কোথায় কি!

25 May 2017

দেবদত্তা ব্যানার্জী




আজ তিনদিন আমি এই বেসরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তিআমার পাশের বেডে একজন বৃদ্ধা ভর্তি রয়েছেন আমার আগের থেকেইদুবেলা দুটি আয়া ওনার দেখাশোনা করছে, বাড়ির কাউকে এই তিন দিনে আসতে দেখি নি একবারওওনার কি হয়েছে তাও জানি নানানারকম পরীক্ষা রোজ হচ্ছেডাক্তাররা আসছেন রাউন্ড দিতেওনাকে যখনি জিজ্ঞেস করেন উনি কেমন আছেন? কি অবস্থা?উনি নানা রকম সমস্যার কথা বলতে থাকেন ওনাকে কিছু পরীক্ষার জন্য নিয়ে গেছিল দেখে ওনার আয়াকে জিজ্ঞেস করলাম যে ওনার কি হয়েছে, বাড়ির লোক কোথায়

আয়া-দিদিটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল -" তেমন গুরুতর কিছু হয় নিওনার হার্টের রোগ আছেপ্রেশার কোলস্টোরেল হাইসুগার ও আছেএসব মিলিয়ে রুটিং চেকআপআসলে ছেলে বৌ বাচ্চা নিয়ে পনেরো দিনের জন্য রাজস্থান ঘুরতে গেছেমা কে হাসপাতালে রাখলে নিশ্চিন্তটাকা তো অফিস দেবেমা এর চেকআপ গুলোও হয়ে যাবে তার সাথেমা ও খুশী ছেলে যত্ন নিচ্ছে দেখে আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝে পেলাম নাঅফিস টাকা দেবে বলে মা কে হাসপাতালে দিয়ে ঘুরতে গেছে ছেলে !!!
আজকাল সব পরিবারেই দেখি অসুস্থ বৃদ্ধ বৃদ্ধারা বোঝা, তাদের শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রমআসলে অণু পরমাণু পরিবারে ওদের দেখার লোক নেইযৌথ পরিবারে এসব অসুবিধা ছিল না
আমি বড় হয়েছি যৌথ পরিবারেআমার ঠাকুরদার এক দূরসম্পর্কের পিসি আমাদের সংসারেই থাকতেনউনি ছিলেন বাড়ির কর্তিবয়সে ঠাকুমার সমবয়সী, বাল্য বিধবাশুনেছিলাম নয় বছরে বিয়ে হয়েছিলশ্বশুর বাড়ি যাওয়া আর হয় নিবছর ঘুরতেই স্বামী মারা গেছিলেন অজানা জ্বরেঠাকুমার এ সংসারে আসার কয়েক বছর পর ঠানদিম্মার আগমন 

ছোটবেলায় দেখতাম ঐ ঠানদিম্মা আমাদের সব কিছুর পরিত্রাতাসকালে উঠেই স্নান সেরে এক সাজি ফুল তুলে উনি ঠাকুর ঘরে ঢুকতেনপ্রায় আটটা নাগাদ বেড়িয়ে এককাপ লাল চা আর মুরি নিয়ে বসতেন রান্নাঘরের বারান্দায়তারপর তরকারী কেটে রান্নার ব্যবস্থাপাশাপাশি দুটি রান্নাঘর ছিলনিরামিষ আর আমিষনিরামিষটায় ওনার একছত্র আধিপত্যকখনো ঠাকুমা সেই দলে যোগ দিতেনমা আর দুই কাকিমা মিলে মাছ মাংস ডিম এসব রাঁধতযদিও সব ভাল রান্না ঐ নিরামিষ ঘর থেকেই আসতোছানার ডালনা, ধোঁকার ডালনা, বড়ার তরকারী, পোস্ত , টক, চাটনি এমন কত কিদারুণ গন্ধ ছাড়ত রান্না গুলোছোটবেলায় খেলা ফেলে আমরা ঐ রান্নাঘরে উঁকি দিতাম, আর বকার সাথে ভাজা ধোঁকা,বড়া বা ছানার টুকরো পেতাম হাতে হাতে
ফুটবল খেলে যখন হাতপা মচকে ফিরতাম তখন ঐ ঠানদিম্মা চুন হলুদ গরম করে লাগিয়ে দিতেন ব্যথার জায়গায়কখনো কোথাও কেটে গেলে ঠানদিম্মার টোটকা ভীষণ কাজে দিতোজ্বর হলে রাত জেগে জলপট্টি দিতেন উনিমা বা কাকিমাদের ঠানদিম্মাকে নিয়ে কখনো অসুবিধায় পরতে দেখি নিঠাকুমার তিনছেলে দুই মেয়েকে একাই মানুষ করেছিলেন উনিআবার আমরা সব ভাইবোনরাই ওনার কোলে পিঠে মানুষ হয়েছি
কতো রাতে ঠানদিম্মার কাছে গল্প শুনে ঘুমিয়েছিআবার আচার চুরি করে খেতে গিয়ে বকাও খেয়েছি কতএ নিয়েও মা দের কোনো অভিযোগ ছিল নাশীতের পিঠে পুলি, নাড়ু মোয়া , তালের বড়া, ক্ষীর সবেতেই দিম্মার অবদান
আমাদের বাড়ি একটা বাইরের কাজের লোক ছিল রহিমদেশ ভাগের সময় মাত্র দু বছরের বাচ্চা রহিমকে নিয়ে ওর মা আশ্রয় চেয়েছিল ঠাকুমাদের কাছেওর পুরো পরিবার পাকিস্তানে চলে গেছিল ও কিভাবে হারিয়ে গেছিলআমাদের বাগানে কয়লা আর শুকনো জ্বালানি কাঠ রাখার ঘরে ওরা থেকে গেছিলওর মা সে সময় আমাদের বাড়ির খুচখাচ কাজ করে দিতমুসলিম বলে ওকে ঘরের কোনো কাজ দেওয়া হতো নারহিম চাচুও মায়ের সাথে সাথে বাগানের বেড়া বাঁধতো, পুকুরের মাছ ধরে দিতশীতের সবজি লাগতোসুপুরি নারকেল গাছ গুলোর তদারকি করতোহাঁস, মুর্গী গুলোকে দেখে রাখতোওর মা ওকে দশ বছরের রেখে মারা গেছিলও এভাবেই থেকে গেছিল আমাদের বাড়িএসব ছাড়াও রহিম চাচু আমাদের সব ছোটদের প্রচুর সাহায্য করতোদুপুরে আম মাখা, তেঁতুল মাখা বা কুল মাখা, গাছ থেকে ফল পেরে দেওয়া, গরমের দুপুরে ডাব পেরে দেওয়া এসব ছাড়াও অনেক দরকারে লাগতটিপছাপ রহিম চাচুর হাতের কাজ ছিল অসাধারণআমাদের সবার স্কুলের হাতের কাজ বানিয়ে দিত রহিম চাচুকোনো কিছু ভেঙ্গে গেলে মেরামত করে নতুন করে দিতে পারতআমার নাচের ঘুঙ্গুর গেঁথে অসাধারণ ভাবে বানিয়ে দিয়েছিলরহিম চাচুর গড়া মূর্তিতেই বাড়ির সরস্বতী, লক্ষ্মী, পূজা হতঠাকুমা বলত মূর্তি পুরিয়ে নিলে দোষ নেইআমাদের খাতা বাঁধিয়ে দিতখুব সুন্দর ফটো ফ্রেম বানাতে পারতএমন আরো কত যে গুন ছিলযদি ঠিকঠাক পড়াশোনা করতো রহিম চাচু তাহলে হয়তো একদিন বড় ইঞ্জিনিয়ার হতে পারত

আমাদের পুকুরে ছেড়ে সাঁতার শেখানো থেকে সাইকেল চালানো শেখানো সবেতেই রহিম চাচুসব কাজ শেষ করে বেলা চারটায় কলা পাতা কেটে এনে খেতে বসতো চাচুআর বারান্দার কোনে মাটির মালসায় ঢাকা দেওয়া ভাত তরকারি যা যা থাকত পরম তৃপ্তি করে খেতো রোজ একটু খাবার বাঁচিয়ে লালু আর ভুলু কে দিতওরা ছিল রহিম চাচুর দুই পোষ্যকোনোদিন দ্বিতীয় বার কিছু চাইতে দেখি নিহাতখরচের যে সামান্য টাকা দেওয়া হত তা দিয়ে মেলায় আমাদের খেলনা, লজেন্স কিনে দিত ওর কোনো চাহিদা ছিল নাআমরাই ওর হৃদয়ের বাঁধনে বাঁধা পরেছিলাম

শুনেছিলাম আমার জন্মের রাতে বাড়িতে কোনো পুরুষ ছিল নাসবাই গেছিল জলসা দেখতে পাশের শহরেআসলে আমার জন্ম হতে তখনো একমাস দেরি ছিলসেদিন সন্ধ্যায় একপশলা বৃষ্টি হয়েছিলরাতে মা সব কাজ শেষ করে বাথরুমে যেতে গিয়ে উঠোনে পা পিছলে পরে গেছিলঠাকুমা আর কাকিমারা কি করবে বুঝে উঠতে পারে নিরহিম চাচু হরি রিকশাওয়ালাকে ডাকতে গিয়ে দেখে সেও জ্বরে বেহুশওর রিক্সাটা নিয়ে রহিম চাচুই মাকে সেদিন ৫ কিমি দুরের হাসপাতালে নিয়ে গেছিলওর জন্যই আমি এই পৃথিবীতে আসতে পেরেছিলামএর পর ঐ প্রিম্যাচিওর বেবিকে ঠানদিম্মাই তেলে জলে বড় করেছিলমা বহুদিন বিছানায় ছিলগরম জলের বোতল চারপাশে দিয়ে ঘরে কাঠকয়লা জ্বালিয়ে তুলোয় মুরে আমায় রাখা হতো
বড়দির বিয়ের তিনদিন আগে বাড়িতে ডাকাত পরেছিলসবাই জানত দিদির বিয়েগয়নাগাটি টাকাকড়ি সব বাড়িতেই, গ্ৰামের বাড়ি গুলো বেশ ফাঁকা ফাঁকা আর অনেক

...জায়গা নিয়ে হয়রহিম চাচু বাগানের ঘরে শুতোডাকাত গুলো বাবাকে চেয়ারের সাথে বেঁধেছিলবড় কাকুর ঘর বাইরে থেকে তালা দিয়েছিলছোটকা সেদিন ছিল নাশহরে গেছিল কেনাকাটা করতে সবাইকে নিয়েআমি আর বড়দি ভয়ে কাঁপছিলামমা ঠাকুমা ঠানদিম্মা সব ঠাকুর ঘরেএমন সময় লালু আর ভুলুকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেছিল রহিম চাচুএকটা বাঁশের লাঠি দিয়ে তিনটে ডাকাতের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলবাকিরা ভয়ে পালিয়েছিলতবে রহিম চাচুকে লক্ষ্য করে ভোজালি ছুঁড়েছিল একটা ডাকাতএকটুর জন্য পিঠ ঘেঁসে বেড়িয়ে গেছিল ঐ ভোজালিঐ তিনটে ডাকাত কে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে পুরো দলটাকেই ধরতে পেরেছিল শুধু ঐ রহিম চাচুর জন্য
ঠাকুমা দাদু বহুবছর আগেই গত হয়েছে
ঐ গ্ৰামের বাড়িতে এখন থাকে শুধু থুত্থুড়ি বুড়ি ঠানদিম্মা, রহিম চাচু বাবা মা গত হয়েছে সাত আট বছর, শেষ দিকে রহিম চাচুই ওদের দেখতআমি তখন বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়িবড় কাকু কাকিমা মেজদার কাছে দিল্লীতে থাকেছোটকা  আর কাকিমা ছেলের কাছে কলকাতায় আজ তিন বছর ঠানদিম্মার সঠিক বয়স জানি না, তবে নব্বই পার করেছেন জানিরহিম চাচুর চুয়াত্তর পঁচাত্তর হবেভাই বোনেরা আজ সবাই আমরা বাইরেঐ বাড়ি জমি জায়গা আগলে পরে রয়েছে ঐ দুইজনএখন ঠানদিম্মাকে রহিম চাচুই দেখেরান্নাও করে দেয় সেদ্ধ-ভাতঠানদিম্মা বলেন -" স্বামীর ঘর না করেই আজন্ম বিধবার সব আচার আচরণ নিষ্ঠা ভরে পালন করেছিএই শেষ বয়সে ঐ মুসলমানের হাতে খেয়ে যদি কোনো পাপ হয় আমি পাপীরহিম চাচুকে দেখে বলতেন -" গত জনমে ও আমার বাবা ছিলআগামীতে ও আমার  পেটের ছেলে হবে "

আজকালকার ছেলেরাও মাকে এতো যত্নে রাখে না যেভাবে রহিম চাচু ওনাকে রেখেছেঠানদিম্মাকে দাদারা আনতে চাইলেও আসেন নি উনিশুধু বলেছেন ঐ বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে শান্তি পাবেন নাআমরা সবাই বছরে একবার যাইএখনো রহিমচাচু আমাদের পথ চেয়ে বসে থাকেপুকুরের মাছ ধরে খাওয়ায়ফল, ফলাদি, নারকেল, সুপুরি বিক্রির হিসাব দেয়এত বছরে একটা দিনের জন্য এদের দুজনকে অসুস্থ হতে দেখি নি আমিপ্রাণ দিয়ে করে গেছে সবার জন্যএখনো করে যাচ্ছেআমরা বোধহয় কিছুই করি নি ওদের জন্যনিজেদের জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেটাতে মেটাতে কখন হারিয়ে গেছি জানি না
পাশের বেডের মহিলাকে দেখে মনে হল আমার ভবিষ্যতেও এই রয়েছেনিঃস্বার্থ ভালবাসা যা আমরা রহিম চাচু বা ঠানদিম্মার থেকে পেয়েছিলাম আমার ছেলে মেয়ে পায় নিতাই আজ বৃদ্ধাশ্রমের চাহিদা এভাবে বেড়ে চলেছে

সমাপ্ত

No comments:

Post a Comment