‘ছুনা হে ছুনা হে, ইয়ে
রস্মে বাফা , যো দিল পে নেশা হে, যো
পেহেলি দাফা হে’ গুন গুন করতে করতে পথে নামলাম। বাসার গেট থেকে মাথা বের করতেই রিকশা নজরে এলো। রিকশা ভাড়া পাঁচ টাকা কমিয়ে ঝটপট উঠে বসতেই সে
বলে, “পিছন দিয়া যাওয়া যাইবো?”
“বাহ রে! পিছন দিয়া কেম্নে যাবেন? চিনেন
না তাতেই আবার ভাড়া বেশি চান। সামনে দিয়ে যান।“ বলে বেশ একটা মিষ্টি ঝাড়ি দিলাম।
এরপরে সে আর কথা বাড়ালো না। কিন্তু, যতই চাইছি এটা এখন পঙ্খিরাজ
ঘোড়ার বেগে ছুটুক। কিন্তু কিসের কী? মনে
হচ্ছে ঠেলাগাড়িতে উঠেছি।
রিকশাওয়ালাকে ইতোমধ্যেই জিজ্ঞেস করে ফেলেছি, পলিথিন
আছে কিনা। দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করতেই
বললো, “আমি তো উঠায় দেখি নাই!”
“মোর জ্বালা! উঠায় দেখি নাই মানে কী? রিকশা
টা কি আরেকজনের?” তাকে ঝাড়তে গিয়ে গানের লিড়িক্স ভুলে গেলাম।
একে তো ঠ্যালাগাড়ি চলছে তার উপরে তার গন্তব্য চেনা নেই। তাকে চিনিয়ে নিয়ে যেতে যেতে ভাবছি, ব্যাগের
সব ভিজে গেলেই মরেছি।
যা হোক, কয়েক মিনিট বাদে গন্তব্যে পৌঁছে যাবো যাবো এর
মধ্যে পাশাপাশি দুটি গাড়ির প্যাঁচ লেগে গেলো। এ পাশে থেকে যাবে মাইক্রো, আর
ওপাশ থেকে আসছে প্রাইভেট কার। দুজনেই এই মোটামুটি চওড়া রাস্তায় একসাথে পাশাপাশি চলতে
চাইছে। যাও বা দুজনের প্যাঁচটা
মিটলো, আমার ঠ্যালাগাড়ির যেন চাকায় আঠা গজিয়েছে। চলেই না। মিনিট দুয়েক পরে নামলাম রিকশা থেকে।
নেমেই দেখি সব ফার্মেসি। এবার আমি নিজেই গন্তব্য চিনতে পারছিনা। “তা বেশ!” ভেংচিয়ে
উঠলাম আনমনেই।
.
দোদুল্যমান মনে সামনে এগোতেই চোখে পরলো ফটোষ্ট্যাট, স্ক্যান
লেখা দোকানের শাটার। “যাক, পেলাম!”
স্বস্তি ঝরলো এক মুহুর্তে।
কিন্তু হেঁটে এগোতে পারছি না মোটেই। ন-দশ বছরের এক অটিস্টিক ছেলেকে কাঁধে করে খুব
সম্ভব তার বাবাই হবে, হাঁটছে ঠিক আমার এক পা সামনেই। বাবা টা হাঁটা থামিয়ে দিলেই বাচ্চা ছেলেটার
মুখে গিয়ে গুতো খাওয়ার সম্ভাবনা। এর মধ্যে বৃষ্টির তোড় বেড়েছে। আমি ফুটপাত ধরে হাঁটছি কিন্তু দোকানের কার্নিশ পাচ্ছিনা
যাতে উঠে গেলে বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচবো। হঠাত চোখে পরল আতিফ আসলাম দাঁড়িয়ে, এতক্ষণ
যার গান গুন গুন করছিলাম, সে আমার সামনে? আল্লাহ
গো! ঠিক যে দোকানে আমি যাব তার আগেরটায়। সময় যেন থমকে গেল। বৃষ্টির ফোঁটা ভিজিয়ে দিচ্ছে আমায় সে খবর নেই একদমই। “ইক
ও নেজার, ইক ও নিগাহ, রুহো মে শামিল ইশ তারাহ...” -“ম্যাম, কী করাবেন?”
“হ্যাঁ?”
অপ্রস্তুত আমি পেন ড্রাইভ
খুঁজতে কাঁধে ঝুলানো ভেনিটি ব্যাগে ত্রস্ত হাত লাগালাম। দেখিয়ে দিলাম কী করাতে চাই। কাজ হয়ে গেলো প্রায় দুমিনিটে।
বের হবার মুখে ঝুম বৃষ্টি। বাসায় ফিরবো না এখানেই দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টি থামবার অপেক্ষা
করবো? ভাবছিলাম দাঁড়িয়ে থেকে। এর মধ্যেই দেখি, একটা রিকশা ঘুরে আমার
কাছাকাছি আসতে লেগেছে। যদিও
দুজনার মাঝের দূরত্বটা ফুটপাথ দখল করেছে। তবু মনে হলো, এটা আমারই জন্যে আসছে। অবাক হলেও খুশী হচ্ছিলাম। রিকশায় পলিথিন মোড়ানো। উঠে বসতে যেতেই দেখি, যাত্রী বসে। কী আশ্চর্য !
এ যে সেই আতিফ আসলাম!
“ম্যাম, আপনি তো থানার পেছনে যাবেন? আমিও
যাচ্ছি উঠে বসুন।“
আমিও কেমন আহাম্মকের মত উঠে বসলাম পাশে।এই প্রথম দেখলাম তাকে। কোন সংকোচ নেই আমার মধ্যেও।
রিকশাটা যেন উড়ে চলে এলো বাড়ির কাছাকাছি। আমার বাসা আরও দুটো বাড়ি পরে। এর মধ্যেই সে ভাড়া দিয়ে বৃষ্টির ছাট মাথায় গায়ে মেখেই নেমে
পরলো। নামবার ঠিক আগে বলে গেলো, “ইফতেখার। দেখা হবে!”
.
হতভম্ব হয়ে ভাবছি, ভদ্রলোক সেই বাসাটাতেই তো নামলো যে বাড়ির
ভদ্রমহিলা তার মেয়েকে সাথে করে আমাকে গেল শুক্রবারে দেখে গেছে। কিন্তু তার ছেলের তো এখন নিউইয়র্কে থাকার কথা। সে দেশে এসেছে এমনটা তো বলেনি সেদিন। বিষয়টা বোধগম্য হতেই সম্পূর্ণ অবয়বে অন্যরকম
অচেনা শিরশিরে এক আনন্দ অনুভব ছড়িয়ে পরলো আমার।
.
(সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment