অনঙ্গ শৃঙ্গার
রাত্রির
চক্রে কোনো মন্ত্রধ্বনির দিকে অবাক তাকিয়ে থাকে পৃথিবী। আর তুমি চিরদিন গীতবিতান, বাগানের ঘরে আলো আলো অলকানন্দা, একটি গানের ভিতর থেকে তাকিয়ে আছো ঘরজুড়ে, একটি বিজলিশব্দের
মুখোমুখি যেনো বা একটি প্রার্থনার রূপ, অনুরূপ তুমি বুঝতে চাইলে নিজের বাইরে একটি বাতাস গাছ উপড়ে এলোমেলো
করে ঘর। এবং আরো প্রলোভনসঙ্কুল দৃষ্টিতে অব্যাহত
থাকে। আমিই সেই এলোমেলো বিবাগী ঘর।
তোমার চিত্রাঙ্গদাপর্বে
আমি একটা জিরাফ এঁকে দিই, কালো রঙে। জিরাফ দেখেছি চিড়িয়াখানায়। চলো, চিড়িয়াখানার জিরাফগুলোকে বের করে নিয়ে আসি। তারপর আসো তোমার সঙ্গে ঘুরি। আর আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। ঝড়ে ভেঙে পড়ে ঘুমগাছের শুকনো একটি ডাল। আর তুমি আমার হাত ধরে ফুটপাথ
থেকে রাস্তায় নামিয়ে নাও। তোমার সহসা স্পর্শে আমার রক্তের ভিতর বিঁধতে
থাকে বৃষ্টির ফোঁটাগুলি। আর নীরবে হেসে যায় তিনটি জিরাফ।
যে অজাত
নোনা পৃথিবীর সঙ্গে এত গভীর প্রণয়, আকাক্সক্ষা যেমন অনুভূত হবে তা থেকে অপহৃত রাস্তার আলো, মানে সোডিয়াম লাইটের
অধীনে নীল ছায়া হাতাহাতি করে। মেঘ আর চাঁদ ভিড় করে। তুমি কার মুখ বহন করে দাঁড়িয়ে থাকো উত্তরের রাস্তায়, প্রশ্নের আকরে? একটি মধ্যরাত্রির পুকুর, জবুথবু ফিরে আসে
যে প্রথম বাড়ি ছেড়ে জলাশয়ে নেমে গিয়েছিলো রাত্রিপাওয়া সেইসব জিরাফের মতো।
তুমি মধ্যে মধ্যে এমন কিছুর সন্ধান দাও যা আর কেউ পারে না। ওপরে ওঠতে ওঠতে, মেঘের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে, পাশে পাহাড়ের খাঁজে, মাথায়, বুকের ভাঁজে মেঘের শৃঙ্গার দেখতে দেখতে আমার প্রথমেই যে কথাটা মনে হলো, এমন সুন্দরকে তোমার সঙ্গে বসে না দেখলে কখনো পূর্ণতা পাবে না। আমার মনে হলো অন্তিম দিনগুলিতে হলেও একবার তোমার সঙ্গে যাবো আবার সেইসব সুন্দরের পেটের ভিতর। পরদিন মনে হলো, আমার আর কারো কথা কেনো মনে হলো না? উত্তর পাইনি। নিজের কাছে আশ্চর্য লাগছে নিজেকে। প্রকৃত অর্থে তুমিই আমার নারীসত্তা।
তুমি মধ্যে মধ্যে এমন কিছুর সন্ধান দাও যা আর কেউ পারে না। ওপরে ওঠতে ওঠতে, মেঘের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে, পাশে পাহাড়ের খাঁজে, মাথায়, বুকের ভাঁজে মেঘের শৃঙ্গার দেখতে দেখতে আমার প্রথমেই যে কথাটা মনে হলো, এমন সুন্দরকে তোমার সঙ্গে বসে না দেখলে কখনো পূর্ণতা পাবে না। আমার মনে হলো অন্তিম দিনগুলিতে হলেও একবার তোমার সঙ্গে যাবো আবার সেইসব সুন্দরের পেটের ভিতর। পরদিন মনে হলো, আমার আর কারো কথা কেনো মনে হলো না? উত্তর পাইনি। নিজের কাছে আশ্চর্য লাগছে নিজেকে। প্রকৃত অর্থে তুমিই আমার নারীসত্তা।
তোমার কণ্ঠ
নীল, একটি চিৎকার ছুঁয়ে তীব্র কালশিটে দাগ বেরিয়ে চিত্রাভ শরীর থেকে। জল থেকে অপহৃত বাতাস যেমন পাতলা ঘনত্বের মধ্যে তার নখ ও নখরে চিরে দেয় বনান্তরের
অনুভূতিকে, ঠিক তেমনিভাবে তোমার শরীরের সঙ্গে বেজে ওঠে আনন্দগান। এই গানের মুক্তি এই জগতে, তার ঠান্ডা পায়ের নিচে আশ্রয় নেয়, যেখানে সঙ্কুচিত নীল মাথা ঢাকবার জন্য
একটি জাল আছে। প্রতিটি নৌকা একই সঙ্গে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য। আমি তোমার পা ছুঁয়ে দিই আমার বরফহাতে, ঘষে ঘষে জাগাই সূর্যকান্ত অরণ্য।
তারপর মুখভঙ্গি
অপরূপ, খেলাচ্ছলে তুমি শোনালে বন্ধবাতাস এবং তার হৃদয়ের কম্পনের ইতিকথা। তার তীরে অদ্ভুত দূরবর্তী সুন্দর ভাঁজ খোলে, যেন এটা একটি প্রাচীন মানচিত্র, নিজেই নিজের মধ্যে
অধিষ্ঠিত। তোমার নীল শিরা, নীলচে কালো চোখ, চোখের পাপড়ি সকল অসুন্দরকে গ্রাস করে।
তোমার পূজাপর্ব
থেকে বের হয়ে আসো, তুমি দুইচোখ বুজে আমার রক্তের ভিতর ঢুকে যাও। দেখো, কেমন করে তৈরি হয় গানের কথা। গানের কথাগুলি কাক হয়ে যায়। আমি তো কাকতাড়ুয়া নই। আমি নিজেই কাক। আর তুমি জগতের সকল পুষ্পভার আমার হাতে দিয়ে হাসো। তোমার চোখের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে আমার রঙিন দীর্ঘশ্বাস। তোমাকে বুঝতে দিই না। বুঝতে না দেয়ার মধ্যে একধরনের আনন্দময়
যন্ত্রণা আছে। সেটা সুন্দর। এবং তা থেকে সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমি মনে মনে চেয়েছি। আমি মনে মনে চাইলে হয়, তুমি আমার হাত ধরো। এই আনন্দ লুকিয়ে রাখি আমি আমার
দীর্ঘশ্বাসের ভিতর।
তুমি কি
দেখতে পাচ্ছ একটি শস্য অথবা একটি তৃণভূমিকে নদী ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে? ধানের মধ্যে, বায়ুর মধ্যে তুমি
তোমার হাত ঘষা পাতার মর্মরধ্বনি শুনতে নেচে বেড়াচ্ছো তোমার মতো। আমি সেইদিন সন্ধ্যায় ব্রিজের ধারে দাঁড়িয়ে তোমার জন্য একজোড়া ঘুঙুর কিনতে চেয়েছিলাম, জানো!
তোমার গুনগুন
করা গান আমার বুকের ভিতর ঢুকে পড়ে। তোমার গানের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকি
তারপর। একটি বারান্দায় প্রাচীন এক কণ্টক দিয়ে গেঁথে রাখি উড়ুক্কু মৃত্যুসমগ্র। একটি নির্জন ফুল সেই মৃত্যুর পাশে বেড়ে ওঠে। আর রং বদল করে প্রতিদিন। প্রতিদিন বদলে যায় তার আলো ও অন্ধকার। প্রতিদিন বিভাবরী রাত আসে তোমার পায়ের পাশে নক্ষত্রের রূপ ধরে। সেইসব রাতের সৌম্য উপস্থিতি আমি ভালোবাসি। আমি দুঃখ ও আনন্দের ভিতর তোমার মুখ মনে করি।
আমি তোমার
নারীসত্তা। আমি একটি ভাঙা হাসি ও হাজার স্মৃতির পায়ের
কাছে মধ্যরাত্রির হাওয়াকে আপন করে তোমাকে যাচনা করি। জলসংগীতে নৌকাবন্ধ ঘাট, পাখি ছেড়ে যায় সন্ধ্যার আকাশ। তারা একটি জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চেহারাহীন ওড়ে ওড়ে করে অর্থহীন ক্রন্দন। বিন্দু নেই, কাউকে স্মরণ করতে যে আকাঙ্ক্ষা লাগে তা তোমার ছোটো রাত্রি আর মনোমোহন কান্নার অখণ্ডতা
থেকে উত্থিত। তুমি তো সেইই গীতবিতান যে আমার এই ভাঙাপৃথিবীর
চিরপুষ্পক রথ, আমার অনঙ্গ শৃঙ্গার।
রাত্রি মা
আমি অনেকদিন
ভুলে গিয়েছিলাম আমার মায়ের নাম রাত্রি। আমার নানার কবরের বুকে পুঁতে
দেয়া খেজুরের ডাল যখন হলুদ হতে হতে একদিন সজীব হয়ে ওঠলো সেদিন মনে পড়লো আমার মায়ের
নাম। রাত্রি জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে
থাকে চিরদিন। শুয়ে থাকে গাঢ় কুয়াশার ভিতর। নানার কবরের ওপর বেড়ে ওঠা খেজুরের ডাল যখন একটা গাছ হয়ে ওঠে তখন শীতের রাতে বড়
মামা একটা মাটির কলসি খেজুরগাছের গলায় বেঁধে দেয়। ভোরবেলা তা গরম রসে পূর্ণ হয়। প্রতিটি ফোঁটায় রাত্রির কান্না
মিশে থাকে। আর বড় মামা শেষ সম্বল একটা কড়ই কাঠের দরোজা
কাঁধে নিয়ে পার হয়ে যায় সাতপাহাড়। সাতপাহাড়ের ওপারে যে শাদাপরী
থাকে সে মামার দরোজার দুইটা কপাটকে বানিয়ে দেয় শাদা দুইটা ডানা। তারপর বড়মামা আর ফেরে না, আমার রাত্রি মা সুরা ইয়াসিন পড়তে পড়তে সুর করে কাঁদে, তার কান্নায় কুরানশরিফের
কালো অক্ষরগুলি শাদা হয়ে যায়। রেহেল কেঁপে কেঁপে ওঠে। এর আগের দিন আমার নানি স্নান করতে করতে মরে গিয়ে পুকুরের জলে ভেসে ওঠে দুইটা শাপলা
আর একটা পদ্মফুলের পাশে, তখনো পদ্মপাতায় টলোমলো করছিলো জীবনদাশের বিলাপ।
আমার রাত্রি
মাকে একদিন তিনটা ডাকিনী নাকি স্বরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো নদীর পাড়ে। মা ভেবেছিলো জরিনা ডাকছে। অথচ জরিনা তখনো ঘুমিয়ে। আমার মা তাহাজ্জুদ নামাজ ভাঙতে ভাঙতে কলসি কাঁখে ডাকিনীদের সঙ্গে জল আনতে গেলো
নদীতে। তখনও ফজরের আযান হয়নি, মা বুঝতেই পারলো
না। তখনো আমি হয়তো মায়ের স্বপ্নের ভিতর ছিলাম
বীজাণু। নানা টের পেয়ে তিন ডাকিনীকে খুন করে মাকে
কুড়িয়ে নিয়ে এলো নদীর চর থেকে। তখনো ম্লান জোছনা ডুবে যাচ্ছিলো
ঘন বাদাম ক্ষেতের আড়ে। এইসব কথা আমি তোমাকে বলছি কেনো জানতে পারবে
না কোনোদিন। কেননা তুমিও কুয়াশার ভিতর শুয়ে শুয়ে তোমার
পাখিশিশুদের উড়িয়ে দাও প্রতিদিন। এই রকম অনেক গল্প আমার মাকে
নিয়ে আমি লিখে রেখেছি কোথাও শালের পাতায়, কোথাও মেঘের ভাঁজে, কোথাও ঝর্ণার তলে ক্ষয়ে যাওয়া প্রাচীন পাথরে, কোথাও আমার হাতের
রেখায়, আকাশের তারায়, কোথাও দিগন্তের গায়ে, কোথাও তোমার চোখের উল্টোপিঠে। তার মানে তুমিও জানো সব গল্প।
কখনো তুমিও
রাত্রি, আমার মায়ের মতো। বসো রাত মুখোমুখি বসো রাত্রির মতন। বসো ঘুম, চোখজুড়ে বসো স্বপ্নের গোপন। শিশির বসো, ভিজিয়ে দাও বামপাশে
খরা আকাশ। ঝড় এসো, ছুঁয়ে যাও রাত, ছুঁয়ে থাকো প্রভাত, কাঁপো দিগ্বিদিক। ঝড় এসো, জানলায় হানো। ঝড় এসো, দরজায় টানো, খুলে যাক দ্বার অবারিত পথ। আসো রাত মুখোমুখি বসি, রাত্রি হও তারপর। খোলো চপল হরিণ। ক্লান্তি তুমি জরির গন্ধে এসো। এই বিষবাষ্পে বাঁধো ভোর। শুধু বিষাদ আসে আনন্দের পাশে, আর পাশে আনন্দ জুয়াচোর। আর রাত্রি মা কুয়াশার মশারির ভিতর শ্যাওলারং রাজহাঁস হয়ে ডুবে থাকে স্মৃতিরহিত।
আমার আর
ঘোর ভাঙে না। যারা পাহাড়ে গান বানায়, যারা ঘোর পূর্ণিমায়
আজলা ভরে নদী এনে ভিজিয়ে রাখে উঠান আর বারান্দার কারুকাজ, যারা দুরন্ত ঝড়ে বনে বনে ঘুরে ঘুরে জ্বালায়
চোখের বৃন্ত, যারা গাছ আর আগাছার নিবিড় রাখীবন্ধন—আমি তাদেরই একজন। আমাকে যদি চিনতে না পারো তবে ফিরে যাও
অলিখিত গুহার ভিতর। ওখানে সূর্য গিয়ে তোমাকে ডেকে নেবে একদিন
ভোরের বেলা। ভোরের অবসান হয়, অন্ধকার পুড়ে ছাই হলে আমরা প্রত্যেকে সিসিফাসের
নিয়তি মেনে নিই দুইহাতে। মা আমার চিরদিন জননী ধরিত্রী হয়ে উদাস
চোখে আমাদের আরোহণ আর অবরোহণ দেখে। আর স্মৃতিমগ্ন চোখে হাসে। মায়ের হাসিতে ম্লান হয়ে যায় উদ্ধত সূর্যের দিন।
শৈশবে আমার
রাত্রি মা’র মুখ ভুলে গেছি। আমার মা ছিলো শৈশবের পাহাড়। আমরা পাহাড়ে থাকতাম, পাহাড়ের পায়ের পাতায় একটা টলটলে পুকুর। পুকুরে স্নান করতে নেমে দুপাটি
ঝিনুক তুলে আনতাম প্রতিদিন। মা বলতো, ‘এর বুকে মুক্তো
থাকে, জানিস!’ প্রতিদিন খুলতাম, বালি থাকতো, মুক্তোর দেখা পাইনি একদিনও।
এইসব রূপকথা
ভেবে তুমি যদি জানলার ওপারে দেখো শ্যাওলারং রাজহাঁস দাঁড়িয়ে আছে, তাহলে তাকে সত্য
ভেবো না। তোমার কণ্ঠে তখন হংসধ্বনি। তুমি ভুলে আছো গতকাল। ভুলে আছো দীর্ঘ চুলের নদীতে ডুবে যাওয়া
প্রেমিক মাছের যন্ত্রণা। তার ঘুমহীন নিষ্পলক চোখের আশ্চর্য বিভা
সূর্যকে করে দিলে ম্লান তুমি বিজয়ী। আমার মা তোমাকে চিনবে স্মৃতিরহিত
চোখে। রাতে এসো। এইখানে কুয়াশার মশারি জীবনদাশের বিলাপ হয়ে আছে। আমার মা তোমাকে চিনে নেবে সত্যি; আমার মায়ের নাম রাত্রি।
No comments:
Post a Comment