আমি খুব অপরাধবোধে
ভুগছি। অনুশোচনা হচ্ছে। খুব অনুশোচনা হচ্ছে। সত্যি বলছি ওকে আমি মারতে চাইনি। স্রেফ
পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে অমন কাজটা করতে হয়েছে। আর এছাড়া আমার আর কোন উপায় ও ছিল না।
এই শহরের মোটামুটি অভিজাত বলা চলে এমন একটা এলাকায় থাকতাম আমি। জায়গাটা বেশ পছন্দের
ছিল। নীরব, সুনসান পরিবেশ। কোন কোলাহল নেই। নিজের মত করে থাকতে পারতাম। কাজে ব্যাঘাত ঘটাবার
মত কেউ নেই। অফিস শেষ করে বাসায় ফিরতাম সন্ধ্যার আগেই। তারপর খেয়েদেয়ে ঘুম। এই তো জীবন।
ছিলাম বেশ। একা থাকার মজাটা যে আসলে কি, যারা কখনো একা থাকেনি তাদের বলে কয়ে
বোঝান যাবে না।
এইতো প্রায়
দুবছর হল এ বাড়িতে আছি। বাড়িটা কয় তলা সেটাও এখনো জানি না। কারা থাকে এ বাড়িতে, সুন্দরী কোন
মেয়ে আছে কি না, কোন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ অথবা আমার বয়েসী কোন ছেলেপুলে আছে কি না তাও জানি না।
না জানলেই বা কি এমন ক্ষতি?
আমি তো আর কারো ধার ধারি না যে সবার খবরাখবর রাখতে হবে। আমি
শুধু জানি এখানে এই ফ্ল্যাটের চারতলায় দুটো রুম, একটা কিচেন, একটা বাথরুম
আর ছোট্ট একটা বারান্দা ভাড়া নিয়ে আমি থাকি। পরিচিত বলতে শুধু বাড়ির কেয়ারটেকার। মাস
শেষে ওকে পাওনা টাকা বুঝিয়ে দেই। এছাড়া ওর সাথে দেখা সাক্ষাত তেমন একটা হয় না।
ঘটনার শুরু
গত কালকে। সকালে অফিসের দিকে ছুটছি। বাসা থেকে বের হয়ে মিনিট দশেক হেটে তারপর বাস স্টপেজে
পৌছাতে হয়। এর মাঝে একটা চায়ের দোকান পড়ে। উঠতি বয়েসের ছেলেপুলেদের ভীর বেশী থাকে ওখানে।
সিগারেটের ধোয়ায় চারপাশটা সবসময় কেমন ঘোলাটে দেখায়। আমি নিজস্ব ভঙ্গিমায় হেটে যাচ্ছি।
এমন সময় বাড়ির কেয়ার টেকারটা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে পেছন থেকে আমার হাত ধরল। প্রায়
চমকে উঠেছিলাম, ওর গোবেচারা ধরনের চেহারা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
“কি হয়েছে?”
“না,তেমন কিছু হয়নি। আপনাকে একটা কথা বলা দরকার”
“যা বলার তাড়াতাড়ি বলে ফেল।”
কেয়ারটেকার
খানিকক্ষণ আমতা আমতা করল। এরপর হরহর করে যা বলল,তার মর্মার্থ হল গ্রামের বাড়ি থেকে
ওর এক আত্মীয় এসেছে। একদিন থাকবে।বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে তারপর চলে যাবে
।থাকার জায়গার অভাব,তাই একটা রাত যেন আমি ছেলেটাকে আমার ঘরে ঘুমোতে দিই।
আমি একবাক্যে
না বলে দিলাম। কিন্তু কেয়ারটেকার নাছোড়বান্দা। অনেক জোড়া জুড়ির পর আমাকে রাজি করিয়েই
ছাড়ল ব্যাটা। আর আমি টা যে কি… মুখ ফসকে
হ্যা বলে দিলাম। ব্যাস হয়ে গেল…
সেদিন আমার
মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না।সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে বারবার শিউড়ে উঠছিল সমস্ত শরীর।
কিন্তু আমি তখন কি করব?
একবার যে কথা দিয়ে ফেলেছি তা কি আর ফিরিয়ে নেয়া যায়?
বিকেলে অন্যান্য
দিনের তুলনায় একটু আগেভাগেই বাসায় ফিরলাম। হাতের কাজগুলো দ্রুত গুছিয়ে ফেলে শুয়ে পড়লাম।
তার আগে কেয়ারটেকারকে বলে দিলাম তার সেই আত্মীয় যেন তাড়াতাড়ি এসে পড়ে। আর আমার সাথে
যেন কোন কথা না বলে। মাথা ঝাকিয়ে হু হা করে চলে গেল সে। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেলেটা
চলে এল। তীব্র গরমের মধ্যেও কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম আমি। ওর ঘরে ঢোকার শব্দ পেয়েই
কাথা থেকে মুখ বের না করে বললাম, “দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ো,কুইক,কোন কথা বলবে
না।”
“আচ্ছা ঠিক
আছে।” বলে আমার নির্দেশ পালন করল ছেলেটা। আর কি আশ্চর্যের ব্যাপার একটা কথাও বলল না।
নিঃশব্দে আমার পাশে এসে শুয়ে পড়ল। একটু খারাপ লাগল ছেলেটার জন্য। নিজের ব্যাবহারের
কারণে আমি নিজেই লজ্জিত। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোন পথ খোলা নেই। ছেলেটার এবং আমার নিজের
মঙ্গলের জন্য এটুকু অভদ্রতা আমাকে করতেই হবে।
ক্রমাগত ঘামছি
আমি। ঘেমে নেয়ে উঠছি। এমনিতেই ঘরের ভেতর দমবন্ধ করা পরিবেশ। তারওপর কাঁথামুড়ি দিয়ে
আছি। প্রচন্ড গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ইচ্ছে করছে গায়ের কাথা ছুড়ে ফেলে দেই। কিন্তু সেটা
করতে পারছি না। অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে ।দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছি। সহ্যের বাধ
ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর কতক্ষণ এভাবে থাকত পারব জানি না। কিন্তু আমাকে সহ্য করে যেতেই হবে।
অন্তত আজকের রাতটা। ওর ঘুমিয়ে পড়ার আগ পর্যন্ত কিছুতেই মাথা বের করা যাবে না।
যন্ত্রণায়
কাতরাতে কাতরাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। মাঝরাতে একটু তন্দ্রা ছুটে গেলেই মনে হল
ঘরে বাতি জ্বলছে। কাথার ভেতর থেকে চোখদুটো বের করতেই আলোর ঝলকানি এসে লাগল চোখে। সাথে
সাথে মাথাটা আবার নিয়ে গেলাম ভেতরে। তারপর কাথাটা সামান্য ফাঁক করে উকি দিয়ে দেখি ছেলেটা
বসে বসে পড়ছে। কোন ভাবান্তর ঘটল না আমার মধ্যে। পাশ ফিরে শুয়ে রইলাম আগের মত। চোখদুটো
বুজে আসল ধীরে ধীরে।
সরতে সরতে
বিছানার এতটাই কিনারে চলে গিয়েছিলাম যে একসময় বিছানা থেকে পড়ে গেলাম মেঝেতে। আউ আউ
করে আর্তনাদ করে উঠলাম আমি। সোজা দাড়িয়ে গেলাম তারপর। ততক্ষণে ছেলেটা চলে এসেছে আমাকে
সাহায্য করতে। ওর দিকে ফিরলাম আমি। চোখদুটো স্থির হল ওর চোখের ওপর। আমি দেখলাম ওর চোখদুটো
মুহূর্তের মধ্যেই যেন বিস্ফারিত হয়ে উঠল ।যে দৃষ্টিতে ছেলেটা তাকাল আমার দিকে তার সাথে
আমি পরিচিত নই। মনে হল ওর চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে ।মুখ হা করল ছেলেটা,সাথে সাথে
লাফিয়ে ওর ওপড়ে গিয়ে পড়লাম। আমি জানি এখনই গগনবিদারী চিৎকারে পুরো শহরকে জাগিয়ে তুলবে ও। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এখন রাত। ওর ভয়ার্ত দৃষ্টিই
আমাকে রাতের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। মনে করিয়ে দিয়েছে রাত হলে আমি বদলে যাই। ও যখন আমার
রাতের চেহারা দেখেই ফেলেছে তখন আর ওকে বাঁচিয়ে রাখি কিভাবে?
ভালো লিখেছো। এই লেখা যেন কখনো না থামে। প্রতিমাসে ৫টা টার্গেট রাখবে, তারপরে যে কয়টা হয়, হোক।
ReplyDelete