প্রতিটি মানুষেরই একটি স্বপ্ন থাকে তার মনের গহীনে। যা তাকে
সেই শৈশব হতে জীবনের শেষ অব্দি তাড়া করে ফেরে বা পিছু পিছু ছায়ার মতো অনুসরণ করে। মানুষ
স্বপ্ন নিয়েই তার যাপিত জীবনাচারণ পরিপালনের একটি ছক আঁকে। কেউ
কেউ তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে, কেউবা ঈশ্বরকে দায়ী করে তার স্বপ্ন
পূরণ না হওয়াতে। তবুও মানুষ স্বপ্ন
দেখে বলেই বেঁচে থাকে, এক আবিষ্ট ঘোরের মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে। স্বপ্ন
না থাকলে মানুষ হয়তো তার জীবন নিয়ে এতো ছন্দময়, গতিময় সময় অতিক্রম করতে
পারতো না। স্বপ্নই তাকে তাড়িত করে, চালিত করে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে।
আমারও তেমনি স্বপ্ন ছিলো। ছোট
বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে সিনেমা দেখতাম। আর সিনেমার
নায়কদের দেখে মনে মনে ভাবতাম আমিও সিনেমার নায়কদের মতো নায়ক হবো। আহা! সে সব কী যে আনন্দের দিন ছিলো। সিনেমা
দেখে নায়কের গাওয়া সেই সব গান গেয়ে বেড়াতাম। একদিন
নানাবাড়ি যাচ্ছিলাম, গ্রামের ফাঁকা মাঠ ধরে গান ধরলাম, ‘আমি এক দুরন্ত যাযাবর’। যাক, সেটা আর হলো না। সে স্বপ্ন
আর বেশি দূর এগুতে পারেনি। স্কুল
থেকে কলেজ জীবনে উঠার আগেই রাজনীতির পাঠ নিলাম। তখন
স্বপ্ন দেখলাম, একজন বিরাট রাজনীতিবিদ হবো। ভাষণ
দিয়ে বেড়াবো, মানুষের দুঃখে নিজেকে জড়িয়ে নেবো। মানুষের
কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত একজন কর্মী হিসাবে ভাবতে ভীষণ ভালো লাগতো। বেশ
অনেক দিন চললো তার তালিম। সেদিন গুলোও কিন্তু
বেশ ভালোই ছিলো। ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব দিতাম। ছাত্ররা
অনেক সমীহ করতো। রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে অনেক পড়াশুনা হলো। এক সময়
আর এগুনো গেল না। রাজনীতিবিদ হওয়ার স্বপ্নও ভেস্তে গেল। তবে
ছাত্রাবস্থায় লেখালেখি শুরু করেছিলাম। আর লেখালেখি
করতে করতেই সাংবাদিতকায় ঢুকে পড়া। সাংবাদিকতার
মতো ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলাম।
সাংবাদিকতা করতে যেয়ে স্বপ্ন দেখতাম, আহা! যদি প্রথম শ্রেণির জাতীয় কোন দৈনিকে কাজ করতে পারতাম!
থাকতাম মফস্বলে, তাই মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবেই
চিন্তা করতাম। এ স্বপ্নটি আমার
পূরণ হয়েছিল। খুলনা থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক প্রবাহ’ দিয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম। অতঃপর
জাতীয় পত্রিকা ‘দৈনিক আজাদ’, ‘বাংলার বাণী’, ‘অবজারভার’, ঘুরে ‘দৈনিক বাংলা’। আর সেদিনই
আমার স্বপ্ন পূরণ হয়েছিল। যে স্বপ্ন দেখেছিলাম
একদিন কোন জাতীয় দৈনিকের সংবাদদাতা হবো। অধুনালুপ্ত ‘দৈনিক বাংলা’র মতো পত্রিকায় মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার
ফলে আমার সে স্বপ্ন পূরণ হলো। আমার
স্বপ্ন আমাকে ধন্য করেছে। স্বপ্ন নিয়ে
এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে।
সাংবাদিকতার পাশাপাশি ঝোঁক ছিল লেখালেখিতে। কবিতা, ছোটগল্প, ফিচার, কলাম লিখতাম সংবাদপত্রে। পাশাপাশি
‘নোঙর’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা করতাম। নেশার
মতো মনে হতো। স্বপ্ন দেখতাম, আমার সাহিত্য পত্রিকাটি দেশময় ছড়িয়ে পড়বে। সে স্বপ্ন
পুরোপুরি পূরণ হয়নি, আংশিক পূরণ হয়েছে। স্বপ্ন
দেখতাম আমার লেখা কবিতা গল্প সংবাদপত্রে ছাপা হবে। লেখক
হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তুলবো। পারিনি। যা লেখি, তা হয়তো অখাদ্য। হয়তো
কেউ পড়েই না। তাই আমার পরিচিতিও নেই। সেখানেও
ব্যর্থ। তবু হাল ছাড়িনি। কেউ
পড়ুক বা না পড়–ক, আমি আমার লেখা চালিয়ে যাবো। হলে
হবে, না হলে না হবে, সময়ই বলে দেবে। তাই
মনে হয় লেখক হয়ে ওঠা হয়নি। হয়তো
হবেও না কস্মিন কালেও, তবুও ব্যর্থ চেষ্টা চলছে। ব্যর্থ
প্রয়াস নিয়েই স্বপ্ন দেখি। আর এখনো
স্বপ্নবাজের মতো স্বপ্ন দেখি বলেই কিছু লেখার অনুপ্রেরণা নিজের মধ্যেই জেগে ওঠে। স্বপ্ন
অন্তরে ঘুমিয়ে থাকে আগ্নেয়গিরির মতো।
আমি এখন আমার অনেক হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের মধ্যে নতুন
করে একটি স্বপ্ন দেখছি। ‘এবং মানুষ’ নামে সাহিত্যের একটি ছোটকাগজ বের করার স্বপ্ন দেখি। আর তা
দেখতে দেখতে তিন বছরের আগেই আটটি সংখ্যা প্রকাশিত হলো। তবে
শত শত লিটলম্যাগের ভিড়ে একে টিকিয়ে রাখার যে স্বপ্ন দেখছি, তা কতোটা সম্ভব আমি নিজেই তা জানি না। তবে
স্বপ্ন নিয়েই এগুচ্ছি। আর মানুষের এসব
ব্যক্তিগত স্বপ্ন আশা আকাঙ্ক্ষা যাই বলিনা কেন, এসব আছে দেখেই মানুষ
বেঁচে থাকে তার নিজের মধ্যে। বেঁচে
থাকে তার কাজের মধ্যে, ঘোরের মধ্যে। স্বপ্ন
না থাকলে মানুষের এই ক্ষণস্থায়ী জীবদ্দশায় মানুষ হয়তো কোন কাজই তেমন সফলভাবে করতে পারতো
না। তাই আমি নিজেকে একজন স্বপ্নবাজ বলে ভাবতে
ভালোবাসি। স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে আছি এবং স্বপ্ন দেখেই
মরতে চাই।
________________________________________________________
আনোয়ার কামাল: কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য আলোচক।
সম্পাদক-এবং মানুষ (সাহিত্য বিষয়ক ছোটকাগজ)
No comments:
Post a Comment