জলের ক্রন্দন
গাঁয়ের দক্ষিণ
রেখায় ঝুমকোলতায় থোকা থোকা ফুল ফুটলে তুমি আন্দোলিত হও। তোমার সেই মুগ্ধতা গ্রাম
পেরিয়ে গ্রামান্তরে পরিব্যপ্ত হলে আমার জ্বর আসে। তোমাকে অদ্ভুত কিছু ভাললাগার
অনুভূতি জানাতে চাই। এই যেমন, কালরাতে মেহেন্দীর গন্ধে আমার
নিদ্রা টুটে গেলে সারারাত এক জ্যোৎস্না কবলিত মাঠে বসে ছিলাম; কিংবা নদীর ধার ঘেঁষে অলৌকিক শুদ্ধতা নিয়ে যে মানবী দাঁড়িয়ে আছে সে আমার মৃত
বোন। এরকম অজস্র দৃশ্য চিত্রের কথা তোমাকে
লিখতে চাই। তবে লেখা হয়ে উঠে না, কেননা, আমার
বানান ভুল হলে তুমি রাগ করো। অথচ মহাপৃথিবীর মহাসৃষ্টি জুড়ে যে অজস্র ভুল বানানের ছড়াছড়ি তা তুমিও যেমন জানো, আমিও জানি। মহাপৃথিবীর মহাগ্রন্থের অজস্র বানান ভুল আমার ভুল বানানের কাছে
কিছুই নয়। তুমি অনুধ্যায়ী হয়েছ মহাগ্রন্থের বানান ভুল শুধরে দিতে। পিরামিড স্কিংস
এর ভুল বানান রোধ করতে করতে তোমার কলমের দজলা-ফোরাতের কালি নিঃশেষিত প্রায়।
আফ্রিকার গহীন জঙ্গলে ঈশ্বরের বিভ্রমে যে আধা জন্তু আধা মানুষের জন্ম তাও তুমি
জ্ঞাত আছো। তুমি কি জ্ঞাত আছো বংশাই নদের জল ঘোলা হয় কেন ভরা বর্ষায়? কিংবা দুই নদীর জল কখনো এক রকম হয় না কেন? আমি জানি
তুমি এসব প্রশ্নের উত্তর জানো। তবু তোমাকে জানাতে ইচ্ছে করে খুব। তবে, তুমি ইচ্ছে করলেই জগতের মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারো না, যেমন পারো না আমার বানান ভুল রোধ করতে।
তীব্র ভালোলাগা এখন আমার
ভেতর। কোথায় যাই বলো তো! নগরীর ওই পুরাতন বৃক্ষটি পাতা ছুঁয়ে আসতে ইচ্ছে করছে খুব।
পৃথিবীর কোথাও কি লায়ন লিলিগুচ্ছ সৌরভ ছড়াচ্ছে! কী জানি!
নিজেকে সেই আকাডিয়ান কন্যা
মনে হচ্ছে। আজ থেকে চার হাজার তিনশত বর্ষ পূর্বে সুমেরু কন্যা আকাডিয়ান রাজকুমারী;
রাজমন্দিরের প্রধান পুরোহিত এনহেদুয়ানা চন্দ্রদেবী নান্নার
সম্মুখে উপস্থিত হয়েছেন।
‘হে আমার দেবী; আমি একান্ত অনুরক্ত তোমার। উপস্থিত হয়েছি সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে;
এই রাজ্যের বিদুষী রাজকন্যা এক।
কেবল তোমার উপাসনা করি এবং করে যাবো চিরদিন। জেনে রেখো,
আমিই একমাত্র এবং বিশ্বস্ত
পূজারী। যদি এক ফোঁটা অনুগ্রহ বর্ষিত না হয়, যদি বিস্মৃত হও আমাকে তবুও সমস্ত যজ্ঞ তোমার। কেননা তোমার
সর্বোচ্চ শাস্তি প্রত্যক্ষণের অভিজ্ঞতা আমার আছে।’
তুমি তো জানো,
এই মন্ত্র উচ্চারণের মুহূর্তে নতুন করে বাক দেবীর প্রাণ
প্রতিষ্ঠা হলো। তবু তোমাকে একথা আবার জানাতে চাই, জানাতে চাই, কী নিমগ্নতা আর ধ্যানস্থ হয়ে তিনি উচ্চারণ করেন এই মন্ত্রগুলো। তার উচ্চারণে
ঝরে পরে আভিজাত্য, সৌন্দর্য আর
শুদ্ধতা। কবিকূল জননী তিনি। তবু তোমাকে তা বলা হয় না। বানান ভুল হওয়ার ভয়ে তোমাকে জানাতে পারিনা কবি
চন্দ্রাবতীর প্রেমিক, কৈশোরসঙ্গী
জয়ানন্দ কেমন করে মুহূর্তের মধ্যে পিছু নেন। চন্দ্রাবতীর বিয়ের লগ্ন প্রায় হয়ে
এসেছে, অথচ জয়ানন্দ তখন
নৌকায় করে জল-পরিভ্রমণ করছেন। নৌকার ছইয়ের ভেতর এক মায়াবতী শুয়ে আছে। বৃদ্ধ মাঝি
দাঁড় টানছে। কনক গোঙুলী তখন। মাঝি তার মেয়েকে ডাকে পালের দড়িটা ধরতে। সেই মেয়ে ওঠে,
দু’পায়ের আঙুলে ভর করে পালের দড়িতে টান দেয়। পূবের হাওয়ায় উড়ছে তার শাড়ি। জয়ানন্দ
দ্যাখে, মেয়েটির নাকের
পাটায় জোনাকির ফোঁটা। অলীক আলোয় সেই নারী জোয়ারি জলের ওপর। তার সেই মুহূর্ত নদী
হয়েই তাকে ডুবে মরতে বলছে।
এই তো মাহেন্দ্রক্ষণ! এমন সময়
অনন্তেও আসে না কিংবা কদাচিৎ আসে। জয়ানন্দ মুহূর্তের পিছু নেন। আর ভাটিতে পড়ে থাকে তার বিদুষী প্রেমিকা
চন্দ্রাবতী। চন্দ্রাবতী তখন কী করেন! চন্দ্রাবতী! কবি তিনি। তিনি জানেন কী করে
শোককে পরিণত করতে হয় শক্তিতে। তিনি রচনা করেন সীতার বারোমাসি। সম্পূর্ণ নতুন করে।
যে সীতা কেবলই এক মানবী। চন্দ্রাবতী তাকে রামায়নের নারী থেকে আলাদা করেছেন। এসব
কথা তুমি জানো, তবু বারংবার
তোমাকে জানাতে ইচ্ছে হয়।
কেবল জানো
না, চাঁদের লাগোয়া ঘরে বাস করে এক
চন্দ্রাবতী নারী
কালীগঙ্গার ঢেউয়ের ভেতর থেকে সুর ভেসে আসে - সময় গেলি সাধন হবে না।কেউ প্রশ্ন করে, এমন ঘুটঘুইট্যা আন্ধারে
কই যাও কন্যা?
কে প্রশ্ন করে আমি তারে দেখি না। তবু বলি, আমি আমার সাঁইজির তালাশ
করি।
তাঁর খোঁজ কি আর এমনি
এমনি পাওয়া যায়? তাকে পেতে হলে ডুব দাও কালীগঙ্গায়, মন ভাসাও হৃদ যমুনায়।
দ্যাখো, জল বাড়ছে বংশাইয়ের।
জোয়ারের জল আসতেছে। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো জোয়ারের ডাক! জলের শব্দ!
পাগল! এতো জলের শব্দ নয়; জলের কান্দন। এমন কান্দন
তোমার ভেতরেও আছে। তখন তুমি ঘর-বাহির করো, নিমবৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে থাকো তখন তোমার ভেতর কান্দনের সুর ওঠে। তুমি
বুঝতে পারো না। তাই অমন অস্থির হয়ে উঠো।
‘জলের কান্দন’-এর কথা তোমাকে বলা হয় না। তুমি তো জানো, আমার জন্মগৃহে রাহু আর কেতুর অবস্থান। তাই কন্যা লগ্নে জন্ম নিয়েও খুব
সহজে কোনো কিছুর প্রাপ্তি ঘটে না আমার। আর ভাগ্যরেখা সোজা উঠে গেছে চন্দ্রক্ষেত্র
থেকে শনির ক্ষেত্রর দিকে। তাই চন্দ্র প্রসন্ন হলেই আমি কেবল মহাপৃথিবীর মহাপথগুলো
পাড়ি দিতে পারি।
আর তাই ‘পুরণমাসি’রাতে প্রার্থনা পড়ি
হে চন্দ্র, হে আমার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক, তুমি প্রসন্ন হও, আমি তো তোমারই কন্যা
চন্দ্র প্রসন্ন হোন কি
হোন না ঠিক বুঝতে পারি না।
তবু, তোমাকে আমার জীবনের
যাবতীয় বানান ভুলের কথা লিখে যেতে চাই; আমার কী দোষ বলো, ঈশ্বর যদি ভুল বানানে আমার জীবনগাঁথা লিখে রাখেন!
...একদিন আমাদের গাঁয়ের বাঁশঝাড়ে নিরাধারা কান্না করে চৈত্রের বাতাস। নিভৃত
গন্ধমের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ে নৈঋতে নৈঋতে। দক্ষিণের ভিটায় ঘুঘুর ডাক প্রলম্বিত হয়।
আমরা ভীত হই। সমস্বরে জপ করি ঈশ্বরের নাম। সেই দিবালোকে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসে; দিনের আলোয় রাত্রি নেমে
এলে আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা কিয়ামত আসন্ন ভেবে আমাদের আগলে রাখেন। ঝড় ও ঝঞ্ঝায় উড়ে
যায় ঢেউটিন। আমাদের রক্তপ্লাবিত কাটা স্কন্ধ পড়ে থাকে ফসলী ক্ষেতে। কেউ কেউ বেঁচে
থাকে কিংবা পুনর্জন্ম লাভ করে। তারা ঈশ্বরের নামে গৃহ বানায়; জমিতে হাল দেয়।
আর
আমি !
জন্ম নিচ্ছি পুনর্বার, আপন উদর হতে ক্রমশ নতুন। প্রগাঢ় অন্ধকারে ডিম ভেঙে জন্ম নিলে সূর্য ও
কুসুম, আমিও খোলস ভেঙে ফেলি। আমি নীত হচ্ছি নতুন এক
শহরে। এ কোনো মৃতের নগরী নয়। এইখানে প্রতিদিন জন্ম নেয় জীবনের রেণু। আরো একবার
কোনো এক পুষ্প ভোরে আমার মৃত্যু হলে এইখানে ছিলাম আমি। এই বর্ষণসিক্ত পথ, পিচ্ছিল পাহাড়ি পথ আমার চেনা। ঘনবর্ষা আবেগ ঝরায় দুর্বার ধার ঘেঁষে।
পৃথিবীর কোথাও কি তবে জীবনের আকাঙ্খা ছিল! এখন মহাকাল গুটিয়ে নিয়েছে তার ডানা
বিপন্ন বিষাদে। এখন বিসর্জিত অস্তিত্ব আমার ধাবমান অনস্তিত্বের দিকে।
এখন সকাল নয়
সন্ধ্যা নয়,
দিন কিংবা রাতও নয়
নিয়মও স্থিরতম
মন্দিরের ঘন্টাগুলো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে লাফিয়ে
লাফিয়ে ...
No comments:
Post a Comment