একটি যুদ্ধ, তারপর..
ঝিক্ ঝিক্...ঝিক্ ঝিক্...করে ট্রেন চলছে দৃশ্যমান গতিতে আর আমার জীবন চলছে অদৃশ্যমান গতিতে যে গতির গতিময়তা কখনো আমি উপলব্ধি করি না করতে পারি না । ট্রেনের কামরায় বসে আধবোজা চোখে অনুপমসেনের ‘কল্পন’উপন্যাসের নায়ক স্বকল্পের নিজের মতামত পড়ছি। লেখকের প্রতিটি কথা সমুদ্রের এক একটি ঢেউ এর মতো আছড়ে পড়ে আমার বুকে। জীবনের অনেক মিল রয়েছে স্বকল্প আর আমার ব্যর্থময় জীবনের প্রতিটিধাপে ধাপে। বয়স ছত্রিশের ঘরে পৌঁছলেও বিয়ে করা হয়নি আজ অবধি। নীড়হারা পাখি সব হারিয়ে ক্লান্ত মনে যেমন করে ভাবে, তেমনি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো। ট্রেন থামছে কোন এক অচেনাস্টেশনে। জায়গাটির নাম মনে নেই। ট্রেন থামার সাথে সাথেই আরো তিন জন মানুষ একই কামরায় উঠল। তিন জনের মধ্যে একজন চল্লিশ পয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক পুরুষ, এক জন তিরিশ পয়ত্রিশ বছর বয়স্ক স্ত্রীলোক, আরেকজন দশ-এগার বছরের বালিকা।
পুরুষ লোকটির মাথায় সামান্য কিছু চুল আছে, তাও পিছনে। ন্যাড়া মাথা ঢাকতে তার মাথার পিছনের সামান্য কিছু চুল চিরুণী দিয়ে এমনভাবে আঁচড়িয়েছে যা দেখেই আমি মুচকি হাসতে লাগলাম। কিন্তু সেই হাসি মুহুর্তেরমধ্যে বেদনাময় সময়ের ভিড়ে তীব্র বেগে ছুটে চলল। স্ত্রী লোকটির মুখের দিকে চোখ পড়তেই সাত আর চার দুটি অংক আমার মাথার উপর বজ্র বিদ্যুতের মত গর্জে উঠলো। ভুল দেখছি নাতো? বনিয়াকে মনে হলেই মনে পড়ে,অনেক বেদনার স্মৃতি। আজ এত বছর পর আমার এত নিকটে! এ বনিয়া? নাকি বনিয়ার সাদৃশ্য কোন নারী? আমি তো জানি, বনিয়া সৌদি আরব চলে গেছে অনেক আগে। তবে...।
চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল ’৭৪! আজও আমার হৃদয় কেঁপে উঠে সে দিনগুলোর কথা মনে পড়লে। হতভাগী মা আমার, আজ আর নেই।
বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে আমার ছোট বোন। বাবা আর কোনদিন ফিরে আসেনি’৭১ এর অন্ধকার থেকে। বড় মামা পঙ্গু আর অর্ধ উন্মাদ হয়ে তার বন্ধুর সাহায্যে গ্রামে ফিরে আসে চার বছর পর মা তখন ছিলেন এক উঁচু ঢিবির শিমূলতলায় চিরশায়িতা। দাদী আর ফিরে আসেনি রিলিফের গম নিয়ে।নুনের দাম আর অভাব সেদিন কলমি শাকের স্বাদ পেতে দেয়নি। কি দুঃসহ অভাব ছিল আমাদের জীবনে! দরিদ্র ছিলাম কিন্তু এমনঅভাব কোনদিন ভোগ করিনি। কারো কারো বাড়িতে গমের বস্তা ইঁদুরে খায়, কারো চুলায় জ্বলেনা
এক টুকরো আগুন। কারো মুখে খৈ ফুটে রাজাকার আর আলবদর বিশেষণের গালি, কারো মুখ ভাতের মাড়ের দিকেতাকিয়ে থাকে ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মৃত্যুক্ষুধার মত। হ্যাঁ, সেদিন আমরা দু’ভাই দু’জন মায়াময় হৃদয়ের স্পর্শেবেঁচে
গিয়েছিলাম। সেই দুটি মানুষ আজো জীবিত আছে আমাদের দুই ভাইয়ের জীবন সত্তার মাঝে। বাস্তবে রিয়াজ চাচা নেই;হয়তো স্বর্গের সুখ নিয়ে
স্বর্গের মাঠে জনসেবায় আত্মনিমগ্ন হয়ে আছেন। চাচী আম্মা হয়তো আজোবিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছে মৃত্যুর বিষ বায়ু পান করার জন্যে। বাবার সাথে রিয়াজ চাচার কথা হয়েছিল। আমাকে ডাক্তারী পড়াবেন কারণ আমি খুবই ভাল ছাত্র।
দু’দুবার বৃত্তি পেয়েছি। আর চাচী আম্মা আর আমার মা জেদধরেছেন বনিয়াকে আমার সাথে...।
একটা যুদ্ধ, অসংখ্য মৃত্যু, একটা স্বাধীনতা--সবকিছু পাল্টে দিল। মনে পড়ে ’৭১ এর যুদ্ধ। বাবা ছিলেন কমরেড।
জন্ম থেকেই দেখছি গ্রামের কৃষক-মজুর-ছাত্র যুবকদের নিয়ে মিটিং করতে আর মিছিল এর সাথে দৌঁড়াতে।
মুক্তিযুদ্ধের জন্য ২৬ বা ২৭ শে মার্চের শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতারঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। ৭ ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেদের দলের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা শেষে দলের সবাই গেরিলা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।
অস্র সংগ্রহের জন্য ২৫ শে মার্চ বাবা ছিলেন পুরানঢাকার নবাবপুরে, তার দলের এক কর্মীর বাসায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের ঢাকা আক্রমণের রাতেই বাবা গ্রামে চলে আসেন । রিয়াজ চাচার কাছে আমাদের রেখে মামাকে নিয়ে চলে গেলেন পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা করার জন্য বনিয়া থাকত নানার বাড়িতে। নানা ছিল হিংস্র আর বদমেজাজী। সে তার আভিজাত্য আর ধন সম্পদের খুবই বড়াই কর।
বনিয়ার নানা আর খালা মামারা আমাকে সহ্য করতে পারত না। অথচ তাদেরই বাড়ি থেকে খাবারএনে চাচা আর চাচীযা করেছেন, তাদের ঋণ কবে শোধ করব? কোনদিনই পারব না। একদিন রাতে টুপি দাঁড়িওয়ালা, কারা যেন বনিয়ার নানাকে ধরে নিয়ে যায়, অথচ যুদ্ধ শেষে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন একবারে হজ্বযাত্রীহয়ে।
বনিয়ার মা আমাকে খুব আদর করত। দুর্ভিক্ষে বনিয়ার ভূমিকা প্রেমিকা নয় বরং স্ত্রীর মত ছিল। যদিও তাকে নানার অনেক বকুনি খেতে হয়েছে। কারো মুখে শুনেছিলাম, বনিয়ার মা প্রেম করে বিয়ে করেছেন রিয়াজ চাচাকে।রিয়াজ চাচা তাদের বাড়িতে প্রাইভেট শিক্ষক মানে জাইগীর ছিলেন। সে যাই হোক, আমি বনিয়াকে ভালবাসি, বনিয়াও আমাকে...।
দুর্ভিক্ষের সময় যখন নিজেদের ক্ষেতের কাজ করে বাড়ি ফিরতাম তখন বনিয়াই আমাকেনিজের হাতে খাইয়ে দিত। বাবার শোকে শোকে মা-দাদী দু’জনেই বেহেস্তবাসী হলেন। বনিয়া মায়ের আর দাদীর শূন্যস্থান অনেকটা পূরণ করতে পেরেছিল। একদিন ওর মদখোর মামা জোর করে আমার বুক থেকে বনিয়াকেছিনিয়ে নিয়ে গেল। বনিয়া পরম শান্তিতে কান্নার্ত চোখে ওর অভ্যাস মত আমার বুকে তখন স্বপ্ন আঁকতে ছিল ভবিষ্যতের। সব স্বপ্ন ’৭৪ এর পর থেকে ভাঙ্গতে শুরু করল।
অনেক বেদনার পথ পার হয়ে ’৭৬ সালে কলেজে ভর্তি হলাম। অতি কষ্টে পঙ্গু মামা আমাদের জন্যে খাবার আর অর্থ যোগাড় করতে লাগলেন। সারাদিনে মামা কতটুকু খেতেন জানি না। তবে আমার সামনে তাকে কখনো খেতেদেখিনি। একদিন রাতে কান্নার্ত চোখে আমার মাথায় হাত রেখে বলল, কামাল, তোর বাবাকে আমি কথা দিয়েছি। তোদেরকে এ বাংলার বুকে মানুষ করে তুলব। মাস্টার দা, ক্ষুধিরাম, আসাদ--এদের রক্ত, এদের কণ্ঠস্বর, আদর্শতোর মাঝে দেখতে পাই। যুদ্ধ শুধু পাকিস্তানীদের সাথেই হয়নি; হয়েছে, এদেশের রাজাকার, আলবদরদের সাথেও। তোর বাবাকে হত্যা করেছে এদেশের রাজাকাররা। মামা স্কেচের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একটি পুরাতন ট্রাংক বেরকরলেন খাটের নিচ থেকে। চোখে তার পানি, হাত কাঁপছে। চাবি দিয়ে ট্রাংকের তালাটি খুলেই বের করলেন একটা ষ্টেনগান। যুদ্ধের সময় মামা আমাকে এ অস্ত্র চালানো ভালভাবে শিখিয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের শত বাধার কারণেতিনি আমাকে যুদ্ধে নিতে পারেননি। অস্ত্রটি আমার হাতে দিয়েই বললেন, ‘ধর আমার সাথে, বল, আর একটা যুদ্ধ চাই; যে যুদ্ধের গর্ভ থেকে জন্ম নেবে আমার মা, আমার বাবা-আমার সত্যিকারের স্বাধীনতা।’ সেদিন মামারকথা এতটা উপলব্ধি করিনি। মামা কলেজ জীবন থেকেই রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। পঙ্গু হবার পর থেকে পাগলের মত প্রায়ই বিড়বিড় করে বলতেন, ‘কি চেয়েছিলাম, কি পেলাম, সবই হারালাম...।’
চোখের তীর বেয়ে অবুঝ বালিকার মত অশ্র“ ঝরতে ঝরতে যখন অশ্র“ধারা আমার বুকের উপর ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে লাগল তখন টের পেলাম, আমার চোখ তার নিজের ভাষায় কথা বলছে। চোখ বলছে, তাকিয়ে দেখ,বনিয়া কাঁদছে। সত্যিই তাকিয়ে দেখি বনিয়া কাঁদছে। মেয়েটি বনিয়ার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। পুরুষটি অন্য পাশে নিজের সীটে হেলান দিয়ে এমনভাবে ঘুমাচ্ছে, যেন কত রাত সে ঘুমায়নি। বনিয়া কান্নার্ত চোখে আমার দিকেতাকিয়ে আছে। নিজেকে কেমন জানি অপরাধীর মত মনে হচ্ছে আজ। মনে পড়ে, শ্রাবণের সেই বিকেল বেলার কথা।
(মনে পড়ে ’৭১ এর যুদ্ধ। বাবা ছিলেন কমরেড। জন্ম থেকেই দেখছি, গ্রামের কৃষক-মজুর-ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মিটিং আর মিছিল করতে মুক্তিযুদ্ধের জন্য ২৬ বা ২৭ শে মার্চের শেখ মুজিবের নামে স্বাধীনতার ঘোষণা পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি ৭ ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাক সাড়া দিয়ে নিজেদের দলের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা শেষে দলের সবাই গেরিলা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয়।
অস্ত্রসংগ্রহের জন্য ২৫ শে মার্চ বাবা ছিলেন পুরান ঢাকার নবাব পুরে, তার দলের এক কর্মীর বাসায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের ঢাকা আক্রমণের রাতেই বাবা গ্রামে চলে আসেন। রিয়াজ চাচার কাছে আমাদের রেখে মামাকে নিয়ে চলে গেলেন পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা করার জন্য।)
No comments:
Post a Comment