(১)
‘ভালোবাসা এবং ভূত দুটোরই কোন অস্তিত্ব নেই। কিন্তু মজার বিষয় হলো আমরা এ
দুটোকে আঁকড়ে বাঁচি। আমাদের মনের ভেতরটা ভালবাসা এবং ভূতের ভয়কে আপন করে এক আপন
ভুবন বানিয়ে সেখানে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এক পর্দা দিয়ে আড়াল করে রাখে। যখনই শুনশান
রাতে অন্ধাকারে একাকী হাঁটতে থাকি আমরা কিংবা চেয়ে থাকি শূন্যে অন্ধকার অরণ্যে তখন
সেই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পর্দায় ভূতের কল্পিত অস্তিত্বে নিউরনের অনুরণ ঘটে এবং আমরা
কেঁপে ওঠি। ঠিক তেমনি যখন মনে হয় কাউকে ভেবে ভাল লাগছে, কেউ
আমাকে ভাবছে, আমার মত করে আমার কাছে থাকছে, কিংবা কাউকে মনে হচ্ছে কাছে আসলে, কথা বললে আমার ভাল
লাগবে তখনও সেই ভাল লাগার একটা সংকেত ইলেকট্রোম্যাগনেপিক পর্দায় আবার অনুরণ ঘটায়
এবং আমরা কেঁপে ওঠি। দুটি কাঁপার মধ্যে কেবল একটাই তফাৎ, একটার
সাথে মৃত্যু ভয় জড়িত আরেকটির সাথে বেঁচে থাকা সুখ...’
এরকম একটি কাল্পনিক দর্শন আমি রুহিকে পড়ে শোনাচ্ছিলাম। আমারই লেখা। এ
কোন গবেষণা প্রবন্ধ নয়। কাল্পনিক দর্শন। কিন্তু সত্যি আমি বিশ্বাস করি ভালোবাসা আর
ভূত দুটোরই কোন অস্তিত্ব নেই।
রুহি আমাকে থামিয়ে দিয়েছিল। ও আর শুনতে চায় না। ইনফেক্ট আমার মিষ্টি
মধুর কোন কবিতাও সে শুনতে চায় না। শোনাতে গেলেই থামিয়ে দিয়ে বলে চুপ করে কিছুক্ষণ
আমার হাতটা ধরে থাক। কি আর করার। আজ অবশ্য তেমনটি করলো না। একটু অন্যরকম দেখালো
তার মুখের অভিব্যক্তি। একটু কর্কশ হয়ে উঠল মিষ্টি কণ্ঠস্বর। বললো, তোমাকে আমি সত্যি
একদিন ভালোবাসা আর ভূত দুটোই একসাথে দেখিয়ে ছাড়বো।
রুহি দুটোতেই বিশ্বাস প্রবল। সে আমি জানি। তবু আমি হেসে উঠলাম। সে আরও
ক্ষিপ্ত হলো। বিষয় ওখানে থামানো যেতে কিনা জানি না। আমি চেষ্টা করি নি। ও বললো, আমি তাকে ভালোই
বাসিনি আসলে কোনদিন। বাসলে ভালোবাসার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারতাম না।
আমি তখনও তার রাগের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারি নি। পারলে হয়তো
পরিস্থিতি অন্যরকম হতো। কিন্তু আমি তো মানি যেমন হয়েছে সেটাই বাস্তব। কি হলে কি
হতে পারতো তাতে পৃথিবীর কচুটা এসে যায়।
ও ভীষণ রেগে গেলো।
ও আরও বললো, ভালোবাসা বোঝো না তাহলে প্রেম করতে এসেছো কেনো। বিয়ে বোঝো তো? নাকি তোমার কাছে তারও অস্তিত্ব নেই।’
ও আরও বললো, ভালোবাসা বোঝো না তাহলে প্রেম করতে এসেছো কেনো। বিয়ে বোঝো তো? নাকি তোমার কাছে তারও অস্তিত্ব নেই।’
বললাম, এর মধ্যে আবার বিয়ের কথা কোথা থেকে আনলে। তোমাকে ভাল লাগে, তোমার সংগ ভালো লাগে, কথা শুনতে ভালো লাগে, হয়তো তোমার কথা মতে এটাই প্রেম। কিন্তু কি জানো- তুমি না থাকলে যে সব ভালো
লাগা হারিয়ে যাবে সেটাও আমার মনে হয় না।
এটা বলেই বুঝি ফেঁসে গেলাম। ওর রাগের মাথায় আমি এমন একটা ফালতু দর্শন
কপচালাম।
কিন্তু কিছু আর করার নেই। সরল অংকের নিয়মে সে রেগে আগুন হলো এবং বললো, তাহলে তুমি তোমার
ভালো লাগা হারায় কিনা সে এক্সপেরিমেন্টে সফল হও। আজ থেকে আমাদের ব্রেক আপ।
আমি তারপরও থামলাম না। বললাম ব্রেক আপ মানে, আমরা কি কিছু জোরা লাগিয়েছি
নাকি।
লাগাও নি সে তো আজ বুঝলাম। ওক্কে বাই। তবে তোমাকে আমি একদিন সত্যি ভূত
ও ভালোবাসার অস্তিত্ব বুঝিয়েই ছাড়বো। না পারলে আমার নাম রুহি না।
আমিও ওর চলার পথের দিকে তাকিয়ে শেষ বারের মত অংকের সরল নিয়েমে বললাম, আই রুহি সত্যি
সত্যি রাগ করলে নাকি। ভালোবাসা এত ঠুনকো কেনো ?সামান্য
কথাতেই সে ভেঙে পড়ে কেনো?
ওর তখন মাথায় আগুন । আর সে শোনে নি।
(২)
রুহির সেই প্রস্থান বেশ সিরিয়াসই ছিলো। আমি তাই নতুন করে নতুন দর্শন
লিখেছিলাম আরেকখানা।
‘ভালোবাসার মেটেরিয়ালটাই এমন যে তা খুব দ্রুতই শক্ত হয় কিন্তু শক্ত তো
পারদও হয় , আবার সামান্য টোকাতেই ভেঙে ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে।
ভালোবাস তাহলে পারদের মত হয়তো। রুহিকে ফেরাতে খুব বেগ পেতে হয়নি কারণ ওর ভালোবাসার
পারদ বেশ জমেছিলো। সামান্য টোকাতেই তাই অনেক টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে।’
বুঝতেই পারছেন। ওমন ভালোবাসার নারীটিকে কেউ খুব বেশি নির্বোধ না হলে
ওভাবে তাড়ায়। তাড়ায় না। আমি নির্বোধ না। সেদিনের ওকে রাগানোর খেলাটা পুরোটাই আমার
সাজনো। ও খালি খেলে গেছে অজান্তে। আমার হৃদয় ভেযে টুকরো টুকরো হয়ে ভূতের সে ভয়ের
থেকেও বেশি যাতনা দিচ্ছিলো। ইনফেক্ট ভূত বা অন্ধকারের যে ভয় সেটাতো
ইলেকট্রোমেগনিটিক পর্দাটা কাঁপিয়ে দিয়ে আবার থেমে যায়। আর রুহি হারানোর বেদনাটা, কম্পনটা অবিরত
হৃদস্পন্দনের মত। সে বোঝাবার নয়।
পরপর দু সপ্তাহ পেরিয়ে গিয়েছিলো। ভার্সিটিতে রাস্তার ওপাশ দিয়ে দুদিন
ওকে হেঁটে যেতে দেখেছি। আমি বেশ ভালো আড়চোখে তাকাতে পারি। ও পারে না। আমি জানি। ও
পারেও নি। ধরা পড়ে গিয়েছে আমার কাছে। সে কারণেই আবার ভয় হচ্ছিলো, চরম আবেগে না
আবার কাছে চলে আসে। সঙ্গত কারণে আমি এড়িয়েছি। ওর টাইমন টেবিল সব আমার মুখস্ত। আমি
সে হিসেবে গিয়েছি এসেছি। তারপরও ওর ফোন এল। একবার
দুবার এভাবে মোট ১৩ বার। আমি সবগুলো কেটে দিয়েছি।
আসলে কষ্ট ভীষণ পাথরের মত শক্ত। জাগতিক সকল কাজ হলো তরলের মত। সে তরলে
পাথর সম কষ্ট ডুবে যেতে বাধ্য। অপেক্ষায় উপর তাই কোন সমাধান নেই। কিন্তু নারীর মনে
শক্ত পাথরও মাঝে মাঝে ভাসে। সে কোন থিউরী মানে না। জানি।
কিন্তু কি উপায়। জন্মদাতা মা তার আজন্মের কোন সখীকে কথা দিয়েছে তার
মেয়ে সাথে আমার বিয়ে। সে কথা আজকের না। সে আরও ১৪ বছর আগে। তখন আমার বয়স আর কতই বা
ছিলো। বড়জোর দশ বা এগারো। ঠিক বাংলা সিনেমার পুরনো আমলের কাহিনীর মত। কিন্তু
মাতৃভক্তি, মায়ের প্রেসটিস , মায়ের দেয়া কথা এবং মায়ের প্রতি
বাবার অগাধ প্রেম আমাকে সেদিন যখন বিয়ের কথা শোনালো আমার আকাশটা মাথায় পড়েছিলো,
কিন্তু আমি এক রাতের নির্ঘুম প্রহর গুলো পার করে সকালে মা’কে হাসি মুখে কবে বিয়ে করতে হবে জানিও বলেছিলাম।
মা বললেন,
সেকি? বিয়ে তো তোদের হয়ে গেছে সেই বাল্যকালেই।
আমি বললাম মা,
চুপ কাউকে বলো না। এ যুগে এ বড় অন্যায়। পাছে না আইন আদালত শুনে
ফেলে। হলে হয়েছে। আমি নতুন করে আবার জনসম্মুখে বিয়ে পড়ে নেবো।
মা বললেন,
মেয়েটাকে দেখ। লক্ষ্মীটা কিন্তু বেশ সুন্দর হয়েছে।
মনে মনে বললাম,
এ মা নাম লক্ষ্মী! হলে হবে। দেখে আর কি করবো। দেখাদেখি তো পছন্দ
অপছন্দের নিমিত্ত। আমার তো আর সে জো রইলো না।
রুহির জন্যে সাথে সাথে কষ্টটা এসে প্রাণে লেগেছিলে। কিন্তু কেনো যেন
মনকে মন বলে উঠলো, যা ভালোই হলো আমার মতো এলোমেলো মস্তিস্কের সাথে মিলতে হলো না মেয়েটার। হোক,
ওর একটা সত্যিকারের ভালো বিয়ে হোক।
(৩)
বিয়ের দিন তারিখ পাকা হয়ে গেছে। এর মধ্যে মা আবারও দেখা করার কথা
বলেছিলেন। একবার ওদের বাসায় গেলে হতো না এমন কথাও বলতে যাচ্ছিলেন...আমি থামিয়ে
দিয়ে বললাম তোমার পছন্দ তাও সেই কবে থেকে...মায়ের উপর একটু অন্ধবিশ্বাস নাহয়
থাকলোই। আর একটা দারুণ কবিতা লিখেছি মা হবু বউয়ের জন্য। দেখলে ও কবিতা আর আমি ওকে
শোনাতে পারবো না। আমার এক কথা বাসর ঘরেই প্রথম দেখবো। তা একটা কথা মা, মেয়েটা আমাকে
দেখেছে তো।
তা আবার দেখেনি। এ যুগের মেয়ে গো। আমি আর ওর মা তো ভয়েই ছিলাম। তবে ওর
মার কাছ থেকে তোর নাড়ি নক্ষত্র নিয়ে তোকে দেখে শুনে সেও বেজায় খুশি। ও লক্ষ্মীটা
কিন্তু তোদের উইনিভার্সিটিতে পড়ে।
বোটানিতে। একবার গোপনে গিয়ে দেখে আসতে পারিস। গিয়ে ওর নাম বলবি রেহনুমা
সাবাব। সাবাব ও বাবার নাম।
বোটানি! ওদিকে গেলে নির্ঘাত রুহির সাথ দেখা হয়ে যাবে। মনে মনে সে কথা
আর মাকে একগাল হাসি দিয়ে ‘না থাক’ বললাম। মনে মনে আরও বললাম ইস্ রেহনুমা তো
বেশ নাম তা ডাক নামটা ওমন লক্ষ্মী কেনো?
বিয়ের দুদিন আগে রুহির কল এল। আমি যথারীতি ধরলাম না। তারপর এল একটা
এসএমএস। রুহি লিখেছে,
‘ শুনলাম বিয়ে করছো। তা ভালোবাসতে পারবে তো? ও
জিনিস নাকি নেই বাস্তবে! আফসোস তোমাকে ভূত আর ভালোবাসা দেখাতে পারলাম না। আমি এখন
শক্ত হয়েছি। তোমার বিয়ে খেতে এলেও আমার আর কষ্ট হবে না। সুখি হও।’
ইস্ । বিয়ে খাবে। আমার বুঝি কষ্ট হবে না।
পরিশিষ্ট
বিয়ে শেষ। কেবলমাত্র গোলাপ দিয়ে
সাজানো সুন্দর গাড়ীতে পাশাপাশি বসে নববধূকে নিয়ে বাড়িতে এসে গেছি। রাত তখন প্রথম
প্রহরের কাছাকাছি। বধূ আগেই বাসর ঘরে ঠাঁই পেয়েছে। চিরায়ত নিয়মে এক ভাবী হাত টেনে
সেই ঘরে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে ছিটকানি লাগিয়ে দিয়ে গেছে। আমি ভাবছি ভেতর
থেকে ছিটকানি দিয়ে কি হবে। আমার প্রথম কথাই তো হবে।-দেখো আমি অন্য একজনকে
ভালোবাসতাম । যতদিন তাকে ভুলতে না পারছি আমি তোমাকে মিথ্যে ভালোবাসায় স্পর্শ করতে
পারবো না।
তবুও ছিটকানি দিলাম। পাশে বাইরের ভাবী গোত্রীয় কেউ ঢুকে না পড়ে অতি
উৎসাহে। তারপর খাটের কিনারে এগিয়ে গেলাম। গাড়ীতে যেমন লম্বা একটা ঘোমটা টেনে ছিলো।
এখনও তেমনি রয়েছে। সে কাঁদছে না হাসছে বুঝতে পারছি না। কাঁদবে কেনো। সে তো আমাকে
দেখেশুনেই বিয়ে করেছে। কপাল পুড়েছে তো আমার।
তার সামনা-সামনি বসলাম। বললাম, দেখো আমি এখনও তোমাকে দেখিনি। তোমার কি
একটুও অবাক লাগছে না? লাগাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখো আমি আসলে
জানতাম না তোমার আমার মা এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে রেখেছেন। আমাদের নাকি বিয়েও
হয়েছিলো। দেখো কত কান্ড। কিন্তু অজান্তে আমি তো অন্য একজনকে সত্যি সত্যি ভালোবেসে
ফেলেছিলাম। নাম বলবো না। সেও তোমাদের বোটানির ছাত্রী। সে যাক যতদিন তাকে মন থেকে
পুরো মুছতে না পারছি এবং তোমাকে ভালোবাসার মর্যাদা দিতে না পারছি ততদিন তোমাকে আমি
ছুঁতে যাবো না...
হঠাৎ ঘোমটাটা খুলে গেলো, মেয়েটা
এক লাফে আমার মুখের সামনে তার মুখটা এগিয়ে এনে আমার ডান হাতটা তার ডান হাত দিয়ে
টেনে তার বাম গালে স্পর্শ করিয়ে বললো, কেনো ছোঁবে না কেনো?
বিয়ের আগে তো খুব ছুঁতে এখন ছুঁতে পারবে না কেনো বলো দেখি?
একি! রুহি তুমি ? আমি কি ভূত দেখছি?
রুহি তার সেই ভুবন ভুলানো হাসিটা ছড়িয়ে বললো, ভাগ্যিস আমার
পুরো নাম তুমি জানতে না, জানলে কি একসাথে ভূত এবং ভালোবাসা
দুটোই তোমাকে দেখিয়ে দিতে পারতাম।
No comments:
Post a Comment