কোথায় কি!

05 July 2016

আবু উবায়দাহ তামিম





ক.
নাজনীন স্কুল থেকে ক্ষুধার ব্যাথা পেটে নিয়ে বাড়ি ফিরল। মনুষ্য শরীরে যখন ক্ষুধা চেপে বসে, তখন পেটে খাবার না পড়া পর্যন্ত সবকিছু অন্ধকার দেখা যায় এবং মেজাজ মাত্রাতিরিক্ত খারাপ হয়। কিন্তু নাজনীনের মেজাজটা এখন তীব্র থেকে তীব্রতর খারাপ হয়ে উঠল, যখন দেখলো তার আপন মায়ের সাথে একটা পরপুরুষ জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে। তাও কী অশ্লীল ভাবে! দুজনেরই প্রায় হাফ উলঙ্গ অবস্থা। নাজনীনের রাগে আগুন হওয়া চোখটা এদিক ওদিক সন্ধানী হয়ে ঘুরতে লাগল, এখন চোখের সামনে দা, খুন্তা কিংবা কোদাল যাই পড়ুক -সেটা দিয়েই ওই লুচ্চা বেটাকে মেরে দেবে। জীবনের চরম শিক্ষা হয়ে যাবে ওর, যাতে আর কখনো এমন লুচ্চামুর কল্পনা মনে না আসে, —এমন আরো কথা মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে, আর রাগ বেড়েই যাচ্ছে নাজনীনের।



খ.
নাজনীনের মা রুখসানা বেগম, বয়স আটত্রিশ বা উনচল্লিশ এ দাঁড়ালেও শরীরের ঢকঢুক এবং উজ্জ্বলতায় পঁচিশে পেরোনো নারীর মতো লাগে। একটা সময় ছিল, তার স্বামী কত সতর্কই না থাকত বৌয়ের এই ধারালো সৌন্দর্য নিয়ে। রাস্তাঘাটে বেরুবার আগে কড়া গলায় বলতো,
-মাতায় বড় ঘুমটা টেনে বেরুবি। মানষির চোক জানি তোর ধলা মুক না ছোঁয়
রুখসানাও আবদারসূচক পাল্টা উত্তরে বলতো,
-এরাম করে ঘুমটা টানলি রাস্তা দ্যাকপো কী করে? তার স্বামীর দ্বিতীয় বকুনিতে আর কথা বাড়ায়না রুখসানা। কিন্তু একদিন সেই সতর্কবান স্বামী বড় রাস্তার পরে বাসের ধাক্কায় প্রাণ হারালো, তখন আর কেউ থাকলো না রুখসানাকে সতর্কবাণী শোনাবার। তারপর থেকে কেমন যেন সুন্দরী রুখসানা 'সবার জন্য উন্মুক্ত' স্টাইলে সবার দৃষ্টিতে পড়তে লাগলো। এবং গ্রামের সব বয়সী পুরুষদের দেখার একটা উল্লেখযোগ্য বস্তু হয়ে উঠল।
ধীরে ধীরে একসময় রুখসানার কোলে আসে নাজনীন, আয়হীন সংসারে যখন দীনতা হানা দেয় গাল হা করে। তখন বাধ্য হয়েই তাতের মিলে কাজ জুটালো রুখসানা। আর সেখান থেকে পরিচয় হয় এই পাশে শুয়ে থাকা মফিজ মোল্লার। রুখসানার শাদা চামড়ার কারণে তখন মিলের কত উঁচু উঁচু পদের লোকজনও তার গা ঘেঁষতে শুরু করেছে। রুখসানা বেগম সবার কাছ থেকে এড়িয়ে গেলেও কিছু টাকা ধার নেওয়ার কারণে মফিজ মোল্লার গা ঘেঁষাটা শেষ পর্যন্ত সয়ে নিল। একদিন পাওনা টাকা পরিশোধ করতে গেলে মফিজ মোল্লা বলে,
-ভাবি ওসপ টাকা দিয়া লাগবে না। তুমি রেকে দাও, মেয়ের পড়াশুনায় উটা খাটায়ো।
রুখসানার মনে ঐ টাকা রেখে দিতে মন চাইলেও অভ্যেসমত মুখে হাসির রেখা টেনে বললো,
-তালি কিরাম হয়, এট্টা অসুবিদের সুমা তুমি আমার সাহায্য কল্লে, এখন যদি তুমার টাকা আমি মেরে দিই...
-এটা তো তুমারে আমি হাদিয়াস্বরুপ দিলাম।
তারপর এই হাদিয়ার সুবাদে তাতের মিলের কলকারখানা ডিঙিয়ে রুখসানা বেগমের বাড়ি আসা শুরু করলো মোফিজ মোল্লা। এখন প্রায় সময়ই এসে নাজনীনের মা'র রান্নাঘরে বসে, ব্লাউজের পেছন থেকে বেরনো টলটলে মাংশ দেখে দেখে তৃপ্তির পলক ফেলে। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে ঝুড়ি খুলে গল্প করে। স্বামীহীনা রুখসানা বেগমেরও এই টুকটাক গল্প মন্দ লাগেনা খুব। নাজনীন এসব দেখেও কিছু বলে না বা বলার প্রয়োজন পড়ে না। সে রসুলপুরের সজিবের সাথে প্রেম করে, এতে তার মা কখনো বাধা দেয় না, বরং সাপোর্টই করে হয়ত। যেমন এই গেল শুক্কুরবার সজিব সেই রসুলপুর মাড়িয়ে যখন নাজনীনদের বাড়িতে এলো, তখন রুখসানা বেগম খুব যত্ন করে একটা মুরগীর ডিম ভেজে খাওয়াল। সুতরাং তার মা কী করলো বা না করলো, তার পেছনে পড়ে থাকার কোন অর্থ খুঁজে পায়না সে।
কিন্তু ইদানীং নাজনীনের চোখের কাঁটা হয়ে গেছে মফিজ মোল্লা। এর কারণ হল, সে প্রায়দিন এসে এসে নাজনীনের কথা নালিশ করে যায় তার মায়ের কাছে। আর রুখসানা বেগম পরে মেয়েকে অনেক শাষায়। সেদিন নাকি ওরা রসুলপুরের এক দেয়ালের আবডালে চুমোচুমি করা মুহূর্তে মফিজ মোল্লার সামনে ধরা পড়ে গিয়েছিল, তখন সে কোন কথা না বাড়িয়ে সোজা রোখসানা বেগমের কাছে এসে খবর দেয়,
-তুমি তো ঘরের কোণে থাকবা, মায়েডার ইট্টু সাবধানি রাকো, এই বয়োসি বাইরির ছেলেপুলের সাথে চুমোচুমি করে বেড়ায়।
এরপর সেদিন বিকালে নাজনীন বাড়ি ফিরলে খুব শাষায় তার মা। এতে নাজনীন ভেতরে প্রচন্ড ক্ষুদ্ধ হয় মফিজ মোল্লার পরে। এবং মনে মনে বলে,
-দাড়া কানা খাটাশ, নালিশ করা মারাও! মজা দেকপিনে!
 মায়ের কাছে এত বড় অপরাধী হয়ে যাওয়ার রাগ ভেতরে পুষতে পুষতে হঠা একদিন স্কুলে যাওয়ার পথে নাজনীনের মুখোমুখি পড়ে গেল মফিজ মোল্লা। তখন প্রচন্ড ক্ষীপ্ত হয়ে যাচ্ছেতাই বলে গালি দিয়ে বসে নাজনীন।
-এই শালার বুড়ো নুচ্চো! নিজির কাজ নিজি কত্তি পারো না! পরের পুঙ্গায় গু দেখে বেড়াও!
মফিজ মোল্লা পাল্টা কোন কথা না বলে হনহন করে হেঁটে যায়া। কী আর করা! যদিও ফাঁকা রাস্তা; তবু এতটুকু মেয়ের কাছে এমন বড় বড় কথা শুনে অনেক অপমানিত হল সে, এবং তারপর থেকে রুখসানা বেগমের বাড়ি যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিল। কিন্তু চোর শোনে না ধর্মের কাহিনি, —মোফিজ মোল্লা ঠিকই তিন চার সপ্তাহ পরে আবারো এ বাড়িতে পা দিয়েছে। এবং নাজনীনের মার সাথে এক চৌকিতে শুয়েছে।



গ.

নাজনীনের ঘরে ঢোকাটা তাদের দুজনের কেউ খেয়াল করেনি অথবা খেয়াল করেও পেছন ফিরিয়ে ঠিক না-পাওয়ার ভঙ্গি করে শুয়ে আছে। নাজনীনের রাগ ঠান্ডা হওয়ার আগেই হাড়িকুড়ি রাখা টেবিলের নিচ থেকে ধারহীন দা খান উঁকি মারল, লোহার বাট, বেশ ভারী। নাজনীন দা'র মাথা হাতে মুট করে ধরে আস্তে আস্তে মোফিজ মোল্লার পেছন দিকে গিয়ে শরীরের সমস্ত শক্তিতে প্রচন্ড এক আঘাত কষলো মাথার পেছনে। অমনি 'অরে অাল্লারে, আমি গিছিরে' বলে একটা চিক্কুর দিয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো চৌকির পরে থাকা মানুষটি। নাজনীনের হাতে দা, আর হতবিহ্বল দৃষ্টি স্থির হলো আঘাত প্রাপ্ত লোকটির দিকে। এতো সেই মফিজ মোল্লা নয়। তাহলে সে কাকে মারলো! নাজনীন বিশ্বাসের চোখ কচলাতে কচলাতে বুঝতে পারলো, এটা তারই প্রেমিক, মানে রসুলপুরের সজিব। মুহূর্তেই তার চোখ ঝাপশা হয়ে আসলো এবং তার মনে হতে থাকলো এটাতো একরকম অবাঞ্ছিতের প্রবেশ ধরণের কিছু।


No comments:

Post a Comment