___বোধ___
কোন দৈবশক্তি তার অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করে নাই,
সে নিজেই অদৃষ্টের স্রষ্টা; এই রকম চিন্তায় বিশ্বাসী মনোয়ারা বেগম গতরাতের
ঘটনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য
অজু করতে বেড় হয়। সুবেহসাদিকের সময় ফেরেস্তারা মানুষের অনুরোধগুলো আল্লাহর কাছে পৌছে
দেয়। তারা মানুষের পুঞ্জীভূত পাপ-পূণ্যের ডাটা সংগ্রহ করে সৃষ্টিকর্তার কাছে উপস্থাপন
করে। মনোয়ারা
বেগম ব্যস্ত হয় সময়টা ধরার জন্য। উত্তর দিকে পলাশডাঙ্গা স্কুল থেকে তখনও ভেসে আসছিল
পূজার ঢোলের শব্দ; যা বাতাসে একটা মিহি ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করছিল। আজ দশমী,
মা দূর্গা মর্ত্য ছেড়ে চলে যাবে, সুবেহসাদিকের পর ফেরেস্তারাও। মনোয়ারা
বেগম কি চাইবে! অন্ধ নিয়তিতে তার কোনো বিশ্বাস নাই; মানুষের জীবন নিয়ন্ত্রণ করছে তার
নিজেরই কর্মপদ্ধতি; এই
সত্যটা তুলে ধরবে? নাকি কয়েক ঘন্টা আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য ক্ষমা! নাকি সন্তানের
জন্য বেহেস্ত! কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে না পারলেও তার মন কঠোরতায় অটুট থাকে।
হঠাৎ এক দমক হাওয়া নদী থেকে উঠে এসে তাকে স্পর্শ করলে
গতরাতের ময়লা কাদা ধোওয়ার উদ্দেশ্যে নদীর ঘাটে যায়। আশ্বিনে নদীর পানি ইটবাঁধানো ঘাটের
শেষে যেখানে ঠেকেছে সেখানটা টলটলে পানিতে বৃত্তাকার শূন্যস্থানের পর কচুরীপানায় ঢাকা।
ডান হাত দিয়ে ঝুলে পড়া শাড়ির আঁচল ভাল করে কোমরে গুজে ভাবে, আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা আবেগ
ও মাতৃত্ববোধ থেকে এখন সে মুক্ত।
ঘনীভূত আঁধারে নদীর জলে স্থানে স্থানে হালকা ছাইরঙা
আকাশের প্রতিবিম্ব পড়লে ঝুপ করে পানিতে হাত ফেলে। পানিতে হাতের তরঙ্গে কচুরীপানা এগিয়ে
আসলে যতো সরায় ততই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এগিয়ে আসে। ঠিক তার একমাত্র ছেলের মতো। গতরাতে
আসিফ কচুরীপানার মতো ফিরে এসেছিল তিনদিন আগের ঘটনার রেশ না কাটতেই। তখনও মনোয়ারা বেগমের
মন পোড়া গন্ধ বাতাসকে ভারী করছিল। চল্লিশ বছরের সংসার জীবনে তিলতিল করে গুছানো ঘর
মুহূর্তে দাউদাউ করে অগ্নি গহবরে চলে গেল! পূর্ব পুরুষদের রেখে যাওয়া শেষ সম্পদ হলুদ
হয়ে ঢুকে গেল কালো রাতের মাতৃজঠরে। আর সর্বংসহা মনোয়ারা বেগম আত্মগ্লানিতে বুঁদ হয়ে
অসহায় তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখের মণি মোমের মতো গলে পরলো। রোম জ্বলছে আর নেরু বসে
পিয়ানো বাজাচ্ছে...আসিফও তেমনি নিজের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে সেই আগুনে গাঁজা ধরিয়ে শহরের
রাস্তা ধরেছিল।
মনোয়ারা বেগমের মাথাটা একটু ঝুলিয়ে কচুরীপানা সরিয়ে
বৃত্তাকার পানিতে শুঁকনো কাদা জড়ানো শরীর ডুবিয়ে দেয়। গোসল সেরে উঠে দাঁড়ালে চারপাশের ধুপ-ছায়া অন্ধকারে তার রক্তে গ্লুকোজের পরিমান কমে গেলে অঝোরে
ঘামতে থাকে। পায়ের নীচে মাটি সরে গেলে চোখ বন্ধ করে শিমুল গাছে হেলান দিয়ে বসে। এই
মুহূর্তে মরলেও তার কোনো আপসোস নাই। বিধ্বস্ত পোড়া বাড়ির নিচে সন্তানকে শুয়ে এখন সে
দায় মুক্ত।
___প্রাপ্তি___
তেইশ বছর আগের ঘটনা। আব্দুল জলিল রোজা রেখেছে।
নফল রোজা। ঢাকায় বন্ধু শফিকের বাসায় ওঠায় কয়েকদিন ধরে মোনাজাতে বসতে পারছে না। আগামী
কয়েকদিনও পারবে না। পরপর তিনটা রোজা রাখতে হবে তাকে। গৌরাঙ্গ, জব্বার, নগেন ভদ্র আর
জলিল এই চারজনে তাসের মোনাজাতে একবার বসলে
দুনিয়া এসপার-ওসপার হয়ে গেলেও কারো ওঠাবার সাধ্য নাই। সেই জলিলই যখন তাসের আসর ত্যাগ
করে স্ত্রী কথা মতো ঢাকায় বসে তদবির মানছে
তখন সবাই বলাবলি করে, জাতে মাতাল তালে ঠিক।’ জলিলের অনুপস্থিতিতে টুয়েন্টি নাইন বাদ দিয়ে থ্রি কার্ডে জব্বর চাল দিয়ে
বলে, পাঁচ মাইয়ারে ঠিক মতোন মানুষ করতে পারে না তার আবার পোলার শখ! অত্যন্ত কার্ড শার্প
গৌরাঙ্গ টেক্কার জোকার দিয়ে সব কার্ড তুলে নিয়ে বলে, আরে তাস খেলার বংশধর রাইখা যাইতে
হবে না! পাঁচ মাইয়া কি আর তাসের আসরে বসতে পারবে! সমস্বরে সবাই হাসলে বাতাসে হায়েনার
হাসির মতো জলিলের কানে পৌছালে শুধু দাঁতের মাড়ি কামড়ে ধরে। সে আজ অসহায়! স্বভাব কিছুটা
কুটিল ও স্বার্থপর হলেও মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালের সময় ছাত্ররাজনীতির
রেস কিছুটা থেকে যাওয়ায় ভারতে ট্রেনিং নিয়ে কয়েকটা অপারেশনে অংশ নিয়েছিল। পরবর্তীতে
দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে হিন্দুরা এলাকা ছাড়তে শুরু করলে লোভের কাছে হার মানে।
পানির দরে সে সব সম্পদ কিনে নিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে তার এক্সপোর্টর্স-ইমপোর্টের ব্যাবসা,
বিরাট অফিস ও বাড়ি যেন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ।
মনোয়ারা বেগম ওরফে মনু। উকিল বাহাউদ্দিনের বায়ান্নর
ভাষা আন্দোলনের সময় জন্ম নেয়া মনোয়ারা বেগমের পুরোটা জীবন কেটেছে ঢাকায়। ভাষা আন্দোলনের
সময় জন্মেছিল বলে বাহাউদ্দিন তাকে বিদ্বান, বিদূষী ও আধুনিকমনা করে গড়ে তুলেছিল। আব্দুল
জলিল জমি সংক্রান্ত একটি বিবাদে জড়িয়ে বাহাউদ্দিনের স্মরণাপন্ন হলে মনোয়ারা বেগমকে
দেখে উম্মাদ হলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল।
বাহাউদ্দিন হিন্দুদের সম্পদ আত্মসাত করে বড়লোক হওয়া আব্দুল জলিলকে মেয়ের জামাই হিসেবে
মেনে নিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলে উন্মাদিনী মনোয়ারা বেগম বাবাকে না জানিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে
বসেছিল আব্দুল জলিলের বাহ্যিক চাকচিক্য দেখে। বিয়ের ঘটনার পর বাহাউদ্দিন রাগে-অভিমানে
জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত মেয়ের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখে নি।
বিয়ের পরদিন থেকে মনোয়ারা বেগম ঘর সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ি,
দেবর-ননদ,সন্তান নিয়ে ব্যস্ত থাকায় স্বামীর গতিবিধির দিকে ধ্যান দিতে পারত না। বছর
বছর কন্যা সন্তান জন্ম দিতে দিতে কেমন ক্লান্ত আর বিষণ্ন ছিল। তার বড় বড় চোখের নিচে
রাজ্যের কালি জমে হয়েছিল ম্রিয়মাণ। সারাদিন শুঁকনো ঠোঁটের ভেতর দিয়ে প্রয়োজন ছাড়া
কোন কথা বের হত না। অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে ফ্যাকাশে শরীরটা দিনের আলো অথবা মানুষের
কথার আড়ালে যত দ্রুত পারতো লুকিয়ে রাখত ঘরের ভেতর। যদিও তাদের নতুন বাড়িটি হিন্দু এলাকার
হওয়ায় ছিল জনমানবহীন। মুসুদ্দিদের ছেড়ে যাওয়া পরিত্যাক্ত বাড়িটি স্বাধীনতার পর পানির
দরে কিনেছিল বলে বিপদের দিনে তাদের পথে বসতে হয়নি।
তাশের নেশা আব্দুল জলিলকে শুধুমাত্র পূর্বপুরুষদের
ভিটাচ্যুত করেছিল তাই না ব্যাবসা, বাড়ি-ঘর সব কেড়ে নিয়েছিল। সব শেষ হয়ে চারিদিকে ভাঙন
ও পতনের বিকট আওয়াজ উঠলে স্ত্রীর পায়ের পড়ে কান্না বিজরিত কণ্ঠে বলেছিল, মনু, আমার
সব শেষ! আমি এখন পথের ফকির।’ জীবনের প্রথমবারের মত জলিল স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের কাছে
নত হয়েছিল এবং দ্বিতীয়বার হলে ছিল তারও অনেক পরে একটা ছেলে চেয়ে!
স্বামীর বিপদের দিনে মনোয়ারা বেগম সংসারের হাল
ধরেছিল। মার দেয়া গহনা বিক্রি করে বড় বাজারে দোকান কিনে দিয়েছিল। শহুরে বিলাসী জীবন
ছেড়ে হিন্দুদের ছাড়া বাড়িটিকে নিজহাতে বসবাসের উপযোগী করে তুলেছিল। বাড়ির চারিদিকে
হরেক রকম ফুল ও ফল গাছের সঙ্গে শিমুল,পলাশ ও অশ্বত্থের গাছের সমাহার ছিল। শ্যাওলা ধরা
পুকুরের পেছনে কাঁটা ঝোপ তারও পেছনে মাঠের প্রান্ত দিয়ে আদিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত।
দক্ষিণে শুকিয়ে যাওয়া নদীর বাঁক থেকে ওঠে আসত দমকা বাতাস।
ছেলে চাই! স্বামীর মুখে কথাগুলো শুনে কিঞ্চিত ক্ষেপে
মনোয়ারা বেগম জবাব দেয়, সন্তান দেওয়ার মালিক আল্লাহ!’
সবই জানি, সবই বুঝি, তোর যা স্বভাব আমার শত্রু ও তা বলতে পারবে; আল্লাহ
তোর কথা শুনবে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলে তোর এই পোতায় শিয়াল কুকুর..।’
তোওবা কাটেন... মানুষ বলে ছাড়া ভিটায় বংশ বাড়ে
না!
তোকে একটা কথা বলবো ভাবছি, কাস্টমসের এ্যাসিস্টেন্ট
কালেক্টর মোল্লা সাহেবের কথা মনে আছে!’
কৌতূহল দৃষ্টি মেলে মনোয়ারা বেগম বলে, হুম! বড়ই
পরহেজগার, আপনার কত মাল পোর্ট থেকে ছাড়াইছে, হঠাৎতার কথা কেন?’
-আমার কথাটা একটু গুরুত্ব দিয়ে শোন, বন্ধু শফিকের
কাছে শুনলাম, উনি নাকি স্বপ্নে একটা তদবীর পাইছে! কয়েকজনকে নাকি দিছেও। আল্লাহর রহমতে
ফলেছেও।’
-কিসের তদবীর?
-ছেলে হবার তদবীর!
বাস্তববাদী মনোয়ারা বেগম নির্বিকার চিত্তে অবলোকন
করে স্বামীর সরলতা। স্বামীর এ রকম রুপ আগে কোনদিন দেখে নি। তারও ইচ্ছে করে স্বামীর
সরলতার মধ্যে ঢুকে যেতে, সবকিছু বিশ্বাস করতে,পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়।
তবুও শক্তভাবে স্বামীর কথা উড়িয়ে দিতে পারে না বা সাহস হয় না। নির্লিপ্ত চোখে অস্ফুট
ভাবে বলে, আপনার যা ভাল মনে হয় তাই করেন।’
তারপর থেকে শুরু। ঢাকা শহরে তারা মোল্লা সাহেবের
সঙ্গে দেখা করে। মোল্লা সাহেব বলেন, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর। সবই আল্লাহর
ইচ্ছা, আমি তো উছিলা মাত্র। একটু ধৈর্য ধরতে হবে।.. প্রথম মাসে মাসিক শেষ হবার পর পাকসাফ
হয়ে তিনটা রুটি বানিয়ে আনবেন। আমি একটা ফলবতী গাছের নিচে বসে সেই রুটি তিনটায় দোয়া
পড়ে ফুঁ দিয়ে দিব। আপনারা স্বামী- স্ত্রী মিলে তিনদিন রোজা রেখে প্রতিদিন একটা রুটিকে
দু’ভাগ করে রোজা ভাঙ্গবেন। এভাবে তৃতীয় দিন রোজা ভাঙ্গার পর রাতে সহবাসে করবেন। একনাগারে পরপর তিনদিন
সহবাস করবেন। আল্লাহ চাহে তো সব সম্ভব!
বাড়ি ফিরে মাস ঘুরতেই পোয়াতি মায়ের হাসি ঝরে পড়ে
বাড়ির আনাচে-কানাচে। ঋতু পরিবর্তনের ধারায় যেবার চৈত্রও ছিল সরবর সেবার মনোয়ারা বেগমের
কোল জুড়ে দখল কয়ে নেয় একটা ফুটফুটে ছেলে। নাম রাখে আসিফ।
___সিদ্ধান্ত___
নিঃশ্বাস চেপে রেখে যে রকম জীবন মনোয়ারা বেগম যাপন
করছিল; সেখানে শিশুর হাসি অক্সিজেন প্রবাহিত করে দিল। এক সময় অভিমানী কষ্টগুলো সমস্ত
আক্রোশে বাড়ি ছেড়ে পালাল। একএক করে মেয়েদেরও ভাল বিয়ে হয়ে গেল। ছেলে বেড়ে ওঠার সঙ্গে
সঙ্গে মনোয়ারা বেগমের স্বপ্নগুলোও বাড়তে থাকে। দিনে দিনে আব্দুল জলিল পুত্র সন্তান
প্রাপ্তির আত্মদম্ভ ও অহমিকায় অন্ধ হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে থাকে। ছেলের আদর-আহ্লাদ
পুরন করতে করতে সীমা অতিক্রম করে একবারে চরমে। থামাবার চেষ্টা করলে কোনো ভ্রুক্ষেপ
না করে জবাব দিত, ছেলের জন্য সাত খুন মাফ।’
হাল ছেড়ে দিয়ে সবাই যখন বোঝাবার চেষ্টা করত, ধন-সম্পদ ও বংশ গৌরব
কোন চিরন্তন ও চিরকালীন বস্তু নয়...ততদিনে দেখে ছেলে আর ছেলে নাই, নেশা খোর- সন্ত্রাসী।
‘নানার দেয়া হারটা আমাকে দাও’, সেদিন সন্ধ্যায়
ছেলের মুখের কথাগুলো মনোয়ারা বেগমের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ‘হারটা দাও’ কথাটা আচম্বিতে কলিজায় কামড় বসালে চোখের
সামনে ভেসে ওঠে, বাবার নিজ হাতে হার পড়িয়ে দেবার স্মৃতি। ক্লাস এইটে বৃত্তি পেলে বাহাউদ্দিন
নিজে পছন্দ করে চার ভরি স্বর্ণ দিয়ে হারটা মেয়ের জন্য বানিয়েছিল। স্বামীর মহাবিপদের
সময়ও মনোয়ারা বেগম সেটা আগলে রেখেছিল। সময়
অসময়ে ছেলে সব কিছুর উপর অধিকার খাটাতে চাইলে ছেলেকে বোঝাত, সম্পদ কারো কাছে বছর পঞ্চাশ
এর অধিক থাকে না। একদিন সব কিছুর মালিক তো তুমি হবে!
নেশার টানে ধনুকের মতো শরীর বাঁকিয়ে আসিফ চেঁচায়,
প্যাঁচাল ছেড়ে তাড়াতাড়ি হারটা দিয়ে দাও, নইলে কিন্তু..
স্বামীর উদাসীনতা ও ছেলের উধত্যপনা সব মিলিয়ে ততদিনে
সংসারের গৃহলক্ষ্মী মনোয়ারা বেগম বুকে পাথর বেধে পাগল প্রায়। উসকোখুসকো চুলে শামুকের
মতো; হাটত শ্লথ ভঙ্গিমায়, কখন সন্তর্পণে চুপচাপ বসে থাকত সারাবেলা। ছেলের এরকম আচরণে
হতভম্ব মনোয়ারা শেষের ‘কিন্তু’ শব্দটায় কেমন খটকা লাগে। ছেলের সামনে হাত জোড় করে, ক্ষমা
করো বাজান! আমার হৃদপিন্ড চাও দিব, কিন্তু হারটা দিতে পারবো না। ওটা আমার বাবার শেষ
চিহ্ন।
এদিকে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে দেখে বলে, বৃষ্টি নামবে
চলো ঘরে চল।
অন্যদিকে আসিফ মুহূর্তের মধ্যে মার সামনে থেকে
সরে দৌড়ে রান্নাঘর থেকে কেরোসিনের গ্যালন এনে বাড়ির চারিদিকে ছুড়ে দেয়। লাইটার চেপে
পিশাচের জিহ্বার মতো লকলকে আগুন ছুড়ে মারে। মনোয়ারা বেগম মনে করেছিল ছেলে বরাবরের মতো
হাউকাউ করে বাজারে চলে যাবে অথবা মাথা ঠান্ডা হলে খেতে বসবে। হঠাৎ বৃষ্টিমাখানো সন্ধ্যায়
ছেলের হার চাওয়া তাকে চিন্তায় ফেলে। ঠিক তখন দাউদাউ আগুনে রাত পুরতে দেখে আগুন আগুন
বলে চেচিয়ে ওঠে।
ভাগ্যিস আগুন চারিদিক ছড়াবার আগেই উত্তর ধারের
সাহা বাড়ির গৌরাঙ্গদা, বৌদি, আসিফের বয়েসি তাদের ছেলে চিন্ময়, মেয়ে পুটি, ছোট কাকাবাবুসহ
আরো অনেকে যে যা পেয়েছে তাই দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে নদী-
পুকুর-টিউবওয়েলের পানি দিয়ে আগুন নেভাতে নেভাতে সব শেষ। ভিটা শেষ। সবকিছুর জন্য আব্দুল
জলিল নিজে কষ্ট পাবার চাইতে বেশী কষ্ট অনুভব করেছে স্ত্রীর জন্য। তেমনি তার মেয়ে ও
জামাইরা।
অতি শোকে মনোয়ারা বেগম এখন বাকরুদ্ধ। ঘর পোড়া গরু
সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়ার মতো একটুতে চমকে ওঠে। তিনদিন ধরে নাওয়া খাওয়া ভুলে যন্ত্রমানবের
মতো কাজ করে যাচ্ছে। মেয়েরা চলে যাবার আগে বলেছে মা-বাবাকে তারা শহরে নিয়ে যাবে। ভিটা
ও দোকান বিক্রির অর্থ ব্যাংকে রেখে তাদের জীবন সুন্দর চলে যাবে। মেয়েদের কথায় মনোয়ারা
বেগম সম্মতি না জানালেও আব্দুল জলিল মেনে নিয়েছিল। যদিও তারা মাকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে
চেয়েছিল। কিন্তু মনোয়ারা বেগম রান্নাঘরের দাওয়ার মাটি আকড়ে বসেছিল।
সবাই চলে
যাবার পর মনোয়ারা বেগম নামজে ক্রমাগত ক্রন্দনরত সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাবার জন্য। মৃত্যু
প্রায় বাড়িটিতে হঠাৎ তার ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে দেখা সুপার হিট ফিল্ম ‘মাদার ইন্ডিয়া’র
কথা মনে পড়ে। কাহিনীটি তার কচি মনে দাগ কেটেছিল। ছবির সবচেয়ে স্পর্শকাতর অংশ ছিল বখে
যাওয়া ছেলেকে এক সংগ্রামী মার নিজ হাতে হত্যা করার দৃশ্য।
___মা
দূর্গা___
আগুন দেবার তিনদিন পর
গাঢ় রাতে আসিফ বাড়ি ফিরে এমন ভাব দেখায় কিছু হয় নি। কোনো কালের তাদের ঘর পোড়া যায় নি।
এ তল্লাটে তাদের বাড়ির মতো সুন্দর বাড়ি আর একটিও নেই। ঝকঝক করছে বাড়িটি। বাড়ির সামনে
রক্তজবা এবার অনেক বেশী লাল হয়ে ফুটেছে সঙ্গে হাসনা হেনা, মালতীলতা, সন্ধ্যামালতী,
জারুল, কাঁঠালিচাঁপা। ছোট বেলায় বন্ধুরা সরস্বতী পূজার সময় তাদের বাগানের ফুল দেবীকে
দিত বিদ্যা বাড়ার জন্য। লক্ষ্মী, সরস্বতী,মনসা, কালি কেউই বাদ যেত না। সেদিনও বিধ্বস্ত
বাগান থেকে ফুল নিয়েছিল বাচ্চারা। দূর্গাপূজার জন্য একটানা ঢোলের বাদ্য বাতাসকে ভারী
করছিল। আসিফ পূজার মন্ডপ থেকে ভান খেয়ে নেচে কুদে ঘর্মাক্ত শরীরে ঘরে প্রবেশ করে বলে,
ও মা ভাত দাও, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়..
মনোয়ারা বেগম সন্তর্পণে রান্না ঘরের দিকে আগায়,
ঠান্ডামাথায় ভাত সাজায়, ছেলের প্রিয় ডিমের তরকারির সঙ্গে শুধু এক চামচ কীটনাশক।
-ভাত দিস! ভীষন ক্ষুধা লাগছে। ভাতের থালা টেনে
নিয়ে তরকারির বাটিটা উপুড় করে সবটুকু তরকারি ঢেলে গোগ্রাসে খেতে খেতে ছোট বেলায় অপরাধ
করে ক্ষমা চাওয়ার মতো করে বলে, রাগ কর না, তোমাকে নতুন ঘর তুলে দেব.. বলেই ওয়াক করে
সব ভাত ফেলে দেয়। ভাত এমন লাগে কেন!
মনোয়ারা বেগম এতক্ষণ শূন্যের দিকে তাকিয়ে ছিল,
এবার চোখ তুলে ছেলেকে দেখল, ছেলে গলা চেপে ধরে ওয়াক করে বমি করার চেষ্টা করছে। তাকিয়ে
তাকিয়ে দেখল, ছেলের মুখ থেকে ফেনা বেড় হচ্ছে..মনে হলো, ছেলে বিড়বিড় করে কিছু বলছে,
তারপর এক সময় ছেলের ঠোঁট স্থির ও হা হয়ে অদ্ভূত কিছু দেখে চমকে চোখ বড় বড় করলো; তারপর
সব শেষ।
আসিফ দেখলো, পূজামন্ডপ থেকে স্বয়ং মা দূর্গা নেমে
এসে মনোয়ারা বেগমের রূপ ধারন করে দাড়িয়ে আছে..। আসিফ বিড়বিড় করে, মা, মাগো আমায় ক্ষমা
কর!
সব শান্ত হলে মনোয়ারা বেগম দাঁড়াল, বৃষ্টি ঘন হয়,
আব্দুল জলিল মেয়েদের সঙ্গে শহরে গেছে বাসা দেখতে। গৌরাঙ্গের পরিবার গেছে পূজা দেখতে,
আজ শেষ রাতে মা চলে যাবে। মনোয়ারা বেগমের পঞ্চাশ বছরের শরীরে হঠাৎ মা দূর্গা ভর করে।
দ্রুত কাচারী ঘর থেকে শাফল নিয়ে আসে। দূরে উলু ধ্বনি আর ঢোলের বারি বৃষ্টির দমকে কম্পমান।
শাফল দিয়ে বিধ্বস্ত ভিটায় ছাই হয়ে যাওয়া জঞ্জাল সরিয়ে মাটি খুঁড়ে ছেলেকে শুয়ে দেয়।
বৃষ্টিও বুক ফাটিয়ে কেঁদে সমস্ত চিহ্ন ধুয়ে দেয়।
___প্রশান্তি___
রাতের শেষ প্রহরে মাকে ডুবিয়ে গৌরাঙ্গের বউ ঘাটে
ডুব দিতে গিয়ে মনোয়ারা বেগমকে বেহুঁশ পরে থাকতে দেখে চিৎকার দেয়। সবাই মিলে তাকে ঘরে
তোলে। শান্তি ডাক্তার এসে সেলাইন দিয়ে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে রাস্তায় পুলিশের ভ্যান
দেখে গৌরাঙ্গ বউ পুলিশ বলে চিৎকার করে। মনোয়ারা বেগমের ভারী চোখের পাতার নিচে হয়তো
ছেলের স্মৃতি ঘুরপাক খাচ্ছিল; পুলিশের কথাটা কানে যেতেই অনেক কষ্টে চোখ খোলে। ভাবে,
পুলিশকে সব খুলে বললে কী হবে! তার ‘মাদার ইন্ডিয়ার’ সংগ্রামী নার্গিসের কথা মনে পড়ে।
বাবার বলা কথা মনে পড়ে,‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শূণ্য গোয়াল ভাল’। শান্তি ডাক্তারের কথা মনে
পড়ে,‘যার জন্য দশের অনিষ্ট হয় তার থাকার চেয়ে না থাকাই উত্তম। স্বয়ং ভগবান স্বরূপ দেবদেবীগন
মিলে দেবী দূর্গাকে বানিয়ে মর্তে পাঠালেন,
অনিষ্টকারী অসুরকে বধ করার জন্য...ততক্ষণে পুলিশ বাড়িতে ঢুকে পরে। সরি, না বলে ঘরে
ঢোকার জন্য। সাদার উপর রক্তজবা ছাপা একটি সার্ট মনোয়ারা বেগমের সামনে মেলে ধরে বলে,
চিনতে পেরেছেন?
অস্ফুট স্বরে ঢোক গিলে বলে, জ্বী এটা আমার ছেলের
সার্ট। বছর খানেক আগে আমার মেঝো মেয়ে রত্না ঈদে দিয়েছিল।’ পুলিশের হাত থেকে শার্টটি
নিয়ে শেষবারের মতো ছেলেকে অনুভব করে, এই প্রথম মনোয়ারা বেগমের চোখ ভিজে ওঠে..আবেগ সংবরণ
করতে না পেরে সত্যটা মুখ ফসকে যায়, আমিই তাকে পাপী বানিয়েছিলাম, আমার অপত্য স্নেহের
জন্য সে পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল... দিনের পর দিন তার অপরাধ
নির্বিচারে ক্ষমা করে তার অপরাধ প্রবণতাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমি নিজ হাতে তাকে হত্যা
করেছি..
পুলিশ মনোয়ারা বেগমকে শয্যাশায়ী ও বিলাপ করতে দেখে
ভাবে, আহারে! শোকে
বিলাপ করছে। তাই সহানুভূতির স্বরে বলে, আপনি মারবেন কেন? সে গত রাতে হাই ওয়েতে অ্যাকসিডেন্ট
করেছে। ট্রাকের নিচে মাথাটা পড়ায় ভসকে গিয়েছিল বলে চেহারা সনাক্ত করতে পানি নি। পকেটে
ভোটার আইডি কার্ড থেকে ঠিকানা নিয়ে এখানে এসেছি। লাশ এখন পোস্টমর্টেমের জন্য ঢাকায়।
ফর্মালিটি শেষ হলে আপনারা নিয়ে আসতে পারেন।
পুলিশের কথাগুলো মনোয়ারা বেগমকে নির্বাক করে দিল।
তাকে কেউ বিশ্বাস করছে না দেখে বিশ্বাস করাবার সকল পন্থা ব্যর্থতায় মুখ ঢাকে। পুলিশ
চলে যাবার পর তাদের ফিরিয়ে কিছু বলতে চায়, সব খুলে বললে পুলিশ হয়তো ভিটা খুড়ে ছেলেকে
তুলে কাটাছেড়া করবে, কী দরকার! তার চেয়ে শান্তিতে ভিটাতেই ঘুমাক! সে পাশ ফিরে শোয়।
ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাসে ছেলের ব্যাগ চুরি গিয়েছিল মাসখানেক আগে;
তখনই ভোটার আইডি কার্ড খোয়া গেলে কতদিন ছেলেকে তাগাদা দিলেও ভ্রুক্ষেপ করেনি।
গতরাতের ঘটনা তার কাছে কিছুটা বিভ্রম অথবা স্বপ্ন
বলে মনে হয়। আজই কেন এরকম ঘটল! অথবা গতরাতে কোন ঘটনাই ঘটে নি। সবই তার হেলোসিনেশন!
দুর্বলতার কারনে ভাবনাগুলোকে দূরে সরিয়ে এখন বিপদ মুক্ত ভাবতে চোখে রাজ্যের ঘুম এসে
জড়ো হয়; পাছে তার এই দুর্বলতা ধরা পরে যায়, তাই যতদ্রুত সম্ভব দৃষ্টিকে সকলের আড়াল
করে বন্ধ করল। তখন গৌরাঙ্গের স্ত্রী কি মনে করে মনোয়ারা বেগমের পায়ের নিচে পড়ে মা মা
বলে ঢুকরে কেঁদে উঠল!
No comments:
Post a Comment