কোথায় কি!

22 August 2017

প্রজ্ঞা মৌসুমী


কেউ একজন আমার ময়লার বিনে কী যেন খুঁজে হয়তো বাস্তুহারা, হয়তো মাদকাসক্ত, লোকটাকে দেখা হয়নি আজও শুধু হঠাৎ দেখি একান্ত গোপনীয়তা প্রকাশের মতো ছড়িয়ে আছে ডিমের খোসা, জেসমিন চালের প্যাকেট, রেস্তরাঁর খাবারের বাকসো উড়ে এসে জুড়ে বসা এই ঝামেলা কিংবা শুক্রবারে পাশাপাশি থাকা একুশটা সবুজরঙা ট্র্যাশবিন দেখে ইদানিং মনে হয় - পড়ে থাকা জঞ্জালও জানান দেয় একেকটা বাড়ির স্ট্যাটাস এ বাড়ির লোকেরা দামী চালটা কেনে ও বাড়িতে বোধকরি একজন লেখক থাকেন সে বাড়িতে অফুরান অনলাইন শপিং আর এতসব ডাইপারের ঝাঁক মানে পাড়ায় জন সংখ্যাবৃদ্ধি
হ্যাঁ, আমরা গর্ভবতী ছিলাম সাত জন আত্মীয়-বন্ধুদের থেকেও খবর আসে মা হতে যাচ্ছে কে যেন বলেছিল শীত কালটা বেবির সিজন, বিশেষ করে মেয়ে বাচ্চার কাকতালীয়কে আমরাই বোধকরি পরিসংখ্যান বানাই আজকাল মনে হয় জঞ্জাল হাতড়ে বেড়ানো লোকটার মতো আমরাও কী খুঁজি না প্রথা, সংস্কার, কুসংস্কার! হেলথ অ্যাডভাইজরের সামনে বসে যেমন আবিষ্কার করেছিলাম সোহেলের আপত্তি পুরুষ ডাক্তারে আমার নিজের গলাও শুকিয়ে এসেছিল ডাক্তারের লিস্টটা যখন নারীতে এসে হয়ে গেল চিরকুট, যখন একেকটা ফোনকল জানাচ্ছিল নতুন রোগী নিচ্ছে না

জ্ঞানের দেবীর  অ্যাথেনার কল্যাণে জানলাম অনেক কিছুই মিষ্টি খাবার বেশি খাওয়ার ইচ্ছে মানে ছেলে হবে, মেয়ে হলে শরীর দুর্বল লাগবে খুব শাশুড়ি স্বপ্নে সাপ দেখেছেন, নির্ঘাত নাতি হবে আর 'নাতি বংশের বাতি'- সে তো এক কিংবদন্তি বিশ্বাস ভীষণ রকম আনারস খেতে ইচ্ছে হতো ডাক্তার, জনা পাঁচেক নার্স, পুষ্টিবিদ পাকা আনারসে সমস্যা নেই বললেও আম্মা এমন ভাবে চোখ রাঙাতো যেন আনারস খাওয়া হারাম ডাঃ দিনার রেফারেন্স শুনে বলতো 'ছাতা ডাক্তার জানে কিছু!'  স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুজান বলে আনারসের ব্যাপারটা একটা মিথ মিথ আমার বরাবরই ভালো লাগে এই যেমন পৃথিবীতে শিশু আসে সারস পাখির ঠোঁটে করে যে সারস পৃথিবীতে বেঁচে থাকে এক হাজার বছর হাসপাতালে কেবিনের দরজায় তাই ঝুলানো হয় বাচ্চা ঠোঁটে সারস পাখির ছবি মেয়ে হলে গোলাপী রঙের ছাপ কেননা নীল ছেলেদের রঙ আর মেয়েদের রঙ গোলাপী আমার এক ননদ বলেছিল 'স্মার্ট মেয়ে মানে ফর্সা, লম্বা, স্লিম আর তাই হয়তো আমাদের এতসব প্রয়াস- ডালিম খেলে চোখ হবে ডালিম রঙা, সুন্দর বাচ্চার ছবি দেখলে হুবহু সুন্দর বাবু হয় তিন মাসের সময় ডিমের সাদা অংশ খেলে রঙ ফর্সা কাঁচা শরীর তাই বাচ্চার হাত পা টেনে লম্বা করা যায় বোঁচা নাক তুলতে হয় সর্ষের তেল দিয়ে কাপড়ের বিড়ায় শোয়ালে, মাথা গোল হয় মিষ্টি স্বর হয় জন্মের পর মুখে মধু দিলে

একদিন অবশ্য সমস্ত আয়োজনকে ব্যর্থ করে আসে এক নতুন উপলব্ধি- a child does not come with a guarantee সমস্ত সংস্কার সরিয়ে এক শীতের রাতে পুরুষ ডাক্তার আমাকে  এডমিট করেন শীতের সিজন হলেও পাড়ায় আর সবার ছেলে বাচ্চা হয় কেবল আমিই সমস্ত দোয়া দরুদ কিংবা স্বপ্নের সাপকে ছাপিয়ে এক কন্যার জননী হই মেয়ের নিটোল নাক আর হয় না, নীল চোখের ছবিমুখ দেখেও দেখেও  নীলাঞ্জনা হয় না মেয়ে, অফুরান প্রার্থনার পরেও গড়নটা বড়ো বেশি আনস্মার্ট মা ঘেঁষা আমার দিন রাত মন খারাপ হয়

অন্যের চোখ দিয়ে মেয়েকে কেবল পরখ করেছি, বিচার করেছি ও যেমন তেমন করে ভালোবাসতে এত দ্বিধা! বুকের অন্ধকারে এত জঞ্জাল! জঞ্জাল হাতড়ানো অদেখা লোকটার মুখ যেন আমারই মুখ কই হাসপাতালে যে দেয়ালে তাকিয়েছিলাম, সে দেয়ালের ক্রুশবিদ্ধ যীশু তো আমাকে স্পর্শ করেনি স্পর্শ করেনি সপ্ত আসমান থেকে আসা 'আল ইমরান' - "আমি এক কন্যা প্রসব করেছি••• সেই কন্যার মতো কোন পুত্রই যে নেই"  আমাকে বরং স্পর্শ করেছে জঞ্জালের মতো অযাচিত কথা অথচ জানি অন্যের মুখের কথাকে হয়তো নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, তবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় নিজের ভাবনাকে

হয়তো তাই এক সকালে, জঞ্জাল ছাড়িয়ে চোখ দেখে আমার উঠোন ছেয়ে যাওয়া চেরী ফুল মাত্র সাতটা দিনের আয়ু নিয়ে আসে অথচ বাঁচে কী তুমুল ডিগনিটি নিয়ে! বুক ছুঁয়ে থাকে কন্যা মধুমুখ করানো হলোনা মেয়ের, শিশুদের যে মধু খাওয়াতে নেই তবু আঙুল ঠোঁটে দিয়ে কী মিষ্টি সুর বাজায় মেয়ে আমার! আম্মা বলে, দোতারা আমার অন্ধকার ভরে উঠে ভোরের দোতারার নিষ্পাপতায়...

No comments:

Post a Comment