কোথায় কি!

08 October 2016

মনোজিৎকুমার দাস



লক্ষ্মীটেরা
বংশে মেয়ে নেই বলে বিন্দুবাসিনীর আপেক্ষের শেষ নেই। ছোট বেটার বউ বিজয়ার কোল জুড়ে ফুটফুটে জমজ মেয়ে জন্ম নেওয়ায় বিন্দুবাসিনীর আনন্দের সীমা নেই! সে নিজে দুই নাতনি নাম রাখে সরমা ও পরমা। দুই নাতনিকে নিয়ে তার আনন্দে দিন কাটে। দুজনের মুখে ভাত দেবার পর দিনে পর দিন, মাসের পর মাস কাটে। এক একটা বছর ঘুরে আর একটা বছর আসে। সরমা ও পরমা বড় হয়ে উঠে। দুজনের চোখ আর গালের দিকে ভাল ভাবে তাকালেই দুজনের চেহারার পার্থক্য বোঝা যায়। সরমা ও পরমা ঢাকার নাম করা কলেজে একই ক্লাসে পড়ে। বিন্দুবাসিনী ভাবে, আমার নাতনি দুটোকে সিনেমার নায়িকা মতো দেখতে হচ্ছে দিন দিন।


সে সরমা ও পরমাকে সুধোয়, তোরা তো জানিস রমা আমাদের পাবনার মেয়ে। রমার মতো তোরা কি সিনেমার নায়িকা হবি? 'দিদিমার কথা শুনে পরমা খিলখিল করে হেসে উঠে বলে,' তুমি কি আমাদের মাঝে পাবনার রমাকে দেখতে পাও! সুরমা কোন কথা না বলে মিটমিট করে হাসে। সরমা পরমার চেয়ে চার ঘন্টার বড়। পরমা তাই সরমাকে দিদি বলে ডাকে। পরমা বলে উঠে, 'কথা বলার সময় দিদির গালে কিন্তু টোল পড়ে। দিদুন ,তুমি তো বল , গালে টোল পড়লে সে নাকি স্বামী সোহাগিনী হয়। অচ্ছা দিদুন, যে মেয়ে লক্ষ্মী টেরা তার স্বামী কেমন হয়? 'আসলে পরমা লক্ষ্মী টেরা। একবার তাকিয়ে বোঝা যায় না।
পরমা কথার জবাবে বিন্দুবাসিনী বলে, 'তোকে কী আর বলবো লক্ষ্মী টেরা মেয়েরা স্বামীর ভালবাসা পার সারা জীবন। আমাকে দেখেও বুঝিস্ না! জোয়ান বয়সে আমার গালে টোল পড়ত ।তোদের দাদুতো আমাকে... 'কথা শেষ করার আগেই পরমা বলে, 'তুমি তো বল লক্ষ্মী টেরা মেয়েরা নাকি ছেলেদের প্রেমে পড়ে ।আমি প্রমাণ করে দেব তোমার কথা মিথ্যে।''আমি লক্ষ্মী টেরা বলেই তোর দাদু আমার প্রেমে পড়েছিল । 'দিদিমা জবাবে বলে দিদিমার কথা শুনে পরমা ভাবে, সুশোভনকে এর পর থেকে আর পাত্তা দেওয়া ঠিক হবে না । আমি লক্ষ্মী টেরা বলেই তাহলে আমার পেছন পেছন ঘুর ঘুর করে ও ! -


সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয়
মধুমিতা এখন এক ছেলে, এক মেয়ের মা। ছেলে অনিরুদ্ধ কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। সুঠাম দেহী, দর্শনধারী ,আর মেয়ে কঙ্কা সাত ক্লাসে পড়ে। পুরুষ গৃহ শিক্ষক প্রতি মধুমিতার বড় এলার্জি। তাই খুঁজে পেতে বৈশাখী দাশগুপ্তকে মেয়ের গৃহ শিক্ষক রাখলেন মধুমিতা। বৈশাখী সুন্দরী ও মেধাবী। কঙ্কাকে মাস ছয়েক পড়ানোর মধুমিতার মনে হল, যুবক ছেলে অনিরুদ্ধ কঙ্কার যুবতী মাস্টারনির সঙ্গে যেভাবে মেলামেশা করে তাতে তার ভয় লাগে। তাই সে বৈশাখীকে ছাড়িয়ে দিয়ে চুল পেকে সাদা হওয়া একজন বৃদ্ধকে কঙ্কা গৃহশিক্ষক রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন। কয়েকদিন কঙ্কা বৃদ্ধ শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ার পর কঙ্কা নাছোবান্দা সে বৈশাখী দিদিমণি ছাড়া আর কারো কাছে পড়বে না। মধুমিতা ঘর পোড়া গরু সে নিজে যুবা বয়সী গৃহশিক্ষক পঙ্কজের প্রেমে পড়ে আজ সে তার ঘরণী। প্রেমে না পড়লে লেখাপড়া শিখে সে মানুষের মত মানুষ হতো। সে তো ছিল ক্লাসে ফার্স্ট গার্ল। তার একমাত্র ছেলে অনিরুদ্ধ কঙ্কার গৃহশিক্ষিকা বৈশাখীর প্রেম যাতে না পড়ে সেই ভয়ে মধুমিতা বৈশাখীকে বিদায় করে দেয়। সিঁদুরে মেঘ দেখলে মধুমিতার বড় ভয়! 




প্রথমা
অতনু এবারই প্রথম মা বাবা, ভাই বোন ছেড়ে এক টানা দু'মাস বাড়ির বাইরে থাকা। স্কুলের পাঠ চুকিয়ে কলেজে পড়া ভাগ্যে জুটতো না শেষমেষ লজিংটা না পেলে। মা বাবা ছেড়ে অতনু একদিনের জন্য কোথায় থাকে নি। স্বাভাবিক কারণেই অতনুর মনটা খারাপ। তারপর বাড়িটাতে লোকজনের সংখ্যাও তেমন নয়। অতনুর ছাত্রী দু'জন ছাড়া ওদের বাবা মা আর একটা দাদা। পুরনো একতলা একটা দালান। সাকূল্যে তিনটা কুঠুরি। দক্ষিণ দিকের শেষ কুঠুরিতে অতনুকে থাকতে হবে সেটা সে প্রথম যে দিন ওখানে আসে সেদিনই বুঝেছিল। বাইরের দিকে বেশই বড় সাইজের পাল্লা বিহীন একটা জানালা।পূর্ব পশ্চিম আড়া আড়ি লোহার শিক না থাকলে সহজেই যে কেউ বাইরে থেকে ভিতরে ঢুকে পড়তে পারে। খাটের নিচের মেঝে ভাঙ্গা, সাপ, পোকা থাকাও বিচিত্র নয়! দিনের বেলায় অস্বস্তিতে না থাকলেও অতনু মনটা রাতের বেলায় ভয়ে কুঁকড়ে থাকে। সকালে ছাত্রী দুটিকে পড়িয়ে কলেজে ছুটতে অতনু হিমশিম খায়। মাইল পাঁচেক বাসে আর মাইল দেড়েক হেঁটে তবেই কলেজের নাগাল পাওয়া। ছাত্রী দুটোর কাছে অতনু রীতিমতো একজন মাস্টার।ওরা দু'বোন। বড়টির নাম প্রথমা আর ছোটটির নাম দ্বিতীয়া হওয়া স্বাভাবিক হলেও আসলে কিন্তু তা নয়। পায়েল প্রথমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট ,প্রথমা পাঁচ ক্লাশে পড়ে, অতনুর মনে হয় তার বড় ছাত্রীটি শরীর স্বাস্থে আরো দু'ক্লাস উপরে পড়লে মানাতো। অতনু অজপাড়া গ্রামের ছেলে, মেয়েতো দূরে কথা কোন ছেলেকেও সে আজ পর্যন্ত পড়ায়নি। পায়েলকে পড়াতে বেগ পায় না। প্রথমাকে পড়াতে গিয়ে অতনু হিমশিম খায়। সে বুঝতে পারে তার পড়ানো প্রথমার ভাল না। সে ভেবে পায় না কেন মেয়েটি তাকে আর তার পড়ানোকে এমন দৃষ্টিতে দেখে! একটা কথা অতনুর মনে দাগ কাটে। একদিন তার সমবয়সী একটা ছেলে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে কাদের বাড়িতে লজিং থাকে। অতনুর মুখ থেকে তার লজিং মাস্টারের নাম শুনে ছেলেটি ফুটকি কেটে যা বলেছিল তার অর্থ ও বাড়িতে যারা লজিং থাকে তারা তো ওই বাড়ির জামাই হয়। অতনু যাচাই করে দেখে ওই ছেলেটির কথাটা মিথ্যে নয়। অতনু ভাবে, ওই বাড়ির জামাই হবার কথা নয় তার। মেয়েটি ফর্সা হলেও তার মুখশ্রী অতনুর মনকে টানে না। আর অন্যদিকে প্রথমা তাকে তোয়াক্কাই করে না। বহু বহু বছর পরে অতনুর মনে পড়ে প্রথমার মুখটা যাকে সে তার জীবনের প্রথম ছাত্রী হিসাবেই পেয়েছিল।
____________________

No comments:

Post a Comment