“জল পড়ে পাতা নড়ে”
দিয়ে একদিন যে শিশু কবির অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বর্ষা ঋতুর সঙ্গে অতি
শৈশবে,
সে সম্পর্ক জীবনের নানা তরঙ্গাভিঘাতের পরেও অবিক্ষত থেকে গিয়েছিল।
কবি রবীন্দ্রনাথের জীবনে ছয়টি ঋতুর বর্ণ-রূপ-রস চিরটাকাল গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার
করেছিল। প্রকৃতির কবির অন্তরাত্মার সঙ্গে ঋতুপর্যায় তাদের তাল-লয়-ছন্দে বাঁধা পড়ে
গিয়েছিল। বসন্ত ঋতু ঋতুরাজ বলে কথিত হলেও রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্ষাই যেন ছিলো
ঋতুরাজ। একদা অতি শৈশবে বৃষ্টির সেইযে বিশেষ তাল, লয় আর
ছন্দের পতন, আর তার সঙ্গে তরুলতার পাতার বর্ণিল ছন্দময়
নড়ে ওঠা শিশু কবির মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা আজন্ম বন্ধনে কবিকে বেঁধে ফেলে।
প্রতিটি ঋতুর নিজস্ব খেয়ালীপনা কবির মনে নানা রঙের দোলা দিলেও বর্ষার সঙ্গে
সর্বাপেক্ষা গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের। তাই “জল পড়ে পাতা নড়ে” এরপর
কবিকে “বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এলো বান” যেন অন্তরে অন্তরে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
বৃষ্টির বর্ণবৈচিত্রে মুগ্ধ কবি দেখেন-
ও
পারেতে বিষ্টি এলো, ঝাপসা গাছপালা।
এ
পারেতে মেঘের মাথায় এক শো মানিক জ্বালা।
শৈশবের এই অদ্ভুত
দেখা ও জানা ক্রমে ক্রমে বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে ‘নব নব রূপে ...’ বর্ষাকে অনুভূতির
পরতে পরতে জানা ও বুঝার মাধ্যমে চিরকালীন করে বেঁধে রাখতে লাগলো। বিদ্যাপতি
চণ্ডীদাসের মরমী বৈষ্ণব পদাবলী শুনে শুনে আনমনা উদাসী কবি ভাবুক তন্ময় বৈষ্ণব
পদকর্তা যেন হয়ে যান। লিখে ফেললেন 'ভানুসিংহের পদাবলী'। এখানেও বর্ষার অনিবার্য পদ সঞ্চার,
“শাওন গগনে ঘোর
ঘনঘটা,
নিশীথ যামিনী রে।
কুঞ্জপথে,সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।
উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকত বিদ্যুত,পথতরু লুণ্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ।
ঘন ঘন রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম বরখত নীরদপুঞ্জ”।
কুঞ্জপথে,সখি, কৈসে যাওব অবলা কামিনী রে।
উন্মদ পবনে যমুনা তর্জিত, ঘন ঘন গর্জিত মেহ।
দমকত বিদ্যুত,পথতরু লুণ্ঠিত, থরহর কম্পিত দেহ।
ঘন ঘন রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম বরখত নীরদপুঞ্জ”।
'শ্রাবণ আকাশে মেঘের ঘোরতর সজ্জা, নিশীথ অন্ধকার রাত্রি । শ্রীরাধা এমনি রাত্রিতে প্রিয়তম শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলনের জন্য কুঞ্জ অভিসারে কিভাবে যাবেন? বাতাস যেন পাগলপারা হয়ে যমুনার জলকে তর্জন করছে, কিছুক্ষণ পর পর মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে, চমকাচ্ছে বিদ্যুৎ,লুটিয়ে পড়েছে পথে বৃক্ষরাজি, থরথর কাঁপছে শরীর। মেঘপুঞ্জ ঘন ঘন রিমঝিম বৃষ্টি বর্ষণ করেই চলেছে।' কী অপরূপ রাত্রিকালীন বর্ষার বর্ণনা! কিশোর কবির ভাষা যেন কালো ক্যানভাসে গভীর রাতের বর্ষার ভয়ঙ্কর সুন্দর ছবি এঁকে চলেছে আনমনে!
বর্ষা ঋতু মানব মনের গহীনে উথালপাথাল কাণ্ড কারখানা ঘটিয়ে আনমনা যেমন করে তেমনি অনির্বচনীয় এক বেদনার আস্তরণও ছড়িয়ে দেয়। আবার বিদ্যুল্লেখার উজ্জ্বল আঁকাবাঁকা তড়িৎ গতির আনন্দ ছবিও যেন এঁকে দেয়। এই প্রসঙ্গে কবির পরবর্তীতে লেখা গানের প্রথম দুটি চরণ উদ্ধার করা যেতে পারে,
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।। ...
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।। ...
জীবনস্মৃতিতে
রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন যে , জীবনের এক একটা পর্যায়ে এক একটা
ঋতু বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে । সেই হিসেবে বাল্যকালের উপর বর্ষা ঋতুর প্রভাব
লক্ষণীয় ।
কবি বলেন, "বাল্যকালের দিকে যখন তাকাইয়া দেখি তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া মনে পড়ে তখনকার বর্ষার দিনগুলি বাতাসের বেগে জলের ছাঁটে বারান্দা একেবারে ভাসিয়া যাইতেছে, সারি সারি ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ হইয়াছে, প্যারীবুড়ি কক্ষে একটা বড় ঝুড়িতে তরিতরকারি বাজার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে জলকাদা ভাঙ্গিয়া আসিতেছে, আমি বিনা কারণে দীর্ঘ বারান্দায় প্রবল আনন্দে ছুটিয়া বেড়াইতেছি।আর, মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি; দরমায় ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাশ বসিয়াছে ; "... এরপর রবীন্দ্রনাথের বর্ণনাতে বর্ষা ঋতু জীবন্ত মূর্তি পরিগ্রহ করে ভয়ানক সৌন্দর্যে সামনে এসে দাঁড়ালো, "অপরাহ্নে ঘনঘোর মেঘের স্তুপে স্তুপে আকাশ ছাইয়া গিয়াছে ;দেখিতে দেখিতে নিবিড় ধারায় বৃষ্টি নামিয়া আসিল;থাকিয়া থাকিয়া দীর্ঘ একটানা মেঘ- ডাকার শব্দ ; আকাশটাকে যেন বিদ্যুতের নখ দিয়া একপ্রান্ত হইতে আর - এক প্রান্ত পর্যন্ত কোন্ পাগলি ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া ফেলিতেছে ;বাতাসের দমকায় দরমার বেড়া ভাঙ্গিয়া পড়িতে চায় ; অন্ধকারে ভালো করিয়া বইয়ের অক্ষর দেখা যায় না, পণ্ডিতমশায় পড়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন ; বাহিরের ঝড় বাদলটার উপরেই ছুটাছুটি মাতামাতির বরাত দিয়া বন্ধ ছুটিতে বেঞ্চির উপরে বসিয়া পা দুলাইতে দুলাইতে মনটাকে তেপান্তরের মাঠ পার করিয়া দৌড় করাইতেছি। আরো মনে পড়ে শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘুমের ফাঁকের মধ্য দিয়া ঘন বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মনের ভিতরে সুপ্তির চেয়েও নিবিড়তর একটা পুলক জমাইয়া তুলিতেছে;..."। প্রসঙ্গত মনে পড়ে কবির বিরচিত বর্ষা সঙ্গীতের কথা,
কবি বলেন, "বাল্যকালের দিকে যখন তাকাইয়া দেখি তখন সকলের চেয়ে স্পষ্ট করিয়া মনে পড়ে তখনকার বর্ষার দিনগুলি বাতাসের বেগে জলের ছাঁটে বারান্দা একেবারে ভাসিয়া যাইতেছে, সারি সারি ঘরের সমস্ত দরজা বন্ধ হইয়াছে, প্যারীবুড়ি কক্ষে একটা বড় ঝুড়িতে তরিতরকারি বাজার করিয়া ভিজিতে ভিজিতে জলকাদা ভাঙ্গিয়া আসিতেছে, আমি বিনা কারণে দীর্ঘ বারান্দায় প্রবল আনন্দে ছুটিয়া বেড়াইতেছি।আর, মনে পড়ে, ইস্কুলে গিয়াছি; দরমায় ঘেরা দালানে আমাদের ক্লাশ বসিয়াছে ; "... এরপর রবীন্দ্রনাথের বর্ণনাতে বর্ষা ঋতু জীবন্ত মূর্তি পরিগ্রহ করে ভয়ানক সৌন্দর্যে সামনে এসে দাঁড়ালো, "অপরাহ্নে ঘনঘোর মেঘের স্তুপে স্তুপে আকাশ ছাইয়া গিয়াছে ;দেখিতে দেখিতে নিবিড় ধারায় বৃষ্টি নামিয়া আসিল;থাকিয়া থাকিয়া দীর্ঘ একটানা মেঘ- ডাকার শব্দ ; আকাশটাকে যেন বিদ্যুতের নখ দিয়া একপ্রান্ত হইতে আর - এক প্রান্ত পর্যন্ত কোন্ পাগলি ছিঁড়িয়া ফাড়িয়া ফেলিতেছে ;বাতাসের দমকায় দরমার বেড়া ভাঙ্গিয়া পড়িতে চায় ; অন্ধকারে ভালো করিয়া বইয়ের অক্ষর দেখা যায় না, পণ্ডিতমশায় পড়া বন্ধ করিয়া দিয়াছেন ; বাহিরের ঝড় বাদলটার উপরেই ছুটাছুটি মাতামাতির বরাত দিয়া বন্ধ ছুটিতে বেঞ্চির উপরে বসিয়া পা দুলাইতে দুলাইতে মনটাকে তেপান্তরের মাঠ পার করিয়া দৌড় করাইতেছি। আরো মনে পড়ে শ্রাবণের গভীর রাত্রি, ঘুমের ফাঁকের মধ্য দিয়া ঘন বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ মনের ভিতরে সুপ্তির চেয়েও নিবিড়তর একটা পুলক জমাইয়া তুলিতেছে;..."। প্রসঙ্গত মনে পড়ে কবির বিরচিত বর্ষা সঙ্গীতের কথা,
পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন জেগে
উঠে...
কিংবা,
আজি ঝরোঝরো মুখর
বাদরদিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না। ...
সঙ্গীত শিল্পী রবীন্দ্রনাথ ঋতু বিষয়ক অনেক অনেক সঙ্গীত রচনা করেছেন। সম্ভবত এই সঙ্গীত তালিকায় বর্ষা পর্যায়ের সঙ্গীতই প্রাধান্য লাভ করবে। ঋতু পর্যায়ের বর্ষা সঙ্গীত ছাড়াও প্রচুর সংখ্যায় বর্ষা বিষয়ক সঙ্গীত কবিগুরুর গীতিনাট্য, নৃত্যনাট্যগুলিতে যুক্ত আছে। এখানে কবিগুরুর 'জীবনস্মৃতি ' বইটি থেকে বর্ষা বিষয়ে উদ্ধার করা অংশটির দুটি মর্মবাণী আমরা উল্লেখ করতে পারি। প্রথমত এই আলোচনায় বাল্যকালে বর্ষার প্রভাব মানুষের উপর বেশি পড়ে বলে কবি স্বয়ং মনে করেন এবং কবির দৃষ্টিতে বাল্যে অনুভূত বর্ষার ভয়ঙ্কর উন্মাতাল রূপ। আর দ্বিতীয়ত কবির উপরে বর্ষার সুগভীর প্রভাব।
প্রকৃতি প্রেমিক
কবি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ইংরেজি সাহিত্যের কবি Wordsworth - এর তুলনা করা হয়।
তেমনি বর্ষাপ্রেমিক কবি রবীন্দ্রনাথের উপর সংস্কৃত সাহিত্যের মহাকবি কালিদাসের
গভীর প্রভাবের কথা অনস্বীকার্য। বাল্যকাল থেকে কালিদাসের অমর কীর্তি মেঘদূতম্ কাব্যের
প্রভাব রবীন্দ্রনাথের উপর পড়েছে। বড়দাদা উদাত্ত কণ্ঠে মেঘদূতম্ কাব্য যখন
আবৃত্তি করতেন, তখন কিশোর রবীন্দ্রনাথ অদূরে দাঁড়িয়ে
মুগ্ধ চিত্তে তা শুনতেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের পত্নী, রবীন্দ্রনাথের নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী মাত্র দুবছরের বড় ছিলেন কবির
থেকে। নয় বছরের বালিকা যখন ঠাকুর বাড়ির বৌ হয়ে এলেন, তখন
দুবছরের ছোট কবির সঙ্গে হৃদ্যতার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই নতুন বৌঠানের সঙ্গে ছাদে
বসে মুগ্ধ হয়ে কবি জ্যোতিরিন্দ্রনাথের কণ্ঠে মেঘদূতের পাঠ শুনতেন। রেকাবিতে রাখা
সিক্ত যূথীর গন্ধ কবির মনকে বহু যুগের ওপারে কালিদাসের যুগে যেন নিয়ে যেতো।
কালিদাসের সঙ্গে, বিশেষ করে মেঘদূতম্ কাব্যের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যোগাযোগ শৈশব থেকেই।
বড় দাদার কণ্ঠে মেঘদূতমের তন্ময় পাঠ কিংবা কাদম্বরী দেবীর সঙ্গে বসে মেঘদূতমের পাঠ
শ্রবণের আগেরও ইতিহাস আছে রবীন্দ্র জীবনে বর্ষার সঙ্গে। ' জল পড়ে পাতা নড়ে ' দিয়ে বর্ষা ভাবনার, দর্শনের যে সূচনা অতি শৈশবের দিনগুলিতে তা যেন রবীন্দ্রনাথের জীবনের অগ্রগতিব
বাঁকে বাঁকে নব নব রূপে বিকশিত হয়েছে, পরিপুষ্ট হয়েছে।
বর্ষার মেঘসজ্জা আর অবিরাম ঝরো ঝরো বারিধারা সারাটা জীবনে কবিকে রসসিঞ্চিত
অভিষিক্ত করেছে!বহুযুগের ওপারে কবি
কালিদাস মেঘপুঞ্জের শোভা দেখে আনমনা হয়েছেন, চির বিরহী
সত্তার অনির্দেশ্য আবেগে লিখেছেন মেঘদূতম্ কাব্য। শাশ্বত বিরহ কাব্য হয়ে তা যুগ
যুগান্তরের পথ বেয়ে আজও বিরহের তরঙ্গ তুলে। "রামগিরি হইতে হিমালয় পর্যন্ত প্রাচীন
ভারতবর্ষের যে দীর্ঘ এক খণ্ডের মধ্য দিয়া মেঘদূতের মন্দাক্রান্তা ছন্দের জীবনস্রোত
প্রবাহিত হইয়া গিয়াছে, সেখান হইতে কেবল বর্ষাকাল নহে,
চিরকালের মত আমরাও নির্বাসিত হইয়াছি। "মেঘদূত নিবন্ধে
রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি প্রণিধান যোগ্য। সেই যুগ আর নেই, সেসব
জনপদ বধূরাও আজ আর নেই। এখন আর সে পটভূমিতে মেঘকে দূত করে পাঠাবার সুযোগ আমাদের
নেই।"মেঘ দেখিলে,সুখিনোহপণ্যথা বৃত্তি চেতঃ, সুখী লোকেরাও
আনমনা হয় এইজন্যই, মেঘ মনুষ্যলোকের কোন ধার ধারে না বলিয়া
মানুষকে অভ্যস্ত গণ্ডির বাইরে লইয়া যায়। মেঘের সঙ্গে আমাদের প্রতিদিনের চিন্তা
চেষ্টা কাজকর্মের কোনো সম্বন্ধ নাই বলিয়া সে আমাদের মনকে ছুটি দেয়। মন তখন বাঁধন
মানিতে চাহে না, প্রভুশাপে যক্ষের বিরহ তখন উদ্দাম হইয়া
উঠে। প্রভু ভৃত্যের সম্বন্ধ সংসারের সম্বন্ধ। মেঘ সংসারের এই সকল সম্বন্ধগুলোকে
ভুলাইয়া দেয়, তখনই হৃদয় বাঁধ ভাঙ্গিয়া আপনার পথ বাহির
করিতে চেষ্টা করে।"
[ কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ /ডঃ নরেন্দ্রনাথ জানা, পৃষ্ঠা ২০৫]
[ কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ /ডঃ নরেন্দ্রনাথ জানা, পৃষ্ঠা ২০৫]
বর্ষা ঋতু এমনি
সকলের উপর প্রগাঢ় প্রভাব ফেলে। বর্ষার সমাগমে সকলেই নিজের মনে এক অনির্দেশ্য বেদনাবিধুরতা আর বিরহ
বেদনা যেন অনুভব করে।প্রথম জীবনে মেঘদূতম্ রবীন্দ্রনাথের উপরও স্থায়ীভাবে বর্ষার
প্রভাব ফেলেছিল। আর এই প্রভাব জীবন ব্যাপী স্থায়ীত্ব লাভ করে। জমিদারী দেখাশোনার
দায়িত্ব পাবার পরে শিলাইদহ আর সাজাদপুরে রবীন্দ্রনাথ বোটে করে পদ্মা নদীতে দিনের
পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়েছেন। এই দিনগুলিতে
পল্লীবাংলার প্রকৃতি ও বর্ষার শ্যামল শোভন রূপচিত্রের অভাবনীয় প্রভাব
রবীন্দ্রনাথের উপর পড়ে। যে বর্ষা সারাজীবন কবিগুরুর উপর কোনও না কোনও ভাবে প্রবল
আধিপত্য বিস্তার করেছে এবং তাঁর সৃষ্টির যত্রতত্র প্রসন্ন মুখে উঁকিঝুঁকি দিয়েছে,
সেই বর্ষা কবির অনুভবে পদ্মাতীরের যাপিত বর্ষাদিনের অভিজ্ঞতায়
পরিপূর্ণ অবয়বে প্রকাশলাভ করেছে। এই অভিজ্ঞতা বাংলার বর্ষাকে পূর্ণায়ত মূর্তিতে
কবির প্রত্যক্ষগোচর যেমন করিয়েছে, তেমনি সমকালীন
পত্রসাহিত্যে ও বিশেষ করে ছোটগল্প সম্ভারে নব নব রূপে কবি ভাবনাকে পরিচালিত করেছে।
কবির সৃষ্টিতে এই বর্ষাভাবনা বর্তমান আলোচকের অভিমতে প্রকৃতিকেই যেন পৃথক সত্তায়,
চরিত্রে প্রতিস্থাপন করেছে। সমকাল ও ভাবীকালের লেখালেখিতে এই সময়
থেকে যেন একটা সুস্পষ্ট পরিবর্তনের মোড় পরিলক্ষিত হতে লাগলো।
রবীন্দ্রনাথ দুচোখ
মেলে পদ্মাবক্ষ থেকে পল্লী বাংলার সজল শ্যামল মোহনীয় রূপ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। এ যেন
এতোদিনের চেনা জানা জগৎ থেকে আলাদা। দূরে দিগন্তে ' তরুশ্রেণী মেঘে ঢাকা', বিদ্যুৎ
চমকাচ্ছে, মেঘগর্জন শোনাচ্ছে, গ্রামের
বধূটি লজ্জিত হয়ে ঘোমটা টেনে দ্রুতগতিতে কলসী কাঁখে চলে যাচ্ছে। বৃষ্টি নামলো
রিমঝিম। অপূর্ব! এই মেঘ, এই বৃষ্টি নাগরিক জীবন থেকে
একেবারে আলাদা। প্রবল স্রোতোময়ী পদ্মার পাড়ে শান্ত সমাহিত গ্রামের স্তিমিত জীবন!
সে জীবনে বর্ষার আগমন কদম, কেয়ার মঞ্জরিত পাপড়ি ছুঁয়ে,
গ্রামীণ জীবনে আন্দোলন তুলে বর্ষা আসে ' ঐ অতি ভৈরব রভসে'!
"একদিন বর্ষাকালে
মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ- তপ্ত সুকোমল বাতাস দিতেছিল;রৌদ্রে ভিজা ঘাস এবং গাছপালা হইতে একপ্রকার গন্ধ উত্থিত হইতেছিল ;মনে হইতেছিল, যেন ক্লান্ত ধরণীর উষ্ণ নিঃশ্বাস গায়ের উপর
আসিয়া লাগিতেছে... (পোস্টমাস্টার)
"একদিন ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছে। এমনি অন্ধকার করিয়াছে যে, ঘরের মধ্যে কাজকর্ম করা অসাধ্য। বাইরে ঝুপ্ ঝুপ্ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে।
কুলগাছের তলায় লতাগুল্মের জঙ্গল জলে প্রায় নিমগ্ন হইয়া গিয়াছে এবং প্রাচীরের
পার্শ্ববর্তী নালা দিয়া ঘোলা জলস্রোত কল্ কল্ শব্দে বহিয়া চলিয়াছে।
(মধ্যবর্তিনী)
বর্ষাকাল আসিল। ক্ষুধিত পদ্মা উদ্যান গ্রাম
শস্যক্ষেত্র এক এক গ্রাসে মুখে পুরিতে লাগিল। বালুকাচরের কাশবন এবং বনঝাউ জলে
ডুবিয়া গেল। পাড়ভাঙ্গার অবিশ্রাম ঝুপঝাপ শব্দ এবং জলের গর্জনে দশ দিক মুখরিত হইয়া
উঠিল,
এবং দ্রুতবেগে ধাবমান ফেনারাশি নদীর তীব্রগতিকে প্রত্যক্ষগোচর
করিয়া তুলিল।
(খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন)
(খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন)
রবীন্দ্রনাথ রচিত তিনটি ছোটগল্পে বর্ষার
প্রভাব যুক্ত তিনটি অংশ উদাহরণ রূপে সমাহৃত হলো। বর্ষা
ঋতু কবির অজান্তেই যেন তাঁর অন্তর সত্তায় স্থায়ী আসন গেড়ে বসেছিল। তাই রবীন্দ্র সঙ্গীতে ও সাহিত্যে সর্বত্রই তার
প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলার নবনীত কোমল প্রকৃতির সঙ্গে সর্বতাপহরা শ্যামল সজল
বর্ষার যে মধুর সম্পর্ক, ঠিক তেমনি কবি রবীন্দ্রনাথের
সত্তার সঙ্গেও যেন বর্ষার সম্পর্ক। তাই বুঝি কাকতালীয়ভাবে শ্রাবণের মেঘমেদুর
রিমঝিম বর্ষণমুখর দিবসে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাকবির মহাপ্রয়ানও হয়েছিল।
কাজরী,
২৩ জুলাই, ২০১৬
২৩ জুলাই, ২০১৬
No comments:
Post a Comment