কোথায় কি!

08 October 2016

শাশ্বত নিপ্পন





মশারি থেকে বেরিয়ে শোয়ার ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দাটা থপথপ পায়ে পার হয়ে বাথরুমের সুইচে হাত রাখল ওসমান। উজ্জ্বল আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে যায় নিমেষেই। বাথরুমে ঢুকে পানির ট্যাপটা চালু করতে গিয়েই বুঝতে পারে তার হাত কাঁপছে। কাঁপা হাতে ট্যাপটা ঘোরাতেই কলকলিয়ে পানি এসে লাল আরএফএলের বালতিতে জমে থাকা পানিতে পড়তে থাকে। পানি পতনের শব্দে রাতের জমাট নিস্তব্ধতা খান খান হয়ে যায় মুহূর্তেই। ওসমান তার মাথা ও ঘাড় পানিতে ভেজায়। বুকের ধুকধুক আর মাথার দু’পাশের দপদপানিটা এখনো টের পাচ্ছে। বুঝতে পারে, সবই উত্তপ্ত স্নায়ুর প্রভাবে ঘটছে। কাকের ডাক সে শোনেনি, তাছাড়া এত রাতে কাক ডাকেও না। টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি ঢালে। তারপর সিগারেট জ্বালায়। এখনো মাথার দু’পাশের শিরা দুটো দপদপ করছে। জানালা খুলতে ভয় হয়। মনে হয়, জানালা খুললেই দেখবে একটা কাক! স্থির চোখে তাকিয়ে আছে আর চাপা স্বরে ডাকছে। তার আতঙ্ক আরও বাড়ে। ওসমানের বাড়ি এখন ফাঁকা। বউ দিপা মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। আসবে ঈদের পর। তারও যাওয়ার কথা আছে ঈদের আগে আগে। কিন্তু সব রুটিন এখন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সারা মাসের নির্ধারিত কাজগুলো ভুলে যেতে বসেছে ওসমান। কিছুই ঠিক রাখতে পারছে না এখন। কী রাতে কী দিনে- ঘুম নেই তার। কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না সে। সামান্য ছোট একটা দোকান এখন বন্ধ। বাজারে দেনা বাড়ছে প্রতিদিন, আর বাড়ছে মেজাজ। দিপা আর জান্নাতুল মামা বাড়ি গিয়েছে বেশ কদিন। ওরা যেতে চায়নি, কাজের সুবিধার্থে ওসমানই পাঠিয়েছে এই লম্বা সফরে। দিপা বলেছিল,

ঈদ তো দেরি আছে, এখন যাব ক্যানে? আর মার বাড়ি অ্যাতদিন থাকা কি ঠিক?
‘সব সুমায় অ্যাত বুঝো ক্যানে? কাল-ই যাও, এখানে কাজ আছে।’
‘কী কাজ তুমার যে, আমাদের সরিই করতি হবে?
‘চোপ মাগি, কথার পিঠে শুধু কথা, আমার ভাত খেলে আমি যা বুলব শুনবি।’ ওসমানের এই হঠাৎ ধমকে ঘুমন্ত জান্নাতুল চমকে ওঠে। তারপর আর কথা বলেনি দিপা। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে দিপা পাখা নিয়ে এগিয়ে আসে আরও কাছে। ওসমান চাপা স্বরে বলে,
‘বাতাস লাগবে না, গরম লাগছে না আমার।’
‘ক্যানে, শরীল যে ভিজে একেবারে কাক ভিজা।’
ওসমান আর উত্তর দেয় না। গরমে তার ঘুম আসছে না মোটেও। ঘামে ভেজা পিঠে আলতো করে হাত রাখে দিপা। ওসমান পাশ পাল্টায়। বাপের বাড়ি যাওয়ার আগে দিপার ঘামে ভেজা ঠাণ্ডা শরীরের গন্ধ নেয় ওসমান প্রাণ ভরে। তারপর দীর্ঘ সময় বউ আর মেয়ে বাড়ি নেই। শূন্যতায় বসে অন্তহীন ভাবনায় ভেসে চলে ওসমান।
সব ঠিকই ছিল, সমস্যা হলো কাক! আর একটা সৃষ্টি হয়েছে ওসমানের বিল থেকে আসার পর। পরিকল্পনামাফিক সবকিছু রেডি করে ভাদ্র মাসের এক ভ্যাপসা বিকেলে বাংলা মদ নিয়ে ওসমান যখন তার সমবয়সী চাচা বিল্লালের পাঁচ কাঠার পুরনো বাড়িতে সাইকেল নিয়ে হাজির হলো, তখন প্রায় সন্ধ্যা। বিল্লাল নির্ঝঞ্ঝাট সংসারহীন মানুষ। বাজারে সামান্য কিছু টাকা সুদে খাটে। প্রায়ই হোটেলে খায়, চা-সিগারেটের দোকানে মাসিক বন্দোবস্ত। জ্ঞানত কারো উপকার করে না, প্রত্যাশাও করে না। কোনো কিছুতেই তার লোভ বা আসক্তি নেই, শুধু বাংলা মদ আর মাছ শিকার ছাড়া। 

আকাশ কালো হতে শুরু করেছে। ভ্যাপসা গরম, হয়তো বৃষ্টি হবে। দরজা খুলে ওসমানকে দেখে বিল্লাল একগাল হেসে বলে, আয় ভেতরে আয়।’ যেন তার অপেক্ষাতেই ছিল সে। ওসমানকে বলে, ভালো মাল পেলাম। তাছাড়া তোর চাচিরা বাড়িতে নেই। চল বসি।’ বিল্লালের চোখ দুটো লোভী শেয়ালের মতো চকচক করে ওঠে মুহূর্তেই। এক জগ পানি আর দুটো গ্লাস নিয়ে স্যাঁতসেঁতে মেঝের ওপরেই বসে যায়। সাথে ঝাল চানাচুর আর সস্তা সিগারেট। মুহূর্তেই কেটে যায় লম্বা সময়। বাইরের বৃষ্টি একঘেয়ে হয়ে আসে। বিল্লালের ঘরের পুরনো দেয়াল ভিজে ওঠে, ধীরে ধীরে; বাইরের উঠানে পানি জমতে থাকে। দু’লিটার বাংলা মদ প্রায় শেষ হয়ে আসে। নেশা নীল হয়ে ওঠে। ওসমানের চোখে হাজার তারার ঝিকিমিকি খেলতে থাকে। গ্লাসে মদ ঢালতে ঢালতে ওসমান বলে, চাচা চলো বাইরে যাই, মাথাটা ভার ভার ঠেকচি।’ 

বিল্লাল তখন হাওয়ায় উড়ছে। এক কথায় বলে, চল...।’ তার কথা নেশার ঘোরে জড়িয়ে যায়। সে ওসমানের সাইকেলের পেছনে চড়ে বসে। ঝুম বৃষ্টি তখন সামান্য ধরে এসেছে। বেসামাল হাতে পায়ে ওসমান টালমাটাল ভঙ্গিতে সাইকেল চালাতে শুরু করে। 

বেশ কিছু পথ ঘুরে, বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে- ওরা দু’জন যখন ময়ামারীর বিলের ধারে এসে দাঁড়াল, তখন সন্ধ্যা গাঢ় হতে শুরু করেছে। ঝিঁঝিঁ পোকারা ডেকে চলেছে গলা চিরে। মদের তলানিটুকু শেষ করে বিল্লাল বিলের পাড়ের থিকথিকে কাদার মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে বেঘোর। এদিকটা বড়ই নির্জন। কচুরিপানা ঢাকা বিলের এই পাড়টা নিচু জাতের শ্মশান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যারা পোড়াতে সমর্থ হয় না, তারা এই বিলের পাড়েই পুঁতে রেখে যায়। যারা রেখে যায় তাদের ধারণা তাদের প্রিয়জন স্বর্গে গেল, আর সাধারণ মানুষের ধারণা সে ভূত হলো। সে কারণেই এদিকে কেউ একটা বড় আসে না। আর বৃষ্টিমুখর রাতে তো নয়ই। জমাট অন্ধকারে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পতনের শব্দ ওসমানকে উদাস করে দেয়। ওসমান অন্ধকারে কান পেতে বৃষ্টিপতনের শব্দ শোনে। হঠাৎ কাছে পিঠে কোথাও বাজ পড়ে। গোটা বিল এলাকাটা চকচকে আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ঘুমন্ত বিল্লাল সামান্য নড়ে ওঠে। ওসমানও আতঙ্কে চমকে ওঠে। বজ্রপাতের নীল আলোয় চারপাশটা কেমন অচেনা আর অদ্ভুত লাগে। বিকট এই শব্দের পর চারদিকে গভীর নীরবতা নেমে আসে মুহূর্তেই। ওসমানের মনে হয়, সুনসান নীরবতার মধ্যেও একধরনের শব্দ লুকিয়ে থাকে। বিলের পাড়ের গভীর সবুজ বনানীকে চাপচাপ অন্ধকার বলে মনে হয় তার। বিলের জলে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দের মধ্যে ওসমান হারিয়ে যায় মুহূর্তেই। তার মনে হয় পৃথিবী বড় সুন্দর, মায়াময়। হঠাৎ তার নিজেকে এই বিশ্বসংসারে বড় তুচ্ছ, বড় অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। নিজেকে আবার নতুন করে তৈরি করতে ইচ্ছে করে। এই বৃষ্টিভেজা অন্ধকারে সব কিছু মুছে দিয়ে চকচকে আলোয় নতুন এক ঝকঝকে ওসমান হয়ে যেতে ইচ্ছে করে তার। চকিতেই মনে পড়ে যায় তার সাইকেলের ঝোলাতে দড়ি, বস্তা আর একটা চকচকে ডাসার অস্তিত্ব। কিন্তু এগুলো কেন সাথে এনেছে তা সে মনে করতে পারে না কিছুতেই। 

ভূতে পাওয়া মানুষের মতো বিল্লালের হাত-পা দড়ি দিয়ে বেঁধে ওর গলায় যখন ছুরিটা চালাল তখন আরও একবার বিদ্যুৎ চমকালো। ওসমান ভয় পায়, কেউ দেখে ফেলল নাকি! ওসমানের জানতে ইচ্ছে করে, মানুষের গলা কাটলে তার কেমন লাগে? ছেলেবেলায় সে মুরগি জবাই করা দেখেছে; ফাঁক হওয়া গলা নিয়ে রক্তাক্ত মুরগিগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়াত। সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে উঠানের কোণের কদবেল গাছে একটা কাক তারস্বরে ডাকত- কা-কা। বড় হয়ে গরু জবাই দিয়েছে সে নিজেই। বৈশাখ সংক্রান্তির বেলায় কালীমন্দিরে ভোতা খাঁড়া দিয়ে পাঠাবলি দেখেছে সে দূর থেকে। কিন্তু জবাইয়ের অনুভূতি কারো কাছে জানতে পারেনি। এমনকি বিল্লালের ক্ষেত্রেও তা জানা হলো না। বিল্লাল তার দু’ফাঁক করা গলা দিয়ে জবাই করা গরুর মতো ফোঁস করে বাতাস বের করে দু’ তিনটা ঝাঁকি দিয়ে স্থির হয়ে যায়। ওর গরম রক্ত ওসমানের পায়ের নিচে জমা হয়। ওসমান সেদিকে তাকায়, কিন্তু রক্তের রং বুঝতে পারে না। রক্তে যে একটা গন্ধ আছে এটা সে এই প্রথম টের পেল। জীবনে প্রথম খুন করছে ওসমান। কিন্তু তার খুব বেশি খারাপ লাগছে না- কোনো অপরাধবোধ তাকে তাড়িত করছে না। ভয় তাকে স্পর্শ তো করছেই না, বরং ওসমানের মনে হচ্ছে এই নির্মম কাজটি সে ইনজয় করছে ক্ষণে ক্ষণে। রক্তের এই ঝাঁঝালো গন্ধ তার শরীর মনে এক আদিম অনুভূতির আবেশ তৈরি করছে। সব কাজ শেষ করে বডিটা বিলের ভড়ভড়ে কাদার মধ্যে ডুবিয়ে দেওয়ার পর ওসমানের মনে হলো, আসলে মানুষ খুন করা কঠিন কিছু নয়। এবার চকচকে অস্ত্রটা টান দিয়ে সে ফেলে দেয় বিলের মাঝে। বৃষ্টির মধ্যে বিলের মাঝে ধাতব পদার্থ পড়ার শব্দ মিলিয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ কোত্থেকে একটা কাক এসে, কা-কা-কা শব্দ তুলে বিলের জলে নির্দিষ্ট জায়গায় পাক খেতে থাকে। আর রক্তহিম করা আওয়াজ তোলে কা-কা-কা। চমকে ওঠে ওসমান, এই বৃষ্টিতে কাক এল কোত্থেকে! পাখিটা ভয়ালদর্শন। কা-কা চিৎকার করলেও, পাখিটাকে ওসমানের ঠিক কাক বলে মনে হয় না। পাখিটার ঠোঁটটা লাল। চোখটাও লাল! সাধারণ কাকের চেয়ে কয়েকগুণ বড় পাখিটা ওসমানের দিকে তীব্র দৃষ্টি রেখে বিলের নির্দিষ্ট তরঙ্গায়িত স্থানের ওপর পাক খেতে থাকে আর কা-কা চিৎকার করতে থাকে। আতঙ্কে এই বৃষ্টিতেও তার সারা শরীর ঘেমে ওঠে মুহূর্তেই। গলার কাছে আতঙ্কটা যেন আড়াআড়িভাবে আটকে যায়। সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ওসমান প্রাণপণে শব্দ করে, হুস হুস।’ কাকরূপী ভয়ালদর্শন পাখিটা আরও কয়েকবার ডেকে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ময়ামারীর বিলের শ্মশানপাড়টা বৃষ্টি, নৈঃশব্দ আর অন্ধকারের গহিনে ডুব দেয় আবার। বৃষ্টির বেগ বেড়েছে কী কমেছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে। বিলের পাড়ের অন্ধকার মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছগুলো জবুথবু অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে পাগলের মতো মাথা নড়াচ্ছে। সেই আন্দোলনে যেন দুলে উঠেছে চারপাশ। বৃষ্টির ধারাগুলো তীর্যকভাবে পড়ছে বিলের পানিতে। ওসমানের শীত ধরে যায়। তারপরও সে কিছুটা সময় নিয়ে বিলের পানিতে দাঁড়িয়ে থাকে অন্ধকারকে সাথে নিয়ে। নিজেকে বেশ হালকা লাগছে তার এখন, যদিও এর কোনো বিশেষ কারণ নেই। এবার সে তার সাইকেলের দিকে এগুতে থাকে। থিকথিকে কাঁদায় জমে থাকা জলে তার পা ডুবে যায়। পায়ের আঙুলের ফাঁক দিয়ে কাদামিশ্রিত জল বিশ্রী হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। 

বাড়িতে এসে দারুণ ঘুম হলো ওসমানের। কোনো ভাবনা নেই, চিন্তা নেই- একেবারে টান টান ঘুম। কিন্তু হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল ওসমানের। মনে হলো পাখিটা ঠিক মশারির ওপর বসে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে, আর চাপাস্বরে গ...র...গ...র করছে। তারপর থেকে ওসমানের আর ঘুম নেই।
ওসমান শেষ ঘুম বলতে সেদিনই হয়েছে। ওসমানকে তাড়া করে ফিরছে কাক- মানে কাকের আওয়াজ, যে আওয়াজটা সে ফেলে এসেছিল বিলের জলে। রক্ত জল করা কাকের ডাক- কা-কা-কা। যখনই ওসমান একটু একা হয়, কাকটা, মানে কাকের আওয়াজটা, ফিরে ফিরে আসে। ছেলেবেলায় কাক ডাকলে দাদি বলত হুস হুস; হারামজাদা কাক-কাক অশুভ। তখন থেকেই ওসমান কাককে পাখি ভাবত না, ভাবত জন্তু। কাক দেখলে ভয় হতো তার। কিন্তু এখন সে কাকের জগতে বন্দি। ওসমানের মগজজুড়ে কাক। কা-কা-কা। নাওয়া খাওয়া ভুলেছে ওসমান। ঘুম তো গেছে আগেই। চোখের নিচে জমা হয়েছে গভীর অন্ধকার। ক’দিনেই ওসমান হয়ে উঠেছে অন্য মানুষ। দিপাকে মোবাইল করে বলেছে, চলে এসু।’
গলা শুনেই দিপা প্রশ্ন করেছে, কী হয়িছে তুমার? শরীল খারাপ? কেমন লাগচি?
ওসমান বলে, ভয়।’
‘কী?
‘ভয় লাগচি, খুব ভয়। তুমি চলে এসু।’
‘তা আসছি, ভয় লাগচি ক্যানে? কিসের ভয়?
আর কিছু বলতে পারে না ওসমান। কাকের ডাকে ভয় লাগছে-একথা বলা যায় না। এ কথা বললে কেউ বিশ্বাসও করবে না। দিপাও না।
সারা দিন সে শুধু ঘুরে বেড়ায়। ব্যস্ত থাকার ভান করে। সন্ধ্যা হলেই বসে থাকে মহল্লার চায়ের দোকানে। চা সিগারেট চলে একের পর এক। আর চলে রঙিন টেলিভিশন। ডায়াবেটিস, অম্ল, প্রেসার, বাত রোগগ্রস্ত দর্শকেরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখে সে নাচ। সে বুক। আর একান্ত পছন্দের মানুষের কথা ভাবে নিবিষ্ট মনে। তারপর একসময় দোকানের ঝাঁপ পড়ে। এখনো নয়টা, দশটা অথবা এগারোটায়। ওসমান ফিরে আসতে বাধ্য হয় শূন্য নিঃসঙ্গ আর আতঙ্ক দিয়ে ঠাসা বাড়িতে। বাড়ির উঠানের অন্ধকার কোণে কোণে ছোপ ছোপ আতঙ্ক হামাগুড়ি দেয়। বাড়ির ঝাঁপ খুলে ঢুকতেই ওসমানের ঠিক ঘাড়ের কাছে কাকটা বিকটস্বরে ডেকে ওঠে, কা-কা-কা’। ওসমান লাফ দিয়ে ওঠে। প্রবল ভয় তাকে গ্রাস করে নিমেষেই। গলা ছেড়ে চিৎকার করতে চেষ্টা করেও তার গলা দিয়ে স্বর বের হলো না মোটেও। 

প্রাণভয়ে শোয়ার ঘরে ঢুকে যায় সে। মাথার পাশের শিরার বাড়াবাড়ি রকমের দপদপানি আর বুকের ধুকপুকানিটা সে টের পায়। দরজা বন্ধ করে সিগারেট জ্বালায়। সিগারেটের ধোঁয়া ঘরের অপ্রতুল আলোর চারপাশে একটা ঘন ধোঁয়াশার বলয় সৃষ্টি করে। ওসমান এক পাঁইট বাংলা খুলে বসে এবার। দ্রুত মনটাকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে চায়। স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে মদ ঢালে সে। নির্জনতার মাঝে এই মৃদু শব্দ, একধরনের শব্দের মাদকজাল সৃষ্টি করে। তারপর পানি ছাড়াই সেটাকে পেটে চালান করে দেয় ওসমান। মুহূর্তে একটা গলিত আগুন পেটের নাড়ি-ভুঁড়িকে পুড়িয়ে পেটের মধ্যে চলে যায়। তারপর আর একটা, তারপর আরও একটা- ওসমানের পেছনের চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে যায়। জিভ ভারী হয়ে ওঠে, চোখের পাতার ওজন তখন বেশি হয়। আবার চিন্তার জট সরিয়ে নতুন চিন্তাও উঁকি দেয়। ওসমান বিড়বিড় করে বলে, শালা।’হঠাৎই তার মনে হয়, আচ্ছা, আমি বিল্লাল চাচাকে খুন করলাম ক্যানে?
‘ক্যানে? বিল্লালকে কি আমিই খুন করেছি? ওসমান আবার বিড়বিড় করে বলে ওঠে, আমি কি খুনি? আমার তো ফাঁসি হবে, আমি তো খুনি।’তার কথাগুলো ক্রমেই জড়িয়ে যায়। মধ্যরাতের নিস্তব্ধতায়, নিজের কাছেই ওসমানের কথাগুলোকে আতঙ্কগ্রস্ত কোনো পশুর গরগর আওয়াজের মতো মনে হয়। একসময় মদ ফুরিয়ে যায়। এর মধ্যে আরও দু’বার সে কাকের নির্মম ডাকটা শুনতে পায় আর আতঙ্কে কেঁপে ওঠে আবার। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে। ধীরে ধীরে ফুরিয়ে আসে ওসমানের ঘরের অপ্রতুল আলোর চারপাশে জমে থাকা ধূসর ধোঁয়ার ধূম্রজাল। সেই সাথে ফুরিয়ে আসে ওসমানের নির্ঘুম রাত।
সকাল হয় চনমনিয়ে। লাল চোখ আর উদভ্রান্ত চেহারা নিয়ে ওসমান গিয়ে বসে মন্টুর চায়ের দোকানের মাচায়। মন্টুর কালো কেটলির পানি ফুটছে টগবগিয়ে, আর কেটলির বাঁকা নল দিয়ে বেরিয়ে আসছে হালকা ধূসর ধোঁয়া। ওসমান সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তারপর এক ফাঁকে বিড়বিড় করে মন্টুকে বলে, আমি কিন্তুক বিল্লালকে খুন করিছি। আমার ফাঁসি হবে।’
ওর কথাগুলো গোঙানির মতো শোনায়। মন্টু গা করে না। ব্যস্ততা মাখানো গলায় জিজ্ঞেস করে, বিস্কুট নিবা নাকি শুধু চা?
গরম ভাপ ওঠা চায়ে চুমুক দেওয়ার মুহূর্তেই ওসমানের ঠিক বাঁ কাঁধের পাশেই কাকটা বিকট স্বরে ডেকে ওঠে, কা-কা-কা। ওসমানের আর চা খাওয়া হয়ে ওঠে না, সে উঠে পড়ে। তারপর এলোমেলো পা ফেলে উদ্ভ্রান্তের মতো নেমে যায় ব্যস্ত রাস্তায়। 

দিপা জান্নাতুলকে নিয়ে ফিরে এসেছে। আরও কিছুদিন থেকে যাওয়ার জন্য দিপার মা অনুরোধ করলেও দিপা কান দেয়নি। বাড়ি ফিরে এসেছে। ঘরদোরের অবস্থা দেখে তার চোখ কপালে উঠেছে। মাস দেড়েকের মধ্যে বাড়ির চেহারা পাল্টে গেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে ওসমান। উদভ্রান্ত উদাসীন মানুষ এখন ওসমান। রক্তজবার মতো দু’চোখে আতঙ্ক ঠাসা। ঘুম নেই, কোনো কাজেও মন নেই ওসমানের। সারা দিন বিড়বিড় করে চলেছে সে। দিপার চোখের জল বাঁধ মানে না। ওসমানকে জড়িয়ে ধরে বলে, কী হয়িচে তুমার? কি বুলচ বিড়বিড় করে সারাক্ষণ?
স্থির দৃষ্টিতে ওসমান দিপার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর হঠাৎই বড় অস্থির হয়ে ওঠে সে। ওসমান আতঙ্ক জড়ানো কণ্ঠে হিস হিস করে বলে, দিপা, ঐ যে কাক ডাকছে, শালার কাক...
‘কই কাক?
‘হ্যাঁ কাক, সেই কাকটা।’
‘তুমি এসব কী বুলচ?
‘দিপা, আমি কিন্তুক বিল্লাল চাচাকে খুন করিচি। আমি খুনি। আমার ফাঁসি হবে।’ আতঙ্কে ওসমান কাঁপতে কাঁপতে ছোট হয়ে যায়।
দিপা হাউমাউ করে চিৎকার করে ওঠে। জান্নাতুল ছুটে এসে মায়ের মাথায় হাত রাখে গভীর মমতায়। ওসমান দিশেহারা হয়ে জান্নাতুলকে জড়িয়ে ধরে বলে,
‘মা, আমি একটা মানুষকে খুন করিচি।’
জান্নাতুল শিশুসুলভ হাসি হেসে বলে, ধ্যাৎ, খুন তো করে দুষ্টু লোকে, তুমি তো দুষ্টু মানুষ না বাবা।’ 

চকচকে সূর্যের আলোয় জান্নাতুলের পবিত্র হাসিটা ঝিলিক দিয়ে ওঠে। ঝিরঝির হাওয়া জানিয়ে যায়, শীতের আগামবার্তা। গাছের কিছু শুকনা পাতা শব্দ করে ঝরে অপরিচ্ছন্ন উঠানে। কাছেপিঠে কোথায় জানি একটা ঘুঘু ডাকতে থাকে একঘেয়ে সুরে। ওসমানের মনে হয় ঝিরিঝিরি হাওয়ায় দিপার বুকভাঙা কান্নার শব্দ ভেসে যায় দূর অজানায়। সে আর বাড়িতে দাঁড়ায় না। গিয়ে বসে আরজের চায়ের দোকানের মাচায়। এখন মাচা জমজমাট। আরজ দোকান খোলে দুপুরের পর। খোলা রাখে রাত দশটা, কখনো এগারোটা পর্যন্ত। লাল চা, বিস্কুট, পান, সিগারেটের সাথে সমানতালে চলে রঙিন টেলিভিশন। বিকেল হতে না হতেই আরজের দোকানের মাচায় থইথই দর্শক খদ্দের। ওসমান আরজের কাছাকাছি গিয়ে গোঁ গোঁ করে বলে, একডা বিস্কুট দাও, সারা দিন খাইনি কিছু।’
দিতে গিয়ে ব্যস্ততার মধ্যে আরজ আলি ওসমানের রাতজাগা উদ্ভ্রান্ত লাল চোখ দেখে থমকে যায় খানিক। তারপর ওসমান আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আরজ আলিকে বলে, একটা কতা, বুলবু বুলবু করি বুলা হয়নিকো, আমি কিন্তুক বিল্লালকে খুন করিচি। আমি খুনি।’ 

আরজ আলি অবাক হয়ে ওসমানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, কিন্তুক কাল না পরশুই তো বিল্লাল ভাইকে দেখনু বুলে মুনে হলু। আমার দু’কানেই তো এইলো- বৈকালে।’ ওসমানের এই স্বীকারোক্তি মুহূর্তে আরজ আলির চায়ের দোকানের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বিল্লালকে দেখেছে বলে উল্লেখ করল। গ্রাম-গঞ্জে অকর্মন্য লোকের খবর কেউ রাখে না। বেশিরভাগ সময়ই লোকে না জেনে কথা বলে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় অকারণেই। মাথা মু-ুহীন কথা বলে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে মজা পায় কেউ কেউ। সাথে সাথে একজন বলে, বিল্লাল ভাই তো ভুয়াপুর গিয়েচে আনারস আনতে।’
আরজ আলি পান সাজতে সাজতে জিজ্ঞেস করে, কবে?
‘কি জানি...
‘বিস্কুট হাতে নিতে নিতে এই সব কথা শুনতে থাকে ওসমান। তার হাতের ওমে সস্তা বিস্কুট ভিজে ওঠে। তাজুল বলে, আরে না না, ভুয়াপুর না, মামা গিইচে মামির বাড়ি, গোয়ালন্দ। আজ চারদিন হলু।’
‘তুই দেখিচিস?
‘আরে আমার রিখসাতে গেল।ওসমান দ্রুত চিন্তা করে চলে, তাহলে বিলের কাদাতে কে চিৎ হয়ে শুয়ে ছিল? বজ্রপাতের নীল চকচকে আলোতে কে চমকে উঠল? সদ্য জবাই দেওয়া গরুর মতো ফোঁস করে কে বাতাস ছাড়ল সাদা নোলি দিয়ে? তাছাড়া কাক! ভয়ালদর্শন কাকরূপী পাখিটা সারা দিন তার চারপাশে কা কা করছে- সেটাও কি ভুল! ওসমান উঠে পড়ে। টালমাটাল পায়ে সে হাঁটতে থাকে। তার মাথার মধ্যে আটকে থাকা বজ্রপাতের নীলচে আভা, বৃষ্টির শব্দে ধুয়ে যাওয়া বিস্তৃত বিল, চকচকে ডাসা, প্লাস্টিকের বস্তা আর ভয়াল দর্শন কাক। ওসমানের আতঙ্কগ্রস্ত চোখে হঠাৎ ভেসে ওঠে জান্নাতুলের নিষ্পাপ মুখটা। কাকের কর্কশ ডাক ছাপিয়ে ওসমানের কানে বারবার বাজতে থাকে- তুমি তো দুষ্টু লোক না, বাবা।’ওসমান সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে, তার এখন কোথায় যাওয়া উচিত-বাড়ি? বিলেরপাড়? নাকি বিল্লালের বাড়ি? হঠাৎ মনে হয়, তার এলোমেলো ঘুরতেই ইচ্ছে করছে- উদ্দেশ্যহীন। ওসমানের হঠাৎই বিল্লালের বাড়ি যেতে ইচ্ছে হয় মনে মনে। কিন্তু পরক্ষণে ভয় আর আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে। তার মনে হয়, বিল্লালের বাড়ি গেলেই সে হাসিমুখে দরজা খুলে বলবে, আয় ভেতরে আয়...

অমাবশ্যার দিনটা খুবই উজ্জ্বল হয়। আজ সূর্যের ঝাঁঝ অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি। দুপুরের এই শেষ প্রান্তেও সূর্যের প্রখরতা কমেনি। সূর্যের বাঁকা কিরণ তার বেঢপ ছায়া ফেলে খোয়া ওঠা অমসৃণ রাস্তায়। ওসমান তার রাতজাগা লাল চোখ নিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, আর গভীরভাবে ভাববার চেষ্টা করে, কোথাও কি কোনো ভুল হচ্ছে তার। বাড়ির দিকে পা বাড়ায় সে। সামান্য এগিয়ে পেছনে ফিরে তাকায় ওসমান- এই পথের শেষ মাথায় বিল্লাল চাচার বাড়ি। ওসমানের ইচ্ছে হয় বাড়িটা দেখে আসার, কিন্তু সাহস হয় না। সে তীক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। রোদের প্রখরতায় তার দৃষ্টি তিরতির কাঁপতে থাকে। কেমন একটা মরীচিকা তৈরি হয়। ওসমানের মনে হয় একধরনের মরীচিকা তার চারপাশকে ক্রমেই গ্রাস করছে।

No comments:

Post a Comment