কোথায় কি!

25 January 2017

মাহবুব আলী



  
চিৎকারের পটভূমি


আলো জ্বালতে দোমড়ানো আর্তনাদে ভরে গেল রাত। লোকটি দ্রুত উঠে বসে। ফেনিল অন্ধকারে বেরিয়ে যায়। প্রথমবার। যেনবা প্রথমবার নয়। অথচ কি ভয়াবহ পীড়ন! পরদিন কোনো তুলসীতলা নয়। বিছানায় কিংবা সিলিং’এর সঙ্গে লটকানো ফ্যানে নয়। মিলুর লাশ পুকুরের ধারে পাওয়া গেল। এঁদো কাদার হাঁটু জলে। ঘোলাজল। লোকে লোকারণ্য। ফিসফাস গুঞ্জন। কোনোটি বেদনার। কোনোটি নিরাসক্ত। কৌতূহলী প্রশ্ন। মেয়েটি মরল কেন? কীভাবে? নাকি কেউ মেরে রেখে গেছে?

কুড়ি বাইশ বছরের তরুণীর লাশ। কোনো বেনারসি পরনে ছিল না। সাদামাটা প্রিন্টেড শাড়ি জড়ানো ভরা পদ্মার মতো শরীর। পড়ে আছে উত্তর সিঁথানে। চিত হয়ে। মুখে যন্ত্রণার কোনো চিহ্ন নেই। চোখ-দুটো খোলা। আকাশের দিকে তাক করা। লোকটি পুকুর পাড়ে দাঁড়ানো শত লোকের ভিড়ে বসেছিল। লাশের কাছাকাছি। বিলাপ বা প্রলাপের তার কিছু নেই। সে একদৃষ্টিতে মিলু...মিলুর চোখ দেখছিল। হয়তো দেখা নয়। সে কিছু খুঁজছিল। বউটির সাধ ছিল সংসারের। একটি ফুটফুটে সন্তানের। ছেলে কিংবা মেয়ে যা বিধাতা দেয়। মিলু আকণ্ঠ তৃষ্ণা অপূর্ণ রেখে মরে গেল। লোকটির দীর্ঘশ্বাসে সে কথা লেখা আছে।

এক বছর আর মাস তিনেক হবে মাত্র। সে ওকে ঘরে এনেছিল। ঘর আলো করা বউ তার। বাবা-মা বলত ঘরের লক্ষ্মী। পাড়া-পড়শিরা বলেছে প্রতিমার মতো সুন্দর। সে দেখেছে গোধূলির আকাশ ওর কপালে ম্লান হতে। তাই মিলুকে নিয়ে আর কি কি করে তৃষ্ণা মেটে না। দ্বিতীয় দীর্ঘশ্বাসে তার সেই অপূর্ণ সাধের কথা লেখা।

মিলু এখন পড়ে আছে। কাঁচা হলুদ বরণ শরীরে পলি কাদা মাখামাখি। ব্লাউজ নেই। উত্তুঙ্গ স্তন চেয়ে আছে সূর্যের দিকে। ভেজা কাপড় শুকিয়ে ভাঁজে ভাঁজে সেঁটে গেছে। লাজ-নম্র বউটির আর কোনো লজ্জা নেই। পুকুরের পাশে বাঁশঝাড় আচ্ছাদিত ছায়ায় কোনো হিমেল বাতাসও স্পর্শ করে না। লোকজনের ভিড়। ফিসফাস। গুঞ্জন। এসবের মধ্যে লোকটির মা বাড়ির দুয়ারের পাশে বসে করুণ আর্তনাদে কাঁদতে থাকে। সেই প্রলম্বিত চিৎকার শেষ ফাগুনের দুপুরের মতো বেদনায় উচ্চকিত। সেখান থেকে সরল আর বক্র রেখায় ভেসে ভেসে আসে। বড় বিরক্তিকর আর অসহনীয় যন্ত্রণা জাগায়। বুড়ো বাবা একপলক তাকিয়ে ছুটে গেছে থানায়। নিশ্চয় কেউ খুন করেছে। গলায় কলস বেঁধে মধ্য-পুকুরের গভীর জলে চুবিয়ে মেরেছে। লাশ ভেসে উঠে এসেছে কিনারে।

খুন! নির্জলা খুন। কে করল? সবার চোখে-মুখে জিজ্ঞাসা। ওর স্বামী? আহা দুটিতে বড় মিল ছিল! ক-দিনই বা হলো সংসারের! এর মধ্যে ...না না না।

লোকটি স'বির। আগলায় মিলুকে। প্রিয় মানুষের লাশ। এ শরীর যে তার শরীরে মিশে আছে। হৃদয় হতে হৃদয়ে লেগে আছে সুগন্ধ। এখন কেমন খাঁ-খাঁ শূন্যতা। কিছু নেই। কিছু নয় আর। ছোঁয়া যাবে না। চোখদুটো এত খোলা যে আকাশ দেখছে। প্রশ্ন আকুল দৃষ্টি হানছে। কারও মনে কি হানে প্রশ্নবাণ? সেই চোখ স্পর্শ করা যাবে না। থানা থেকে লোক আসবে। তারপর।

লোকটির চোখে এতটুকু জল নেই। খুনির চোখের মতো রক্তলাল দুটো মণি জ্বলছে। উঠে যেতে ইচ্ছে নেই। পুকুর পাড়, বাঁশঝাড় আর শ্যাওড়ার জোনাকিরা দেখেছে মিলুর মৃত্যু। অপমৃত্যু। ‘কিন' এ মৃত্যু কততম হে শুভ সকাল? তুমি কোথা থেকে নিয়ে এলে মহাসাগরের মতো বিষণ্ন আকাশ? শোকের কাঁচপোকারা কুরে-কুরে খায় হৃদয়ের মধ্যে জমানো ভালবাসার বিকেল? যন্ত্রণা কেন গলা অবধি এসেও বাতাসে মিশতে পারে না? বুকের মধ্যে নিশ্চুপ গোমড়ায়। মিলু...লক্ষ্মী বউ...একবার ওঠ, কথা দিচ্ছি আর স্পর্শ করব না কোমল বুক। ঠোঁটে ছুঁয়ে দেখব না ঠোঁট। ভালবাসার মিঠেল একাত্মতায় কোনো কদম ফুল খুঁজব না। রাতের অন্ধকারে জ্বালব না দীপ। মিলু একবার ওঠ...একবার শুধু একবার।’ লোকটির চোখ শুষ্ক বাতাস মরুভমি লু। তবু সবকিছু সজল বাতাসে ভেজা মেঘের মতো ঝাপসা।

এত লোকজন! হট্টগোল। ফিস্‌ফাস্‌...কানাকানি। বউটি কী করে মরল? আহা সাত গেরামের মধ্যে খুঁজে পাওয়া ভার এমন রূপবতী মেয়ে! আসলে এত রূপ সইল না। রূপের আগুন সব জ্বালিয়ে দিল। লোকটির চোখের কোণে কালচে দাগ। অনিদ্রা বা যন্ত্রণার চিহ্ন। রক্তলাল দৃষ্টি ভাবতে ভাবতে ভিজে উঠতে চায়। পুরোপুরি আদ্র হয় না। সেখানে কোনো জল নেই।

ভারী বুটের আওয়াজ। সন্ত্রস্ত গাছের ফিঙে পাখি। সরে যায় গাদাগাদি লোক। জিপ এসে থেমেছে সড়কের ধারে। পুলিশ থানার দারোগা ফটোগ্রাফার আর কে কে আসছে। তাদের পায়ের শব্দে কেঁপে ওঠে মাটি। কম্পনের তীব্র ঢেউ জাগে জটলায়। কেউ কেউ সরে পড়ে। লোকটি নিষ্কম্প নিথর। তাকে কোনো কিছু স্পর্শ করে না। অনুভূতি শূন্য।

কতগুলো ছায়া। সামনে অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে গেল। লোকটির চোখ অবনমিত। এত লোক আজ এখানে! তামাশা দেখছে। তার বুকে আগুনের যে হলকা! তার ঘরের লক্ষ্মী আজ বেআবরু। তার বিস্রস্ত বিপর্যস্ত চেহারায় জমে থাকা নিশ্চুপ ক্রূরতা লোকগুলোর মনে কৌতূহল জাগায়। মন...মন বলে কিছু কি আছে? তার দুর্দশা বিপন্ন নসিব তাদের তামাশার উপকরণ। সে যাত্রাদলের ভাঁড়। সার্কাসের ক্লাউন। আলোর তীব্র কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছে। স্পট লাইট। একটি লাশ এবং তার দৃষ্টি ধরে রাখে অব্যাখ্যায়িত ভয়ানক অন্ধকার। সে কখনো সকল ভবনা আর আলোচনার মধ্য থেকে আড়াল হয়ে যায়। সামনে কয়েক জোড়া চকচকে কালো বুট। সূর্যের আলোয় পুকুরের জলের মতো ঝিলমিল করছে। তার দৃষ্টি উপরে ওঠে। রক্তলাল ফোকাস...অন্ধকার। শুধু অন্ধকার।

‘তুই তা হলে হাজব্যান্ড? কী নাম তোর? কখন লাশ দেখেছিস? আ রে ছুঁড়ির বয়স তো বেশি নয়। তুই খুন করেছিস? কত টাকা ডিমান্ড নিয়েছিস আর কত চাই? চল চল থানায় চল।’

গরুর গাড়িতে লাশ তোলা হলো। লোকটি কিছু বলে না। চোখ-দুটো তখনো রক্তজবা। খুনের নেশায় ফুঁসে ওঠা আগ্নেয়গিরি। সকালের সূর্য এখন মাথার উপর উঠেছে। গাছে গাছে ফুল ধরে আছে জীবনের মিঠেল আগুন। মিলুর সাধ পূর্ণ হলো না। সেইসঙ্গে তার বুকেও আগুন জ্বেলে গেল। আগুন তো জ্বলছিলই। সে কেন তবে নিশ্চুপ নিস্পৃহ থেকে গেছে? এই জিজ্ঞাসা লাশের উন্মুক্ত চোখ-দুটো আকাশ-দিগন্তে লিখে রাখে। আধময়লা বিছানার চাদরে তাকে মুড়ে নেয়া হয়েছে। হিম-শীতল-ঠান্ডা। কঠিন-শক্ত-পাথর। গরুর গাড়ি ঢিমে তালে এগোয়। লোকটির কোমরে দড়ি। শত মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টির গুঞ্জনে বুড়ো মা-বাবার আকুতি ধোঁয়ার মতো মিলে মিশে একাকার।

‘দারোগা সাহেব মোর বেটাক ক্যান্‌ ধরি নেছেন বা রে? ওয় ক্যানে বউওক মারিবে? দারোগা সাহেব এইটা কি করোছেন? ও বাহেরা তরা কিছু কন। হায় আল্লা এইটা কি হছে!’
‘মার্ডারের মোটিভ কিছু আন্দাজ করছ হাওয়ালদার?’
‘দারোগা সাহেব মোর বেটাক ছাড়ি দেন বা রে। ওঁয় কিচ্ছু জানে না। ওঁয় কি অমন লক্ষ্মী বউওক মারিবার পারে? ও দারোগা সাহেব মুই তোমার পা ধরিছু...ওঁয় খুন করেনি। অন্য কাঁহো করিছে। ও বা রে তরা কিছু কন্‌। মোর নির্দোষ বেটাক ধরি নিই যাছে। কন্‌ বাহে কন্‌।’
‘সব থানায় হবে মিয়া। তদন্ত হবে। কেস হবে। বিচার হবে। দু-তিনটা ঘা পড়লে বেরিয়ে আসবে ঘটনা। আসল রহস্য। তুমি বরং লাশের মা-বাবাকে খবর পাঠাও। কাল লাশ নিয়ে যাবে। পোস্টমর্টেম রির্পোট কী বলে দেখা যাক। খুন না হলে তো কথাই নেই! দেখা গেল কী বলে...অ্যা ক্লিন কেস অব সুসাইড।’

লোকটি গরু-গাড়ির পেছনে পেছনে হেঁটে চলে। নগ্ন-পা। শুকনো চোখ-মুখ। সেখানে কোনো উচ্চারণ নেই। যখন শব্দ সমুদ্রের গর্জন হয়ে বুকের মধ্যে আছড়ে পড়ে, মুখে কথা থাকে না। ফাগুনের উদাস বাতাস বুকে কোন্‌ হাহাকার টেনে আনে। এই মানুষজন পৃথিবী বেঁচে থাকার দিনরাত্রি সব অপ্রয়োজনীয় অর্থহীন মনে হতে থাকে। কী প্রয়োজন এসবের! এসবের মধ্যে এ কোন্‌ পরিহাস! জীবন তাকে কী দিল? চোখের নোনা জল। অনতিক্রম্য পাহাড় সমান অস্থিরতা...অতৃপ্তি। নিশ্চুপ উচ্চারণের ব্যর্থ অভিযোগ ।

‘মিলু, আমি কার কাছে অভিযোগ করব? করে কী লাভ? জীবনে যে-সময় চলে যায় তাকে আর ফেরানো যায় না। শোধরানো যায় না কোনো ভুল। হায় জীবন!’

সূর্য একটু আগে হেলে পড়েছে। লোকটি গোধূলিতে তাকিয়ে কি ভাবে? তার পড়ালেখা না জানা চাষা বাবা বলত, ‘সূর্য ডোবে যখন সে ক্লান্ত হয়।’ সূর্য আজ ক্লান্ত। তার ক্লান্তি কোথায়? কোনো বিশ্রাম নেই। পায়ের তালু আর হাঁটুতে সদ্যোজাত ক্ষত। রাতজাগা তৃষ্ণার্ত-বুভুক্ষু মাছি রক্ত চাটছে। বিকেলে ঝরে যাওয়া রক্ত চটকে চটকে কুকুরের জিভে উঠে যায়। তখন দৃষ্টিতে ঘড়ির উলটো-পথ গমনের প্রতিচ্ছায়া। সবকিছু বিপরীত। এই জীবন...বেঁচে থাকা...ঘটনা-দুর্ঘটনা কোনটি সহজ সোজা...সরল রেখায় চলে?

‘দু-ঘা পড়লেই বেরিয়ে আসবে হোয়াট ইস দ্যা মোটিভ। কনেস্টেবল একটু ধোলাই দাও।’
‘কি ধোলাই দিমু স্যার! শালা কথাই কয় না।’
‘আ রে চেয়ারম্যান সাহেব বলেছে। ব্যাটা অরিজিনাল কালপ্রিট। দেখছ ওর চোখ-দুটো। কেমন ঠান্ডা। শালা কেউটের বাচ্চা।’
‘কিন' স্যার আমি শুনছি...।’
‘শোনা কথায় কান দিও না। বসাও হারামজাদাকে।’

অজান্তে গুমট গোঙানি আর আর্তনাদে সন্ধ্যেরাত কেঁপে ওঠে। ছোট ছোট দীর্ঘশ্বাসে বাতাসে ঢেউ তোলে আবদ্ধ নিশ্চুপ মুখ। লোকটি কোনো কথা বলে না। মরণপণ জীবনবাজি। সময় সময়ের গহবরে মিশে যেতে থাকে। মহাকাল চলে যায় ছায়াপথের রেখা প্রান্তে। যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে ক্লান্ত-অবসন্ন শরীর। হয়তোবা ক্লান্তি নয়...স'বির অনুভূতি শূন্য। তারপর একসময় দপ্‌ করে অন্ধকার। নিকষ কালো। আলোর হাজার পাওয়ার বালব নিভে যায়।

এখন লোহার গ্রিল ঘেরা কক্ষে সে একা। মনে পড়ে পুকুর পাড়ের যন্ত্রণাদগ্ধ-সুখ উপলব্ধির কথা। অক্ষম জীবনের একটি মুহূর্ত মিলুর কাজে এসেছে। এটি সুখ নাকি দহন-জ্বালা অথবা সেই আলোর মধ্যে কপিশ অন্ধকার? সে কি অনুসন্ধান করে? আহ্‌ কেন সে আলো জ্বালতে গিয়েছিল? আলো জ্বালতেই নতিশীতোষ্ণ রাত কেমন অস্ফুট-তীক্ষ্ণ চিৎকারে ভরে যায়। টুঁটি চেপে ধরেও বন্ধ হয়নি আকুলতার ধ্বনি...প্রতিধ্বনি। অপ্রতিরোধ্য বিলাপ। অক্ষমতা আর প্রতিশোধের বহ্নিশিখা দু-চোখে এসে মন পোড়ায়। পোড়াতে থাকে। সবকিছু পুড়ে যায়।

সে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল ঘন অন্ধকারে। সারি সারি আমগাছের ভৌতিক সুড়ঙ্গ-গহ্বর। নিজ ঝুম ঝোপে ঝোপে তখন জোনাকির টিপ্‌ টিপ্‌ বাতি অক্ষম বেদনার প্রলয়ঙ্করী ঝড় তোলে। সকল ঝড়ের কারণ আছে...কোনো কোনো বেদনা তাণ্ডবের কথা কখনো বলা যায় না। হয়তো তাই শুক্লপক্ষের নরম রাত মনে হতে থাকে ভয়ংকর আবলুশ অন্ধকার। কোথায় তার আনন্দ-সুখ হারিয়ে গেল? কেন...কেন? কোন্‌ অপরাধে ঈশ্বর? তারপর সকল দুঃস্বপ্ন কিংবা ভুল ভেবে ঘরে ফিরে যেতে সাধ হয়। যখন ফেরে তখন মিলু নেই। সে সারারাত তাকে খোঁজে...শুধু খোঁজে। কোথায় তার নিঃশব্দ নিশাচর দৃষ্টি ঘুরে আসেনি? অবশেষে সেই সকাল। আর্তচিৎকার। জটলা এবং মিলুর দুচোখ উন্মীলিত লাশ। বউটির কোনো সাধ পূরণ করতে পারেনি সে। এখন ধবধবে ফরসা মৃতদেহ। কোনো চাওয়া নেই। অভিযোগ? লোকটি অক্ষম। সে পৌঁছতে পারে না। তাকে স্পর্শ করতে পারে না। সৎকার করতে পারে না। কোনোকিছু পারে না। সে খুন করেছে মিলুকে।

সদরে লাশ চলে গেছে । মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একেবারে পুবদিকে শীতল ঘর। সেখানে নিঃসঙ্গ শুয়ে আছে মিলু। তাকে ব্যবচ্ছেদ করা হবে। কাটা হবে শরীর। অমন সুন্দর শরীর! ছুরি-কাঁচির তীক্ষ্ণ ধার খুঁজে নেবে মাংস আর রক্তের লোনা স্বাদ। অথচ খুনের কোনো চিহ্ন নেই। আলোকে কি ধরা যায়? অন্ধকারকে? লোকটি প্রচণ্ড চমকে ওঠে। অস্বস্তি আর অস্থিরতায় কপালে স্বেদ জমে যায়। রক্তজবা চোখ-দুটো চকচকে ফ্যাকাসে হয়ে পড়ে অন্ধকারের দেয়ালে। ঝিরঝির বরফ-হিম বাতাস। সে অবরুদ্ধ উত্তেজনায় আছড়ে পড়ে গ্রিলের সীমানায়। ফুলে ওঠা পায়ের যন্ত্রণা কোনো অনুভূতিই তোলে না। বিশুষ্ক খাঁ খাঁ সি'র দুটো চোখ কখনো কেঁপে কেঁপে যায়। গোঙানির মতো অস্ফুট স্বগতোক্তি, -

‘চেয়ারম্যান আমি মরে গিয়ে আগুন হই। তোর সবকিছু জ্বালিয়ে ছারখার করে দেব। ধ্বংস করে ছাড়ব। এক এক করে পিশে পিশে মারব তোদের। বেজন্মা কুত্তার বাচ্চা!’

লোকটি আরও কি সব মৃদু বিড়বিড় করে। করতে চায়। যদিও পাথর বুক হালকা হয় না। ঠোঁট নড়ে না। অথচ বাতাসে ছন্দময় দুলছে রাতের ফুল গাছগুলো। নিশিফোটা ফুলের পারিজাত সৌরভে ভরে গেছে চারিদিক। আহ্‌ কি সুন্দর জীবন ছিল তার! কোনো বাহুল্য আকাঙ্ক্ষা নয়। একটি শুধু স্বপ্ন। হাজার বছর ধরে লালিত ক্ষুদ্র সেই সাধ। মিলুর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের পথটুকু হেঁটে যাওয়া। এ ছাড়া আর কোনো চাওয়া নেই। সেই তো অসামান্য অপার্থিব সুখ। অথচ দুঃস্বপ্নের ভয়াল রাত কবরস্থানে খনন করে চলে গেল যন্ত্রণার নীল বিষ। যন্ত্রণা। দুঃসহ যন্ত্রণা! সে তো কোনো দোষ করেনি। কোনো পাপ করেনি। অভিযোগ অক্ষম মুষ্ঠিতে শুধু মাটি কামড়ে ধরে রাখে। সে আর কী করতে পারে তখন?

সেদিন সন্ধ্যেরাতে দু-জনে আসছিল। সিনেমা হল হতে বাড়ি কতটুকু পথ! কবরস্থানের কাছাকাছি হতে উচ্ছল মিলু তার হাত চেপে ধরে। ঘেষে আসে শরীরের সঙ্গে। ভয়। সে তখন শিহরিত ভয়ার্ত নিঃশ্বাসে পুলক খুঁজে নেয়। আদুরে তুলতুলে বউ তার! আরও কাছে টেনে ধরে।

‘শোনো এ রকম জায়গায় সবাই একদিন ফিরে আসে। ভয় কি! আমি তো সঙ্গে রয়েছি।’
‘আমার ভয় করছে। শুধু শুধু শার্টকাট রাস্তা ধরলে। কোথা থেকে কি হয়...বোঝো না!’
‘হো হো হো আচ্ছা ভীতু বউ আমার!’
‘তুমি খুব সাহসী। এ সময় যেখানে সেখানে ঘুরতে নেই জানো না। কোন্‌ বাতাস কখন লাগে!’

সে আর কী বলতে চেয়েছিল। উন্মুখ মুখ স্তব্ধ হয়ে যায়। থরথর করে কাঁপছে সংসার অনুরাগী মিলু। কয়েকটি বিকট অন্ধকার ছায়া রাস্তা ফুঁড়ে দাঁড়িয়েছে কখন? চেয়ারম্যান আর অচেনা ক’জন দুর্ধর্ষ ভয়ংকর মানুষ। তারা আড়াল করে ফেলে পথ। চাঁদের আলো দৃষ্টিসীমায় থাকে না। সেইসঙ্গে জীবন...স্বপ্ন। এতটুকু সুখ। সে একবার নয়...কয়েকবার হাত দিয়ে ছোরার ঘা’কে সরিয়ে দেয়। রেহাই মেলে না। বউটি তার পাঁচ মাসের পোয়াতি। দু-জনের কত সাধ! ছেলে হলে কী নাম রাখবে। অজস্র মুহূর্ত খুঁজে গেছে পরীর মতো ফুটফুটে মেয়ের নাম। সব শেষ। তার সকল স্বপ্ন-মহাকাল-সভ্যতা চোখের সামনে একে একে চারজন পশু তছনছ করে দেয়। আঁধারের দেয়ালে সাক্ষী হয়ে জেগে থাকে কতগুলো চেহারা। বীভৎস-কুৎসিত-ভয়ংকর। সে শুধু রক্তাক্ত হাত-পা-মুখ বাঁধা অক্ষম একজন, পরিত্যক্ত কবরের গহ্বরে পড়ে পড়ে অস্তিত্ব খনন করে যায়। বিষ্ফারিত চোখে অন্ধকার ছায়ার কারসাজি দেখে চলে। আঙুলের নখ হাতড়ে আঁচড়ে কেটে কেটে গর্ত করে ফেলে রাতের কাদামাটি। বুকে জমিয়ে রাখা সুখ-স্বপ্ন-সাধ। উল্লাস-গোঙানির বিদীর্ণ শীৎকারে অদ্ভুত আচ্ছন্ন রাত ভারী হয়ে ওঠে। অসহায় অবরুদ্ধ কান্নার হাহাকার বাতাসের ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভেসে ভেসে চলে দূর-সীমানায়। একলা চাঁদের রূপোলি জোছনা কি ইতিহাস লিখে যায় গাছের পাতায় পাতায়...হিমেল ঘাসের শিখর দেশে। কেউ না জানুক সে জানে। আহ্‌ না জানাই বোধহয় ভালো ছিল!

এরপর পুরোনো সত্যকে জাগাতে কত না মিথ্যা! কত না লুকোচুরি দু-জন দু-জনের কাছে! দৃষ্টির ভেতর দৃষ্টি থেকে। নিজের কাছে।

‘আমার খুব সাধ গো তোমার সাথে ঘর করবার। কিছু হলো না।’
‘কে বলল হলো না? আর এসব কী ভাবছ তুমি? কিছুই হয়নি আমাদের মিলু। কিছু না। তুমি স্বপ্ন দেখেছ। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন। ভুলে যাও। ভুলে যাও সেটা।’
‘আমার বাচ্চা...বাচ্চা কই আমার?

মাঠের সবুজ ঘাস তখনো সব রক্ত শুষে নেয়নি। গাছের পাতারা থেমে যায়নি। মৃদু বাতাসে দুলছিল। আকাশের চাঁদ ক্ষণকাল মুখ লুকোয় মেঘের ভাঁজে ভাঁজে। না তেমন কিছুই হয়নি। অসহায় মানুষ এভাবেই ক্রূরতার কাছে নতজানু হয়। তাই কি? লোকটির দৃষ্টি আবছা অন্ধকারে তীব্র হয়ে ওঠে। বিশুষ্ক আগুনের শিখা। মনের খড়গ টেনে এনে সুতীক্ষ্ণ করে তোলে তার প্রান্তজমিন। একদিন সে শোধ নেবে...একদিন; নিশ্চয় একদিন।

দুর্বিষহ জীবনের মাঝে সময় এনে দেয় নতুনের প্রত্যাশা। পুরোনো ক্ষতের উপর পলির মতো জমে ওঠে দিনকালের প্রলেপ। এই তো বেঁচে থাকা। তাই সে রাতে আলোছায়ায় দু-জনে মুখোমুখি বসেছিল একবার। প্রথমবার। হয়তো প্রথমবার নয়...পুনরায় একবার। আলো জ্বালতে...আলো জ্বালতেই মিলুর দুধ সাদা বুকে কী দেখেছিল সে? একটি ধারহীন দা ঘষে ঘষে তাকে কেটে চলে। কেটে চলেছিল, শ্লথ...অত্যন্ত শ্লথ...বিস্রস্ত ধীর গতিতে। যন্ত্রণা? সে কি শুধুই অক্ষমতার নীল বিষ? মরে যেতে চায় অথচ বেঁচে থাকার সাধ শেষ হয় না। আহ্‌ জীবন তুমি কেন অন্ধ হলে না?

পুকুর পাড়ে বউটির লাশ আগলে সে শুধু মনে মনে এই বলে চলেছিল, -
‘বউ আমারও তো সাধ পূর্ণ হলো না। তোকে নিয়ে আমি যে তাজমহল গড়তে চেয়েছিলাম।’
পুনরায় জেগে ওঠে সেই রাত। অন্ধকার বিভীষিকাময় রুপোলি জোছনা। সহস্র আকুতি জ্বালিয়ে দেয় ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরির সেই প্রতিশোধ স্পৃহা। ভয়ংকর...বিনাশী। পরক্ষণে মনে হয় সে তো হেরে গেছে। পরাজিত অথর্ব এক মানুষ! ভাগ্য বিড়ম্বিত জীবন! তখন ক্ষতবিক্ষত মনের কোণে জেগে ওঠে ভয়ানক দৃশ্য। সেই বিকট গোঙানি...উল্লসিত শীৎকার... । বউটি তার সেই কষ্টে সেই লজ্জায় নিজের নরম হাতে জীবন কেড়ে নিল ।

লোকটি  গগনবিদারী প্রচণ্ড চিৎকার দিয়ে ওঠে। আকাশের চাঁদ থরথর কেঁপে যায়। সে হারবে না। হারতে পারে না। একদিন...ঠিক একদিন প্রতিশোধ নেবে। তারপর ধীরে ধীরে লোনা জলে ভরে ওঠে তার দৃষ্টি। দোমড়ানো চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে থানা কম্পাউন্ড থেকে দূরে...বহুদুরে...দূর দিগন্তে।    
             
***

No comments:

Post a Comment