-“দেখো বিলু দা, এবার
তোমার একটা বিয়ে করা উচিত”।
হাতের ঘুড়িটায় আঠা লাগাতে লাগাতে অল্প হাসল
শৈবাল।
-“সত্যি মাইরি, কবে লরেট
দি চলে গেছে সব চুকিয়ে বুকিয়ে, তুমি এখনো মেমরি আঁকড়ে বসে
আছ”।
-“ফালতু না বকে কাঠি গুলো ধর”। মৃদু ধমক দিলো শৈবাল এবার।
-“সে ধরছি, কিন্তু...”
-চোপ!
মিইয়ে গেলো সুজন। খানিক বিড়বিড় করে শৈবালের কাজে
হাত লাগালো। বিশ্বকর্মা পূজো এসে গেছে,
আর কয়েকদিন। সুদাম মিস্ত্রি লেনে প্রত্যেক বারের মত এবারেও হবে
ঘুড়ির লড়াই। শৈবাল ছাড়া আর কে জিতবে। গত দুই বছর এতে তার একছত্র অধিকার। আর তার
সঙ্গী ক্লাস ইলেভেনের সুজন।
কগনিজেন্টের এই ইঞ্জিনিয়ারটার বই আর সিনেমার
পাশে পাশে অত্যন্ত তীব্র এই ঘুড়ি প্রীতির কথা অফিসে কেউ জানলে বেকুবের মত
ফ্যালফ্যাল করে দেখবে।
-“শৈবাল ঘুড়ি! ওয়াও! সো আনকমন!”
-“টিপিক্যাল নর্থ কোল্কাত্তাইয়া”
উফ,
লিপস্টিক রঞ্জিত ফর্ম্যালসে সজ্জিতা বিবি এবং মেটিরিয়ালিসমে
আচ্ছন্ন বাবুদের এই রিয়াকশান মনে এলে বিরক্ত লাগে।
লরেট যখন প্রথম শুনেছিলো, থুড়ি দেখেছিলো, বাদামী
চোখ দুটো চকচক করে উঠেছিলো। এক ছুট্টে ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলা শুরু। এখনো ওর ব্লগ
ঘাঁটলে দেখা যায়, কাইটস ইন নর্থ কোলকাতা, এ হেরিটেজ, এ প্যাশান অফ কালার। ঘুড়িতে লেজ
লাগাতে লাগাতে মন টা তিক্ততায় ভরে উঠতে লাগল আবার তার। দুই বছর হয়ে গেল,
এখনো বোকার মত ভুল ভাঙ্গার সময়টা বড় তিক্ততা
জাগায়।
*******
শৈবালের বাড়ি থেকে যখন সুজন বেরোলো তখন মোটামুটি
কার্য পদ্ধতি ঠিক করে ফেলেছে সে। বিলুদার ব্যাপারে সব ইনফর্মেশান সবই মোটামুটি
জানা। কবে কোথায় কি পাস করেছে, কিসে চাকরী করে, হবি কি কি...এমনকি কোন
কালারের জাঙিয়া কোনদিন পরবে সেটাও একটু চেষ্টা করলে জেনে ফেলবে। এবার একটা
প্রোফাইল শুধু।
হ্যাঁ ঠিক আছে, বিদেশের মেমসাহেবের মত ডানা কাটা পরী হবে না।
ওরকম ফরসা হবে না। কিন্তু বাঙালি মেয়েরাও বা খারাপ কিসে!
এখন বিলুদার যেটা দরকার, একটা পাশে থাকার মানুষ। তার আবার সুন্দর
অসুন্দর কি। তবে কিনা, বিলু দার সাথে একেবারে খেঁদি পেঁচি
মানাবে না।
লরেট মেয়েটা বড়ই সুন্দর ছিলো। আহা কতদিন মাঝ
রাতে ওকে ভেবে...এই মাইরি থাক। হাজার হোক বিলু দার এক্স। পায়ে পায়ে দীপ্তির বাড়ির
দিকে এগোতে থাকে সে। ম্যাট্রিমোনিয়াল প্রোফাইলে কি লিখতে হবে এটা তার পেটে বোমা
মারলেও বেরোবে না, দীপ্তিই
ভরসা। যেমন আরো অনেক কিছু দীপ্তি ছাড়া ভাবা যায় না জাস্ট।
********
ফোনটা অনেকক্ষণ থেকে ভাইব্রেট হচ্ছে শৈবাল জানে
সেটা, কিন্তু ধরার উপায় নেই।
প্রোজেক্ট ম্যানেজারের কচকচানি শুনতে হচ্ছে। ভাবা যায়, পূজো
আসি আসি করছে। বিশ্বকর্মা পূজোর দুই সপ্তাহ হয়ে গেল।এখনো প্রোজেক্ট, ক্লায়েন্ট মিট, শালা গ্লোবালাইজড শ্রমিক
তারা!!!
এমনিতে গত এক সপ্তাহ নিঝুম ডিপ্রেশানে কেটেছে।
কেউ বোঝেনি যদিও। সুজন শুধু বার দুয়েক খোঁচাতে এসে ঝাড় খেয়েছে। তার মধ্যে অফিসের
স্ট্রেস!
ম্যানেজারের থেকে ছাড় পেয়ে বেরিয়ে ফোনটা দেখলো
সে। আননোন নাম্বার। ক্লায়েন্ট নাকি?
কল ব্যাক করলো সে। গোটা দুই তিন রিং হওয়ার পর একটা মেয়ে ফোন
ধরলো।
-"শৈবাল দত্ত?"
বাপরে,
যেন ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলো!
-"বলছি।"
-"নমস্কার, আমি
অনন্যা।"
-"নমস্কার"
-"অচেনার মত কথা বলছেন কেন? কালকেই তো মেলে কথা হলো।"
-"অ্যাঁ?"
-"সরি?"
-"মানে না, মেলে
কথা হয়েছে কাল আপনার সাথে?আমার?"
-"হ্যাঁ, প্রমাণ
চান? আপনি পোস্ত বাটা খেতে ভালোবাসেন।"
-"ইয়ে মানে... কোথায় আলাপ যদি বলেন।"
-"অদ্ভুত!" মেয়েটা অসহিষ্ণু গলায় বলল, "ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে আলাপ। গত পরশু
আপনি আমাকে নক করেন।"
ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইট, গত পরশু নক, গত কাল
মেলে কথা। একটা অন্য সন্দেহ দানা বেঁধে ওঠে শৈবালের মনে। ওদিকে মেয়েটা হ্যালো
হ্যালো করে যাচ্ছে।
-"এক সেকেন্ড, আমি
আপনাকে পরে কল ব্যাক করছি। আসলে অফিসে আছি তো। সন্ধ্যের দিকে? কেমন?"
-"ওকে।"
কল ডিস্কানেক্টেড হওয়ার সাথে সাথে সুজনের
নাম্বার ডায়াল করলো সে। বার দশেক রিং হওয়ার পর সুজন হ্যালো বলার সাথে সাথে খুব
মোলায়েম স্বরে বলল, "কাজ টা কি ঠিক হলো বাপ?"
ঐ প্রান্ত চুপ করে রইলো, গলায় একটু রাগ এনে এবার শৈবাল বলল,
"এটা কিন্তু কাইন্ড অফ হিউমিলিয়েট করা আমাকে। তাই না সুজন?"
-"বিলু দা..."
-"ধরে নিয়েছিস বিলু দার বিয়ে ছাড়া আর কিছু
করার নেই!"
-"আই এম সরি বিলু দা।" বাঁধ ভাঙ্গা
বন্যার মত অ্যাপোলজি ভেসে আসতে শুরু করেছে তখন, "আমি
আসলে, আসলে তোমাকে একা দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না। মনে
হয় তুমি কষ্টে আছ। সেই লরেট দি চলে যাওয়ার পর থেকে...তোমাকে আজ অনেক দিন চিনি...
কিরকম গুটিয়ে গেছ।" শেষ দিকে গলাটা কেমন কাঁদো কাঁদো হয়ে আসে...
চোখটা জ্বালা করে ওঠে শৈবালের, রাগ তেমন হয়নি, খারাপ
লাগাটাও গলতে শুরু করে। ফোনটা কান থেকে নামিয়ে স্ক্রিনে ছবিটা একবার দেখে সে। পাগল
ভাইটা তার। এত্ত ছেলে মানুষ!
তারপর ফোন কানে নিয়ে বলল, "পার্টনার ইন ক্রাইম কে? দীপ্তি ম্যাডাম?
আবছা উত্তর এলো ঐ প্রান্ত থেকে, হুঁ...
হুঁ শুনে হাসি পেয়ে গেল শৈবালের, মন খারাপ, নিঝুম
ডিপ্রেশানও ভ্যানিশ হতে লেগেছে তখন,গলায় ছদ্ম রাগ মিশিয়ে
বলল–“দুটোয় মিলে আজ সন্ধ্যে সাতটায় বাস্কিন রবিন্সের
সামনে দাঁড়াবি, তোদের বেশ ডিলাইটফুল পানিশমেন্টের
ব্যবস্থা করতে হবে!!”
তারপর সুজনের মুখের অবস্থা কল্পনা করে হাসতে
হাসতে কিউবিকলের দিকে এগিয়ে গেল সে,
নাহ, আজকের কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করে
ফেলতেই হবে।
___________
No comments:
Post a Comment