শান্তি কোথায়
সব দেখেও চুপ করে থাকি । মুখ খুলি সে সাহস নেই। কার কাছে খুলবো? বিয়ের আগে
যে-মেয়ের মধুর বচন শুনে বিমোহিত হয়ে বিয়ে করেছি সেই মেয়েই কিনা বিয়ের পর অমন পালটে
গেল! অমন সুমধুর গলা দিয়েই কিনা অনর্গল ঝরে চলেছে কর্কশ রবের হাঁকডাক এবং
হম্বিতম্বি! গোপনে বলে রাখি, মাঝেমধ্যে মুখের সাথে হাত চালাতেও দ্বিধা করছে না।
বিয়ে করে ঘরে তুলেছি তাই ফেলতেও পারছি না
আবার গিলতেও পারছি না এমতাবস্থায় পড়ে হাঁসফাঁস করছি। না না, শুধু আমি নই । আমার
মা-বাবাও নিস্তার পাচ্ছেন না এই অবস্থা থেকে।
ক’দিন ধরে বাবার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। ডাক্তার দেখাতে
হলেও স্ত্রীর অনুমতি নিতে হচ্ছে। তবে হ্যাঁ, অনুমতি দিচ্ছেন কিন্তু আদিখ্যেতা বলে
উড়িয়ে দিতে ছাড়ছেন না। বৌমাকে খুশী রাখতে চেয়ে মা যেচে পড়ে হেঁশেলের ভার তুলে
নিয়েছেন নিজের অশক্ত কাঁধে। সেই সাথে চলছে বাবার সেবাযত্ন। সেসব দেখে চোখে জল এসে
গেলেও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি স্ত্রীর মুখচোপার ভয়ে। আজ অফিসে যাবার সময় শুনলাম কাজের
মেয়েটা নাকি সপরিবারে বেড়াতে গিয়েছে। দিনকয়েক কাজে আসবে না। ভাবলাম, স্ত্রী এবার
বেজায় ঠ্যালায় পড়বেন। ঘরদোর সাফ করা থেকে বাসন মাজা ইস্তক সব কাজ যে সেই তাকেই
সামলাতে হবে। সেই আনন্দে খুশিমনে অফিসে চলে গেলাম।
পরদিন ছুটি। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাজারে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছি। হঠাৎ চোখে
পড়লো ব্যাপারটা। মা কলতলায় ডাই করে রাখা বাসনগুলো মাজতে বসেছেন! অথচ স্ত্রী কিনা
ঘরে বসে চা খাচ্ছেন সোফায় বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে! দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। বাবার চিকিৎসার
খরচে কোনো টান যাতে না পড়ে মা কি সেদিকে লক্ষ্য রেখে বাসন মাজতে বসেছেন! মা কি
ঝিয়ের কাজটাও স্বেচ্ছায় তুলে নিয়েছেন নিজের কাঁধে শুধুমাত্র বাকী জীবনটা শান্তিতে
কাটাতে চান সেই আশায় বুক বেঁধে?
কল্পনার ডানা মেলে
রোদ তেমন কড়া নয়। ক্র্যাচে ভড় দিয়ে হাঁটতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে পারমিতার। আর
কতটা যেতে হবে বুঝতেও পারছে না। তবে এটুকু বুঝেছে নদীর অনেকটাই কাছে চলে এসেছে।
একঝাঁক গাঙচিল উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। ওদের ক্যাঁচরম্যাচর আওয়াজে বুঝলো আর বেশী
হাঁটতে হবে না। মনে জোর এনে হাঁটতে লাগলো ক্র্যাচ টেনে টেনে।
নৌকাটা জলে কাঁপছে থিরথির করে। ছাউনির ভেতরটা এখনো সুনসান হয়ে আছে। ওপারে
যেতে কত ভাড়া নেবে তাও জানা নেই। কাঠের লম্বা তক্তায় কিছু টুকরো কাঠ লাগানো রয়েছে
ছেড়ে ছেড়ে। যেন সিঁড়ির ধাপ! নৌকা এবং স্থলভূমির মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে মেলবন্ধনের সেতু
হয়ে। পারমিতা দোমনা করতে করতে নৌকায় উঠে পড়লো কাঁপাকাঁপা পায়ে। ছাউনির তলায় সবে
বসতে যাবে নৌকার প্রায় ঢাকা গলুইয়ের ভেতর থেকে মাঝি বলে উঠলো– ‘এ নৌকা ফুটো
দিদিমণি। জমা জল বের না করা ইস্তক নৌকা নড়বে না এখান থেকে।’
-‘তাহলে কি হবে ? আর কোনো নৌকা যে দেখছি না এখানে।’
-‘এই একটাই নৌকা। যখন ছাড়বে যাবেন।’
-‘আমার যে দেরী হয়ে যাবে ভাই। কি করি?’
-‘সাঁতার কেটে পার হয়ে যান যদি তাড়া থাকে।’ লোকটা নিজের মনে জল ছেঁচতে
ছেঁচতে জবাব দিলো। অর্ণব যদি ফিরে যায় ওকে না দেখতে পেয়ে! পারমিতা অসহায় মুখে
দেড়খানা পা দিয়ে জল কাটতে লাগলো সাঁতরে নদী পার হবার জন্য। মাঝি কিছুই টের পাচ্ছে
না ।
No comments:
Post a Comment