কোথায় কি!

05 July 2016

নাজমুন নাহার


সিলভিয়া প্লাথের The Bell Jar  তার দশকে বিপুল খ্যাতি এনে দিয়েছিলোএটি তাঁর একমাত্র উপন্যাস ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। কিছুটা আত্মজীবনীমূলক শুধু মাত্র নাম আর জায়গার নাম পরিবর্তন করে কাহিনীটি অনেকটা আত্মকথন এবং   অটোবায়োগ্রাফিক্যাল। মানসিক ভাবে বিপর্যস্থ এক নারীর কথাই  পূর্বাপর সাজানোএই উপন্যাসটি প্রকাশের কিছুদিন পরেই তিনি আত্মহত্যা করেন ।বিশেষ করে ইংল্যান্ডে এটি প্রকাশের প্রথম দিকেই তিনি আত্মহত্যা করেন।১৯৬৭ সালে প্লাথের নামে বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কিন্তু এমেরিকায় ১৯৭১ সালের আগে প্রকাশিত হয় নি । এক ডজনের উপরে বিভিন্ন ভাষায় বইটি অনুদিত হয়। যদিও উপন্যাসটি জীবনের অন্ধকার এবং মালিন্যকে স্পর্শ করে তবু  বইটি হাইস্কুলের ইংরেজী ক্লাসে পাঠ্য হিসেবে রাখা হয়েছে। কিন্তু এটা দাবী করা অদ্ভুত হবে না যে তার কবিতাই তাকে চরম খ্যাতি এনে দিয়েছে ।

দুঃসাহসী, অন্তরযন্ত্রীয়, সচল, শিল্পানুনাগ এবং বিকৃতি, জাঁকালো ভাব, প্রতিটি স্তবকে গতিশীল সরলতা,  মনোমুগ্ধকর, ভয়ংকর থেকে হিংসাত্মক তার কবিতাকে দিয়েছে ভিন্ন আস্বাদ। আধিপত্যবাদ, হারানোর বেদনা, সৃষ্টিশীলতার জন্য আকুল লিপ্সা, মায়ের সন্তানের প্রতি ভালোবাসা, আত্মহননের ভাবনা, যৌনতার আস্বাদ শরীর এবং মনে এই সবকিছু তার কবিতায় চ্যাপ্টার থেকে চ্যাপ্টারে গমনের যে উল্লাস সেখান থেকে তাকে সময়ের দশজন থেকে পৃথক করেছে। প্রতিটি কবিতা কবির আউটপুট হিসেবে তিনটি স্বতন্ত্র পর্যায়ক্রম এক অংশ হিসেবে বোঝার অবকাশ থাকে।
প্লাথের কবিতার প্রথম পর্যায়ে "juvenilia" ফেজকে গণ্য করা হয়েছেএর সময়কাল ধরা হয় ১৯৫০ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত। তাঁর তেইশ বছর সময়কাল পর্যন্ত  ২২০ টি কবিতা প্রকাশিত হয়এগুলো যে সব তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজ তা নয় বা শ্রেষ্ঠ কাজ হিসেবে গণ্য করা হয় না এবং প্রায়ই শুধুমাত্র পণ্ডিতদের দৃষ্টি আকর্ষনের ব্যপার হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কবিতাগুলোতে বিশেষত সৃজনশীল অন্বেষার ক্ষেত্রে এবং একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একজন নারী হয়েও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বিষয়টি পরিলক্ষিত হয় এবং একজন নারী হিসেবে নিজেকে একটা চ্যালেঞ্জিং অবস্থানে সমাজে প্রমান করার দাবীকে উপেক্ষা করা যায় না বিশেষ করে তাঁর সৃজনশীলতার দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার। যাই হোক অনেকে  সেখানে রাজনৈতিক এবং অপেক্ষাকৃত ব্যক্তিগত এবং মনোগত দিকগুলো বিবেচনায় এনেছেন।
জুবিলিয়ার কিছু কবিতা বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিলো। যেখানে অন্যদের ছিলো টাইপড কপি এবং এমনকি প্লাথের স্বামী টেড হিউজ বিশ্বাস করছিলেন  যে তখনো অনেক কিছুই অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছে।
১৯৫৬ থেকে ১৯৫৯ বা ৬০ এর দিকে  প্লাথের দ্বিতীয় পর্যায়ের কবিতার ক্রমবিকাশ। এই পর্যায়ে অনেক কবিতাই ছিলো যেগুলো প্রথম প্রকাশিত হয়েছে কাগজগুলোতে। কলোসাস এবং অন্যান্য কবিতাগুলো তাঁর মধ্যে অন্যতম। ১৯৫৬ তে টেড হিউজকে প্লাথ বিয়ে করার পরে তারা ইংল্যান্ড যান। এবং ঐসময় তাঁর কবিত্ব শক্তি এবং সৃজনশীলতা যেন বহুগুনে শাখা প্রশাখায় বিস্তার ঘটে।
মানসিক পীড়ন এবং তাঁর জীবনের আনুষাংগিক হতাশা তাঁর কবিতার অনুসংগ। কনফেশনাল কবিতার উলথান সেই সময়টাতে এবং এই সময় রবার্ট লয়েল কনফেশনাল কবিতা লিখতে থাকেন। প্লাথ যাকে তাঁর জীবনের মেনটর এবং শিক্ষক মানতেন।
সিল্ভিয়া প্লাথ এই সময় যে কবিতাগুলো লিখেন সেগুলো বেশীর ভাগই কনফেশনাল কবিতা। ব্যক্তিগত দুঃখবেদনা, হতাশা বোধ কবিতাগুলোর উপজীব্য। এই সময়ের কবিতাগুলোতে কবির স্বাপ্নিক দ্বন্দ , আত্মার গভীর ক্ষরণ, ট্রমা, সামাজিক সমস্যা এবং দুর্ভোগই বার বার উচ্চকিত হয়েছে। হিউজ চেষ্টা করেছেন এই সময়টাকে তাঁর আধ্যাত্মিক অনুশীলন দিয়ে অলংকরন  করতে। এবং যদিও হিউজের সাথে এই ব্যপারে প্লাথ একমত ছিলেন কিন্তু তাঁর কাজ এবং অর্জন ছিলো বহুগুণে বিবর্ধিত । প্লাথ নিজেই তাঁর নিজের সৃষ্টি এবং কাজ সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস রাখতেন।
এবং প্লাথ নিজেকে এই মূল্যায়নের ব্যপারে সচেতন ছিলেন তথাপী তাঁর নিজস্ব কাজ তাকে তার অর্জনের চাইতে আরো বেশী মহ প্রতিপন্ন করে । এবং যে কেউ তাঁর সৃষ্টির সামান্য অনুশীলন থেকেই তার অসামান্যতা বুঝতে সক্ষম হবেন।
১৯৬০ সালে William Heinemann প্লাথের The Colossus এবং আরো কিছু কবিতা প্রকাশ করেন  ।তন্মধ্যে  The Colossus," "Full Fathom Five," "Hardcastle Crags," "Spinster," "Lorelei," and "The Stones." এই কবিতাগুলো ছিলো প্রধান । এই সংগ্রহশালা একজন নতুন তরুণ কবির শক্তিশালী আওয়াজ হিসেবে তকালীন সময়ে আদৃত হয় । এবং সুনাম অর্জন করে। Alfred M. Knopf ১৯৬২ সালে The American প্রথম প্রকাশ করেন। কবির চাতুর্য, টেকনিক, উপস্থাপনা এবং সংবেদনশীল কিন্তু রূচিবাগীশ মানসিকতা সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষন করে।
বেশীর ভাগ রিভিউগুলো পান্ডিত্যপূর্ণ যেখানে পিতৃতান্ত্রিক আধিপত্য ছিল। কেউ কেউ তাকে পরামর্শ দিয়েছেন নিজের পৃথক গমনের বিষয়টি যেন তাঁর লেখার উপর প্রভাব না ফেলে।

প্লাথের তৃতীয় পর্যায়ের কবিতাগুলো লেখা হয় ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৬৩ সাল বিশেষ করে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। এই সময়কার মানসিক এবং ব্যক্তিগত জীবনের তীব্র অশান্তি এবং একই সাথে সেই সময়ের ভাংচুড় সৃজনশীল সত্তাকে সমৃদ্ধ  করে ।
গভীর মানসিক অভিনিবেশ , বিরক্তিকর জটিলতা জীবনের , তীব্র হাহাকার , হতাশা প্লাথের কবিতাকে অনেক বেশী সাবলীল করে। সম্পর্কের ওঠানামার বিষয়টি উঠে এসেছে তাঁর কবিতায় যেখানে তিনি বেশীরভাগ কবিতাতেই তীব্র বেদনাকে এমন জটিল অভিনিবেশের সাথে উচ্চারণ করেন যে কবিতার সুর হৃদয়ের তন্ত্রীতে কাঁপন তোলে । একটি সমালোচনায় বলা হয়  তাঁর এই সময়ের কবিতাগুলোতে বিশেষ করে মৃত্যুর পূর্বকালীন সময়ে লিখায় কবির মানসিক তীব্রতা এবং ব্যক্তিজীবনের নাটকীয় ওঠানামা তাঁর কবিতাকে করেছে “কোলাজ অব ডিসকোর্স অথবা “কোল্ড্রেন মর্ণ”  বা কড়া সকাল ।
১৯৬৩ সালে প্লাথ আত্মহনন করেন । টেড হিউজ তাঁর কবিতাগুলো প্রকাশের জন্য একীভুত করেন । প্লাথ তাঁর কিছু কবিতা Arielএ  প্রকাশের জন্য কবি তীব্র ভাবে ইচ্ছুক ছিলেন । কিন্তু টেড হিউজ উদ্দেশ্যমূলক ভাবে কিছু নির্দিষ্ট কবিতা এই তালিকা থেকে বাদ দেন ।এবং ২০০৪ সালের আগ পর্যন্ত কবিতাগুলো  সংশোধিত আকারে প্রকাশিত হয়নি। Ariel এ কিছু শক্তিশালী কবিতা যেমন "Daddy," "Lady Lazarus," "Contusion,"
"Edge, "Sheep in Fog," "Tulips," এবং "Medusa. প্রকাশিত হয়। Ariel এর কবিতাগুলোর অন্তর্নিহিত ভাব এবং  গভীরতা সমালোচকদের  দৃষ্টি আকর্ষন করে ।
এ ছিলো সাহিত্য জগতে একটা বড় রকমের ঘটনা যে  প্লাথ এত দিন পরে সত্যিকারের কবি প্রতিভা হিসেবে স্বীকৃত হন। আগে অনেক বিখ্যাত সমালোচক তাঁর কবিতাকে স্রেফ আত্মজীবনী মূলক কবিতা হিসেবে প্রমান করতে সচেষ্ট ছিলেন এবং কবিতায় যে হতাশা, দুঃখবোধ, জীবন সম্পর্কে উন্নাসিকতা এবং কবিতায় এর প্রকাশকে কবিত্ব শক্তির চাইতে তাঁর নিজের জীবনের দুঃখবোধের প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয় এমনটি প্রমানে সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের কিছু নারীবাদী সমালোচক  তাঁর কবিতাগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে কবিতার ভেতরের কবিত্বশক্তিকে আবিষ্কার করার সাথে সাথে কবিতার ভেতরের সৌন্দর্যবোধ পাঠকের সামনে হাজির করেন। কবির এক অনুরাগী ভক্ত পাঠককে তাঁর এই অটোবায়ীগ্রাফিক্যাল লেখাকে কবিতা হিসেবে প্রমাণ করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। সুক্ষন এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টির ব্যপারটি উপলদ্ধির মাধ্যমে তিনি ক্ল্যাসিকেল আলোচনার মাধ্যমে দেখিয়েছেন কবির লেখাগুলো যতটা না অটোবায়োগ্রাফিক্যাল ছিলো তার চাইতে বেশী ছিলো কল্পনাশক্তির অসাধারণ ক্ষমতা এবং তার যথাযথ প্রকাশচুড়ান্ত সংশোধিত কবিতা গুলোতে প্রকাশের অভিনব ধারা, নতুন দৃষ্টিভংগি, স্বরায়নের বহুমাত্রিক প্রকাশ প্লাথকে একজন শক্তিশালী কবি হিসেবে প্রমাণ করে।


No comments:

Post a Comment