মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা যখন
মরে যায় তখন যন্ত্রে আর মানুষে তফাত থাকে কই! একটা ঘোর মেক্যানিক্যাল সিস্টেমের
মধ্যে আবর্তিত হয় তার দৈনিক যাপন, বাকি সমাজের সাথে সম্পর্ক হয়
অ্যালগোরিদিমিক্যাল। কাজের সূত্রে সে কথা বলে আবার ঢুকে যায় নিজের মৃত চামড়ার
খোলসে। ঠিক যেন এই মানুষ গুলোর মতই
শিলঙের রাস্তায় হাঁটতে-হাঁটতে রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন লোহার বিমের তলায় থেঁতলে থাকা
টকটকে লালকরবী ফুলসহ ডাল। আবার এই মানুষদের মধ্যে কিছু মানুষ থেকে যায় যারা
অপ্রেশানের মধ্যে ও মাথা তুলে শ্বাস নেয়, ঐ ডালের মধ্যেই কিছু ফুলের মত,
যারা ঐ লোহার বিমের থেঁতলে দেওয়া অত্যাচার সয়ে ও মুখ তুলেছিলো
আকাশের দিকে। ঠিক এই দৃশ্যপট ডেকে আনে সেই কল্পনাকে, যার
সাথে সমাজ আর অগাস্ট স্ট্রিন্ডবার্গের ড্রিম প্লের ভাবধারা মিলে তৈরি হয় বিখ্যাত
সাঙ্কেতিক নাটক রক্ত করবী।
১৩৩০ সালে যক্ষপুরী শিরোনামে
লেখা হলেও, ১৩৩১ সালে প্রবাসীতে প্রকাশের সময় এর নাম হয় রক্তকরবী। মানুষের তুমুল
লোভ কীভাবে জীবনের সব সৌন্দর্য ও স্বাভাবিক অধিকারকে অস্বীকার করে মানুষকে যন্ত্র
ও উৎপাদনের প্রয়োজনীয়
উপকরণে পরিণত করেছে এবং এর ফলে তার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদ কিভাবে প্রকাশ
পেয়েছে তার প্রতিফলন ঘটেছে এ নাটকটিতে। যক্ষপুরীর রাজার রাজধর্ম প্রজাশোষণ; তার
অর্থলোভ দুর্দম, অর্থলোভ না, স্বর্নলোভ
আসলে। তার সে লোভের আগুনে পুড়ে মরে সোনার খনির কুলিরা। রাজার দৃষ্টিতে কুলিরা
মানুষ নয় তারা স্বর্ণলাভের যন্ত্র, তারা ৪৭ক, ২৬৯ফ মাত্র, যন্ত্রকাঠামোর ক্ষুদ্র অঙ্গ,
মানুষ হিসেবে তাদের না আছে কোনো মূল্য না আছে কোনো অধিকার।
জীবনের প্রকাশ যক্ষপুরীতে নেই।একমাত্র আছে নন্দিনী আর বিশু পাগলপ্রেম ও সৌন্দর্যের
প্রতীক ও তার উপাসক।
এ নন্দিনীর আনন্দস্পর্শ
যক্ষপুরীর রাজা পাননি তাঁর লোভের মোহে, সন্ন্যাসী পাননি তাঁর ধর্মসংস্কারের
মোহে, মজুররা পায়নি অত্যাচার ও অবিচারের লোহার শিকলে
বাঁধা পড়ে, পণ্ডিত পায়নি দাসত্বের মোহে। নন্দিনী
অপেক্ষায় শুধু রঞ্জনের, রঞ্জন আনবে মুক্তি। কিন্তু রঞ্জন
যে নিজেই যন্ত্রের শিকলে বাঁধা হয়ে গেছে। এইভাবে এগিয়ে যায় রক্তকরবীর কাহিনী। রক্তকরবী
নিয়ে ভাবলেই একটা গানের দুই লাইন মনে আসে আমার;
“মরি উপায় কি বলো না,
মরার দেশে ভালো লাগে না।“
মরার দেশে ভালো লাগে না।“
-অরূপ
রাহী
এই “মরা” কথাটি রাহী ব্যবহার
করেছেন পুঁজি অর্থে, পুঁজি বাদী সমাজের কাঠামো যা। এর কারণ, পুঁজি হলো মানুষের মৃত
শ্রম। শ্রমকে ইনপুট ধরলে তার উৎপাদিত বিষয় বা ফসল হলো আউটপুট। ইনপুটের সাথে সম্পর্ক থাকলেও
আউটপুটের সাথে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই, সেটা জমা হয় ওপর তলায়। নিজের সাথে
অসম্পর্কে শ্রমের উৎপাদনকে জড়িয়ে
ফেলেছে মানবসমাজ।
মার্ক্স কথিত সাধারণ মজুরীর
সংজ্ঞায়, “সাধারণ মজুরী সেই নিম্নদর যা সাধারণ মানবতার সাথে, মানে জন্তু জানোয়ারের
মত টিকে থাকার সাথে খাপ খায়। “(ইকোনোমিক্স অ্যান্ড ফিলোজফিক্যাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট),
কিন্তু যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা (যা এই নাটকে যক্ষপুরী) এই সব নির্ধারণ করছে টা কিন্তু
মানুষের সাথে জন্তু জানোয়ারকে গুলিয়ে ফেলেনি, অতি সুক্ষ্ম সুতোর মত স্পেসে সে
ঝুলিয়ে রেখেছে আমোদ প্রামোদ আর মানসিক শান্তির কিছু ব্যবস্থা। ঐ যে নাটকে মদের
কারখানা আর গোঁসাই ঠাকুরের আগমন! মনের মদের নাগাল না দেওয়ার জন্য নেশার মদের যোগান
তো বেশি দিতেই হবে, তাই না। এই মদ গোঁসাইয়ের বানী ইত্যাদি দিয়ে রাষ্ট্র যন্ত্র বেশ
এক খানা উদারতাবাদের ধ্বজা তুলে রেখেছে। ভাবখানা এমন, ফেলো কড়ি, মাখো তেল। আমোদ
করো, বিনময়ে শ্রম দাও হে! উদারতার আড়ালে ফ্যাসিবাদের কর্মশালা। এসব চালু রাখার জন্য দরকার
ক্ষমতা, একটা ব্যবস্থা যা বেকায়দায় চাবুক মেরে শাসন করবে, আবার মদের যোগানও দেবে। দেবতাকে যুগপৎ ভয় ও শান্তির প্রতীক হিসেবে
উপস্থাপিত করবে। এই ক্ষমতা কি?
আদি না অনাদি সেই সময় সূচক
প্রশ্নে না দিয়ে মোটা চোখেই দেখা যাক, ক্ষমতা আসলে দুই প্রকারঃ
১। বর্তমান ব্যবস্থাকে
বহাল রাখার ক্ষমতা
২। বিরুদ্ধ ক্ষমতা
বিরুদ্ধ ক্ষমতা আসলেই বিরুদ্ধে
কথা বলতে চায়, বিশুদ্ধভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সাধারণ মানুষের অধিকারকে। এখানে বলে রাখা ভালো
কাঁটাকে তুলতে যেমন কাঁটা বা চিমটির প্রয়োজন হয়, তেমনি রাষ্ট্রঅনুমোদিত ক্ষমতাকে
তুলতে আরেকটি ক্ষমতার প্রয়োগই চাই, ক্ষমতা শুনে নাকসিঁটকালে
চলবে না, সেরোম্যান্টিসিজম কোনোকালেই ছিলোনা! তো এই বিরুদ্ধ ক্ষমতার স্বতস্ফূর্ত তা নিয়ে এসেছে নন্দিনী, তার রঞ্জনের পথ চাওয়া আর বিশুপাগলের গান, প্রত্যেক
সংলাপে খুঁজতে চাওয়া হয়েছে অধ্যাপক আসল কি সে ভয় পাচ্ছেন। মানুষ যখন মানুষে ফিরতে
চায়, মান আর হুঁশের অধিকার চায়, তখনি অমানুষ বানানোর
কারবারীদের সঙ্গে তার সংঘাত আসবেই।
এ একপ্রকার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক
অনুভূতি, যা দেখানোর জন্যই নাটকটি প্রাসঙ্গিক।
মানুষের সাথে মানুষের আসলেই কোনো সম্পর্ক নেই, এরকম অসম্পর্কের দর্শনের ওপর বসে চলুন রঞ্জনের আসার দিকে চাওয়া যাক, ধুলোর আলো সরিয়ে সুর্যালোকের অপেক্ষা নামে…
মানুষের সাথে মানুষের আসলেই কোনো সম্পর্ক নেই, এরকম অসম্পর্কের দর্শনের ওপর বসে চলুন রঞ্জনের আসার দিকে চাওয়া যাক, ধুলোর আলো সরিয়ে সুর্যালোকের অপেক্ষা নামে…
“It is night: now do all leaping fountains speak
louder. And my soul too is a leaping fountain.
It is night: only now do all songs of lovers awaken. And
my soul too is the song of a lover. Something
unquenched, unquenchable, is in me that wants to speak out. A craving for love
is in me, that it speaks the language of love. Light am I: ah, that I were
night! But this is my solitude that I am girded round with light!”
Friedrich Nietzsche
কৃতজ্ঞতা
স্বীকার রাজর্ষি কুণ্ডু
No comments:
Post a Comment