বাঙালির নবজাগরণে কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির
অবদান স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। বাংলার কৃষ্টি সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করার
ক্ষেত্রে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির প্রতিভাধর
নারী পুরুষদের মধ্যে অন্যতম বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই সংস্কৃতিবান
পরিবারের কন্যা ইন্দিরা দেবী (১৮৭৩-১৯৬০) সঙ্গীতশিল্পী, লেখক ও
অনুবাদক। তাঁর পিতা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর
এবং পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত জ্ঞানদানন্দিনী তাঁর
মাতা। চিন্তাচেতনা ও আদর্শগত দিক থেকে ইন্দিরা দেবী রবীন্দ্রনাথের ভাবশিষ্যা ও মানস সঙ্গিনী।
পত্র সাহিত্য রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্মের অন্যতম শাখা।
তাঁর পত্রসাহিত্য তাঁর গল্প-উপন্যাস,
প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, গানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।।তাঁর পত্র
সাহিত্যেও অন্যতম হচ্ছে ‘ছিন্নপত্র’। ছিন্নপত্রের চিঠিগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে রবীন্দ্রনাথ প্রায়
২২টি জায়গা থেকে চিঠিগুলো লিখেছিলেন। জায়গাগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশের শিলাইদহ,
সাজাদপুর, পতিসর, কালিগ্রাম গোয়ালন্দ, বোয়ালিয়া, নাটোর, কুষ্টিয়া, ইছামতি,
দিঘাপতিয়া, পাবনা ইত্যাদি। সবচেয়ে বেশি
চিঠি লিখেছিলেন শিলাইদহ থেকে ৫৬ খানা, সাজাদপুর থেকে ২৬
খানা, পতিসর থেকে ১৩ খানা। আর সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছিলেন
ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে।ছিন্নপত্র রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশের নদীমাতৃক নিসর্গের
অতি অন্তরঙ্গ এক পত্রকাব্য। রবীন্দ্রনাথ
ছিন্নপত্রের প্রতিটি ছত্রে ছত্রে পদ্মাতীরের সুখ সৌভাগ্য, আনন্দ চিত্র কাব্যিক ভাষায় তাঁর আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা লিখেছেন।
ইন্দিরা দেবীর জন্ম ২৯
ডিসেম্বর ১৮৭৩ সালে কলকাতা থেকে অনেক দূরে বোম্বাই প্রদেশের বিজাপুরের অন্তর্গত কালাদিঘীতে। পিতা
সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর,
মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পুত্র এবং ভারতের প্রথম আই সি এস,
কন্যার জন্মকালে বোম্বাই প্রদেশে কর্মে নিযুক্ত। মাতা
জ্ঞানদানন্দিনী অসামান্যা সুন্দরী, অসাধারণ গুণবতী। বিয়ের
পর তিনি আপন প্রতিভাবলে উচ্চশিক্ষিতা হন।
পিতা মাতার আদর যত্নে ইন্দিরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠতে থাকেন।
ইন্দিরার পিতা সত্যেন্দ্রনাথ
আমেদাবাদ সেসনজজ,
বোম্বাই প্রদেশে সে সময় পর্যন্ত
প্রায় চৌদ্দ বছর ধরে চাকরি করার
পর ছুটির জন্য তিনি আবেদন করেন।
নিয়মানুসারে সেপ্টেম্বর মাসের আগে সে ছুটি পাওয়া যাবে না। সে সময়ে বেশ শীত পড়ে
যাবে। শিশুরা শীতে কষ্ট পাবে ভেবে শীতের আগেই স্ত্রী জ্ঞানদানন্দিনীকে
পুত্র-কন্যাসহ বিলাতে পাঠিয়ে দিলেন। ইন্দিরার বয়স তখন পাঁচ। লন্ডন থেকে পঞ্চাশ
মাইল দূরে সাসেক্স জেলার ব্রাইন নামক এক সমুদ্রতীরবর্তী শহরে ইন্দিরা তার মায়ের
সাথে বাস করতে থাকেন।
তারপর ১৮৭৮ সালের ২০
সেপ্টেম্বর সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর ছোট ভাই রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লন্ডন পাড়ি দেন। আর
সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিলাত
যাত্রা। দূর বিদেশে ৫ বছর বয়সী শিশু ইন্দিরাকে কাছে পেয়ে রবীন্দ্রনাথের মন খুশিতে
ভরে ওঠে। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, “শিশুদের
কাছে হৃদয়কে দান করিবার অবকাশ সেই আমার জীবনে প্রথম ঘটিয়াছিল।”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর
ভ্রাতুষ্পুত্রী কে নিজে পড়ে শোনাতেন ছোটদের‘ হেলেন’স
বেবীস, আর তাঁকে পড়তে দিয়েছিলেন লুই ক্যারলের ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এবং ‘থ্রো দি লুকিং
গ্লাস’ ইত্যাদি বই। শিশু বয়স থেকে রবি কাকার সঙ্গে
তাঁর সম্পৃক্ততা ইন্দিরার মনে গেঁথে ছিল। ইন্দিরা দেবী তাঁর লেখা ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’তে লিখেছেন, “রবিকাকা ছোট ছেলেমেয়েকে স্বভাবতই
ভালোবাসতেন, আমাদের ভাইবোনকে দিয়ে এ বিষয়ে তাঁর হাতেখড়ি
হয়। বিলেতে গিয়ে আমাদের সঙ্গে সেই যে তাঁর ভাব হয়ে গিয়েছিল, সেটা শেষ জীবন পর্যন্ত অটুট ছিল। ছেলেদের মন ভোলানোর তাঁর এক উপায় ছিল,
নানারকম মজা করে গান গাওয়ান।”
অতি শৈশবেই ইন্দিরা তাঁর
সাহিত্যপ্রীতির পরিচয় দেন। তার মূলে ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। কিশোরী ইন্দিরার মন
সাহিত্যরসে আপ্লুত না থাকলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রীকে যে ভাষা ও অনুষঙ্গে
চিঠিগুলো লিখতেন তা হৃদয়ঙ্গম করা ইন্দিরার পক্ষে সহজ হতো না। এ কথার স্বীকৃতি মেলে
ইন্দিরা দেবীর লেখা এ কথা থেকে, “আমার যখন আন্দাজ ন’বছর
বয়স তখন থেকেই অক্ষয় চৌধুরীকে কবিতায় চিঠি লিখতুম।”
১৮৮০ সালে ইন্দিরা দেশে ফিরে
আসেন। বয়স তখন তাঁর সাত বছর। পড়াশুনার জীবন আরম্ভ হল। তাঁকে ভর্তি করা হল সিমলার
অকল্যান্ড হাউস স্কুলে। ওখান থেকে কলকাতায় এলেন পরের বছরে। ভর্তি হলেন এবার লরেটো
হাউসে। ছ’বছর এখানে পড়াশুনো করে ১৮৮৭ সালে ইন্দিরা এনট্রান্স পাশ করেন। এবার
বাড়িতে বসেই পড়াশুনো আরম্ভ হল। পাশ করলেন এফ এ এবং বি এ। বি এ পাশ করলেন ১৮৯২ সালে অতিরিক্ত অধীত বিষয় ফরাসি ভাষা নিয়ে। সেই
বছরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়ে-পুরুষ সবার নম্বর মিলিয়ে ইংরেজি বিষয়ে হলেন প্রথম;
আর শুধু মেয়েদের মধ্যে প্রথম হলেন যোগফলে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে।
তাঁর মেধার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘পদ্মাবতী’
পদক লাভ করেন।
রবীন্দ্রনাথ ভ্রাতুষ্পুত্রীকে
ফরাসিভাষা শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করেন। ইন্দিরা দেবী ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’তে লিখেছেন, “আমি লরেটো ইস্কুলে ফরাসি শিখতুম
বলে একবার আমার জন্মদিনে ইস্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি, টেবিলের
উপর তখনকার দিনের বিখ্যাত ফরাসি কবি কপ্পে, মেরিমে,
কঁৎদলীল লা ফঁতেন প্রভৃতির রচনাবলী সুন্দর করে বাঁধিয়ে সোনার জলে তাদের
নাম ও আমার নাম লিখিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলেন। দেখে যে কত আনন্দ হয়েছিল বলা যায় না।
এখনো সেই বইগুলি শান্তিনিকেতনের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের শোভাবর্ধন করছে ।”
রবীন্দ্রনাথ এর মাঝেই কবিতা,সঙ্গীত,
গল্প উপন্যাস লিখে নিজের আসন পাকাপোক্ত করে নিয়েছেন ।
ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা রবীন্দ্রনাথের লেখালেখি, গান,
নাটক ইত্যাদির সঙ্গে মনে প্রাণে সম্পৃক্ত হন। ইন্দিরা ইতিমধ্যেই
ট্রিনিটি কলেজ অফ মিউজিক থেকে ডিপ্লোমা অর্জন করেন এবং বাদ্রিদাস মুকুলের
নিকট উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিক্ষা করেন। ইন্দিরা
দেবী রবীন্দ্রসঙ্গীতে এবং পিয়ানো, বেহালা ও সেতার বাজনায় পরদর্শী
হন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্বরলিপি রচনা করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ প্রসঙ্গে
বলা যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘মায়ার
খেলা’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’, ‘কালমৃগয়া’
ইত্যাদি সহ দু’শ রবীন্দ্র সঙ্গীতের
স্বরলিপি রচনা করেন, আর সেই সঙ্গে রবীন্দ্র সঙ্গীতের বহু
স্বরলিপি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন।
ইন্দিরার যখন ছাব্বিশ বছর বয়স
তখন আইনজীবী প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে ১৮৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁর বিয়ে হয়।
ইন্দিরা ‘দেবী’ ‘দেবীচৌধুরানী’ হলেন। প্রমথ চৌধুরী তখন সবেমাত্র ব্যারিস্টারি পাস করে এসে প্রাকটিস
শুরু করেছেন। সে সময়েই তাঁর পড়াশুনার
গভীরতা ও সাহিত্যানুরাগের কথা ঠাকুরবাড়ির লোকেরা জেনেছিলেন। প্রমথ চৌধুরীর অগ্রজ আশুতোষ চৌধুরীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের
দীর্ঘদিনের পরিচয়। আশুতোষ ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যের
সঙ্গী’। লেখালেখির সূত্রে প্রমথ চৌধুরীও রবীন্দ্রনাথের
বন্ধু হলেন। প্রমথ চৌধুরী আইনজীবী থেকে সাহিত্যিক প্রথম চৌধুরীতে পরিণত হন
অল্পদিনের মধ্যেই।
পড়াশোনা, গানবাজনা,
সংস্কৃতি ও সাহিত্যে ইন্দিরার কৃতিত্ব অর্জনের ক্ষেত্রে
রবীন্দ্রনাথের অবদান কোন অংশেই কম নয়। এ
প্রসঙ্গে ইন্দিরা দেবী নিজেই লিখেছেন, “সিমলা থেকে নেমে
এসে সেই যে বছর আষ্টেক বয়সের পর কলকাতার স্কুলে ভর্তি হলুম তখন থেকে প্রায় তাঁর
জীবনান্ত পর্যন্ত রবি কাকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আমাদের সাহিত্য জীবনকে গড়ে
তুলেছিল, এ কথা অবশ্যই স্বীকার্য। সে ক্ষেত্রে আজ পর্যন্ত
আমরা যা কিছু করেছি, হয়েছি, এমন
কি ভেবেছি, পর্যন্ত তা তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আচ্ছন্ন।”
জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি শিক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি,
সাহিত্যে কৃতিত্বের দাবীদার। সে সময়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে বেশ কয়েকটি
পত্রিকা প্রকাশিত হতো। বিভিন্ন সময়ে ঠাকুরবাড়ি থেকে বিভিন্ন পত্রিকা প্রকাশ পায়।
প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, ‘বালক’ পত্রিকার
কথা। রবীন্দ্রনাথ পরিচালিত এবং ইন্দিরার মাতা
জ্ঞানদানন্দিনী দেবী-সম্পাদিত ‘বালক ’পত্রিকায় ইন্দিরার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। ওটা ছিল রাস্কিনের একটি
রচনার অংশ বিশেষের তরজমা। তিনি রবীন্দ্রনাথের বহু কবিতা , গল্প ও প্রবন্ধসহ ‘জাপানযাত্রীর ডায়েরী’র ইংরেজি অনুবাদ করেন। ইন্দিরার সাহিত্য জীবনে অনুবাদের সাহায্যে
বিদেশি সাহিত্যের রস গ্রহণ এবং রবীন্দ্রসাহিত্যের রস বিদেশকে উপহার দেওয়া ইন্দিরার
সাহিত্য জীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়। কৈশোর থেকে অনুবাদকর্মে অনুরাগ তাঁকে উত্তরজীবনে
দক্ষ অনুবাদকে হিসাবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ‘বামাবোধিনী’,
‘বঙ্গলক্ষ্মী’ ‘সাধনা’, ‘সবুজপত্র’, ‘পরিচয়’ ইত্যাদিতে
তাঁর অনুদিত গল্প, সঙ্গীত ও সাহিত্য বিষয়ে তাঁর অনেক
মৌলিক রচনা প্রকাশিত হয় বঙ্গনারীর শুভাশুভ
বিষয়ে তাঁর মতামত ‘ নারীর উক্তি’ নামক প্রবন্ধে বিধৃত করেছেন। এখানে উল্লেখ করার মত একটা বিষয় হচ্ছে,
রবীন্দ্রনাথের ‘ গীতাঞ্জলি ফরাসি ভাষায়
অনুবাদ করেছিলেন মনীষী আঁদ্রে জিদ। অন্যদিকে , গীতাঞ্জলির
অতিবিখ্যাত ভূমিকাটি ফরাসিতে অনুবাদ করেছিলেন ইন্দিরা দেবী। ইন্দিরা দেবী
পরবর্তীকালে এ ছাড়াও বেশকিছু মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলো মধ্যে বিশেষ
উল্লেখযোগ্য- ‘ শ্রুতি- স্মৃতি’, ‘রবীন্দ্র সঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম (১৯৫৪),’ ‘রবীন্দ্রস্মৃতি
(৫খন্ড, ১০৫৯) ’ ইত্যাদি।
ইন্দিরা রবীন্দ্র্রনাথের কত
স্নেহভাজন ছিলেন তা বোঝা যায় তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিগুলো থেকে।
রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিগুলো থেকে ইন্দিরার মনের ও রুচির প্রসারতা ঘটেছিল। ইন্দিরা দেবীকে রবীন্দ্রনাথ
তাঁর স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে একগুচ্ছ পত্রে পদ্মা ও তার চারপাশের নিসর্গ
ও মানুষের কথা এবং তাঁর চারণক্ষেত্র শিলাইদহ , সাজাদপুর, পতিসর
ইত্যাদি স্থানে দেখা নানা অনুষঙ্গের কথা লিখেছিলেন। জমিদারী দেখাশোনার কাজে এক সময় দফায় দফায় পদ্মা
তীরে এবং পদ্মা বক্ষে পদ্মাবোটে বাস করতে হয়েছিল। তাঁকে কাটাতে হয়েছিল পদ্মা ও
পদ্মার শাখা নদীগুলোর তীরবর্তী মানুষদের ও প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে। সময়টা ১৮৮৫
থেকে ১৮৯৫ সাল। এই দশ বছরে সময়ের মধ্যে কবি স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে বেশ
কিছু ব্যক্তিগত চিঠি লেখেন। এই সব চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ভাবনা, কল্পনা, ধ্যানধারণা, মানুষজন,
নদনদী ও প্রকৃতিক সৌন্দর্যকে সহজ সরল সাবলীল গদ্যে লিখেছেন।
ইন্দিরা দেবী চিঠিগুলোর
ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অংশ বাদ দিয়ে সাহিত্য সম্পর্কীত অংশ একটি খাতায় লিখে
রাখেন। পত্রগুলোর ‘ছিন্নদশা’ এভাবেই শুরু হয়।পরে এই সব পত্রাংশকে
স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ আরো একবার পরিমার্জন করেন। পরিমার্জিত পত্রগুচ্ছ ১৯১২ সালে ‘ছিন্নপত্র ’ নামে প্রকাশিত হয়। এখানে
উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মাত্র শ্রীশচন্দ্র মজুমদারকে লিখিত পত্র সংযুক্ত হলেও ছিন্নপত্রে অধিকাংশ পত্র ইন্দিরা দেবীকে লেখা।
উনিশ শতকের শেষ দশকের বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, পাবনা,
ও রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ, প্রকৃতি ও
পরিবেশের চিত্র উঠে এসেছে ছিন্নপত্রে। চব্বিশ বছরের তরুণ রবীন্দ্রনাথ পত্রগুলো
লিখতে শুরু করেন, আর লিখেছেন চৌত্রিশ বছরের তারুণ্য
পর্যন্ত। বলা যায় তারুণ্যের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অপরূপ সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন তাঁর
লেখা পত্রগুচ্ছে। অবশ্যই তাঁর লেখার মধ্যে রোমান্টিকতা আছে।ছিন্নপত্রের পত্রগুলোতে
রবীন্দ্র নাথ নিটোল বর্ণনায় প্রকৃতির বৈচিত্রকে উপস্থাপন করেছেন অসংখ্য রূপক, উপমার সাহায্যে। সামান্য বিষয়বস্তু, গাছপালা বৃক্ষলতা, নদনদী, গায়ের কিশোর কিশোরী, চাষী , মজুর এমনকি সমাজের অপাক্তেয় বেদেরদের যাযাবর জীবনের কথা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি। এক কথায় বলা যায় মাঠঘাটের ছোট্ট তৃণটি থেকে বিশালাকৃতির হাতি, বর্ষার পদ্মার বিপুল জলরাশির প্রচন্ড স্রোত। বিল আর ঝিলের নিস্তরঙ্গ জল, শিলাইদহ সহ পদ্মার চরগুলোতে নির্জন নিস্তব্ধতাকে উপলব্ধি করার কথা তিনি তুলে ধরেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে লিখছেন- ‘তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয়নি।
রবীন্দ্র নাথ নিটোল বর্ণনায় প্রকৃতির বৈচিত্রকে উপস্থাপন করেছেন অসংখ্য রূপক, উপমার সাহায্যে। সামান্য বিষয়বস্তু, গাছপালা বৃক্ষলতা, নদনদী, গায়ের কিশোর কিশোরী, চাষী , মজুর এমনকি সমাজের অপাক্তেয় বেদেরদের যাযাবর জীবনের কথা রবীন্দ্রনাথের চোখ এড়ায়নি। এক কথায় বলা যায় মাঠঘাটের ছোট্ট তৃণটি থেকে বিশালাকৃতির হাতি, বর্ষার পদ্মার বিপুল জলরাশির প্রচন্ড স্রোত। বিল আর ঝিলের নিস্তরঙ্গ জল, শিলাইদহ সহ পদ্মার চরগুলোতে নির্জন নিস্তব্ধতাকে উপলব্ধি করার কথা তিনি তুলে ধরেছেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে লিখছেন- ‘তোকে আমি যে-সব চিঠি লিখেছি তাতে আমার মনের সমস্ত বিচিত্র ভাব যে রকম ব্যক্ত হয়েছে এমন আমার আর কোনো লেখায় হয়নি।
...তোকে আমি যখন লিখি
তখন আমার এ কথা কখনো মনে উদয় হয় না যে, তুই আমার কোন কথা বুঝবি নে, কিম্বা ভুল বুঝবি, কিম্বা বিশ্বাস করবি নে,
কিম্বা যেগুলো আমার পক্ষে গভীরতম সত্য কথা সেগুলোকে তুই
কেবলমাত্র সুরচিত কাব্যকথা বলে মনে করবি। সেই জন্যে আমি
যেমনটি মনে ভাবি ঠিক সেই রকমটি অনায়াসে বলে যেতে পারি...’
ইন্দিরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের
চিঠির ওপরের অংশে তিনি তাঁর আদরের ভ্রাতুষ্পুত্রীকে নিজের মনের অনুভূতি যে ভাবে
প্রকাশ করেছেন,তা থেকে উপলব্ধি করা যায় তাঁর মনের সঙ্গিনী ছিলেন।
পূর্ববঙ্গে অবস্থানকালে
রবীন্দ্রনাথের দেখা বাংলাদেশের নদীমাতৃক
নিসর্গের অনুষঙ্গ ও অনুভূতি কাব্যিক ভাষায় ইন্দিরা দেবীকে জানিয়েছে এক একটা পত্রে। শিলাইদহ
কুঠিবাড়ির দু’পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা ও
গড়াই নদী, সাজাদপুর ও পতিসরের কাচারী বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে
যাওয়া নদনদী এবং মানুষজন, নিসর্গ প্রকৃতি, জল জমিন, নৌকা - মাঝি মাল্লা, গাছপালা, ফলফুল ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের মানসপটে যে ভাবে ধরা দিয়েছে, তা তাঁর বিদুষী ভ্রাতুষ্পুত্রীকে কাব্যিক গদ্যে লিখেছেন।ইন্দ্রিরাকে
লেখা রবীন্দ্রনাথের সেই সব চিঠির কয়েকটা থেকে অংশ বিশেষ এখানে তুলে ধরলে পাঠক
বুঝতে পারবেন বিদুষী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা রবীন্দ্রনাথের মনে কী আসন লাভ
করেছিলেন।
এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ
ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে গ্রামের খালের
পাড়, বেদেদের ছাউনি ফেলার দৃশ্য তুলে ধরেছেন- ‘আমার সামনে নানারকম গ্রাম্য দৃশ্য দেখতে পাই, সেগুলো আমার দেখতে বেশ লাগে। ঠিক আমার জানলার
সুমুখে, খালের ওপারে, একদল বেদে বাখারির উপর খানকতক
দর্মা এবং কাপড় টাঙিয়ে দিয়ে তারই মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। গুটিতিনেক
খুব ছোট ছোট ছাউনি মাত্র- তার মধ্যে মানুষের দাঁড়াবার জো নেই। ঘরের বাইরেই তাদের
সমন্ত গৃহকর্ম চলে।’
আর এ চিঠিতে তিনি ইন্দিরাকে
লিখছেন গ্রামের সুখদু:খের কাহিনী এভাবে-‘আমাদের এই মাটির মা, আমাদের এই আপনার পৃথিবী, এর সোনার
শস্যক্ষেত্রে এর স্নেহশালিনী নদীগুলোর ধারে, এর সুখদুঃখময়
ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে করে
এনে দিয়েছে বালি।’রবীন্দ্রনাথ ইন্দিরাকে তাঁর প্রিয়
শিলাইদহ কুঠিবাড়ির যে বিবরণ দিয়ে কতটা তাঁর মনের মাধুরী মেশানো তা পড়লেই বুঝতে
পারা যায়।
‘শিলাইদহের অপর পারে একটা চরের সামনে
আমাদের বোট লাগানো আছে। প্রকান্ড চর- ধু ধু করছে-
কোথাও শেষ দেখা যায় না- কেবল মাঝে মাঝে এক এক জায়গায় নদীর রেখা দেখা যায়- আবার
অনেক সময়ে বালি’কে নদী বলে ভ্রম হয়।... গ্রাম নেই, লোক নেই,
তরু নেই, তৃণ নেই- বৈচিত্রের মধ্যে
জায়গায় জায়গায় ফাটল-ধরা ভিজে কালো মাটি, জায়গায় জায়গায়
শুকনো সাদা বালি।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেক গল্প উপন্যাস,
কবিতা লিখেছিলেন শিলাইদহ, সাজাদপুর,
পদ্মাবোটে, পতিসরে বসে লিখেছিলেন তিনি।
‘অনেক কাল বোটের মধ্যে বাস করে হঠাৎ সাজাদপুরের বাড়িতে এসে
উত্তীর্ণ হলে বড়ো ভালো লাগে। বড়ো বড়ো জানলা দরজা, চারিদিক
থেকে আলো বাতাস আসছে...যেদিকে চেয়ে দেখি সেই দিকেই গাছের সবুজ ডালপালা চোখে পড়ে
এবং পাখির ডাক শুনতে পাই। ...বিশেষত এখানকার
দুপুর বেলাকার মধ্যে একটা নিবিড় মোহ আছে। রৌদ্রের উত্তাপ, নিস্তব্ধতা,
নির্জনতা, পাখিদের- বিশেষত কাকের ডাক,
এবং সুন্দর সুদীর্ঘ অবসর- সবসুদ্ধ আমাকে উদাস করে দেয়। ...কেন
জানি নে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য উপন্যাস তৈরি হয়েছে।...আমার
এই, সাজাদপুরের দুপুর বেলা গল্পের দুপুর বেলা। মনে আছে, ঠিক এই
সময়ে এই টেবিলে বসে আপনার মনে ভোর হয়ে পোস্টমাস্টার গল্পটা লিখেছিলুম।’...এখানে
যেমন আমার মনে লেখবার ভাব ও ইচ্ছা আসে এমন কোথাও না। বাইরের জগতের একটা
সজীব প্রভাব ঘরে অবাধে প্রবেশ করে। ...আলোতে আকাশে বাতাসে শব্দে
গন্ধে সবুজ হিল্লোলে এবং আমার মনের নেশায় মিশিয়ে কত গল্পের ছাঁচ তৈরি হয়ে ওঠে...
প্রসঙ্গক্রমে আবারও বলতে হয়
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনেক গল্প উপন্যাস, কবিতা লিখেছিলেন শিলাইদহ, সাজাদপুর, পদ্মাবোটে, পতিসরে বসে ইন্দিরাকে লিখছেন-‘অনেকে
বাংলাদেশকে সমতলভূমি বলে আপত্তি প্রকাশ করে; কিন্তু
সেইজন্যেই এ দেশের মাঠের দৃশ্য, নদীতীরের দৃশ্য আমার এত
বেশি ভালো লাগে। যখন সন্ধ্যার আলোক এবং সন্ধ্যার শান্তি উপর থেকে
নামতে থাকে তখন সমস্ত অনবরদ্ধ আকাশটি একটি নীলকান্তমণির পেয়ালার মতো আগাগোড়া
পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে,
যখন স্তিমিত শান্ত নীরব মধ্যাহ্ন তার সমস্ত সোনার আঁচলটি বিছিয়ে
দেয় তখন কোথাও সে বাধা পায় না।
রবীন্দ্রনাথের মনের সঙ্গী কারা
হবে সেকথাই প্রকাশ করেছেন এ চিঠিতে তাঁর মানস সঙ্গিনী ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে এ
চিঠিতে-‘কাল থেকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা হ্যাপি থট এসেছে। আমি চিন্তা করে দেখলুম, পৃথিবীর
উপকার করব ইচ্ছা থাকলেও কৃতকার্য হওয়া যায় না; কিন্তু তার
বদলে যেটা করতে পারি সেইটে করে ফেললে অনেক সময় আপনিই পৃথিবীর উপকার হয়, নিদেন যা হোক একটা কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আজকাল মনে হয়, যদি আমি আর
কিছুই না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তা হলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য
হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনের সুখের কারণ হওয়া যায়। ...গল্প
লেখবার একটা সুখ এই,
যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির সমস্ত অবসর একেবারে ভরে
রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে।
-কিন্তু কী চমৎকার হয়েছিল, কী বলব!
কতবার বলেছি, কিন্তু সম্পূর্ণ কিছুতেই বলা যায় না। নদীতে
একটি রেখামাত্র ছিল না;
ও-ই সেই চরের পরপারে যেখানে পদ্মার জলের শেষ প্রান্ত দেখা যাচ্ছে
সেখান থেকে আর এ পর্যন্তএকটি প্রশস্ত জ্যোৎস্নারেখা ঝিক্ ঝিক্ করছে। মনে
হয়, যেন একটি উজাড় পৃথিবীর উপরে একটি উদাসীন চাঁদের উদয় হচ্ছে, জনশূন্য জগতের মাঝখান দিয়ে একটি লক্ষ্যহীন নদী বহে চলেছে, মস্ত একটা পুরাতন গল্পেই পরিত্যক্ত পৃথিবীর উপরে শেষ হয়ে গেছে। আজ
সেই-সব রাজা রাজকন্যা পাত্র মিত্র স্বর্ণপুরী কিছুই নেই, কেবল সেই
গল্পের ‘তেপান্তরের মাঠ’ এবং ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ ম্লান জ্যোৎস্নায় ধু-ধু করছে।আমি
সেই মুমূর্ষ পৃথিবীর একটিমাত্র নাড়ীর মতো আস্তে
আস্তে চলছিলুম।
পূর্ববাংলার নদনদী, মাঠঘাট,
গাছপালার নির্জনতা রবীন্দ্রনাথের মনে কতটা রেখাপাত করেছিল তা
তিনি তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে লেখা পত্রে মনোমুগ্ধকর বর্ণনায় উঠে এসেছে এ
ভাবে: ঐ যে মস্ত পৃথিবীটা চুপ করে পড়ে রয়েছে ওটাকে এমন ভালোবাসি ওর এই গাছপালা নদী
মাঠ কোলাহল নিস্তব্ধতা প্রভাত সন্ধ্যা সমস্ত শুদ্ধ দু’হাত
আঁকড়ে ধরতে ইচ্ছা করে, মনে হয় পৃথিবীর কাছে থেকে আমরা যে
ধরতে ইচ্ছা করে- মনে হয় পৃথিবীর কাছ থেকে
আমরা যে এ পৃথিবীর ধন পেয়েছি এমন কি স্বর্গ থেকে পেতুম?
রবীন্দ্রনাথ আমাদের মাটির মা, আমাদের এই
আপনার পৃথিবী, এর সোনার শস্যক্ষেত্রে এর স্নেহ শালিনী
নদীগুলোর ধারে এর সুখ দুখঃময় ভালোবাসার লোকালয়ের মধ্যে এই সমস্ত দরিদ্র মর্ত হৃদয়ের অশ্রুর ধনগুলিকে কোলে
করে এনে দিয়েছে।’
রবীন্দ্রনাথের মানসলোকে পূর্ববাংলার ঋতুচক্রের নানা দৃশ্য অপূর্ব অনুষঙ্গে ধরা দিয়েছিল। সবুজের মাঝে
শরতের কাশের বনের কাশফুল কেমন করে তাঁর মনকে আপ্লুত করেছিল সে কথা এক পত্রে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরাকে লিখছেন এই ভাবে
-এই সুবিস্তীর্ণ জলরাজ্যে
মধ্যে শরতের উজ্জ্বল রৌদ্রে আমি জানালার কাছে এক চৌকিতে বসে আর এক চৌকিতে উপর পা
দিয়ে সমস্ত বেলা কেবল গুনগুন করে গান করছি।
-রামকেলি প্রভৃতি সকাল বেলাকার
সুরের একটু আভাস লাগা মাত্র: -এমন এশটি বিশ্বব্যাপী করুণা বিগলিত হয়ে চারিদিককে
বাষ্পাকুল করছে যে এই সমস্ত রাগিনীকে সমস্ত পৃথিবীর নিজের গান বলে মনে হচ্ছে। এ
একটা ইন্দ্রজাল, একটা মায়ামন্ত্র।
এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ এদেশের হতভাগাদের সম্বন্ধে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন এ ভাবে। আমরা হত হতভাগারা তাদের রাখতে পারি নে, বাঁচাতে পারি নে, নানা অদৃশ্য প্রবল শক্তি এসে বুকের কাছ থেকে তাদের ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিয়ে যায়। কিন্তু বেচারা পৃথিবীর যতদূর সাধ্য তা সে করেছে, আমি পৃথিবীকে বড় ভালবাসি।
কলকাতার ছেলে রবীন্দ্রনাথ
পূর্ববাংলার শিলাইদহ,
সাজাদপুর, পতিসর এবং পদ্মা বোটে বসে
কালবৈশাখীর তান্ডবে গাছপালার মাথা লুটিয়ে পড়া, জলের টেউ
গুলো যেন ফলা তুলে নৃত্য করার কথা চিঠিতে কেম ভাবে প্রকাশ করেছেন দেখা যেতে পারে। ‘কাল পনের মিনিট বাইরে বসতে না বসতে পশ্চিম ভয়ানক মেঘ করে এল। খুব গাঢ়
আলুথালু রকমের মেঘ, তারই মাঝে মাঝে চোরা আলো পড়ে রাঙা হয়ে
উঠছে। গাছগুলো হাউ-হাউ শব্দে একবার পূর্বে একবার পশ্চিমে লুটিয়ে পড়তে লাগল। ঝড় যেন
সোঁ সোঁ করে সাপুড়ের মতো বাঁশি বাজাতে লাগল। আর জলের ঢেউগুলো তিন লক্ষ সাপের
ফণা তালে তালে নৃত্য আরম্ভ করে দিল।
ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথ বহু ছোটগল্প, কবিতা
লিখেছিলেন বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে। এখানে তাঁর অসাধারণ ’ছুটি’
গল্পের কথা বলা যায়। এ গল্পের নায়ক ফটিক, ফটিকের দুরন্তপনা ও শেষ পরিনতির কথা তিনি অসাধারণ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন।
এ গল্পটি সাজাদপুর কাচারি বাড়িতে বসে লেখা ।
রবীন্দ্রনাথ নৌকাযোগে তাঁর কাচারি বাড়িতে জমিদারী দেখাশোনা করতে আসতেন ।
এমনই একদিন ওই রকম নৌকা ঘাটে ভিড়েছিল। নদীর তীরে গ্রামের ছেলেগুলো খেলা করছিল।
তাদের মধ্যে সর্দার গোছের ছেলে ছিল। সেই ছেলের ডানপিটেমি কে কেন্দ্র করেই তিনি ‘ফটিক’ চরিত্র অবতারণা করে ‘ছুটি’ গল্প লেখেন। ছিন্নপত্র কাব্যের নায়িকা
যেন পদ্মা, নায়ক কবি রবীন্দ্রনাথ! পদ্মা যেন তাঁর পরাণ
প্রিয়া, সে কথার
অনুরণন আমরা দেখতে পাব তাঁর এ কবিতায়-
...হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
একদিন জনহীন তোমার পুলিণে,
গোধুলির শুভলগ্নে হেমন্তের দিনে,
সাক্ষী করি পশ্চিমের সূর্য অস্তমান
তোমারে সঁপিয়াছিনু আমার পরান।
অবসান সন্ধ্যালোকে আছিলে সেদিন
নতমুখী বধুসম শান্ত বাক্যহীন;
সন্ধ্যাতারা একাকিনী সস্নেহ কৌতুকে
চেয়ে ছিল তোমাপানে হাসিভরা মুখে।
সেদিনের পর হতে, হে পদ্মা আমার,
তোমায় আমায় দেখা শত শত বার।
ইন্দিরা দেবী স্নেহাধন্য ছিলেন তাঁর
খুল্লতাত রবীন্দ্রনাথের তা তিনি তাঁর লেখা ‘ রবীন্দ্রস্মৃতি (৫খন্ড, ১০৫৯)’ এর পাতায় পাতায় কৃতজ্ঞচিত্তে লিপিবদ্ধ
করেছেন। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতে ত্রিবেণী সঙ্গম’ (১৯৫৪)
গ্রন্থে ইন্দিরা দেবী স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে, যার স্নেহের পরশের তিনি
সঙ্গীতে ঋদ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইন্দিরা দেবীচৌধুরানীকে
ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক,
১৯৫৭ বিশ্বভারতী ‘দেকিকোত্তম’ উপাধি এবং ১৯৫৯ সালে রবীন্দ্রভারতী সমিতি প্রথম ‘ রবীন্দ্রপুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯৬০ সালের ১২
আগস্ট লোকান্তরিত হন। ইন্দিরা দেবীকে লেখা
রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্রে তিনি চির ভাস্বর হয়ে আছেন।
No comments:
Post a Comment