কোথায় কি!

29 November 2016

রাবেয়া রাহীম


কলরাডো অঙ্গরাজ্যের ডেনভার শহর। কলোরাডোর প্রতীক রকি মাউন্টেইন। প্লেনে বসেই সুকন্যার মনে পড়ছিল জন ডেনভারের সেই বিখ্যাত গান‍ রকি মাউন্টেইন হাই। শেকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য আকুতি নিয়ে গাওয়া গান। হ্যা, শেকড়ের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রতিটি প্রাণেই থাকে তাড়া কিন্তু সবাই কি আর পারে ফিরে যেতে! আপনজন, নিজ জন্মভূমির জন্য ছটফটানি থেকেই যায়। নিউ নিউইয়র্কের যান্ত্রিক জীবনে হাঁফ ধরে যায় তার। প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে। পাহাড়, অরণ্যে, মাটি তিনটেই ভীষণ টানে তাকে।এই শহরটি পাহাড় বেষ্টিত। দেখে মুগ্ধ হয় এয়ারপোর্টের টার্মিনাল বিল্ডিংও রকি মাউন্টেনের আদলেই বানানো।

শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে নিরিবিলি লেকসাইড শহরে এই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে সে। নিউইয়র্কের তুলনায় ভাড়া এখানে অনেক কম। শান্ত, নিরিবিলি শহর । লেকের পাড়ে রাস্তা, রাস্তার পাশে সাদা রং করা চারদিক কাঠের বেড়া দিয়ে ঘেরা কাঠের দোতলা ছিমছাম বাড়িটির সামনে টিউলিপ ফুলের সুন্দর বাগান। বাড়ীর মালিক মেলানি উইলিয়াম সব ঘুরিয়ে দেখাল। মাসে পাঁচশত ডলারে এর থেকে ভালো বাড়ি পাওয়া যায়না এই এলাকাতে। স্বামী মারা যাওয়ার পর একাই থাকে । তাই একটা অংশ তাঁর কাছে ভাড়া দিয়েছে। এই বাড়ীতে স্বামীর সাথে কাটানো দিন গুলোর কথা বলে যাচ্ছিল নিঃসঙ্গ মেলানি। সু মেলানির বকবকানি শুনছিল না। সে বাড়ীর সামনে হ্রদের স্বচ্ছ নীল জলের দিকে চেয়ে ভাবছে---জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সীমার নাম জীবন। এই সীমানার নির্দিষ্ট কোন পরিমাপ নাই, বোধকরি কোনো কালেই ছিলনা। ফিরে যেতে ইচ্ছে করছেনা আর কোথাও, এখানেই কোথাও যদি আমার মৃত্যু হয়! কি অপার শান্তির জায়গা!

আকাশের তপ্ত সূর্যটা হঠাৎ তেজ কমিয়ে ফেলে। চারিদিকে একটা গুমোট পরিবেশ। হ্রদের জলে মেঘলা আকাশের ছায়া পড়ে এখন রঙ ঘোলাটে দেখাচ্ছে। সে নিজের শোবার ঘরে চলে যায়। বাড়ীটা কাঠের হলেও বোঝার উপায় নেই। ডিজাইন আর রঙ দেখে বাড়ীর সব কিছুই তার পছন্দ হয়। শোবার ঘরের পাশেই খোলা বারান্দায় দাঁড়াতেই ভীষণ ভাল লাগায় হঠাৎই মনটা ভাল হয়ে যায়। সামনে বিশাল পাইন বন। উদাস দৃষ্টি লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়ায়। একটা কাঠবেড়ালী দৌড়ে যায় হঠাৎ। দৃষ্টি পিছু নেয় তার। ছুটে যায় সেটি তার ঘরের কাছে--তার সংগীর কাছে। হঠাৎ সুকন্যার ভেতরের সমস্ত আবেগ অনুভূতি গুলো প্রচন্ড কোন শক্তিতে মন্থন করে হৃদয়ের গভীর থেকে একটি নাম বের হয়ে আসে- "অনিকেত"। পৃথিবীর জ্বালা থেকে বেঁচে বুকের গভীরে নিরিবিলি একটা সংসার সু আর অনির । ঘোরের সংসার। ভাঙবে কি আর! অনিকে ভুলবে কি করে সে?
দোতলার বারান্দা থেকে প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্যের রহস্যে মন হারায় তাঁর। লেক সাইডের চোখ ধাঁধানো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতা উড়ন্ত মন কে ভীষন ভাবে শান্ত করে দেয়। কি জানি মনের কোথায় কি অদ্ভূত রহস্য খেলা করে যায়। মনের গভীরে নানা রংঙের অনুভূতির নিত্য আসা যাওয়া। কেমন করেই বা সে ব্যাখ্যা করেবে! ডেনভারের সাথে সুকন্যার নিস্তব্ধ-নিস্তরঙ্গ গল্প। বেশ কিছুক্ষন সে চোখ বন্ধ করে রাখে। তারপর দীর্ঘশ্বাস নেয় বুক ভরে। চিক চিক করে উঠে চোখের কোণ। চোখের জলের কোন রং হয় না তবুও কত রং এর নকশা আঁকা থাকে এই জলে। মন ছুয়েঁ কিছু কবিতার নতুন লাইন মনে খেলা করে-

চাপা দিয়ে সব বোধ--কার আশায় চেয়ে পথ
কি মায়ায় সাজাই ঘর শেষ বেলার আসে ডাক!
গহীনে পুষে বিবশ বাতাস সুখ খুঁজি গোলাপ কাটায় 
পুড়ে পুড়ে সুখের আশায় অনিমেষ শুভদৃষ্টি হোক আবার।।

পুরো রাত আলতো আলতো চোখ বুজে আসলেও ঘুম আর সাড়া দেয় না। আকাশ জুড়ে দিনের আলো বাড়ছে, কিছুই আসে যায় না। আজ আর অফিসের তাড়া নেই। বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠে সু। নাস্তা খেতে বসে অনুভব করে নিত্যপ্রয়োজনীয় টুকটাক কিছু কেনাকাটা ছিল। শহরে যেতে হবে।এখানে থেকে শহর ২০ কিলোমিটার। বাড়ীর পাশেই বাস স্ট্যান্ড। প্রতি বিশ মিনিট পর পর এই স্ট্যান্ডে বাস আসে শহরে যাওয়ার জন্য। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে ঝকঝকা রোদ দেখে মন ভাল হয়ে যায়। ঝটপট তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে সে। এখন সেপ্টেম্বর মাসের শেষ।গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে শরৎকালের শুরু। এই সময়ে সূর্যের উত্তাপ কমে আসতে থাকে । এখন পাতা ঝরার সময়--রাস্তায় ঝরা পাতাদের চঞ্চলতায় মন আদ্র হয়ে যায় তার। ঝরা পাতা মাড়িয়ে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ায় সু।

খুব পরিচ্ছন্ন গোছানো শহর ডেনভার। নিউ ইয়র্কের তুলনায় অনেক নিরিবিলি। রাস্তার দুপাশে নিত্য প্রয়োজনীয় দোকানের সারি। বড় চেইন গ্রসারী স্টোরে যাওয়ার পথে ডাকঘরের সাইন দেখে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় সে। মনে পড়ে অনির কথা। নামটা ভুলতে পারে না। কি করেই বা ভুলে! অনেক দিন তাকে কোন চিঠি লেখা হয় না। গভীর ভালোবাসার অনুভূতি গুলো সব সময়ই বড় বেশি অসহায়। শব্দহীন ভাংচুর সামলে নিয়ে নি:শব্দ ধ্বংস গুলো যত্ন করেই বয়ে বেড়াতে হয়। ভালোবাসা শরীর নির্ভর কিছু নয়, এটি সম্পূর্ণ মন নির্ভর অনুভুতি।এই অনুভূতিতে... দুটো শরীর গৌণ দুটো মনের মিলনই মুখ্য হয়ে উঠে। বুকের গভীরে প্রচন্ড ভালোবেসে দ্বিতীয় কাউকে লুকিয়ে রেখে অনবরত তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাই-তো একাকীত্ব। হ্যাঁ এই মুহূর্তে ভীষণ একাকীত্বে পেয়ে বসে তাকে।

বাড়ি ফিরে আসতে তাঁর প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যায়, বাতাসে টিউলিপ ফুলের গন্ধ। চাঁদ উঠেছে, হ্রদের পানিতে চাঁদের আলো পড়ে মহনীয় আবহ। কাঠের সিঁড়ি ভেঙ্গে সু লেকের পাড়ে এসে দাঁড়ায়। ফুটফুটে জোছনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে চারিদিক। সাথে উথাল পাতাল বাতাস। লেকের পাড় ধরে হাঁটতে ভালো লাগে তাঁর। জোছনার আলোয় পরিষ্কার দেখা যায়- হ্রদের জলে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। পানিতে ইঞ্জিনের শব্দ তোলে একটি নৌকা এগিয়ে চলে। পাশের বাড়ির কেউ বের হয়েছে সাথে সঙ্গী। আহ! এই সময়ে যদি অনি পাশে থাকতো! বুকের ভেতরে কিছু নস্টালজিক অনুভূতি হাতুড়ী পেটা করতে থাকে। কেমন এক শূন্যতার দোলা টের পায় সে। প্রচন্ড কফির তেষ্টা পেয়ে বসে।

ঘরের টুকটাক জিনিস পত্র গোছাতে যেয়ে বেশ রাত হয়ে যায় তার। প্রায় মাঝরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়ে। নির্জন হ্রদের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছো অনি সেই চেনা হাসি দিয়ে। অনেক দিন পর স্বপ্নে অনির মায়াময় মুখটি দেখার পর ঘুম ভেঙ্গে যায়। আর তখনই অন্ধকারের মধ্যে পাইন বনে বাতাসের মিহি শব্দ শুনে মনে হয় খুব শিগগির অনির সঙ্গে তাঁর দেখা হবে। কিন্তু, তা কি করে সম্ভব? ঠিক সেই মুহূর্তে হৃদয়ের সব টুকু ভালোবাসা বিদীর্ণ হয়ে অনিকেতের চেহারাটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে হৃদয়ের কোথাও গভীর কষ্টের সুর বেজে উঠে। বুঝতে পারে অনি কে জড়িয়ে বেচেঁ থাকার অনু্ভূতিগুলো খুব গভীর । বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখে সু। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় ঊঠে বসে। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশে টেবিলের উপর রাখা খাতা কলম টেনে নেয়। এক মুহূর্ত ভাবে জীবন নিয়ে তারপর লিখতে বসে অনি কে না বলা অনেক কথা।


প্রিয় অনি,
গতকাল শহরে গেলাম। ডাকঘরের সামনে দিয়ে যাওয়ার পর খুব ইচ্ছে করলো তোমাকে চিঠি লিখতে। ডাকঘরে গিয়ে দেখি ডাকঘর বন্ধ হয়ে গেছে। এখানে শুক্রবারে দুপুর একটার পর সাধারণত সরকারি অফিসে লোক খুব একটা থাকে না। আচ্ছা, চিঠিতে কী লিখবো তোমাকে! ভাবছি। কেমন করেই বা শুরু করি! কতদিন তোমার সাথে কথা হয়না! তবে মনে মনে আমি সারাক্ষণ তোমার সাথে বকবক করি। নিউ ইয়র্ক ছেড়ে এসেছি আজ একমাস। পাহাড় ও অরণ্যে ঘেরা এই জায়গাটিকে বলা যায় পৃথিবীর বুকে আরেক পৃথিবী!
বাড়ীটির পাশে লেকের পাড় ঘেঁষে এঁকেবেঁকে চলে গেছে নির্জন রাস্তা। রাস্তার দুপাশে দীর্ঘ পাতার পাইন গাছের সারি। সেই পাইন পাতাগুলি বাতাসে দুলে সূর্যের আলোয় ঝলমল করে উঠে অবাক ভাল লাগায় মন শান্ত হয়ে যায় , শহরের জীবনে এই ভালো লাগা কোথায় বল? ভাবছি আর শহরে ফিরে যাব না । এখানেই নিরিবিলি বাকি জীবন কাটিয়ে দেব। তুমি হয়তো বারান্দায় দাঁড়িয়ে জাম গাছটার দিকে চেয়ে আছো। বারান্দার ওপারে রাস্তা তাঁর পাশেই ব্যস্ত শহর। আচ্ছা, দেখ তো বিদ্যুতের তারে জোড়া শালিক বসা কিনা! শুনেছি জোড়া শালিক দেখলে দিন ভালো যায়। আমার এখানে তো শালিক পাখি নেই!

তোমাকে কখনো বলা হয়নি আমার একটি অদ্ভুত নেশা আছে মাছ ধরার নেশা, হ্রদের পাড়ে বাস করে বাকি জীবন মাছ ধরে কাটিয়ে দিলে মন্দ হয়না কি বল। এখানে আসার পর ঠিক মাছ ধরি না। লেকের পানিতে এমনি এমনি ছিপ ফেলে বসে থাকি। কখনও মাছ উঠলেও ছেড়ে দেই । আমি দেখি কলরাডোর নীল আকাশ, ঢেউ খেলানো সবুজ পাহাড়শ্রেণী, হ্রদের স্বচ্ছ জল; তাছাড়া আমার হাত থেকে মুক্ত হয়ে মাছ যখন হ্রদের পানিতে "ঝপাৎ" শব্দ তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি তখন তাদের মুক্তির আনন্দ উপভোগ করি। কখনো ছল্কে উঠা পানি আমাকে ভিজিয়ে দেয় আমি আকাশের দিকে মুখ করে হো হো হো করে হেসে উঠি। আর ...আর হ্রদের পাড়ের মাছ ধরার কাঠের সেতুর মাঝখানে তোমার একটি ছবি ফ্রেমে বাঁধাই করে রেখেছি সেটা দেখি আর কথা বলি। তারপর খিলখিল করে হাসি। আশেপাশের বেশ কিছু কাঠবেড়ালি আমার দিকে অবাক তাকিয়ে থাকে তারপর তাঁরাও লেজ উঁচিয়ে লাফ দেয় । তাঁদের লাফ ঝাঁপ দেখে মনে হয় তারাও আমার সাথে যোগ দিচ্ছে। হাসতে হাসতে পেটে খিল নিয়ে হ্রদের পাড়ে বসে যাই, চিৎকার করে কাঁদি। খুব কাঁদি।

হ্রদের মাঝখানে দ্বীপের মতন ছোট্ট একটি আইল্যান্ড আছে। সেখানে আছে অনেক গাছ, পাখি, ঝরনা, সাদা-কালো মানুষ, তাদের সহজ সরল অযান্ত্রিক , আর প্রাণচঞ্চল জীবনযাপন। অনেকেই সেখানে সারাদিনের জন্য বেড়াতে যায় আমি কখনো যাইনি। তোমায় ছেড়ে কি করে যাই বল-- আমি তো জানি তোমার এমন জায়গা খুব পছন্দ। তাই ঠিক করেছি যদি কখনো তুমি আমাকে দেখতে এখানে আসো তখন তোমাকে সাথে নিয়ে ঐ আইল্যান্ডে বেড়াতে যাবো...

দূর থেকে ভোরের শীতল বাতাস খোলা জানালা দিয়ে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে। চিঠিটা এখানেই শেষ করে জানালা বন্ধ করতে উঠে আসে সুকন্যা। সকালের সূর্য উঁকি দিচ্ছে পাইন বনের ফাঁকে। চিঠি হাতে করেই ঘর থেকে বের হয়ে আসে সে। পাশের বাড়ীর সোনালী চুলের মেয়েটি পোষা কুকুরটি নিয়ে জগিং এ বের হয়েছে। হাটতে হাটতে হ্রদের পাড়ে এসে দাঁড়ায় সে। হাতের চিঠিটি টুকরো টুকরো করে হ্রদের পানিতে ছুঁড়ে দেয়। ভোরের বাতাসে হ্রদের পানিতে মৃদু ঢেউ চিঠির টুকরোগুলোর সাথে খেলার ছলে ডুবিয়ে নিয়ে যায় অতলে। পাড়ে দাঁড়িয়ে ছল ছল চোখে তাকিয়েই থাকে সুকন্যা। ভাবে কলরাডোর নির্জন হ্রদ আর পাহাড়ে তাঁর জন্য কি অপেক্ষা করে আছে, এটা কেউ জানে না। 

No comments:

Post a Comment