে গেছে কাবিন নামায়।/ শরীর আটকা পড়ে গেছে খাঁচায়/ কখন যেন মানুষের মধ্যে থেকে/ ভাগ করে নেই নিজেকে নারী। (স্বপ্নের মুঠো খুলে দাও)
৩. দশহাজার টাকা মাইনের বারো ঘণ্টা কাজ/ অত:পর টিউসনি তিনখান,/ ঘর ভাড়া, মায়ের ঔষধ, ভাইয়ের/ কলেজ কোচিং।/ রাতে ঘরে ফেরা সব মেয়েরা বুঝি নষ্ট মানুষ! (রাত যখন সারে এগারোটা)
৪. তোমার সঙ্গে দেখা করতে/ আমার চুলে রঙ মাখাতে হয়/ চোখে মাস্কারা, মুখে ফাউন্ডেশন/ ঠোঁটে কড়া রঙের ম্যাট লিপস্টিক। (প্রেমিক নও)
৫. পুরুষের পাঁজরের হাড় দিয়ে তুমি তৈরি,/ তোমার নিজস্ব কোনো আলো নেই,/ তাই তো এই একবিংশ শতাব্দীতেও/ বাসে, ট্রেনে, ঘরে, বাইরে প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে তুমি ধর্ষিতা। (কন্যা)
৬. বৈশাখের টিএসসিতে বালিকার ঘ্রাণ/ চেটে খায় ব্যক্তিগত আদিম জৈবিক জেৌলুসে শেয়ালের দল।/ উলঙ্গ সভ্যতায় ওরা লিখে রাখে/ ওদেরই জারজ ইতিহাসনামা! (জোছনার ব্যাকরণ)
এভাবে কাব্যটিতে নারীর দুর্দশা
ও লাঞ্ছনার অজস্র ছবি তুলে ধরেছেন কবি। এক কাব্যে নারীত্বের অবমাননা নিয়ে এত
বিস্তারিত ও ব্যাপক বর্ণনা ও অভিব্যক্তি খুব কম কবির লেখনীতেই আমরা দেখি। সুস্থ
নারীবাদ প্রচারই তাঁর কবি-কৃতির আরাধ্য। তা সুস্থ এই অর্থে যে, পুরুষের
সাথে সহাবস্থানের সম্পর্ক রেখেই নারীর সামাজিক অধিকার পাবার চেতনায় উজ্জীবিত তিনি।
তিনি নারীমুক্তির প্রশ্নে মানবধর্মাশ্রয়ী চেতনায় উদ্বুদ্ধ। আর এই চেতনাটি হলো-
তথাকথিত রক্ষণশীল সমাজ, লিঙ্গ বিভেদকারক পরিবারপ্রথা ও
ধর্মান্ধতা – এ সবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নারীকে আধুনিক জীবন
ও সমাজে মানুষ হিসেবে মাখা উচু করে দাঁড়াবার মন্ত্র, বন্দীত্ব
দশা হতে নারীর মুক্তির মন্ত্র।
এ কাব্যে নারীবাদী চেতনার
পাশাপাশি কবির ইতিবাচক মানবিক ও সামাজিক চেতনারও প্রকাশ ঘটেছে। সমকালের সন্ত্রাস, হত্যাকাণ্ড,
পুঁজিবাদী হাইব্রিড সভ্যতার অপকর্ম, ধর্মের
লেবাসে ধর্মান্ধতার অশুভ কর্মকাণ্ড, অমানবিকতা ইত্যাদির
বিরুদ্ধে বেশকিছু কবিতায় উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন তিনি। পাশাপাশি কয়েকটি কবিতায় হতদরিদ্র ও
নিরন্ন মানুষের দু:খচর্চিত নি:শ্বাস, গ্রামীণ গরীব কৃষকের
বাঁচার আর্তি ও মধ্যবিত্তের কষ্টের জীবন –এসব নিয়ে তাঁর
অন্তরের বেদনা ও সহমর্মিতার দারুণ প্রকাশ লক্ষ্য করি। এমনকী নির্মম হত্যার শিকার
শিশু রাজনের হতদরিদ্রা ও দু:খিনী মায়ের আহাজারিকেও তিনি উপস্থাপন করেছেন একটি
কবিতায়। এত সব নির্মমতা ও দু:খকষ্ট থেকে উদ্ভূত বেদনাকে চিত্তপটে ধারণ করে কবি বাংলাদেশের
চুয়াল্লিশতম স্বাধীনতা দিবস নিয়ে লেখেন দারুণ এক মর্মভেদী কবিতা-
মাত্র চুয়াল্লিশের কপালে এত ভাঁজ!
লাবন্যহীন শরীরে দুর্বিসহ নির্মমতা
শহীদের করোটিতে বিষবাষ্প।
স্বাধীনতা দিবসের ফুল বোধের আগুনে জ্বলে,
তবুও অপেক্ষায়
আর্তনাদে জীবন যাপনের অতৃপ্ততায় জীবন।
(চুয়াল্লিশের আমি)
লাবন্যহীন শরীরে দুর্বিসহ নির্মমতা
শহীদের করোটিতে বিষবাষ্প।
স্বাধীনতা দিবসের ফুল বোধের আগুনে জ্বলে,
তবুও অপেক্ষায়
আর্তনাদে জীবন যাপনের অতৃপ্ততায় জীবন।
(চুয়াল্লিশের আমি)
কবি সাফিয়ার নির্মিত
চিত্রকল্পগুলো দৃশ্যমান শ্রেণীর (visible image), ক্যামেরায় স্ন্যাপশট নেওয়ার মতো।
তাঁর ছবিগুলো হুবহু জীবনেরই ছবি। তিনি যেমন দেখেছেন তেমনই এঁকেছেন। পরাবাস্তবতা,
বিমূর্ততা বা অবাস্তবতার কোনো নান্দনিক খেলায় মজেননি তিনি। তবে
তাঁর হৃদয়জ ভাবটি বর্ণনার মাঝে যত বেশি প্রকাশিত, চিত্রকল্পে
ততটা নয়। হৃদয়ের রঙে রাঙানো সমকাল ও সমাজবাস্তবতার প্রস্ফূটনই তার চিত্রকল্পের
প্রধান উপজীব্য। কিছু উদাহরহণ দেওয়া যাক-
১. পুরানো
প্রেমিকের মতো/ পুঁজিবাদী জোছনা উপন্যাসের পাতায়/ ছাপাখানায় বেঘোরে ঘুমায় এখন২. সময়ের ফ্রেম বন্দী চোখে স্বপ্নের কোলাহল
৩. ফড়িং মন ওড়ে ময়ূরাক্ষীর ঢেউ গুণে গুণে/ সময়ের ব্যবধানে চোখগুলো হয়ে ওঠে অদ্ভূত নাগরিক
৪. সম্পর্কের ভেতরে সম্পর্ক/ নোনতা কবিতা যেনো
৫. শরীরের গ্রন্থিগুলো বিশ্রাম নেয় স্বপ্নাচ্ছন্নতায়,/ উনিশ বছরের যেৌবন রাষ্ট্ররোষে দগ্ধ হতে থাকে
কবির গদ্যভঙ্গি বর্ণনাত্মক বা
বিবৃতিমূলক। গাঢ়বদ্ধ শব্দের জটাজাল তৈরি করেননি তিনি। গভীর ভাবোদ্দীপক উপস্থাপনও
তাঁর আরাধ্য নয়। ছড়ানো বাক্যে বলে গেছেন তাঁর যত কথা। এর ফলে সহজবোধ্য হয়ে উঠেছে
তাঁর কবিতা, সর্বসাধারণের পাঠের উপযুক্ততা পেয়েছে। যেন সৃজনী কল্পনা দিয়ে লেখা
মন্ময় নিবন্ধের মতো আবেগ ঝরানো গদ্যভঙ্গী তাঁর। তবে এই শৈলী কাব্যটির কোথাও স্থবির
হয়ে পড়েনি, প্রবহমান থেকেছে। সর্বত্র কবির আপন ছন্দ
ছাপিয়ে বক্তব্যই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সরল ও সুন্দর বাণীবন্ধ গঠনের মাঝে তাঁর
কাব্যশক্তি প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর শব্দমালা সুচয়িত ও আধুনিকতাসম্মত। তাঁর
বক্তব্যপ্রধান কবিতা বোধকে জাগ্রত করে, মানুষের ঘুমন্ত
চেতনায় ঘাই মারে। বস্তুনিষ্ট সামাজিক কবিতার প্রচলিত চারিত্র্যের নিরিখেই কবি
সাফিয়া খন্দকার রেখার কবিতাগুলো উত্তীর্ণ। আগ্রহী পাঠকগণ কাব্যগ্রন্থটি পড়ে দেখতে
পারেন।
গ্রন্থ পরিচয় :-
'জোছনার' ব্যাকরণ’।
লেখক- সাফিয়া খন্দকার রেখা। প্রকাশক: সৈয়দ রনো, অন্যধারা পাবলিকেশন্স,
২২, ইন্দিরা রোড (৩য় তলা), ফার্মগেট, ঢাকা-১২১৫, মোবাইল-০১৯৪৭৪৪১১১৪। পরিবেশক: আল্পনা প্রকাশনী, ৩৮/৩, দক্ষিণ কুনিপাড়া, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮, মোবাইল-০১১৯১৭৬০৩৮৮। প্রচ্ছদ শিল্পী- মনিরুজ্জামান পলাশ। মূল্য -২০০
টাকা।
No comments:
Post a Comment