আজ তিনদিন
আমি এই বেসরকারি সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে ভর্তি। আমার পাশের বেডে একজন বৃদ্ধা ভর্তি রয়েছেন আমার আগের থেকেই। দুবেলা দুটি আয়া ওনার দেখাশোনা করছে, বাড়ির
কাউকে এই তিন দিনে আসতে দেখি নি একবারও। ওনার কি হয়েছে তাও জানি না। নানারকম পরীক্ষা রোজ হচ্ছে। ডাক্তাররা আসছেন রাউন্ড দিতে। ওনাকে যখনি জিজ্ঞেস করেন উনি কেমন আছেন? কি
অবস্থা?উনি নানা রকম সমস্যার কথা বলতে থাকেন। ওনাকে কিছু পরীক্ষার জন্য
নিয়ে গেছিল দেখে ওনার আয়াকে জিজ্ঞেস করলাম যে ওনার কি হয়েছে, বাড়ির
লোক কোথায়।
আয়া-দিদিটি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল -" তেমন গুরুতর কিছু হয় নি। ওনার হার্টের রোগ আছে। প্রেশার কোলস্টোরেল হাই। সুগার ও আছে। এসব মিলিয়ে রুটিং চেকআপ। আসলে ছেলে বৌ বাচ্চা নিয়ে পনেরো দিনের জন্য রাজস্থান ঘুরতে
গেছে। মা কে হাসপাতালে রাখলে নিশ্চিন্ত। টাকা তো অফিস দেবে। মা এর চেকআপ গুলোও হয়ে যাবে তার সাথে। মা ও খুশী ছেলে যত্ন নিচ্ছে দেখে। আমি হাসবো না কাঁদবো বুঝে
পেলাম না। অফিস টাকা দেবে বলে মা কে
হাসপাতালে দিয়ে ঘুরতে গেছে ছেলে !!!
আজকাল সব পরিবারেই দেখি অসুস্থ বৃদ্ধ বৃদ্ধারা বোঝা, তাদের
শেষ ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম। আসলে
অণু পরমাণু পরিবারে ওদের দেখার লোক নেই। যৌথ পরিবারে এসব অসুবিধা ছিল না।
আমি বড় হয়েছি যৌথ পরিবারে। আমার ঠাকুরদার এক দূরসম্পর্কের পিসি আমাদের সংসারেই থাকতেন। উনি ছিলেন বাড়ির কর্তি। বয়সে ঠাকুমার সমবয়সী, বাল্য বিধবা। শুনেছিলাম নয় বছরে বিয়ে হয়েছিল। শ্বশুর বাড়ি যাওয়া আর হয় নি। বছর ঘুরতেই স্বামী মারা গেছিলেন অজানা জ্বরে। ঠাকুমার এ সংসারে আসার কয়েক বছর পর ঠানদিম্মার
আগমন।
ছোটবেলায় দেখতাম ঐ ঠানদিম্মা আমাদের সব কিছুর পরিত্রাতা। সকালে উঠেই স্নান সেরে এক সাজি ফুল তুলে উনি ঠাকুর ঘরে
ঢুকতেন। প্রায় আটটা নাগাদ বেড়িয়ে
এককাপ লাল চা আর মুরি নিয়ে বসতেন রান্নাঘরের বারান্দায়। তারপর তরকারী কেটে রান্নার ব্যবস্থা। পাশাপাশি দুটি রান্নাঘর ছিল। নিরামিষ আর আমিষ। নিরামিষটায় ওনার একছত্র আধিপত্য। কখনো ঠাকুমা সেই দলে যোগ দিতেন। মা আর দুই কাকিমা মিলে মাছ মাংস ডিম এসব রাঁধত। যদিও সব ভাল রান্না ঐ নিরামিষ ঘর থেকেই আসতো। ছানার ডালনা, ধোঁকার
ডালনা, বড়ার তরকারী, পোস্ত , টক, চাটনি
এমন কত কি। দারুণ গন্ধ ছাড়ত রান্না গুলো। ছোটবেলায় খেলা ফেলে আমরা ঐ রান্নাঘরে উঁকি
দিতাম, আর বকার সাথে ভাজা ধোঁকা,বড়া
বা ছানার টুকরো পেতাম হাতে হাতে।
ফুটবল খেলে যখন হাতপা মচকে ফিরতাম তখন ঐ ঠানদিম্মা চুন হলুদ গরম করে লাগিয়ে
দিতেন ব্যথার জায়গায়। কখনো
কোথাও কেটে গেলে ঠানদিম্মার টোটকা ভীষণ কাজে দিতো।জ্বর হলে রাত জেগে জলপট্টি দিতেন উনি। মা বা কাকিমাদের ঠানদিম্মাকে নিয়ে কখনো অসুবিধায় পরতে দেখি
নি। ঠাকুমার তিনছেলে দুই মেয়েকে
একাই মানুষ করেছিলেন উনি। আবার
আমরা সব ভাইবোনরাই ওনার কোলে পিঠে মানুষ হয়েছি।
কতো রাতে ঠানদিম্মার কাছে গল্প শুনে ঘুমিয়েছি। আবার আচার চুরি করে খেতে গিয়ে বকাও খেয়েছি কত। এ নিয়েও মা দের কোনো অভিযোগ ছিল না। শীতের পিঠে পুলি, নাড়ু
মোয়া , তালের বড়া, ক্ষীর সবেতেই দিম্মার অবদান।
আমাদের বাড়ি একটা বাইরের কাজের লোক ছিল রহিম। দেশ ভাগের সময় মাত্র দু বছরের বাচ্চা রহিমকে নিয়ে ওর মা
আশ্রয় চেয়েছিল ঠাকুমাদের কাছে। ওর পুরো পরিবার পাকিস্তানে চলে গেছিল । ও কিভাবে হারিয়ে গেছিল। আমাদের বাগানে কয়লা আর শুকনো জ্বালানি কাঠ রাখার ঘরে ওরা
থেকে গেছিল। ওর মা সে সময় আমাদের বাড়ির
খুচখাচ কাজ করে দিত। মুসলিম
বলে ওকে ঘরের কোনো কাজ দেওয়া হতো না। রহিম চাচুও মায়ের সাথে সাথে বাগানের বেড়া বাঁধতো, পুকুরের
মাছ ধরে দিত। শীতের সবজি লাগতো। সুপুরি নারকেল গাছ গুলোর তদারকি করতো। হাঁস, মুর্গী গুলোকে দেখে রাখতো। ওর মা ওকে দশ বছরের রেখে মারা গেছিল। ও এভাবেই থেকে গেছিল আমাদের বাড়ি। এসব ছাড়াও রহিম চাচু আমাদের সব ছোটদের প্রচুর সাহায্য করতো। দুপুরে আম মাখা, তেঁতুল মাখা বা কুল মাখা, গাছ
থেকে ফল পেরে দেওয়া, গরমের দুপুরে ডাব পেরে দেওয়া এসব ছাড়াও অনেক দরকারে
লাগত। টিপছাপ রহিম চাচুর হাতের কাজ
ছিল অসাধারণ। আমাদের সবার স্কুলের হাতের
কাজ বানিয়ে দিত রহিম চাচু। কোনো কিছু ভেঙ্গে গেলে মেরামত করে নতুন করে দিতে পারত। আমার নাচের ঘুঙ্গুর গেঁথে অসাধারণ ভাবে বানিয়ে
দিয়েছিল। রহিম চাচুর গড়া মূর্তিতেই
বাড়ির সরস্বতী, লক্ষ্মী, পূজা হত।ঠাকুমা বলত মূর্তি পুরিয়ে নিলে দোষ নেই। আমাদের খাতা বাঁধিয়ে দিত। খুব সুন্দর ফটো ফ্রেম বানাতে পারত। এমন আরো কত যে গুন ছিল। যদি ঠিকঠাক পড়াশোনা করতো রহিম চাচু তাহলে হয়তো একদিন বড়
ইঞ্জিনিয়ার হতে পারত।
আমাদের পুকুরে ছেড়ে সাঁতার শেখানো থেকে সাইকেল চালানো শেখানো সবেতেই রহিম চাচু। সব কাজ শেষ করে বেলা চারটায় কলা পাতা কেটে এনে
খেতে বসতো চাচু। আর বারান্দার কোনে মাটির
মালসায় ঢাকা দেওয়া ভাত তরকারি যা যা থাকত পরম তৃপ্তি করে খেতো । রোজ একটু খাবার বাঁচিয়ে লালু আর ভুলু কে দিত। ওরা ছিল রহিম চাচুর দুই পোষ্য।কোনোদিন দ্বিতীয় বার কিছু চাইতে দেখি নি। হাতখরচের যে সামান্য টাকা দেওয়া হত তা দিয়ে
মেলায় আমাদের খেলনা, লজেন্স কিনে দিত । ওর কোনো চাহিদা ছিল না। আমরাই ওর হৃদয়ের বাঁধনে বাঁধা পরেছিলাম।
শুনেছিলাম আমার জন্মের রাতে বাড়িতে কোনো পুরুষ ছিল না। সবাই গেছিল জলসা দেখতে পাশের শহরে। আসলে আমার জন্ম হতে তখনো একমাস দেরি ছিল। সেদিন সন্ধ্যায় একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। রাতে মা সব কাজ শেষ করে বাথরুমে যেতে গিয়ে
উঠোনে পা পিছলে পরে গেছিল। ঠাকুমা আর কাকিমারা কি করবে বুঝে উঠতে পারে নি। রহিম চাচু হরি রিকশাওয়ালাকে ডাকতে গিয়ে দেখে
সেও জ্বরে বেহুশ। ওর রিক্সাটা নিয়ে রহিম চাচুই
মাকে সেদিন ৫ কিমি দুরের হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। ওর জন্যই আমি এই পৃথিবীতে আসতে পেরেছিলাম। এর পর ঐ প্রিম্যাচিওর
বেবিকে ঠানদিম্মাই তেলে জলে বড় করেছিল। মা বহুদিন বিছানায় ছিল। গরম জলের বোতল চারপাশে দিয়ে ঘরে কাঠকয়লা জ্বালিয়ে তুলোয়
মুরে আমায় রাখা হতো।
বড়দির বিয়ের তিনদিন আগে বাড়িতে ডাকাত পরেছিল। সবাই জানত দিদির বিয়ে। গয়নাগাটি টাকাকড়ি সব বাড়িতেই, গ্ৰামের
বাড়ি গুলো বেশ ফাঁকা ফাঁকা আর অনেক
...জায়গা নিয়ে হয়। রহিম চাচু বাগানের ঘরে শুতো। ডাকাত গুলো বাবাকে চেয়ারের সাথে বেঁধেছিল। বড় কাকুর ঘর বাইরে থেকে তালা দিয়েছিল। ছোটকা সেদিন ছিল না। শহরে গেছিল কেনাকাটা করতে সবাইকে নিয়ে। আমি আর বড়দি ভয়ে কাঁপছিলাম। মা ঠাকুমা ঠানদিম্মা সব ঠাকুর ঘরে। এমন সময় লালু আর ভুলুকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরেছিল রহিম চাচু। একটা বাঁশের লাঠি দিয়ে তিনটে ডাকাতের মাথা
ফাটিয়ে দিয়েছিল। বাকিরা ভয়ে পালিয়েছিল। তবে রহিম চাচুকে লক্ষ্য করে ভোজালি ছুঁড়েছিল
একটা ডাকাত। একটুর জন্য পিঠ ঘেঁসে বেড়িয়ে
গেছিল ঐ ভোজালি। ঐ তিনটে ডাকাত কে পুলিশ তুলে
নিয়ে গিয়ে পুরো দলটাকেই ধরতে পেরেছিল শুধু ঐ রহিম চাচুর জন্য।
ঠাকুমা দাদু বহুবছর আগেই গত হয়েছে।
ঐ গ্ৰামের বাড়িতে এখন থাকে শুধু থুত্থুড়ি বুড়ি ঠানদিম্মা, রহিম
চাচু ।বাবা মা গত হয়েছে সাত আট বছর, শেষ
দিকে রহিম চাচুই ওদের দেখত। আমি তখন বিয়ে হয়ে শ্বশুর বাড়ি।বড় কাকু কাকিমা মেজদার কাছে দিল্লীতে থাকে। ছোটকা
আর কাকিমা ছেলের কাছে
কলকাতায় আজ তিন বছর । ঠানদিম্মার
সঠিক বয়স জানি না, তবে নব্বই পার করেছেন জানি। রহিম চাচুর চুয়াত্তর পঁচাত্তর হবে। ভাই বোনেরা আজ সবাই আমরা বাইরে। ঐ বাড়ি জমি জায়গা আগলে পরে রয়েছে ঐ দুইজন। এখন ঠানদিম্মাকে রহিম চাচুই দেখে। রান্নাও করে দেয় সেদ্ধ-ভাত। ঠানদিম্মা বলেন -" স্বামীর ঘর না করেই আজন্ম বিধবার সব আচার আচরণ নিষ্ঠা ভরে পালন করেছি। এই শেষ বয়সে ঐ মুসলমানের হাতে খেয়ে যদি কোনো
পাপ হয় আমি পাপী।" রহিম চাচুকে দেখে বলতেন
-" গত
জনমে ও আমার বাবা ছিল। আগামীতে
ও আমার পেটের ছেলে হবে ।"
আজকালকার ছেলেরাও মাকে এতো যত্নে রাখে না যেভাবে রহিম চাচু ওনাকে রেখেছে। ঠানদিম্মাকে দাদারা আনতে চাইলেও আসেন নি উনি। শুধু বলেছেন ঐ বাড়ি ছেড়ে কোথাও গিয়ে শান্তি
পাবেন না। আমরা সবাই বছরে একবার যাই। এখনো রহিমচাচু আমাদের পথ চেয়ে বসে থাকে। পুকুরের মাছ ধরে খাওয়ায়। ফল, ফলাদি, নারকেল, সুপুরি
বিক্রির হিসাব দেয়। এত বছরে একটা দিনের জন্য
এদের দুজনকে অসুস্থ হতে দেখি নি আমি। প্রাণ দিয়ে করে গেছে সবার জন্য। এখনো করে যাচ্ছে। আমরা বোধহয় কিছুই করি নি ওদের জন্য।নিজেদের জীবনের চাওয়া পাওয়ার হিসাব মেটাতে মেটাতে কখন
হারিয়ে গেছি জানি না।
পাশের বেডের মহিলাকে দেখে মনে হল আমার ভবিষ্যতেও এই রয়েছে। নিঃস্বার্থ ভালবাসা যা আমরা রহিম চাচু বা
ঠানদিম্মার থেকে পেয়েছিলাম আমার ছেলে মেয়ে পায় নি। তাই আজ বৃদ্ধাশ্রমের চাহিদা এভাবে বেড়ে চলেছে।
সমাপ্ত
No comments:
Post a Comment