১৯১৩ সাল। সুইডিশ একাডেমী থেকে আসা খবর সারাবিশ্বকে
এক নতুন চমক দিলো। সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন ভারত
এর এক কবি। নাম রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর। ব্যাপারটা বিস্ময়ের। সাহিত্যে সেসময় জার্মানি, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সের জয়জয়কার। সেসময় গীতাঞ্জলী কাব্য দিয়ে
নোবেল অর্জন করলেন দারিদ্র্যের
চাপে পিষ্ট, ঔপনিবেশিক শাসনে
জর্জরিত ভারতের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথ এক নোবেলই রচনা
করলেন তিন ইতিহাস।
১. প্রথম বাঙালি নোবেলজয়ী
২. প্রথম উপমহাদেশীয় নোবেলজয়ী (সাহিত্যে
এখনো একমাত্র)
৩. এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী।
এখানে একটা ব্যাপার বলে রাখা
উচিত, রবীন্দ্রনাথ 'গীতাঞ্জলী' এর জন্য
নোবেল অর্জন করেননি। তিনি
নোবেল পেয়েছেন, এর ইংরেজি
অনুবাদ Song Offerings এর জন্য। যার ভূমিকা
লিখেছিলেন মাইকেল.জি.ইয়েটস। আর অনুবাদক
কবি নিজেই।
.....
রবীন্দ্রনাথ বাল্যকাল থেকেই
একটু অন্যভাবেই বড় হয়েছেন। আমার ছেলেবেলা তে পাওয়া
বর্ননা অনুযায়ী, সমকালীন আর দশজনের
মত ইংরেজি শিক্ষা তে তিনি
সময় দিতেন কম। তার ১৪ ভাইবোনের
প্রত্যেকেই বেড়ে উঠেছেন 'আগে চাই বাংলা
ভাষার গাঁথুনি, পরে ইংরেজি
ভাষার পত্তন' নীতিতে। প্রিন্স
দ্বারাকানাথ ঠাকুর ছিলেন সমাজসেবী
আর বড় এক জমিদার। দাদার এই সমাজসেবা রবীন্দ্রনাথ
কে যে অনুপ্রাণিত কপ্রেছে
তা বোঝা যায়, বিশ্বভারতী কিংবা
শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার মত কাজ দেখে। তাই রবীন্দ্রনাথ একদিনে নয় বেড়ে
উঠেছেন এক সুনিপুণ পরিবেশে। ছোটকাল থেকেই।
.....
'জল পড়ে পাতা
নড়ে'
ইতিহাস বলে এটাই নাকি
ছিল কবিগুরুর প্রথম লেখা। যা কিনা লেখা হয় ৮ বছর বয়সে। এ নিয়ে কারো চোখই কপালে
উঠেনি কারণ রবীন্দ্রনাথ তার প্রথম
কাব্য লিখেছেন ১৪ মতান্তরে
১৫ বছর বয়সে। ১৭ বছর বয়সে
ব্যারিস্টারি পড়তে চলে যান লন্ডনে। কিন্তু যে কিশোর কখনো
স্কুলের বারান্দাতেই ভাল করে পা রাখেনি
সে কি আর ব্যারিস্টারি
পড়তে পারে? কিশোর কবি তাই দেশে
ফিরেন পড়া অসমাপ্ত রেখে। তবে সাথে করে নিয়ে
প্রচুর প্রচুর অভিজ্ঞতা।
......
কবিতা ছিল তার প্রথম
বিচরণক্ষেত্র। তবে সাফল্য
তিনি রেখেছেন সবখানেই। সে গল্প
হোক কিংবা গান। 'রবীন্দ্র
সঙ্গীত' এদেশের গানের ভুবনে এক অনন্য
শাখা। আর রবীন্দ্রনাথই
একমাত্র যিনি দুটো দেশের
জাতীয় সঙ্গীত লিখে গেছেন। সংখ্যাটা আসলে ৩ ছিল। তবে নেপাল তাদের জাতীয়
সঙ্গীতে পরিবর্তন আনায় এখন তা দুই। এদিক থেকেও কবি অনন্য।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যাকে
বলা চলে একজন পূর্ণাঙ্গ
মানুষ। ছবি আঁকা, সামাজিক
পদে নিয়মমাফিক চলা, দার্শনিকতা, গান রচনা
ও গাওয়া এমনকি অভিনয়েও যুক্ত
ছিলেন কবি। ব্যর্থতা
হয়ত তার 'সনেট' রচনায়। পেত্রার্কীয়,
শেক্সপিয়েরীয় সব পাশ কাটিয়ে
যখন সনেট লিখেছিলেন তখনই
নাকি ব্যর্থ হন কবি। যদিও ইতিহাসে এ নিয়ে
তর্কের শেষ আজো হয়নি। আজকের যুবসমাজের সেলফি বা নিজের
ছবি নিজেই তোলা ব্যাপারটা
কে অনেক বোদ্ধাই মেনে
নেন রবীন্দ্রনাথ এবং লিওনার্দো
দ্যা ভিঞ্চির অবদান হিসেবে। যারা কিনা আয়নার সামনে
দাঁড়িয়ে সাদা ক্যানভাসে ফুটিয়েছিলেন
তাদের নিজেদের মুখ।
......
এত গুণের মাঝেও রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুরের যে গুণ সবসময়
আড়ালে পড়ে থাকে তা হল তার দেশপ্রেম
আর দার্শনিকতা। স্বদেশী
আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ তার লেখনী
দিয়ে বিপ্লব এনেছেন শত নাগরিকের
মনে। বঙ্গভঙ্গ হবার
পর তার লেখা 'আমার সোনার
বাংলা' আজ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। আর জালিওয়ালানবাগ হত্যাকান্ডের
পর তার নাইট উপাধি
বর্জন ছিল বৃটিশ সরকারের
প্রতি অন্যরকম ঘৃনারর প্রকাশ।
......
ভিনদেশী আর কোন কবি স্বাধীন
বাংলার পাঠ্যতালিকায় এভাবে
স্থান করতে পারেননি যা রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর করে গেছেন। 'আমাদের
ছোট নদী, জন্মভূমি, সোনার তরী, বৃক্ষ' এর মত কবিতা
কিংবা 'আমার ছেলেবেলা, ছুটি, হৈমন্তী' শিরোনামের গল্প
এদেশের মাঝে যে আরো যুগ যুগ ধরে চলবে
এনিয়ে তর্ক চলে না।
.....
রবীন্দ্রনাথ তার শেষ লেখা
লিখেছেন ' তোমার সৃষ্টির পথ রাখিয়াছো
আকীর্ন করি'। এই লেখাই
ছিল কবিগুরুর বিদায় বানী। রবীন্দ্রচর্চা, রবীন্দ্র নিয়ে উচ্চতর
ডিগ্রী সবই আছে। কিন্তু
নেই সেই কিংবদন্তী। না না। আমি ভুল বলছি। রবীন্দ্রনাথ
তো লিখেই গিয়েছিলেন শতবর্ষ
পরে কেউ তার কবিতা
পড়ছে কিনা? হ্যা। পড়ছে। রবীন্দ্রনাথ আজো বেঁচে আছেন। প্রতিটা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের
হৃদয়ে। শতবর্ষ পর হয়ত আমি বা এই ডিজিটাল
মিডিয়া থাকবে না। হয়ত মানুষ
অন্য কোথাও জায়গা করে নিবে
কিন্তু একথা সত্য যতদিন
এ জাতি আছে ততদিন রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর থাকবেন।
No comments:
Post a Comment