-এক-
আষাঢ় মাস। সাগরে সক্রিয় লঘুচাপের প্রভাবে
দিনভর থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। রাত দশটার মতো বাজে। এখন যেটা হচ্ছে সেটাকে ঠিক
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও বলা যাবে না। ফিনফিনে মিহি জলের ছিঁটার মতো সূক্ষ্ম বৃষ্টি
হচ্ছে। এরই মধ্যে আপন মনে রাস্তায় হাঁটছে রাজিব। সুযোগ পেলেই রাজিব এমন মিহি
বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে হাঁটে। এটি রাজিবের
খুবই প্রিয় একটি কাজ। এসময় জীবন ও জগত সম্পর্কে অনেক ভাল ভাল চিন্তা ও দর্শন তার
মাথায় আসে। জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ে নানা জটিল বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে
এসব চিন্তা তাকে নাকি বেশ সাহায্য করে।
আজ রাজিবের বৃষ্টিতে ভেজার এমনই একটা
সুযোগ এসে যায়। বারডেমে গিয়েছিল এক অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে। ফেরার সময় দেখে এমন
বৃষ্টি। হাতেও সময় ছিল। তাই রিকশা না নিয়ে হাঁটতে শুরু করল। উদ্দেশ্য নীলক্ষেত।
নীলক্ষেতের তেহারী খেয়ে তারপর পলাশীর মেসে ফিরবে।
রাজিব হাঁটছে আপন মনে। মিহি জলের ছিঁটার
মতো বৃষ্টি হচ্ছে। এতটাই মিহি এই বৃষ্টি যে এর মধ্যে ঘন্টাদুয়েক হাঁটলেও দেখা যায়
শরীরের কাপড় তেমন ভিজে যায় না। মাথাটা কেবল ভিজে জবজব হয়ে যায়। হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ পাড় হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র
শিক্ষক কেন্দ্র হয়ে নীলক্ষেতের দিকে হাঁটতে শুরু করল রাজিব। রোকেয়া হল পাড় হয়ে
ভাষাতত্ত্ব ইনিস্টিটিউটের ফুটপাত ধরে হাঁটতে গিয়ে তার কেমন যেন একটু ভয় ভয় করছে।
সময়টা রমজান মাসের একেবারে শেষ দিকে। দুই দিন পর ঈদ। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে।
তার উপর এমন আষাঢ় মাসের বৃষ্টির দিন। এদিকটায় কোনো মানুষজনও নেই; এই মুহূর্তে কোনো রিকশা বা গাড়িও নেই।
হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে গিয়ে শিখসংগত গুরুদুয়ারা নানক শাহি। গুরু দুয়ারা শিখ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। এটি পার হয়ে গেলে একটু সামনে দেখা
যাচ্ছে কলাভবনের সামনের ফুটপাত। মাথার উপরে বড় বড় গাছ ঢালপাল বিস্তার করে আছে।
ঝিঁঝিঁপোকাদের একটানা ডেকে যাওয়ার শব্দ মাথার ভেতর ঝংকৃত হচ্ছে। কলা ভবনের মাঠে
জমে উঠা পানিতে মনের আনন্দে নেচে গেয়ে ফুর্তিতে মেতে উঠেছে একদল ব্যঙ। এই ব্যঙগুলো
সারা বছর কোথায় থাকে সে এক রহস্য রাজিবের কাছে। এসবের ভেতর দিয়ে একাকী হাঁটতে কেমন গা ছম ছম করছে রাজিবের! চিন্তা-ভাবনা গুলিয়ে যাচ্ছে। তারপরও হেঁটেই চলে সামনের দিকে। বড় বড়
গাছ ছাড়াও এখানটায় কলাভবনের প্রাচীর ঘেষে কিছু গাছ
ঢালপালা বিস্তার
করে ঝোপের মতো হয়ে ফুটপাতে পথচারীদের মাথা ছুঁয়ে দেয়। আচমকা
একটু সামনে এমনই একটা ঝোপের
নিচে একটা মানুষের মতো অবয়ব দেখতে পেল রাজিব। রাস্তার লাইটগুলো জ্বলছে না। কেন
জ্বলছে না সেই কারণ জানার উপায় নেই। লোডশেডিং নাকি লাইটগুলোই নষ্ট কে জানে। একটু দূরেই দেখা
যাচ্ছে মূর্তিটা। সাদা একটা অবয়ব দুলছে যেন। সাদা
অবয়বটার উপরে কাল একটা মুন্ডুর মতো দেখা যাচ্ছে।
ভয়ে রাজীবের গা ছমছম করলেও ফুটপাত থেকে
নেমে একটু পাশকাটিয়ে রাজীব এগোতে থাকে সেই অবয়বটির দিকেই। ভয় পেলেও মনে মনে নিজেই
নিজেকে প্রবোধ দেয়, ‘আরে ওটা হবে
কোনো একটা টোকাই ছেলে মেয়ে। তাছাড়া আর কী হবে!’
তারপর এগোতে এগোতে অবয়বটার ঠিক পাশটা
অতিক্রম করার সময় ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। তারপরও সন্দেহ দূর করতে সাহস করে একবার
ঘাড় বাঁকা করে সরাসরি তাকায় অবয়বটার দিকে। হাসল যেন ওটা।
একটা উষ্ণ
অনুভূতি শিড়দাঁড়া বেয়ে মস্তিষ্কে চলে যেতে যেতে আচমকাই বাস্তব বুদ্ধি ফিরে আসে যেন
রাজিবের। অবয়বটা আসলেই একটা মানুষের। মানে মানুষের বাচ্চা। একটা টোকাই কিশোরী।
হেসে হেসে আর নাচের ভঙ্গি করে রাজীবের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। মেয়েটিকে
দেখেই রাজিবের ধারণা হল, ‘হতভাগি বৃষ্টির
মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে কোনো পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। নিশ্চিত হওয়ার জন্য
প্রশ্নটা করেই ফেলল,
'যাবি?'
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল মেয়েটি।
মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল মেয়েটি।
মেয়েটার জন্য রাজিবের ভেতরে মমতা জাগে।
ভাল করে দেখে সে মেয়েটাকে। বুকপিঠ সব শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। আবারও প্রশ্ন করে,
‘তোর শরীরে তো
দেখছি কিছু নাই। পুরা কাঠবডি!’
‘আমাগো এই রহম
কাঠবডি দেইখাও তো আপনেরা বেডারা খালি খাবলাখাবলি করেন।!খালি পয়সা চাইলেই শরীরে মাংস খোঁজেন!’
‘তোর কি অনেক
ক্ষুধা পাইছে?’
‘হ, ক্ষিদা পাইছে দেইখাই তো এই কাঠবডি নিয়া এহানে খারাইছি, নাইলে পেডের যন্ত্রণা মিডাইমু কেমনে?পেডের যন্ত্রণা না মিডাইলে বাঁচুম কেমনে?আর আমারা না বাঁচলে আপনাগো বিষ মিডাইবেন কই? আপনাগো বিষ মিডানের লাইগাই আমরা বাইচা থাকুম।’
‘কোনো কাজটাজ
করতে পারিস না?’
‘এই যে রাস্তা-ঘাটের জিনিসপত্র টুকাইয়া বেচি এইডা কি কাম না? এক বস্তা টুকাইন্না মাল দিলাম মহাজনরে। হেয় কয় আইজকা টেকা
নাই। কাইলকা নিস। টেকা না দিলে খামু কী। টেকা দেয় না, আবার দোকানের ভিতরে যাইতে ডাকে! আর কী কাম করুম,
কেমনে করুম? আর কিছু কাম ত জানি না!
আপনে গো বিষ
মিডাই এইডা কি কাম না? এইডাও আমগো কাম! ভাবতাছেন এইডা আমগো সুখের?
না, এইডা আমগো কষ্টের কাম!
আমগোর এই কষ্ট
দেইখা আমগোরে যে সৃষ্টি করছে সেও কষ্ট পায়। আপনেরে আমারে তো একজনেই সৃষ্টি করছে।
আমগোরে খারাপ মনে কইরেন না।’
মেযেটার কষ্ট রাজিবকে ছুঁয়ে যায়। তার
কথাগুলো রাজিবকে গভীর ভাবনায় ফেলে দেয়। মানিব্যাগ বের করে একশ টাকার একটা নোট
মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল,
‘যা, কিছু কিনে খা গিয়ে।’
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে টাকাটা নিল। অন্ধকারেও
বুঝা গেল না মেয়েটির মুখের কোনো অভিব্যক্তি। রাজিব আর না দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল নীলক্ষেতের দিকে।
-দুই-
দোকানের ছোট্ট টেবিলে বসে বেশ আয়েশ করে
রাজিব তার প্রিয় খাবার তেহারী খাচ্ছিল। খাওয়া প্রায় অর্ধেক শেষ হয়েছে এমন সময় ঐ
তেহারীর দোকানের সামনেই বালিকাটিকে আবার দেখতে পেল সে। তেহারী কিনছে। বড়সড় একটা
ডেগ থেকে একটা কাগজের বোর্ডে তৈরী প্যাকেটের এক পেকেট তেহারী মেয়েটির হাতে দিল
তেহারীঅলা।
উৎসুক হল রাজিব। তাকিয়ে রইল মেয়েটির হাতের দিকে। এক শ’ টাকার নতুন একটা নোট তেহারীঅলাকে দিল বালিকা। রাজিব তাকে
একটা চকচকে একশ টাকার নোট দিয়েছিল। ঐ টাকাই সে দোকানদারকে দিয়েছে। মেয়েটিকে টাকাটা দেওয়ার পর থেকে রাজিবের ভেতর একটা খচখচানি কাজ করছিল
যে, সে মেয়েটিকে ভিক্ষাবৃত্তিতে উৎসাহিত করল কি না। এখন সে সম্পূর্ণ
নির্ভার বোধ করছে। মেয়েটি এই মুহূর্তে ক্ষুধার কষ্টে কাতর। সেই কষ্ট দূর করা তার
দায়িত্ব ছিল। বাকী ভিক্ষাবৃত্তি কিংবা পতীতাবৃত্তি থেকে মেয়েটিকে ফেরাতে সে
এককভাবে কী-ই বা করতে পারে। সেসব কাজের জন্য চাই
সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। তবে সমাজের একজন হিসেবে একটা দায় তারও আছে। সেটা সে
অস্বীকার করতে পারবে না।
রাজিব মনে মনে মেয়েটির একটি পরিচয় কল্পনা
করে। বাবার কথা কিছুই জানে না। একজনকে মা ডাকতো। একদিন তাকে ফুটপাতে ফেলে রেখে
কোথায় চলে গেছে আর ফিরে আসে নি। একটি মেয়ে শিশু;
বাবা নেই, মা নেই, পরিবার নেই, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রও এই শিশুটির পাশে নেই। কিভাবে মেয়েটি
আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছে সে নিজেও জানে না। বর্তমানটাই তার কাছে একমাত্র সত্য।
ভদ্রসমাজের রীতিনীতি, সভ্যতা-ভব্যতা, কাজকর্ম কিছুই
সে জানে না। যেন ফুলের একটি কলি অকালে ঝরে গেল বৃন্ত থেকে। যেই কলিটির উদগম হয়েছিল
মালির আদর যত্নে পূর্ণাঙ্গ ফুল হিসেবে প্রস্ফুটিত হওয়ার জন্য সেই কলিটি যখন অকালে
ঝরে পড়ে তখন সেটি আর মানুষের মনোযোগ পায় না। তখন সেটা আর সৌন্দর্যেও আধার থাকে না; ঝরাপাতা আর আগাছার সাথে চলে যায় আবর্জনার ভাগাড়ে। রাজিব
দেখল ভাংতি ফেরত নিয়ে মেয়েটি হাঁটতে শুরু করেছে আপন গন্তব্যে। কোথায় তার গন্তব্য
রাজিব জানে না। তার জানার কথাও না। তবে অনুমান করতে পারে, এই শহরের কোনো পথই তার ঠিকানা।
No comments:
Post a Comment