কোথায় কি!

25 May 2017

মামুন ম. আজিজ





সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে রাস্তায় এক পা দেয়া মাত্রই মনে হলো ওমন একটা মিথ্যা কথা শিলাকে না বললেও হতোশিলা আমার স্ত্রীমিথ্যা কথা গাছের শিঁকড়ের মতো, ভেজা মাটি পেলেই শাখা প্রশাখা বাড়াতে থাকবেঅপরিকল্পিত মিথ্যা নিয়ে শেকড়ের শাখা গজানো বেশিক্ষণ ঠেকানো যাবে নাকল দিয়েই দিলামদিয়েই মনে হলো আরও একটা ভুল হলোমাত্র সকাল ৮টা, ছুটির দিন, ওর ও ক্লাশ নিতে যেতে হবে নাআমারও অফিস নেইস্বভাবতই আমি সিঁড়ি দিয়ে চারতলা হতে নামতে নামতে ও আবার ঘুমিয়ে পড়তেই পারেসেই ঘুম ঘুম অবস্থায় যখন শুনালাম, শিলা তোমাকে আসলে মিথ্যে বলে এসেছি, তুমি তো জানো আমার অনিদ্রা রোগটা বেড়েছেস্বপ্নের পরিমাণও বাড়ছেতোমাকে না বলেই একজন সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে গিয়েছিলামতারই চিকিৎসার অংশ হিসেবে এই সাত সকালে ছুটির দিন বেড়িয়ে পড়াআমার মোবাইল বন্ধ থাকবেতুমি কিন্তু চিন্তা করো না
 ওপাশ থেকে, ‘কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা, হুম...যাক তবু সাইকিয়াট্রিস্ট দেখালে শেষ মেষবলোনি কেনোআচ্ছা সে পরে শুনবঘুম পাচ্ছেযাও যেখানে খুশি যাওবিকাল ৩টায় তোমার মেয়ের কোচিং আছে  ওখানে নিয়ে যেতে যেন ভুল না হয়
! আশ্চর্য তোচিরচেনা শিলা তো নয়বৃষ্টির মানে আমার মেয়ের কোচিং মনে আছে কিনা- ওটুকু! আহারে ঘুমঘুম মানুষের মাঝে কত পরিবর্তনই না আনেআর আমার সেই ঘুম নেইচোখ বুঁজে থাকি ঘন্টার পর ঘন্টা, একটু ঢুলু ঢুলু ভাব যেই এল এল ভাব অমনি আর একের পর এক স্বপ্নগভীর ঘুমের স্বপ্ন নয়, সব যেন স্পষ্টনা ঘুম, না স্বপ্নএ এক ভীষণ অস্থিরতাপ্রতিটা স্বপ্ন ভয়াবহ ভীষণএ যেমন, আমি অফিসের ক্যাশ কাউন্টারের ভেতর আমার আসনটিতে বসে আছিচেক আসছেপাস করে দিচ্ছিহঠাৎ চোখ টা একটু কাউন্টারের দিকে ফেরালামএকটা মহিলা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেকাঁধে একটা কালো ব্যাগবোরকার আড়ালে তার চোখ দুটো  একটু  দেখা যাচ্ছে  কেবলভীষণ সুন্দর দুটি চোখআমার সাথে চোখাচোখি হলোহঠাৎ মহিলা কাঁধের ব্যাগটি নামিয়ে কাউন্টারের দিকে ছুঁড়ে দিলোমুহূর্তে ভীষণ শব্দ, সব অস্পষ্টআর আমার চোখ খুলে গেলোঘুম টলে গেলোআবার ঘুমের চেষ্টা করলামআবার স্বপ্ন- এবার পট ভিন্ন; আমি আর শিলা হাঁটছিতার সুন্দর হাত দুটো আমার হাতে বন্দিএকটা বাগান পেরিয়ে আমরা একটা বাঁধের উপর দিয়ে হাঁটছিসরু বাঁধহঠাৎ বাঁধের দুদিক থেকে দুটি বড় বাঘ দৌঁড়ে আসতে দেখলামশিলা কাঁপছেকাঁপতে কাঁপতে তার হাত ছুটে গেলো সে নিচের জলাধারে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেআর একটা বাঘ আমাকে কামড়ে পেটে পুড়ছেআমি বাঘের পেটে থেকে বের হবার জন্য চিৎকার করতেই, চোখ খুলে গেলোকিংবা হয়তো স্বপ্ন এমন, আমি দুপুরের লাঞ্চ করতে অফিস থেকে বের হয়েছিরেষ্টুরেন্টে খেয়ে হেলে দুলে একটা সিগারেটে আয়েশ করে টান দিতে দিতে (যদিও আমি সিগারেট খাইনা) অফিসের গেটের কাছে যেই পৌঁছালাম ওমনি ম্যানেজারের গলা শুনতে পেলামদরজা খুলে সে এগিয়ে আসছেতার সাথে কালো পোশাকের দুজন  ভয়ংকর লোকহাতে আগ্নেয়াস্ত্রতারা আমার দিকে এগিয়ে আসছেএগিয়ে এসে আমার হাত ধরে তাদের গাড়িতে উঠিয়ে ফেললোম্যানেজার বলছে, এই এই ব্যাটাই ক্যাশ থেকে ১ লাখ সরিয়ে একটু আগে বাইরে পাচার করেছেআমি কেঁদে উঠি, চোখ খুলে যায়এমনি শত শত স্বপ্ন
এসবই পরশু সাইকিয়াট্রিস্টকে বলেছিসব শুনে তিনি বলেছেন, পারিবারিক ব্যস্ততা, অফিসের অমানুষিক কাজ আর পত্রপত্রিকায় ও অনলাইনে অস্থির সব খবরাখবর বারংবার পড়তে পড়তে আমার ব্রেন অতিরিক্ত পরিমাণ চাপ সহ্য করছেএর একটাই সমাধান- নিজের জন্য  সকল প্রকার সোশাল মিডিয়ার ঘোরফেরা এবং মোবাইল বন্ধ রেখে কেবল নিজের জন্য নিজের মত করে কিছুটা সময় হলেও ব্যয় করতে হবে  
আজ শুক্রবার ছুটির দিন সকালে সেই একক কিছুটা সময় ব্যয় করার জন্যই বের হয়েছিবড় রাস্তায় পৌঁছানোর আগেই মোবাইলটা বন্ধ করেছিএটুকুন পথ আসতে আসতে ভেবে নিয়েছি কোথায় যাবছোট বেলায় খুব প্রিয় জায়গা ছিলো চিড়িয়াখানাপশুপাখী বন্দি বিষয়টা আমার ভালো লাগে না যদিও তবু ওদেরকে বন্দি না করলে তো আমরা ওদের সান্নিধ্য পাবো নামানুষ হবার এটাই লাভ, নিজের স্বার্থে আমরা জগতের সব স্বার্থকে হত্যা করতে পারিজ্যাম এর পরিমাণ ২৫ শতাংশ হলেও আমি ঘন্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে যাবঐ তো বাস আসছেবাসটার দিকে তাকিয়ে আছি
হঠাৎ একটা শব্দআঁতকে ওঠার মতডানের গলিটা থেকে একটা গাড়ি বের হচ্ছিলোবাসটাও গলিটা পার হচ্ছিলো সজোড়ে চালিয়ে দ্রুত স্ট্যান্ডে আসার জন্যওটার পেছনে একই সিরিজের আরেকটা বাস ওটাকে ওভারটেক করে আগে আসতে চাচ্ছিলোএই তাড়াহুড়ায় মুখোমুখি সংঘর্ষবাসটা ব্রেক করে কুলাতে পারে নিপাঁচ হাত সামনে ছিটকে পড়লো সাদা প্রাইভেট টাআঁতকে উঠলামস্বপ্নে বুঝি নতুন মাত্রা যোগ হলোছুটে গেলামড্রাইভার একা মনে হলোতার তখনও জ্ঞান আছে
কিন্তু একি, এযে আমার সাইকিয়াট্রিস্ট! নিজেই ড্রাইভ করছিলেনএই সাত সকালে এখানেদূর কত কাজেই আসতে পারেন এই আদাবরেওনার তখনও ভালোই জ্ঞান আছেআমাকে চিনতে পারলেনআরে এহাস সাহেব নাআমি হ্যাঁ বলে আরও এক দুজনের সহায়তায় ওনাকে একটা সিএনজি ডেকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম


আমাকে চিনতে পারলেন। আরে এহসান সাহেব না। আমি হ্যাঁ বলে আরও এক দুজনের সহায়তায় ওনাকে একটা সিএনজি ডেকে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। 
নিজের জন্য নিজের মতো করে একটা দিন কাটানো হলো না। হাসপাতালে কতক্ষণ লাগে থাকতে হয় কে জানে। তার উপর পুলিশ এসে যদি আরও সময় কিছু ছিনিয়ে নেয়। তিনটার আগে ফিরতে পারবো তো?
ফিরতে পেরেছিলাম তিনটার আগে। তবে একটা দারুণ অভিজ্ঞতা নিয়ে। ডাক্তারের দু'হাতেই  হালকা ফ্রাকচার হয়েছে আর মাথায় গালে কপালে কিছুটা কাটাকুটি। সিরিয়াস তেমন কিছু হয়নি, বেঁচে গেছেন সে যাত্রায়। সিএনজিতে বাম হাতটা একটু নাড়িয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দিয়ে বলেছিলেন, এহসান সাহেব দয়া করে দুটো কল  করে দিবেন। একটা দেখেন ‘বউ’ নামে সেভ করা আছে। ওকে কল করে বলবেন সিরিয়াস এক্সিডেন্ট করেছি, হাসপাতালে আসতে বলবেন। আর পরেরটা কল দিয়ে একটু আমার কানে ধরেন। ওর নামটা  পিএটিয়াইইএনটি-১ নামে সেভ করা আছে।
পরের নম্বরটিতে কল দিয়ে যখন ডাক্তারের কানে দিলাম, উনি ফিসফিসিয়ে বললেন, তোমার বাসা থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় আসতেই একটা বাসের ধাক্কায় এই সামান্য একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে । তেমন কিছু না। রিয়া আসছে। তুমি চিন্তা করো না। রিয়া চলে গেলে আমি জানাবো।
আমি বুঝলাম যা বোঝার। বুঝলাম মনোরোগ বিশেষজ্ঞেরই তো নিজের কোন সময় নেই। ঘর ওয়ালি আর বাহার ওয়ালির চক্করে তা তার জীবনই নির্ঘুম।

 

No comments:

Post a Comment