কোথায় কি!

01 January 2016

চারন রনি

monisingh
কি পেয়েছেন মণি? অমূল্য মনি সিংহ-মূল্যায়িত না হলে ক্ষতি কার? কি পেয়েছেন মণি? এই প্রশ্নবানে, লজ্জিত আমি, এক সুসং বাসীন্দা। সূদূরের স্বপ্নে বিভোর চঞ্চল মন ভালোবাসায়-ভালোবেসে বুকভরা প্রত্যাশায় কমরেড মণি সিংহ কে নিয়ে লিখতে বসা, মনে বারবার কড়া নাড়ছে কবীর সুমন এর গান,”যদিও আকাশ ধোঁয়াসায় ম্রীয়মান-তোমার জন্য লিখছি প্রেমের গান”। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮জুলাই ২০০০সালে এই বিপ্লবীর জন্মশতবার্ষীকিতে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, মনি সিংহের ত্যাগ, আদর্শ, সততা, নিস্টা ও অনুকরনীয় দৃষ্টান্ত বাংলাদেশের রাজনৈতীক পরিমন্ডলে পুনরিজ্জীবত হউক, তিনি হয়ে উঠুক তরুন বিপ্লবীদের আদর্শ ও অনুপ্রেরনার উৎস।কে ছিলেন মণি, কি ছিলেন মণি, কি দিয়েছেন মণি?
সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে। এই পথচলা অব্যাহত থাক অভিস্ট লক্ষ্য পূরণে আরোও দ্বি-গুন গতি সঞ্চারী। ১৭৫৭সালে’র ২৩জুন  পলাশী প্রান্তরে  সিরাজের করুন পরিনতি’তে  বাংলা’র যে স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো একদা, সেই অস্তগামী সূর্য এই ভাগ্যাকাশে উদিত হতে সময় নিয়েছিলো প্রায় ২১৫ বছর। তমশাছন্ন থেকে আলোকচ্ছটা’র যাত্রা’য় আত্মহুতি হয়েছে অগনীত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য’র, পাকিস্থান শাসকের শাসন-শোষনের বিরুদ্ধাচারন করে জেল-জুলুম-জরিমানা ও আত্মবলীদান দিতেও কুন্ঠিত হয়নি অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ’র  সন্তান গন। সেই সব লড়াই-সংগ্রামে  যে সূর্য্য-সস্তানদ্বয় মাথা উঁচু করে জানান দিয়েছিলো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ, বিদ্রোহী হয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও পাকিস্থান সরকার’কে করেছিলো নতজানু, সেই সময়-কালের দুরন্ত এক লড়াকু শ্রেনী-সংগ্রামী মনি সিংহ।
আ-মৃত্যু যিনি ছিলেন শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, খেটে-খাওয়া কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের জন্য অ-সংবিধিত নেতা ,আন্দোলনে কিশোর বয়সে’ই ব্রিটিশকে উচ্ছেদের জন্য সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল অনুশীলনের হাত ধরে যার বিপ্লবী জীবনের যাত্রা শুরু, মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের রাজনীতি, দর্শন ও আদর্শ যার অনুপ্রেরনা, দেশের স্বাধীনতা অর্জন, গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আ-মৃত্যু যিনি লড়েছেন, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠাকল্পে আপোষহীন আন্দোলনে যাঁর অসামান্য অবদান অবিস্মরণীয়, ত্যাগের মহিমায় যিনি স্ব-মুজ্জ্জল তিনি কালের যাত্রায়, হালে হয়ে উঠেন অবহেলীত জন-মানুষের মুক্তির কান্ডারী কমরেড মনি সিংহ।
১৯০১ সালের ২৮ জুলাই, পূর্বধলার জমিদারের সন্তান কালীকুমার সিংহ ও সুসং রাজবংশের কন্যা শ্রীমতি সরলা দেবী’র  কোল  আলোকিত  করে পশ্চীম বঙ্গের কলকাতা শহরে জন্ম নেন কমরেড মনি সিংহ। জন্মের দুই-তিন বছরের মাথায় পিতৃহারা জনিত কারনে আর্থিক সংকটে পরে কলকাতা থেকে পাড়ি জমান ঢাকা মামা’র বাড়িতে, সেখান থেকে নেত্রকোনা মহকুমা’র সুসং দুর্গাপুর মাতুল রাজ্যে, মা এর স্বল্প অংশীদারিত্বে’র দরুন বাড়ি-ভিটে, ফসলি জমি, মাসোয়ারা’য় সংসারের চাকায় গতিসঞ্চার ঘটে, ফলে স্থায়ীভাবে  বসবাস শুরু করেন সুসং রাজ্যে। প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখরি হয় সুসং থেকে, তারপর কলকাতা। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহী সংগঠন ‘অনুশীলনের’ চেতনায় বিশ্বাসী মন, লড়াকু হাজং’দের সংগঠীত করার নিমিত্তে সুসং থেকে মাইল দশ ক্রোশ দূরের গ্রাম কালিকাবাড়ি/পুর থেকে যাত্রা শুরু করেন বন্ধু উপেন সান্যাল কে সহচর নিয়ে, উচু-নিচু জাত-পাতের ব্যাবধান হটিয়ে শিক্ষা কে অস্ত্র হিসাবে বেছে নিয়ে স্থাপন করেন বিদ্যালয়, কুসংস্কারের বিরোধ করে সেই গ্রামে ক্রমশ হয়ে উঠেন জনপ্রিয়। অনুশীলন দলের উচ্চ মার্গীয় নেতা সুরেশ চন্দ্র দে এর পত্র নিয়ে কালিকাবাড়ী/পুর গ্রামে আসে রুশ বিপ্লবী গোপেন চক্রবর্তী, গড়ে উঠে সখ্যতা, গোপেন চক্রবর্তী’র যুক্তি-অনুপ্রেরনায় পরিচিত হন মার্কসী’য় মতবাদের সঙ্গে, মার্কস-লেলীন’বাদে উজ্জীবিত মণি, শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ করত ছুটে আসেন কলকাতা, সখ্য’তা গড়ে উঠে কমিউনিজম মতবাদী নেতা কমরেড মোজাফফর আহমেদ সহ নানান বিপ্লবীদের সহিত, সেখান থেকে মিশন মেটোয়াব্রুজ, লালঝান্ডা’র উত্থান ও সফলতা।
সন ১৯৩০, চট্টগ্রামে মাস্টার দা সূর্য্যসেন এর নেতৃত্বে অস্ত্র লুটে ভীত ইংরেজ প্রশাসন তাদের বিরোধ মতবাদকে দমনে হয়ে উঠে মরিয়া, এরই ধারাবাহিকতায় কলকাতা থেকে গ্রেফতার করা হয় কমরেড মনি’কে, ৫বছর কাটে উপমহাদেশের বিভিন্ন জেলে,১৯৩৫ সালে নিজ গ্রাম সুসং এ অন্তরীন অবস্থায় ও নিয়মিত হাজিরাদানের শর্তে জেল থেকে ছাড়া পান এই বিপ্লবী।
সন ১৯৩৭, মায়ে’র সঙ্গে দেখা করতে আসা মনি সিংহ নিজ বাড়ির আঙ্গীনায় পড়েন শোষীতে’র অশ্রুবানে’র মুখমোখি। খোদ নিজ পরিবাররের সামন্তপ্রভূ’দের অত্যাচারের লৌহমর্ষকতা পীড়িত করে কমরেড মনি সিংহ কে, টঙ্ক প্রথার নামে কৃষক’দের যে জোর করে তার ন্যায্য অংশ থেকেও বঞ্চীত করা হচ্ছে, তিনি উপলব্ধি করেন এই চরম বাস্তবতা, যদিও প্রথমে নানাবিধ দ্বীধা-দ্বন্দে ভোগেন কিন্তু পরবর্তী’তে মার্কসীয় শিক্ষার আলোকে নিজেকে চালিত করে ঔ সব ভুখা-নাঙ্গা’দের মুক্তির মিছিলের নেতৃ্ত্েব আসেন, গড়ে তোলেন দুর্বার আন্দোলন। নিজ পারিবারের এই বিদ্রোহী’র ভয়ে, ভীত-স্বতন্ত্র সামন্তপ্রভূ’গন তাদের প্রভূ ইংরেজদের সহায়তায় আবারো জেলে পাঠায় টংক নেতা’কে, দমিয়ে রাখা যায়নি হাজংদের প্রিয় নেতা মণি বেটা কে, ১৯৪০ এ ময়মনসিংহ জেলা কমিউনিস্ট এর সেক্রেটারী, ১৯৪৫ এ নেত্রকোনা’র নাগড়া তে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কৃষক সম্মেলনে অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান, ১৯৪৬ এ ভারতের সাধারন নির্বাচনে ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে পার্টি’র হয়ে নির্বাচন করেন। ১৯৪৬-৪৭ তেভাগা আন্দোলনে রাখেন অসামান্য অবদান, দেশভাগের পর আইয়ুব সরকারের হুলিয়া মাথায় নিয়েও মা-মাটির টানে রয়ে যান পূর্ব-পাকিস্থানে, পাকিস্থান সরকার মই চালায় উনার ভিটে’তে ও উনার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ঘোষনা করে, ১৯৪৮ এ পূর্ব পাকিস্থান কমিউনিস্ট পার্টি গঠীত হলে তিনি সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন, ১৯৪৮ এ পুনরায় জঙ্গী রপে নামেন টঙ্ক প্রথা রহিতে।
সন ১৯৫০, ভীত পাকিস্থান সরকার তীব্র আন্দোলনের মুখে বিলুপ্ত করেন টংক প্রথা, চালু করে টাকায় খাজনা, কৃষকের জমি স্বত্ব প্রতিস্টা পায়। টংক আন্দোলনের বিভিন্ন সময় হাজংমাতা রাশমণি সহ ৬০ জন নারী-পূরুষ-শিশু বলীদান হন। পাকিস্থান সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ পার্টি কমিউনিস্ট ও এর নেতা কমরেড মনি সিংহ কে ধরিয়ে দিতে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষনা করেন আইয়ুব সরকার, কার্য্যত হুলিয়া মাথায় নিয়ে ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ পর্য্যন্ত আত্মগোপনে থেকেও অব্যাহত রেখেছেন লড়াই-সংগ্রাম, ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৫৪ এর প্রাদেশিক নির্বাচনে, ৫৬তে রাস্ট্র ভাষা বাংলার স্বীকৃ্তি আদায়ে, ১৯৬১ এর শিক্ষক আন্দোলনে রাখেন ভূমিকা।
সন ১৯৬১, মাস পড়ন্ত নভেম্বর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীব, কমরেড মনি সিংহ, কমরেড খোকা রায়, ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সংবাদ সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধরি মিলিত হন ঢাকা’র মগবাজারের এক বাসায়, আলোচনা করেন দেশের রাজিনৈতিক করনীয়তা নিয়ে। নানা মত-পথে সংঘর্ষ ঘটার পরে একাধিক বৈঠকে ঐক্যমতে পৌঁছান নায়ক-মহানায়কগন, বিকশিত হয় পুস্প, শুরু হয় সংগবদ্ধ আন্দোলন ছাত্র-জনতা’র। এই মিটিং’কে বঙ্গের বোদ্ধা’গন পরবর্তী’তে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সেতু বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সন ১৯৬৭, গ্রেফতার হন আত্মগোপনে থাকা মণি বেটা, ১৯৬৯ এর ২২ফেব্রুয়ারী ছাত্র-জনতার দাবীর প্রেক্ষীতে সকল বন্দি নেতাদের সঙ্গে মুক্ত হন। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মাথায় ৬৯ এর  জুলাই মাসে আবার গ্রেফতার হন বিপ্লবী নেতা।
সন ১৯৭১,সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুর ডাকে নামেন স্বাধীনতা যুদ্ধে, মণি বেটা রাজশাহী’র জেলে বন্দি, এপ্রিল মাসে অন্যান্য বন্দিগন কারাগার ভেঙ্গে মুক্ত করে কমরেড মণিসিংহ কে ভারতে পাঠায়, নির্বাচিত হন মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকারের অন্যতম উপদেষ্টা হিসাবে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে রাখেন অসামান্য ভূমিকা, বিশেষত রশ সররুার-ভারত সরকারের সমর্থন আদায়ে। যুদ্ধে বিজয়ে’র মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ যুদ্ধ-বিদ্ধস্থ দেশ গঠনে রাখেন অবদান। এই সালেই মেটিয়াব্রুজের আন্দোলনের নায়ক কমরেড মণি সিংহ কে বাংলার প্রথম রেড ফ্লেগ এর প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কলকাতায় শ্রমিক গন সংবর্ধনায় সম্মানিত করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রিয়ভাজন মণি দা, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু কে আমন্ত্রন জানান বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি’র দ্বীতিয় কাউন্সিলে, প্রিয় মণি দা’র আমন্ত্রনে সাড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হন কাউন্সিলে, সেই কাউন্সিলে নির্বাচিত হন সভাপতি হিসাবে। পরবর্তী তত্তৃীয় কাউন্সিলে ১৯৮০সালে পুনরায় নির্বাচিত হন সভাপতি হিসাবে এবং ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত উক্ত পদে স্থায়ী ছিলেন নিজ দলের প্রিয়ভাজন-আস্থাভাজন “বড়ভাই”।
সন ১৯৭৫, বঙ্গবন্ধু  সূদূর প্রসারী চিস্তার প্রতিফলনে এক জাতীর ঐক্য সমুন্নত রাখতে এবং উন্নয়নশীল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে, বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক-আওয়ামীলী গঠন করেন। সেই দলেও মতানৈক্য শেষে সমাজতান্ত্রিক স্বপ্নে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন কমরেড মণি বেটা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন স্বপ্ন ভাঙ্গে তবুও হাল ছাড়েন নি বঙ্গবন্ধুর মণি দা, প্রতিবাদ করেন বঙ্গবন্ধু হত্যার। ১৯৮০ সালে জিয়া সরকার গ্রেফতার করে এই মহান বিপ্লবী কে, কমরেড ফরহাদ সহ। পরবর্তী’তে পার্টি’র দূর্বার আন্দোলনে মুক্ত হন “বড়ভাই”। চাঙ্গা করে তুলেন স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, কিন্তু বিধির বিধানে গুরুতর অসুস্থ হয়ে ১৯৮৪ সালে’র ২৩ফেব্রুয়ারী হন শয্যাশায়ী, মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত ছিলেন পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী।
সন ১৯৯০, ডিসেম্বর মাসের ৩১তারিখ সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে ঢাকা’য় নশ্বরদেহ ত্যাগে ঠাঁয় নেন অনন্ত-অসীমে পার্টি’র বড়ভাই, হাজংদের বেটা, বঙ্গে লাল ঝান্ডার স্থাপক, কৃষক-শ্রমিক-মেননতী মানুষের মুক্তি আন্দোলনের মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধের সফল সংগঠক, বঙ্গবন্ধুর মণি দা। সৈয়দ শামসুল হক, শেষ শয্যায় শায়িত কমরেড মনি সিংহ কে দেখে, কবিতার শেষ চরনে লিখেছিলেন-
“প্রতিশ্রুত বন্দর সমুখে;
আমাদের প্রতিটি নৌকার গলুইয়ে আঁকা থাকবে আপনারই চোখ চিরদিন”।
বিভিন্ন সময়ে দেশ-জাতির কল্যানে অবদানের স্বীকৃ্তি স্বরুপ বাংলাদেশ সরকার ২০০৪সালে মরোণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে এই প্রবাদ পূরুষ কে।
এই মহান নেতার  মৃত্যুর পর তাঁহার স্মৃতি-রক্ষার্থে পার্টি ও তাঁর সন্তান ডাঃ দিবালোক সিংহ সুসং দুর্গাপুরে “মনি সিংহ স্মৃতিস্তম্ভ” স্থাপন করেন। সেখানে প্রতিবছর ৩১ডিসেম্বর থেকে ৬ জানুয়ারী পর্যন্ত তাঁহার মৃত্যুবার্ষীকি স্মরনে আয়োজিত হয় “মণি মেলা”। পরিতাপের বিষয় হলো এই মাটি’তেই রক্তাক্ত হতে হয়েছে মণি সিংহের সন্তান কে, মেলা প্রাঙ্গনে হামলা হয়েছে বারবার মেলা’র স্থান নিয়ে। যদিও মেলা’র স্থান ও এর আস পাশ একদা মণি সিংহের নিজের সম্পত্তী ছিলো যা পাকিস্থান সরকার হুলিয়া জারী করে নিলাম করে। স্বাধীনতা পরবর্তী’তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর প্রিয় মণি দা কে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলো তাঁর ভূ-সম্পত্তী, কিন্তু বাধ সাধে খোদ সর্বহারা মানুষের নেতা কমরেড মণি সিংহ। তিনি বলেছিলেন, এখানে এখন অনেক পরিবার বাস করে তাদের উচ্ছেদ স্বম্ভব নয়, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন সকল কে আমি স্থানান্তর করে আপনাকে আপনার ভিটা ফিরিয়ে দিবো দাদা, মণি সিংহ বলেছিলেন আমি টঙ্ক আন্দোলনের নেতা, এই আন্দোলনে যেসব হাজং সহ মানুষেরা তাদের ভিটে-মাটি হারিয়েছে তাদের কে কি সম্পত্তী ফিরত দিতে পারবেন, বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আসাম থেকে আসা রিফুজীরা ঔ সব জমিতে এখন আইন সম্মতভাবে বসবাস করছে ওদের উচ্ছেদ কি সম্ভব। মণি বেটা বললেন, তাহলে আমিও চাইনা আমার ভিটে-মাটি। বঙ্গবন্ধু মণি সিংহের এই নির্লোভ নেতৃত্ব’কে শ্রদ্ধায় বাহবা জানালেন। এই আত্মত্যাগী নায়ক নিজ সম্পত্তী হাসিমুখে ছেড়ে সুসং এ আসলে বসবাস করতেন উনার প্রিয়ভাজন দূর্গা প্রসাদ তেওয়ারী’র বাড়িতে। আবার কমরেড মণি সিংহ যখন শুনলেন সুসং কলেজ প্রতিষ্ঠাপর্বে জমি নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে, ছুটে গেলেন বঙ্গবভনে, নাম মাত্র মূল্যে বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে সুসং কলেজ কে পাইয়ে দিলেন ৩.৫৬ একর ভূমি। যা আজ নেত্রকোনা জেলা’র দুর্গাপুরে, সুসং মহাবিদ্যালয় নামে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
আমাকে আমার বন্ধু আশিক, সুসং দুর্গাপুরে ঘুরতে এসে কমরেড মণি সিংহ এর স্মৃতিস্তম্ভে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেছিলো, এই মহান বিপ্লবী’র যে এত কৃর্তী, যিনি লড়েছিলেন তোমাদের জন্য নিজ পরিবারের বিরুদ্ধে, তাঁর কোনো মূল্যায়ন কি তোমরা দিয়েছো, একটা স্কুল একটা কলেজ বা কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেখলাম না উনার নামফলক, যদিও এই এলাকার সাধারনের শিক্ষার ব্যাবস্থার নিমিত্তে সূদুর গ্রামে তিনিই স্থাপন করেছিলেন বিদ্যালয়!? আমি লজ্জায় নতমুখে, আত্মঘৃণায় নিজেকে তিরস্কৃত করলাম যদিও আমি অক্ষম ফলক স্থাপনে।
এর কিছুদিন পর ঢাকা’য় এক ইন্টারভিও বোর্ডে আমাকে জনৈক কর্মকর্তা আমার বাড়ি সুসং শুনে প্রশ্ন করলেন, আপনাদের এলাকার একজন মহান নেতা ছিলেন তিনি কে? আমি বলেছিলাম কমরেড মণি সিংহ, তিনি আবার প্রশ্ন করলেন উনার সম্পর্কে কিছু বলুন, আমি কিছুই বলিনী যদিও উনার কর্মজীবন আমার অবগত, উনার প্রশ্ন শুনে আমার আশিকে’র কথা মনে পড়লো, কি বলবো মণি বেটা কে নিয়ে,আমরা কি তাঁকে মূল্যায়িত করেছি!?
এর কিছুদিন পর চ্যানেল ২৪ থেকে এক বন্ধু আসলো ফারুক (বার্তা), সে একটা ডকুমেন্টারী বানাতে চায় টঙ্ক আন্দোলন নিয়ে, তাকে বাধ্য হয়ে বললাম টংক ও মণি সিংহ (যদিও আমি যা বলেছি তা তার জানা ছিলো)। অতঃপর সে দেখতে চাইলো কমরেড মণি সিংহের ভিটা-বাড়ি, আমি বলেছিলাম সমগ্র সুসঙ্গ উনার ভিটা-বাড়ি, উনার ত্যাগের মহিমায়। কি বলবো আর! কমরেড মণি’র সন্তান নিজ ভিটে’র অল্প অংশ ক্রয় করেছে, ওটা মণি সিংহের ভিটা হতে পারে না, কারন মণি বেটার ব্যাপ্তী সমগ্র সুসঙ্গ, তাঁর ভিটে আমাদের জন্য আন্দোলনে হারিয়েছে, তাই মনি আমাদের, আমার-আমাদের ভিটে মণি’র। আমি জানতে চাইলাম, মতিঝিল থেকে জিপিও রাস্তাটা কমরেড মণি সিংহ নামে আছে তো? ফারুক বললো হুম আছে।
সাম্প্রতীক সময়ে শুনলাম শিক্ষা মন্ত্রনালয় এক প্রজ্ঞাপনে সুসং কলেজ কে, সরকারী কলেজ হিসাবে ঘোষনা করতে যাচ্ছে। এই সময় কমরেড মণি সিংহের নাম ফলক চাইলে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার স্থাপন করতে পারে “কমরেড মণি সিংহ সরকারি মহাবিদ্যালয়”, এবং পাঠ্যপুস্তকে সংযোজন করতে পারে “মণি কথা”, যা হবে সুসং, তথা বাংলাদেশ, তথা ভারতীয় উপমহাদেশের এক বীর বিপ্লবীকে নিজ বাসভূমে-রনাঙ্গনে দেওয়া যোগ্য পুরস্কারে মূল্যায়ন।
বাংলাদেশে অনেকে আছে হয়তো এখনো জানেনা মনি সিংহের জীবনসংগ্রাম, সুসং এ অনেকে আছে মূল্যায়ন করতে পারে না মণি বেটা’র ত্যাগ, যার দরুন রক্তাক্ত হতে হয় মণি পুত্র কে। সুসং এর “অমূল্য মণি”, হাজং দের “মনি বেটা” কমিউনিস্ট কর্মীদের “বড়ভাই”, জ্যোতী বসুর “মণি দা”, বঙ্গবন্ধুর “মণি দা”, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ঘোষীত তরুন বিপ্লবীদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণার উৎস কমরেড মণি সিংহ, কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী মানুষের প্রান পূরুষ, জীবনসংগ্রামী, চিরঞ্জীব, অমূল্য কমরেড মণি সিংহ মূল্যায়িত না হলে ক্ষতিকার!

No comments:

Post a Comment