আমি, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক,
নিতান্ত অল্প পরিচিত স্কুলের শেষ বেঞ্চের অধঃপতিতদের
একজন। রবিবাবুর নিখিলেশের
মতো আমিও নিজেকে ভাবি- অযোগ্য, অযোগ্য, অযোগ্য। যদিও বা রবিবাবু তাঁর চরিত্রের
ভাবনায় এক মন্দার আশ্বাস দিতে লিখেছিলেন, “ভালোবাসার মূল্য তাই, সে অযোগ্যতাকেও সফল
করে তোলে। যোগ্যের জন্যে পৃথিবীতে অনেক পুরস্কার আছে, অযোগ্যের জন্যেই বিধাতা কেবল
এই ভালোবাসাটুকু রেখেছিলেন” তথাপি আমার মতো
কচুঘেচু কিংবা আমড়া কাঠ থেকে উদ্ভাবিত ঢেঁকির
বরাতে বিধাতা ভালোবাসাটুকু নয়, হরদমই লিখে
রাখেন- ভরা থাক বেতঝাড়ের সুধায়।
জন্মদাতা এক সময় আশা করেছিলেন (এতদিনে
অবশ্য বুঝে গেছেন কৈলাসসম দুরাশা) সরকারী কিংবা ক্যাডেট কলেজ কিংবা স্বনামধন্য কোন
একটা স্কুলে ভর্তির সুযোগ আমার হয়েই যাবে। তখনও বাবা জানতেন না, সৃষ্টিকর্তা কোন কোন
সোভাগ্যবানের সীমানা আকাশ করে দিন ঠিকই, তবে
সেই সাথে জুড়ে দেন আকাশমুখী এক জোড়া ডানাও। আমি তথৈবচ, বাবার স্কেল নিয়ে টেনেটুনে উচ্চতা
মাপার পরীক্ষায় অল্প-বিস্তর উত্তীর্ণ হলেও ক্যাডেট কলেজে পড়ার স্বপ্ন ধুলিষ্মাৎ করার জন্য ছিল আমারই স্বয়ংসিদ্ধ অনুর্বর মস্তিষ্ক। ভেবেছিলাম ভর্তি পরীক্ষা নামক ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি
দিয়ে হব ব্রজেন দাস অথচ কপালে ছিল নেহাতই নাকানিচোবানি। নাহ্, স্বনামধন্য কোন স্কুলের ক্ষয়ে যাওয়া অথচ
কিংবদন্তি-গৌরবমণ্ডিত সফেদ, হলদে, বাদামি কিংবা পানসে রঙের কোন প্রধান ফটকই সদর্পে
অতিক্রম করা হয়নি আমার।
বাবা আমার সাথে কথা বলেননি পনেরো দিন,
অবশেষে মৌনতা ভঙ্গ করেছিলেন এক প্রশ্ন করে- বুল শব্দের অর্থ কী? বাংলা ভাষার গাঁথুনির
থেকে ইংরেজী শিক্ষার পত্তনেই তখন আমার দেহ-মন-স্বপ্ন ঝপাং। তাই বাবাকে খুশী করার উদ্দেশ্যে চতুষ্পদ প্রাণী
‘ষাঁড়’ কল্পনা করলাম, অবশ্য অতি ধড়ফরানিতে
কন্ঠাগত হল ‘গরু’। বাবা বললেন- হুম, তুমি সেই গরুর স্কুলেই পড়িবে। আমার স্কুলের নামের
এই বুল শব্দই শুধু নয়, মা কিংবা কাকীমা প্রতি শুক্রবার যখন সরোজা, মানিক’দা আর আমার স্কুল-ইউনিফর্ম
মাড় দিয়ে রোদে শুকোতে দিত, নির্মম পার্থক্য
উড়িয়ে দেয়া এক টুকরো রঙ আমার গভীরে হয়ে যেত জগদ্দল পাথর।
এক সময় সঙ্গীত অনুরাগী বাবা চেয়েছিলেন
পড়াশোনার অবসরে অল্প-বিস্তর একটু রবীন্দ্রসঙ্গীতও সাধনা করি। দিব্যি করে বলছি, দুপুর- বিকেল হারমনিতে ঝড়ের তাণ্ডব
চালিয়েও সাধনা করেছি অথচ “তুচ্ছ সা-রে-গা-মা'য়
আমায় গলদ্ঘর্ম ঘামায়”। নাহ, বহু সাধনা
করেও গলায় আমার সুর বসাতে পারিনি। তবে কী করে
জেন সুর না বসলেও শব্দ বসে যেত মনে। আমার বই, মানিক’দার বই, বুক সেলফের পোকায় কাটা কবিতার বই কিংবা সাহিত্য সাময়িকীর একের পর এক কবিতা
মুখস্ত হয়ে গেল।
সে বছর থানা পর্যায়ের কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নামও লিখিয়ে ফেললাম। আমার স্কুল থেকে আমি ছিলাম একাই, একাই গেলাম। প্রতিদ্বন্দ্বীদের
গৌরব আর গর্বের ইউনিফর্মের পাশে ম্লান থাকা, এক কোণায় গুটিয়ে থাকা একলা আমি অন্যদের
আবৃত্তি শুনতে শুনতে আরও যেন গুটিয়ে যেতে লাগলাম ভয়ে, আশংকায়, আত্নবিশ্বাসের শূন্যতায়।
মনে হলো না এলেই ভালো ছিল তবু কী এক ঘোরে সমস্ত অস্বিত্বকে কাঁপিয়ে উঠে এল এক চিৎকার, মনে মনেই। তারপর আমার সমস্ত
জগদ্দল পাথর সরে আমার যাবতীয় বৃত্ত-ব্যাসার্ধ-পরিধিতে উচ্চারিত হল কবিতা- “সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি/ লভিলে শুধু বঞ্চনা
/ নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয়”
অতঃপর ভাগফলে ছিল এক অবিশ্বাস্য নিয়তি
অথবা দৈববিড়ম্বনা। সেদিন দ্বিতীয়- তৃতীয় স্থান অর্জনকারী বিজয়ীর কিংবা স্কুলের নাম
উচ্চারণের সাথে সাথে পুরো ঘরে সামদ্রিক গর্জনে উপচে উঠেছিল হাততালি অথচ অপ্রত্যাশিত
প্রথম বিজয়ী হিসেবে আমার নাম ঘোষণার পর হাততালি পড়েনি একটিও। পিনপতন নীরবতার ভেতর গুটিয়ে
থাকা আমি ভেবেছি এই স্বাভাবিক, পরাজিতের জন্য
কবেই বা কোথায় জমে ছিল হাততালি। কে-ই বা এই আমি? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, নিতান্ত অল্প পরিচিত স্কুলের
উপেক্ষিত বেঞ্চের অধঃপতিতদের-ই একজন। তবু গভীরে কোথাও ছুঁয়েছিল এক আশ্চর্য ভাগফুল,
বলেছিল ছুঁয়ে- একলা চল, একলা চল, একলা চল রে...
No comments:
Post a Comment