একটি রহস্য গল্প
মিজান সাহেবের ঘুম ভেঙ্গেছে অনেকক্ষণ। সেই তখন থেকে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে আছেন
তিনি ব্যথিত চোখে। কেনো এতো দ্রুত সাতটা বেজে যায়! চোখ টেনে খুলে নিজেকে বোঝানোর
চেষ্টা করেছেন, আসলে ছয়টা বাজে। নিশ্চিন্তে আরও একটা ঘন্টা ঘুমিয়ে নেয়া যেতেই পারে।
কিন্তু ঘড়িটা কিছুতেই সেটা মানতে রাজি না। ছোট কাটা টাকে সে সাতটার ঘরে জেদী ছেলের
মতো দাঁড় করিয়ে রেখেছে।চোখটাও মিজান সাহেবকে বিশ্বাস করলো না। ঘড়িটাকেই করলো।
অগত্যা বিছানা থেকে নিচে নামেন তিনি শরীর ঘষটে ঘষটে। পঞ্চাশ বছরের পুরানো শরীরটা
আর একটু আরাম চেয়েছিল। সেটা দিতে পারলেন না। অফিসের তাড়া আছে। তাই স্যান্ডো
গেঞ্জিতে আটকে থাকা হৃষ্ট -পুষ্ট ভুড়িটায় হাত বুলিয়ে নিজের আরামের ঘাটতিটা পোষানোর
ব্যার্থ চেষ্টা করেন তিনি। ঘার ঘুরিয়ে একবার দেখে নেন বিছানায় শুয়ে থাকা বছর
পঁয়তাল্লিশের গিন্নী হুমায়রা বেগমকে। একদা ছিপছিপে তরুণী ঢোলা কোলবালিশ হয়ে
বিছানায় শুয়ে আছেন। ম্যাক্সি পড়া যে কোন স্বাস্থ্যবান মহিলাকে মিজান সাহেবের
কোলবালিশ বলে মনে হয়। আগে বয়স্করা শাড়ী পড়তেন। বয়সের কারণে তাদের মধ্যপ্রদেশ স্ফিত
হলেও দৃষ্টিকটু লাগতো না। আঁচল দিয়ে ঢেকেঢুকে রাখতেন। এখন হয়েছে ঐ এক ম্যাক্সি।
যেটা পড়ে মোটাসোটা মহিলা গুলি বেঢপ কোলবালিশের আকার ধারণ করেন। যে কোলবালিশ সুদৃশ্য
নয়। কোথাও কোথাও অপ্রয়োজনে অতিরিক্ত তুলা ভরা হয়েছে।
গিন্নী ঘুমোচ্ছেন অঘোরে।
অনেক রাত পর্যন্ত হিন্দী সিরিয়াল দেখেন তিনি। তাই সকালে তাকে ডাকাডাকি একদম নিষেধ।
হায়রে! পুরুষ মানুষের জীবন! আজ মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মালে এই শীতের ভোরে গোসল সেরে
বাসে ঝুলতে ঝুলতে অফিস যেতে হতো না। লেপ কাঁথা মুড়ি দিয়ে জম্পেশ একটা ঘুম দিতেন
তিনি।একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস আটকাতে পারেন না মিজান সাহেব। বুক চিরে বেরিয়েই আসে।
গোসল সেরে তিনি যখন খাবার
টেবিলে বসলেন তখন গিন্নীর শেখানো পড়ানো কাজের মেয়েটা নাস্তা ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে
টেবিলে। ভেজা ভেজা আলু চচ্চড়ি আর ভেজা টিস্যু পেপারের মতো তুলতুলে নরম রুটি। মুখের
ভিতর ঢুকে রুটি -চচ্চড়ির কম্বিনেশন মিজান সাহেবকে মশলাদার কাদা খাওয়ার অনুভূতি
দিলো। মুখ বিকৃত করে গিলে ফেললেন তিনি। খাওয়া -দাওয়াতেও গিন্নীর স্বেচ্ছাচারিতা
চলে। পাইরিয়া হওয়ায় মুখের দাঁত সব পড়ে গেছে এই বয়সেই হুমায়রা বেগমের। বাঁধানো
দাঁতেই কাজ চালান তিনি।তার মচমচে ভাজিতে অসুবিধা, তুলতুলে রুটি নাহলে চলে না।তাদের
একমাত্র ছেলেটা হোস্টেলে থেকে ডাক্তারি পড়ছে। সে ছুটিছাটায় বাড়ি এলে দু-একদিন
পরোটা হয় এই বাড়িতে নইলে স্বাস্থ্য সচেতনতার অজুহাত দিয়ে হুমায়রা বেগম দিনের পর
দিন মিজান সাহেবের শক্ত সামর্থ্য দাঁতগুলিকে জাস্ট পাত্তা না দিয়ে নরম নরম রুটি
খাইয়ে যান। মিজান সাহেবের বড় প্রিয়, মচমচে আলু ভাজা যার ওপরে ছড়ানো থাকবে
গোলমরিচের গুঁড়ো। সাথে থাকবে গরম গরম রুটি, যেটাকে অহেতুক নরম বানানোর চেষ্টা করা
হয়নি।আহা! শেষ কবে খেয়েছেন, মনে পড়লো না।
ফ্লাস্ক থেকে গরম পানি ঢেলে তার মধ্যে টি ব্যাগ
ছেড়ে লিকার চা বানিয়ে চায়ে চুমুক দেন মিজান সাহেব। এ বাড়িতে দুধ চা বারণ। সেটা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। মিজান সাহেবের সুগার ধরা পড়েনি এখনো। তাতে লাভটা কি হলো! এই
শীতে এক পেয়ালা খেজুর গুড়ের মালাই চা জুটলো না কপালে।গত বছর খেয়েছিলেন এক বন্ধুর শ্বশুর বাড়িতে। এলাচের সুগন্ধ এখনও নাকে লেগে আছে।
মিজান সাহেব যখন অফিস
যাবেন বলে বের হলেন, তখন গলির মুখের দোকানটায় গরম গরম সিঙ্গাড়া ভাজা হচ্ছে। সে
সুগন্ধ সামনের নদর্মাটার কথা ভুলিয়ে দিয়েছে অনেককে। দোকানের নাম "মায়ের দোয়া
হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট "। মায়ের দোয়াতেই বোধহয় মাছি বসা সিঙ্গাড়া দেদারসে
বিক্রি হচ্ছে। একটা সিঙ্গাড়ার জন্য প্রাণটা আইঢাই করলেও না খাওয়াই মনস্থির করলেন
তিনি। বাইরের খাবার তার ঠিক রোচে না।
এক ঘন্টা বাসে ঝুলে যখন
অফিসে পৌঁছলেন মিজান সাহেব, তখন ঘড়ির কাঁটা ন'টা ছুঁই ছুঁই করছে। মনটা খুশি হয়ে
ওঠে তার, যাক্ লেট হয়নি তবে আজ। জ্যামের কারণে আজকাল ঠিকসময়ে অফিসে পৌঁছানোই
মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। চেয়ারে বসতে না বসতেই মিজান সাহেবের ধূসর নীল মোবাইলটা বেজে
ওঠে। হেড অফিস থেকে বসের ফোন। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে -" ডগ কলিং "।
বদমেজাজি বসের সেলফোন নাম্বার 'ডগ' নামে সেভ করেছেন মিজান সাহেব।ব্যাটা জানে না,
যতোবার সে কল করবে মিজান সাহেবকে, ততোবার নিজেকে কুকুর প্রমাণ করবে।
বসের সাথে কিছু তিক্ত
মুহূর্ত কাটিয়ে মিজান সাহেব বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে নিজের রুমে ফিরে আসেন। একজন মানুষ
তার অধিনস্থ ব্যক্তির সাথে কেমন আচরণ করেন , তা থেকে বোঝা যায় তিনি মানুষ হিসাবে
কতোটা উন্নত। সেই হিসাবে মিজান সাহেবের বস অতি নিম্ন শ্রেণীর একজন মানুষ। যে
কর্মচারী তার যতো অধীনস্থ ,তিনি তার সাথে ততো দুর্ব্যবহার করেন। বসের মুখের ওপর
একটা রেজিগনেশন লেটার ছুড়ে মারতে পারলে শান্তি পেতেন মিজান সাহেব । কিন্ত সেটা
সম্ভব নয়। এক ধরনের স্বচ্ছলতায় অভ্যস্থ হয়ে আছে সংসার । চট করে সেখান থেকে সরে আসা
যায় না। চাকরি ছেড়ে দিলে পানিতে পড়বেন না তিনি । হুমায়রা বেগমের পৈতৃক সূত্রে
পাওয়া একতলা বাড়ীর ছাদে কষ্টে সৃষ্টে দোতলাটা তুলেছেন মিজান সাহেব । একতলায় তারা
নিজেরাই থাকেন ,দোতলাটা ভাড়া। সেই ভাড়ার টাকায় দিন গুজরান হয়ে যাবে কিন্তু হাত পা
ছড়িয়ে বাঁচা চলবে না। গিন্নী মেনে নেবেন না সেটা।
তাছাড়া বাড়িতে বসে করবেন
কি! অফিসে বসের ঝাড়ি তো বাড়ীতে গিন্নীর ঝাড়ি । জীবনটা ভাজা ভাজা হয়ে গেলো। মিজান
সাহেবের মাথায় ঠিক তখনই একটা বুদ্ধি খেলে যায় । তিনি যদি স্মৃতিশক্তি হারানোর ভান
করেন,তাহলে কেমন হয়? চাকরি বাকরি করতে হবে না আবার অসুস্থ বলে যদি গিন্নী বকাঝকা
একটু কম করেন, তাহলেও মন্দ হয় না । সারাদিন ভাবনাটা নেড়েচেড়ে দেখতে থাকেন তিনি কাজের
ফাঁকে ফাঁকে। একটা চাপা উত্তেজনা নিয়ে বাড়ি ফিরলেন সেদিন মিজান সাহেব ।
সন্ধ্যায় শোবার ঘরের
বিছানার সাথে লাগোয়া সোফাটায় বসে এক বাটি মুড়ি মাখানো খাচ্ছিলেন তিনি । হুমায়রা
বেগম আলমিরা খুলে কিছু একটা করছিলেন। মিজান সাহেব সেদিকে তাকিয়ে গলা খাকারি দিয়ে
বললেন -
-আপনি কি কাউকে বলবেন,
যাতে আমাকে এক কাপ চা দেয়? গলাটা বড্ড খুশখুশ করছিলো ।
কাজে বাঁধা পড়ায় কিঞ্চিৎ বিরক্ত চোখে তাকালেন
হুমায়রা বেগম, বললেন-
-চা খাবে ভালো কথা, আপনি
আপনি করার কি হলো?
তারপর আলমিরার পাল্লা টেনে
দিয়ে বেরিয়ে যান।
কিছুক্ষণ পর মিজান সাহেব গিন্নীর হাত থেকে চায়ের
কাপ নিতে নিতে বললেন-
-একটু আগে এক ভদ্রমহিলা তোমার
আলমিরা খুলে কি যেন খুটুর-মুটুর করছিলেন? ভদ্রমহিলা কে বলোতো? আমি তাকে আপনি বলায়
খুব রাগ করলেন!
-আশ্চর্য! কে ভদ্রমহিলা
মানে! আমি ছিলাম!চশমা তো চোখেই আছে দেখছি। তাহলে? শরীর ঠিক আছে?
বলে মিজান সাহেবের কপালে
হাত রেখে উত্তাপ মাপেন হুমায়রা বেগম । জ্বর নেই দেখে ব্যস্ত হয়ে পাশের রুম থেকে
প্রেশার মাপার যন্ত্র নিয়ে আসেন। তিনি যখন প্রেশার মাপতে যাচ্ছেন, তখন মিজান সাহেব
বললেন -
-আপনি কেনো শুধু শুধু কষ্ট
করবেন? হুমায়রাকে বলুন না,ও মেপে দেবে।
হুমায়রা বেগম হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন -
-কি হয়েছে? ওগো তোমার কি
হয়েছে?
পরবর্তী কয়েকটা দিন মিজান
সাহেবের স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে ভালো কাটলো। বহুদিন তিনি এমন আনন্দময় সময়
কাটাননি। যদিও গিন্নীর দিককার কিছু আত্মীয় স্বজন এসে কিছুটা ঝামেলা করার চেষ্টা
করেছেন। তাদের নানান রকম কৌতূহল, কেনো মিজান সাহেব কাউকে চিনতে পারছেন না, হঠাৎ
করে কি এমন হলো? তাদের সাথেও অসংলগ্ন ব্যবহার করলেন মিজান সাহেব।
যেমন, হুমায়রা বেগমের বড়
ভাই ও ভাবি এসেছিলেন খবর পেয়ে। এই দম্পতি তাদের নাক দুইটা সর্বদা মিজান সাহেবের
সংসারে ঢুকিয়ে রাখেন, নানারকম বুদ্ধি সাপ্লাই করেন হুমায়রা বেগমকে । সেসব বুদ্ধি
বেশীর ভাগ সময় মিজান সাহেবের সুখ - শান্তি নষ্ট করে দেয়। তাদের দেখে মিজান সাহেব
মনের ঝাল মেটালেন। গিন্নীর বড় ভাই কে বললেন,
"আপনাকে দেখতে অবিকল
বানরের মতো লাগছে! আমি নিশ্চিত আপনার লেজটা পোশাকের মধ্যেই কোথাও আছে।
না! না! যতোই ঘার নাড়ুন
আমি বিশ্বাস করবো না, অাপনি বানর নন। নিশ্চয় কলা খাবেন? হুমায়রা ওনাদের কলা দাও।
আপনার বানরী টি তো বেশ সুন্দরী! পুতু পুতু চোখে
কি চমৎকার কাজল পড়েছেন। এমন কাজল দেয়া ভুড়িওয়ালা বানরী তেমন একটা চোখে পড়ে না,
বুঝলেন। "
এরপর থেকে গিন্নী তার
বাপের বাড়ীর কোন অাত্মীয় স্বজনকে মিজান সাহেবের সামনে অানছেন না।
ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি
করতে হচ্ছে এটুকুই যা সমস্যা। অবশ্য গিন্নীর এতো আদর যত্নের বিনিমযে সেটুকু ঝামেলা
মেনে নেয়াই যায়।
গিন্নী আজকাল খুব ভালো
ব্যবহার করছেন। বিয়ের পরপর হুমায়রা বেগম যে মিহি সুরে কথা বলতেন, সেই সুর আবার
কোত্থেকে যোগাড় করে কথা বলা শুরু করেছেন। রান্না-বান্না কি হবে তাও মিজান সাহেবের
সাথে পরামর্শ করে নেন। বেশ মনের মতো খাওয়া দাওয়া জুটছে আজকাল মিজান সাহেবের।
ছেলেটা এসে দিন চার থেকে গেলো। পই পই করে বুঝিয়ে
গেলো - "ওষুধ ঠিকমতো খাবে বাবা। "মিজান সাহেব ওষুধগুলো সবার চোখ এড়িয়ে
খুব কায়দা করে ফেলে দেন।
মিজান সাহেবের বস্ কেরামত মোল্লাকে যতোটা খারাপ
মানুষ মনে করা হয়েছিল, তিনি আসলে ততোটা খারাপ মানুষ নন। আশ্চর্যজনকভাবে তিনি মিজান
সাহেবের এক মাসের ছুটি মঞ্জুর করেছেন। বেশ ফুরফুরে একটা মেজাজে দিন কাটছিল মিজান
সাহেবের।
বেশ কয়েকদিন এভাবেই কেটে
গেলো। একদিন মিজান সাহেব অনেকটা স্বাভাবিক আচরণ করায় হুমায়রা বেগম খানিকটা ভরসা
পেলেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর বিকেলের দিকে কাজের মেয়েটাকে সাথে নিয়ে বাজারে বের
হলেন । কিছু কেনাকাটা জরুরী হয়ে পড়েছে। যাওয়ার সময় মিজান সাহেবকে বলে গেলেন,
"তুমি একটু ঘুমাও
এখন। আমি গেট লক করে চাবি নিয়ে যাচ্ছি। ঘন্টা খানেকের মধ্যে ফিরবো। কোন অসুবিধা
মনে করলে ফোন দেবে, ঠিক আছে?"
যাক্। গিন্নীই বাজার হাট
করুক কয়েকদিন। তিনি তো এতো বছর অনেক করলেন। 'আচ্ছা ' বলে মিজান সাহেব একটা ভৌতিক
উপন্যাস নিয়ে বিছানায় লেপের নিচে ঢুকে গেলেন। বেশ গায়ে কাঁটা দেয়া গল্প। আয়েশ করে
পড়তে পড়তে কাহিনীর ভিতর ঢুকে পরেছিলেন তিনি । হঠাৎ কিছু উচ্চকণ্ঠের বাক্যালাপ
শুনতে পেলেন মিজান সাহেব। বসার ঘর থেকে আসছে। কেউ তো নেই বাসায়, কে কথা বলে!
গিন্নী কি তবে যাননি? কিন্তু যাওয়ার সময় দরজা বন্ধের শব্দ স্পষ্ট শুনেছিলেন তিনি
শোবার ঘর থেকে। তবে কি ভুল শুনেছিলেন? ভাবতে ভাবতে বিছানা থেকে নেমে পায়ে চটি
গলিয়ে রওয়ানা হোন মিজান সাহেব। শোবার ঘর পাড় হয়ে, বসার ঘরের সামনের সরু প্যাসেজটায়
আসতেই টের পান, লোকজন নয়, টিভি চলছে। হুমায়রা বেগম টিভি বন্ধ না করেই চলে গেছেন।
টিভি বন্ধ করার জন্য মিজান
সাহেব যখন বসার ঘরে ঢুকলেন, দেখলেন চলন্ত টিভির সামনে সোফার ওপর পা তুলে বসে টিভি
দেখছেন তার বাল্যকালের বন্ধু রতন দাস ।
"আরে তুই !"-মুহূর্তেই
উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন মিজান সাহেব।
রতন তার ছোটবেলার বন্ধু।
আজকাল কাজের চাপে তেমন যোগাযোগ নেই দুজনের মধ্যে। কিন্তু যখনি দেখা হয়, বুকের
মধ্যে গভীর আবেগ আর আনন্দ অনুভব করেন মিজান সাহেব। যেন তার শৈশব, কৈশোর, যৌবন
একবার এসে একযোগে তাকে 'হ্যালো' বলে যায়। সেই রতনের সাথে স্মৃতিশক্তি চলে যাওয়ার
মিথ্যা নাটকের কোন মানে হয় না। তাই বন্ধুকে দেখে নিজের উচ্ছ্বাস গোপন করেন না
তিনি। কিন্তু পরক্ষণেই মিজান সাহেবের মনে পরে, হুমায়রা বেগম তো দরজা লক করে
গেছেন!রতন তবে ঢুকলো কেমন করে?
রতন দাসকে দেখে উৎফুল্ল
মিজান সাহেব আলিঙ্গনের জন্য এগিয়ে যান । রতন দাসও উঠে আসেন সোফা ছেড়ে কিন্তু শেষ
মুহূর্তে মিজান সাহেবকে পাশ কাটিয়ে বসার ঘরের লাগোয়া বারান্দাটার দিকে পা বাড়ান।
যেতে যেতে বলেন -
"দাঁড়া ,তোর সদর দরজা
খোলা রয়েছে । বন্ধ করে আসি ।"
রতন দাসের এড়িয়ে যাওয়াটা
ভালোই টের পান মিজান সাহেব। কারণটাও অনুধাবন করতে পারেন।কিছুদিন আগে একটা ঝামেলায়
জড়িয়ে টাকা ধার চেয়েছিলেন রতন দাস তার কাছে।টাকার অঙ্কটা নিতান্ত কম ছিলো না।
গিন্নী তাই প্রবল আপত্তি করেছিলেন জানতে পেরে। তাছাড়া তার নিজেরও মনে হয়েছিলো, এই
ধারের টাকা কখনোই ফেরত পাওয়া সম্ভব হবে না। আর্থিক অবস্থা চিরকালই দুর্বল রতন
দাসের। ঘর গৃহস্থালির টুকিটাকি জিনিসপত্রের ছোট একটা দোকান চালান তিনি। দুটি
বিবাহযোগ্যা কন্যা পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে এখন ঘরে বসে আছে। টুকটাক টিউশনি করে বাবাকে
সাহায্য করে তারা। এখনো চাকরি- বাকরি জোটেনি । তাদের পাত্রস্থ করার চিন্তায় রতন
দাস প্রায়ই নির্ঘুম রাত কাটান।
সাতপাঁচ ভেবে টাকা ধার
দেয়ার ব্যপারটা সেদিন সুকৌশলে এড়িয়ে গেছিলেন মিজান সাহেব। মনঃক্ষুণ্ণ রতন দাস তাই
বুঝি আজ বন্ধুর আলিঙ্গন এড়িয়ে গেলেন। আজও যদি টাকার জন্য ধরে বসেন রতন দাস তবে
গিন্নীকে লুকিয়ে সামান্য কিছু না হয় ধরিয়ে দেবেন তিনি । সিদ্ধান্তটা নিতে পেরে
কিছুটা হাল্কা বোধ করেন মিজান সাহেব । জানালার কাছের ইজি চেয়ারটায় আরাম করে বসে
দরাজ গলায় হাঁক পাড়েন -
"রতন ! দরজা তো বন্ধ
করেই তোর বৌদি বেড়ালেন। তুই ঢুকলি কেমন করে বলতো? চুরি-বিদ্যার কৌশলও আয়ত্ব করেছিস
না কি রে ব্যাটা ? হা হা হা !"
মিজান সাহেবের হাসি সংক্রমিত
করতে পারে না রতন দাসকে । মৃদু পায়ে ঘরে ঢুকে সিঙ্গেল একটা সোফায় তিনি বসে পড়েন
শান্ত মুখে। চিরকালের রোগা ঢ্যাঙা শরীরটাতে বিস্তর শীতের কাপড় জড়ানো। সবই মলিন।
শুধু গলার মাফলারটা বড্ড বেশি লাল , চোখে লাগে । বোধহয় নতুন কেনা। তাই এখনও
ফ্যাকাসে হওয়ার সুযোগ পায়নি । রতন দাস বলেন -
"চুরি বিদ্যা জানা
থাকাটা মন্দ নয়, আজকের যুগে এটা একটা প্রতিভার সম্মান দাবি করে। আমি চিরকালই কম
প্রতিভাবান।"
কথার মাঝখানে মাফলারের ওপর
দিয়ে সাবধানে গলায় হাত বোলান রতন দাস । বলেন -
"গলাটায় বড্ড ব্যাথা
বুঝলি , অনেকটা রক্ত গেছে তো !"
"বলিস কি? কি হয়েছে
তোর গলায়?"
উদ্বিগ্ন শোনায় মিজান
সাহেবের কণ্ঠস্বর ।
রতন দাস সে কথার উত্তর না
দিয়ে বলেন -
"তোর সদর দরজাটা খোলা
ছিলো। ডোর বেল বাজানোর কথা কেনো যেনো মনে পড়লো না। দরজার নবটা ঘোরাতেই খুলে গেলো।
দিনকাল ভালো না । আজকাল মানুষ ঘরে ঢুকে , বুকে -পেটে ছুরি ঢুকায় না । একেবারে জবাই
করে দেয় । সাবধানে থাকিস ।"
মিজান সাহেব মনে মনে ভাবেন
,গিন্নী তবে দরজা খোলা রেখেই চলে গেছেন ! কিন্তু এসব ব্যাপারে হুমায়রা বেগম তো খুব
সাবধানী। যাকগে মানুষ মাত্রই ভুল হয়। ব্যাপারটা মাথা থেকে তাড়িয়ে তিনি বন্ধুর
প্রতি মনোযোগী হন। রতন দাস কে বলেন -
"তোর গলা ব্যাথা ।
গরম গরম আদা চা খা তবে এক কাপ, আরাম লাগবে ।"
উত্তরে রতন দাস স্মিত
হাসেন। সেই হাসিকে সম্মতি ধরে নিয়ে মিজান সাহেব চা বানাতে উঠে পড়েন। এক কাপ চা বন্ধুর হাতে
দিয়ে মিজান সাহেব নিজের চায়ে আয়েশ করে একটা চুমুক দিতে দিতে প্রশ্ন করেন-
" তোর মুখটা এমন মলিন
দেখাচ্ছে কেনো রে ? আবার ঝামেলা করছে না কি সেই পাতি নেতা ? "
চায়ে চুমুক দেন না রতন দাস
। কাপটা তিনপায়া টেবিলটার ওপর নামিয়ে রাখেন। বলেন -
"নেতা কই রে ,সে তো
মাস্তান । যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তখন সে দলে যোগ দিয়ে স্বার্থ সিদ্ধি করে বেড়ায়।
ইদানীং দোকানটার চারপাশে বেশকিছু হাইরাইজ বিল্ডিং হওয়ায় দোকানের বিক্রিবাটা কিছু
বেড়েছিলো। বহুদিন পর দুটো পয়সার মুখ দেখেছিলাম জানিস। তবে সে আর কপালে সইলো না। সেই
ভুট্টো মাস্তান একদিন এসে বলে কিনা -
দাদা দোকানটা আমায় দিন ।
নিজের দেশ ছেড়ে বিদেশবিভূঁই পড়ে রয়েছেন কেনো? এবার নিজের দেশ ভারতে যান।
বাংলাদেশের ব্যাবসা বাণিজ্যে আমাদের হক আগে। আপনি তো আমাদের হক মারছেন দাদা ।
চিন্তা কর মিজান, এটা
অামার বাপ - ঠাকুর্দার দেশ। এই দেশের জন্য আমার বাবা জীবন দিলেন ,আর অামি হিন্দু
ধর্মের মানুষ বলে এট অামার দেশ নয়, ভারত অামার দেশ হয়ে গেলো? আমায় বলে নিজের দেশ
ভারতে যান ! "
মিজান সাহেব একটা দীর্ঘ
নিশ্বাস ছেড়ে বললেন -
"ওদের সাথে লাগতে যাস
না . ওরা বড় ডেঞ্জারাস রে!"
রতন দাস বলেই চলেন -
" কয়দিন পর এসে বললো-
মূল্য ধরে দিন ,আর বিরক্ত করবো না । তিন লাখের নিচে রফা হবে না ,বলে দিলাম । তিন
লাখ দিন, শান্তিতে দোকানদারি করুন।
সবাই বললো টাকা দিয়ে মিটিয়ে নিন রতন' দা। চেনা
জানা সবার কাছে হাত পাতলাম । কেউ একটা পয়সা দিলো না! "
প্রসঙ্গটা উঠতেই অপ্রস্তুত
বোধ করেন মিজান সাহেব। অকারণে কেশে গলা পরিষ্কার করে বলেন -
"এখন কি অবস্থা?
কতোদূর কি ব্যাবস্থা করলি?"
"গতকাল রাতে দোকান
বন্ধ করবো করবো ভাবছি ,ভুট্টো এসে হাজির । মাল খেয়ে টাল হয়ে আছে । ভাঙ্গচুর করলো
অনেক কিছু । তার সাথে অশ্রাব্য গালাগাল । ভয় পাইনি জানিস , উল্টে কোথা থেকে খুব
সাহস এসে ভর করলো । হাতের কাছে পিতলের একটা মূর্তি ছিলো । দিলাম সেটা দিয়ে হাতের
ওপর একটা বাড়ি । ভাঙ্গা হাত নিয়ে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে শাসাতে শাসাতে চলে গেলো
। "
মিজান সাহেবের শিরদাঁড়া
বেয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায় । আতঙ্কিত কণ্ঠে বলেন -
"করেছিস কি! ভুট্টো
তো প্রতিশোধ নেবে এবার! তুই তো বিরাট বিপদের মধ্যে আছিস! কি সর্বনাশ!"
রতন দাস বললেন -
"তোর বৌদি আর
মেয়ে দুটো ভয়ে, আশংকায় বড় কান্নাকাটি করছে । তাই তোকে ডাকতে এলাম । তুই একটু
বোঝাবি ওদের মিজান ? ওদের কান্নাকাটি আর সহ্য হচ্ছে না ।"
শুনে মিজান সাহেব বললেন -
"ওদের আর কি দোষ বল ,
আমারই তো ভয়ে হাত -পা অবশ হয়ে আসছে । পুলিশকে জানিয়ে লাভ নেই । সব ওদের টাকায়
বিক্রি হয়ে বসে আছে । ক্ষমতাসীন দলের কোন বড় নেতাকে ধরতে হবে । দাঁড়া দেখি কি করা
যায় । আমার এক বন্ধুর পরিচিত এক প্রভাবশালী নেতা আছেন । তুই চা টা শেষ কর রতন ।
আমি কাপড়টা বদলে আসি । যাবো তোর সাথে "
মিজান সাহেব যখন বাইরের
কাপড় পড়ে বসার ঘরের দিকে আসছিলেন ,তখন অবাক হয়ে দেখলেন রতন দাস নিজের কাপের চা
সোফার পাশে রাখা পাতাবাহার গাছটার টবে ফেলে দিচ্ছেন ! কেনো ?
চা টা ফেলে দিলি রতন ?
টাকা দিয়ে সাহায্য করিনি বলে এ বাড়ির খাবার মুখে তুলবি না? -মনে মনে এই প্রশ্ন গুলি
আওড়ান মিজান সাহেব । কিছু টাকা যে তিনি দিতে চান , এটা কি এখনই বলবেন? ভাবতে ভাবতে
তিনি যখন রতন দাসের সামনে এসে দাঁড়ালেন , ঠিক তখনই বিপ বিপ শব্দে বেজে উঠলো সাইড
টেবিলে রাখা কডলেস ফোনটা । হ্যালো বলতেই হুমায়রা বেগমের উদ্বিগ্ন কণ্ঠ ভেসে আসে -
" মোবাইল বন্ধ করে
রেখেছো কেনো ? সব ঠিক আছে তো ? শোন , আমার আর আধা ঘন্টা লাগবে ।"
মিজান সাহেব বললেন,
" রতন এসেছে । "
"তুমি রতন দা কে
একবারে চিনতে পারলে? অন্যকাউকে রতন দা বলে ভুল করছো না তো ? দাঁড়াও , দাঁড়াও !
গেইট তো লক করা ছিলো,উনি ঢুকলেন কিভাবে ?"
"লক করা ছিলো না।
"
"হতেই পারে না । আমি
চেক করে তবে বেড়িয়েছি ।"
বিরক্ত হন মিজান সাহেব ।
নিজের স্ত্রীকে তিনি কখনো ভুল স্বীকার করতে দেখেননি । মিজান সাহেব বলেন -
"আমি রতনের সাথে ওর
বাড়ি যাচ্ছি ।"
আৎকে ওঠেন গিন্নী -
"না , না , যেও না ।
তোমার শরীর ভালো নেই । বাসায় বসেই গল্প করো না দুজন । আচ্ছা , আমি এখনি ফিরে আসছি
তবে ।"
মিজান সাহেব ফোন নামিয়ে
রাখলেন। রতন দাস কে বললেন -
"চল তাড়াতাড়ি উঠি,
তোর বৌদি আসলে আর যেতে দেবে না ।"
তার পরপরই একটা রিকশা নিয়ে
রওয়ানা হয়ে যান মিজান সাহেব আর রতন দাস ।
রতন দাসের বাড়ির সামনের
গলিটার মুখে তারা যখন পৌঁছালেন, তখন সেখানে গাড়ি ও মানুষের জটলা । রিকশাটার আর
সামনে এগোনোর উপায় নেই । গলির মুখেই থামতে হলো তাদের । গলির ভিতরের দিকে গাড়ি গুলির
লম্বা একটা সারি তৈরি হয়েছে । মিজান সাহেব ঝুঁকে গাড়ি গুলিকে লক্ষ্য করেন।
সংবাদপত্রের গাড়ি , টিভি চ্যানেলের গাড়ি ,একেবারে সামনেরটা পুলিশের গাড়ি ।
"কি হলো রে তোদের
এদিকটায় ?"
প্রশ্নটা করেন পাশে বসা
রতন দাসকে । কিন্তু উত্তর না পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন বন্ধুটি পাশে নেই ।তার
অন্যমনস্কতার সুযোগে , চিরদিনের খেয়ালি রতন দাস কখন যেনো রিকশা থেকে নেমে ভিড়ে
মিশে গেছেন ! বন্ধুর ওপর কিঞ্চিৎ বিরক্ত হন মিজান সাহেব। রতন দাসের বাড়ি তিনি
ভালোই চেনেন। তাই বলে তাকে না নিয়ে একাই রিকশা থেকে নেমে রওয়ানা দেয়া ঠিক হয়নি
রতনের।
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে
একা একা রতন দাসের বাড়ির দিকে রওয়ানা হন তিনি।
গলির মুখ থেকে কিছুদূর
যেতেই রতন দাসের বাড়ি। একটি প্রায় জীর্ণ , পুরাতন , পলেস্তরা খসা তিন তলা বাড়ির নিচতলায়,
উত্তর দিকের ফ্ল্যাটটায় স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে বাস করেন রতন দাস । সেই বাড়ি
পর্যন্ত হেঁটে আসতে আসতে মিজান সাহেব লোকমুখে যা শুনলেন , তা হলো -আজ দুপুর নাগাদ
এ গলিতে একটা খুন হয় । গৃহকর্তা বাড়িতেই ছিলেন । দুর্বৃত্তরা ঘরে ঢুকে তাকে জবাই
করে চলে যায় । এটা ডাকাতি না কেবলই একটা খুনের ঘটনা তা এখনো জানা যায়নি । কোন বাড়ি
জানতে চাওয়ায় একজন হাত লম্বা করে সামনে দেখিয়ে দিলেন, আর একজন বললেন -
"ঐ যে রতন দাস ,
মোড়ের মাথার দোকানটা যার , সেই রতন দোকানদার খুন হয়েছেন । আহা ! বড় ভালো মানুষ
ছিলেন । কারো সাতে পাঁচে থাকতেন না কখনো । কে তার এমন সর্বনাশ করলো ! মেয়ে দুটির
এখন কি হবে তার ঠিক নেই !"
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে
পারছিলেন না মিজান সাহেব । ভুল হচ্ছে , কোথাও বড় ধরনের ভুল হচ্ছে । তিনি উদগ্রীব
হয়ে জানতে চাইলেন-
"দুপুর ঠিক কটার দিকে
ঘটনাটা ঘটেছে বলতে পারবেন ?"
" এই তো , তা ধরুন
একটা -দেড়টা নাগাদ । এখনও লাশ নিয়ে যায়নি পুলিশ ।"
"তা কি করে হয় ? রতন
তো মিনিট পনেরো আগেই আমার সাথে ছিলো । দুপুর তিনটার দিকে সে আমার বাড়ি যায় । আমরা
একসাথে একই রিকশায় চেপে এখানে এলাম একটু আগে !"
লোকটি এমনভাবে মিজান
সাহেবের দিকে তাকালেন, যেনো তার সামনে কোন পাগল দাঁড়িয়ে আছে । আলগোছে তাই সরে যান
তিনি মিজান সাহেবের কাছ থেকে।
মিজান সাহেবের মাথা ঘুরতে
থাকে। প্রচন্ড পানি পিপাসা অনুভব করেন তিনি । চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলান কিছুক্ষণ।
তারপর উদভ্রান্তের মতো দ্রুত পায়ে ভীড় ঠেলে সামনে এগোতে থাকেন। কিন্তু রতন দাসের
বাড়ির সামনে এসে দেখলেন পুলিশ কাউকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। অসহায় মিজান সাহেব যখন
কি করবেন বুঝতে পারছেন না, ঠিক তখনই তার চোখ চলে যায় , বাড়ির উল্টোদিকের পুকুর
ঘাটটায়। অপেক্ষাকৃত কম ভিড় সেখানে । পুকুরের দক্ষিণ দিকের নারিকেল গাছটার নিচে রতন
দাস একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছেন !
মিজান সাহেবের দেহে যেনো
প্রাণ ফিরে আসে। ওই তো রতন! দিব্যি বেঁচে আছে। ঐ ফালতু লোকটা কি সব আবোলতাবোল
বকছিলো। বন্ধুকে ফিরে পেয়ে শিশুর মতো খুশিতে উল্লাসিত হয়ে ওঠেন মিজান সাহেব। প্রায়
দৌড়ে ছুটে যান বন্ধুর দিকে । কিন্তু কাছাকাছি যেতেই চমকে ওঠেন । প্রচণ্ড আতংক নিয়ে
লক্ষ্য করেন, রতন দাসের গলার সাদা মাফলারটা দ্রুত লাল রঙ ধারণ করছে । মুহূর্তেই
সেটা টকটকে লাল বর্ণে পরিণত হলো । তারপর গলা থেকে রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়তে শুরু
করলো অঝোর ধারায় ।
মিজান সাহেবের সহজাত
প্রবৃত্তি তাকে নির্দেশ দেয় দৌড়ে পালানোর । তিনি প্রচণ্ডভাবে অনুভব করেন, এই দৃশ্য
পৃথিবীর দৃশ্য নয় । এই দৃশ্য তৈরি হয়েছে অন্য কোন জগতে ,অন্য কোন ভুবনে । সেই
ভুবনের দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা মিজান সাহেবের নেই । আতংকে অস্থির হতে
হতে তিনি দেখলেন , রক্তাক্ত শরীর নিয়ে রতন দাস দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসছেন ।
মিজান সাহেব দৌড়ে পালাতে
গেলেন কিন্তু তার পা জোড়াকে তিনি একবিন্দুও নাড়াতে পারলেন না । আয়াতুল কুড়সি পড়ার
চেষ্টা করে দেখলেন, কিন্তু প্রথম লাইনের পর আর মনে পড়লো না । ততোক্ষণে রতন দাস
প্রায় সামনে চলে এসেছেন । ভয়ংকর অবয়বের রতন দাসের মুখ থেকে অদ্ভুত স্নেহের
কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন মিজান সাহেব । গভীর মায়া নিয়ে রতন দাস তাকে বলছেন -
" আমায় ভয় পাচ্ছিস
মিজান ? ভয় পাস না ভাই । আমি তোর কোন ক্ষতি করবো না ।
আমায় টাকা দিয়ে বিপদের দিনে সাহায্য করিসনি,
সেজন্য আমার কোন রাগ নেই রে তোর ওপর । হয়তো নানা কারণে দিতে পারিসনি। সংসার বড়
জটিল জায়গা । সে সবাই কে জ্বালায় । আমায় দ্যাখ , আমার জীবনটাই কেমন করে নিয়ে নিলো
। ভুট্টোকেও দোষ দেই না। বেচারা জীবনের লোভের হাতে বন্দী । তোকেও তাই আর দোষ দেই
কেমন করে , বল?
আমার শুধু তোর কাছে একটা
দাবি আছে । তোর মনে আছে কি না জানিনা, তুই বলেছিলি - সবসময় , যে কোন পরিস্থিতিতে
তুই আমার সাথে সাথে থাকবি । মরে গেলাম হঠাৎ করে । কোন প্রস্তুতি ছাড়াই। একা একা
নতুন একটা জগতে যেতে বড্ড ভয় করছে রে । তুই যাবি ভাই আমার সাথে? মরতে খুব বেশি
একটা কষ্ট হয় না, বুঝলি । ওই প্রথম দিকে একটু হাঁসফাঁস,ছটফটানি লাগে ; তারপরই সব
ঠিকঠাক। তুই ভাবিস না , আমি খুব সাবধানে তোর গলা টিপে ধরবো , তুই একটুও কষ্ট পাবি
না।"
রতন দাস তার দুই হাত মিজান
সাহেবের গলার দিকে বাড়িয়ে দেন । প্রচণ্ড মৃত্যুভয় থেকে গগন বিদারী এক চিৎকার বের হয়ে
আসে মিজান সাহেবের ভিতর থেকে। সেই চিৎকারে আশেপাশের মানুষজন ছুটে আসেন । ততোক্ষণে
জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন তিনি। পথে পড়ে থাকা পাথরে মাথা ঠুকে যায় তার।
এলাকার কয়েকজন মিজান
সাহেবকে চিনতে পারলেন। রতন দাসের দোকানেই আলাপ হয়েছিলো তাদের মিজান সাহেবের সাথে।
তারা বলাবলি করতে থাকেন, দুই বন্ধুর এতো মিল ছিলো যে, একজনের এমন বীভৎস মৃত্যু
আরেক জন সইতে পারছেন না। তাই নিজেকে সামলাতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেছেন মিজান
সাহেব।
পকেট হাতড়ে মিজান সাহেবের মোবাইল থেকে হুমায়রা
বেগমকে তারাই ফোন করেন এবং জ্ঞান ফিরে না আসায় মিজান সাহেবকে কাছের একটা ক্লিনিকেও
ভর্তি করে দেন ।
মিজান সাহেবের যখন জ্ঞান
ফিরে আসে, তখন তিনি কাউকে চিনতে পারছিলেন না । অভিনয় নয় , সত্যিই চিনতে পারছিলেন
না। ব্রেণ হেমারেেজে তার মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দারুণভাবে । রতন দাসকে নিয়ে
একটি তীব্র আতংক ও কঠিন অনুতাপের স্মৃতি মুছতে গিয়ে মস্তিষ্ক ভুল করে তার সারা
জীবনের সব স্মৃতি মুছে ফেলেছে ।
বহু চেষ্টা করেও স্মৃতি
ফিরেয়ে আনতে পারেননি চিকিৎসকরা । মস্তিস্ক তার ভুলের জন্য 'সরি ' বলেছিলো কি না জানা
যায় না, তবে মিজান সাহেবকে যে আর কেউ কোনদিন অফিসে বা বাজারে যেতে দেখেননি ,
সেটুকু নিশ্চিত জানা যায় । মিজান সাহেবের কোন কাজ না করে বাড়িতে বসে থাকার গোপন
অভিলাষ প্রকৃতি নিষ্ঠুর ভাবে পূর্ণ করেছিল!
_______________
No comments:
Post a Comment