কোথায় কি!

17 December 2017

ইজিবাইক- সাব্বির জাদিদ



ছুটিপুরের নিস্তরঙ্গ জীবনে ইজিবাইকের যুক্ত হওয়া খুব বেশি পুরনো ঘটনা নয়। আমরা তখন কিশোর৷ এইট পাশ করে নাইনে উঠিছে। পড়াশোনার বালাই নেই। সারাদিন ফুটবল খেলে বেড়াই। খেলার ফাঁক-ফোঁকরে কখনো যদি সুযোগ জোটে, পড়ি। না জুটলে পড়ি না। সে সময়কার গ্রামে পড়াশোনার তেমন চল নেই। প্রাইভেট-কোচিং আবিষ্কার হয়নি৷ বাবা-মারা সচেতন না। ছেলে রোজ সকালে গরম ভাত খেয়ে রাস্তায় কুলি ফেলতে ফেলতে বোগলে বই নিয়ে স্কুলে যাচ্ছেএই পড়াশোনাই তাদের কাছে অনেক। আমাদের কাছেও। হাতে অঢেল সময়। এতটা সময় তো আর ঘাম ঝরানো ফুটবল খেলে পার করা যায় না৷ সম্ভবও না৷ আমরা আনন্দ খুঁজে বেড়াই৷ যাকে নিয়ে মগ্ন থাকা যায়৷ কিন্তু সেকালের গ্রামের আর দশটা জিনিসের মতো আনন্দেরও বড় অভাব৷ এর ভেতর হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করি, আমাদের একমাত্র খোয়া বিছানো রাস্তায় ইজিবাইক৷ প্যাসেঞ্জার বোঝাই ধুলো উড়িয়ে বাজারের দিকে ছুটছে৷আনন্দে আমরা হই হই করে উঠিএই জিনিস কোনে ছিল এ্যাদ্দিন!

ইজিবাইক কোনদিন দেখিনি আমরা এমন না। টাউনে গেলে দেদারসে দেখা হয়, চড়াও হয় -রোড থেকে -রোডে। কিন্তু এতদিন আমরা ভেবে এসেছি কারেন্টের চার্জে চলা তিন চাকার এই জিনিস বুঝি শুধুই শহরের গাড়ি ৷ শহরেই তাকে দেখতে পাওয়া যায়৷ শহরে গিয়েই তার কোলে চড়তে হয়৷ সেই গাড়ি, শহরের সেই মূল্যবান গাড়ি যদি একদিন দুম করে আমাদের অজপাড়াগাঁয়ে চলে আসে আর প্যাসেঞ্জার বোঝাই করে উঁচুনিচু রাস্তায় হেলেদুলে চলতে থাকে, আমরা কিশোররা তো হইচই করবই। নাকি রব না!
আমাদের ক্লাসবন্ধু আবদুল, হ্যাঁ, আমাদের বন্ধুই সে। যদিও সে আমাদের বছর পাঁচেকের বড়  স্কুলে ভর্তি হয়েছিল দেরিতে৷ থ্রি আর ফাইভে ফেলের আশীর্বাদে দুই দুই চার বছর খরচা করে আমাদের ক্লাসে জুটে গেছেপরদিনই সে ইজিবাইকের আগমনী রহস্য উদঘাটন করে ফেলে৷ এর আগে যেভাবে সে অনেক রহস্যের শিকড় উদঘাটন করেছিল৷ এরপরেও যেভাবে সে অনেক রহস্যের শিকড় উদঘাটন করবেসেভাবেই
 
ইজিবাইকের যে মালিক তার নাম সাবদার। অচিরেই যাকে আমরা ইজিবাইক চাচা সম্বোধনে ডাকব। সেই ডাক শোনার জন্য আপনাদেরকে অবশ্যই আরো কিছুক্ষণ গল্পের সঙ্গে থাকতে হবে। ইজিবাইক চাচা সপরিবারে শহরের রেলের ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকত আর শহরে ইজিবাইক চালাত। সেই ঝুপড়িতে ছিল তার মোটামুটি সুখের সংসার৷ ঘরভাড়া দিতে হতো না বলে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই কাটত দিন। বেশ-টাকা পয়সাও জমিয়েছিল৷কিছুদিন আগে সরকারী দলের এমপি রেলের ধারের সেই জায়গাটা দখলে নিয়েছে মার্কেট তৈরি করবে বলে৷ আর ইজিবাইক চাচা হয়েছে ঘরহীন৷ আমাদের গ্রামে ইজিবাইক চাচার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় আছে। সেই আত্মীয়র এক টুকরো জমি ক্রয় করে ঘর তুলে আমাদের গ্রামের নতুন বাসিন্দা হয়েছে ইজিবাইক চাচা। এখন থেকে সে আমাদের গ্রামে থাকবে। গ্রাম টু বাজার, বাজার টু গ্রাম ভাড়া খাটবে।

আমাদের গ্রামের সকল বাজারি কাজকর্ম সম্পন্ন হয় কমলাপুরে৷ কমলাপুর বেশ বড়সড় বাজার। শাক-সব্জি, গোশ-মাছ, ধানভানা কল থেকে শুরু করে গায়ের জামা, পায়ের জুতা সবই সেখানে পাওয়া যায়। এমনকি আশপাশের একমাত্র অভিজাত সিনেমা হল পান্না টকিজ, সেটাও এই কমলাপুরে ৷ আর তাই আমাদের গ্রামের লোকদের প্রায়ই যেতে হয় কমলাপুর ৷ ছুটিপুর থেকে কমলাপুরের দূরত্ব সাড়ে তিন কিলোমিটার ৷ ভ্যানভাড়া পাঁচটাকা৷ যাদের সাইকেল আছে তারা সাইকেলে যাতায়াত করে ৷ যাদের সাইকেল নেই তারা পাঁচ টাকা খরচ করে ভ্যানে চড়ে৷ ভ্যানওয়ালাদের প্রায় সবাই আমাদের ছুটিপুরেরএই ভ্যানগুলোর সাথে নতুন করে যুক্ত হয় শহর থেকে আসা ইজিবাইক৷ইজিবাইকের আবির্ভাবে দীর্ঘদিন থেকে সার্ভিস দিয়ে আসা পা-চালিত ভ্যানগুলো অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে৷ বাজারগামী  লোকজন ইজিবাইকের জন্য মুখিয়ে থাকে ৷ ইজিবাইক ভ্যানের চেয়ে তিনগুণ (গ্রামের মানুষের অনুমান) জোরে যায়৷ এই জিনিসে যাতায়াত করায় সাহেবি ভাব আছে৷ এর ভ্রমণ আরামদায়ক৷ অথচ ভাড়া সেই পাঁচটাকাই৷ লোকেরা শুধু শুধু এতো সুযোগ থেকে কেন বঞ্ছিত হবে! অতএব, ভ্যান বাদ দিয়ে তারা কেবল ইজিবাইকের পেছনেই ছুটতে থাকে। ফলে ইজিবাইক চাচার পকেট ফুলেফেঁপে উঠতে লাগে আর দরিদ্র ভ্যানওয়ালারা শুকিয়ে মরতে থাকে। অবশেষে বাধ্য হয়ে ভ্যানওয়ালারা মাতবরদের কাছে যায় ৷ ইজিবাইক তাদের কী সর্বনাশ করছে তুলে ধরে৷ মাতবররা গা করে না৷ কারণ, মাতবরদের ফিফটি মোটরসাইকেল আছে৷ তাদের ভ্যানেও চড়তে হয় না ৷ ইজিবাইকেও চড়তে হয় না৷ এই মামলার সাথে তাদের কোন যোগ নাই ৷ অতএব তাদের কিছু করারও নাই ৷ ভ্যানওয়ালারা মন খারাপ করে ফিরে আসে যে যার বাড়ি৷ আফসোস করে বলাবলি করতে থাকে গরিব মানষির কতা কেও শোনে না৷

কয়দিন পর ভয়াবহ ঝড় হয় ছুটিপুরে৷ আশপাশের গ্রামগুলোতেও হয় ৷ কয়েক জায়গায় কারেন্টের পোল ভেঙে পড়ে ৷ গাছ ভেঙে তার ছিড়ে যায়৷ ছুটিপুরে পাঁচদিন কারেন্ট থাকে না ৷ কারেন্ট থাকে না বলে ইজিবাইক চাচার ইজিবাইকও অচল পড়ে থাকে উঠানে৷ তখন ভ্যানের কদর বেড়ে যায় ৷ কিন্তু ভ্যানওয়ালারা বড় অভিমানী৷ তারা স্ট্রাইক করে বসে ৷ ইজিবাইক সমস্যার সমাধান না হলে ভ্যান নামাবে না রাস্তায় ৷ বাজারগামী লোকজন বিপদে পড়ে ৷ মরতে মরতে এই দুর্দিনে ফজল মাতবরের শ্বশুরবাড়ির মহিলা-আত্মীয় বেড়াতে আসে ছুটিপুরে৷ এসে তারা আর ফিরতে পারে না বাহনের অভাবে ৷ তখন এই সমস্যার সমাধান করতে ফজল মাতবরকে এগিয়ে আসতে হয়৷ ফজল মাতবর আরো দুই মাতবরকে নিয়ে ভ্যানওয়ালাদের সাথে বসে ৷ ইজিবাইক চাচাও সেখানে থাকে৷ আমরা না থাকলেও আমাদের বন্ধু আবদুল সেখানে থাকে৷ সে সবখানেই থাকে ৷ মজলিসে সিদ্ধান্ত হয় সাবদার অর্থাৎ আমাদের ইজিবাইক চাচা ছুটিপুর টু কমলাপুর ভাড়া মারতে পারবে না৷ভাড়া খাটতে তাকে প্রতিদিন ভোরে চলে যেতে হবে বারো মাইল দূরের থানা শহরে৷ সেখানে অনেক ইজিবাইক আছে ৷ তাদের সাথে ভাড়া খাটবে৷ ফিরবে সন্ধ্যায়৷ অবশ্য যাওয়া এবং আসার পথে ছুটিপুরের
লোকদের আনা-নেয়া করা যাবে ৷ ভ্যানওয়ালাদের পেটের দিকে তাকিয়ে ইজিবাইক চাচাকে এই কষ্টটুকু স্বীকার করতেই হবে৷ মজলিসের সিদ্ধান্তে আমাদের মন খারাপ হয়৷ মন খারাপ হয়, কারণ, গত কয়েক মাস ধরে আমাদের রঙচঙহীন ছোট্ট গ্রামটার জৌলুস খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছিল ওই ইজিবাইক ৷
আমরা ইজিবাইক চাচাকে পথের ভেতর ধরিইজিবাইক চাচা, আপনের কি মন খারাপ?
আমরা মনে করেছিলাম, ইজিবাইক চাচার খুব মন খারাপ৷ শত হোক রিজিকের উপর হামলা ৷ অথচ আমাদের ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে ইজিবাইক চাচা হো হো করে হেসে ওঠে৷ হাসতে হাসতে বলে মন ক্যান খারাপ হবি! মাতব্বাররা তো আমার ভালো করেছে ৷
ভালো করেছে! আমরা বিস্মিত হই ৷
হ ৷ গিরামের রোড ভালো না ৷ গাড়ি খালি ঝাকি খায়৷ আমার কলজের মুদি কাঁপে ৷ থানার রোড শানের মতো ৷ ভাড়াও ম্যালা৷ গিরামে পড়ে থাকপ ক্যা!
ইজিবাইক চাচার এই খুশিতে আমরা হতাশ হই ৷ হতাশ হই আর ভেতরে ভেতরে গজরাই-- সব শালা স্বার্থের গুলাম! গাড়িখেন গিরামে চললি কত ভালো হতো! হতাশার ভেতর দিয়ে দিন কেটে যায় আমাদের৷ আমরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠিআমাদের কারো কারো ঘুমের ভেতর মেয়ে মানুষ হানা দেয় ৷ সেই খারাপ স্বপ্নের কথা বলাবলিও করি নিষিদ্ধ আনন্দে ৷ এর মাঝে হঠাৎ একদিন খুবই চটকদার এক খবর নিয়ে হাজির হয় আবদুল৷ কী সেই চটকদার খবর? ইজিবাইক চাচার এক যুবতী মেয়ে আছে ৷ রোমানা৷ এই রোমানা নাকি এক নটি ৷ সবাইরে দিয়ে বেড়ায়৷ উত্তেজনায় আমরা আবদুলকে ছাই দিয়ে ধরি-- সবাইরে?
হুম, সবাইরে ৷
ফস করে বলে ফেলি আমিরুমানাও তাহলি এক ইজিবাইক ৷ সবাই তার উপর চড়ে৷ বলেই আমি লজ্জায় পড়ে যাই৷ বন্ধুরা হো হো করে হেসে ওঠে-- চরম কইছিস দোস্ত!
চর্মচক্ষে রোমানাকে দেখার জন্য আমরা ব্যাকুল হয়ে উঠি ৷ ইজিবাইক চাচার বাড়ির পেছনে ঘুরঘুর করি ৷ খুব সহজেই তার দেখা মিলে যায়৷ তাদের বাড়ির পেছনে হাতের তালুর মতো এক টুকরো জমিতে লালশাকের চাষ৷পরদিন বিকেলে দেখি রুমানা কোমর বাঁকা করে শাকে পানি দিচ্ছে ৷ লাল রঙের সালোয়ার কামিজ পরা। ঠোঁটে পুরু লিপিস্টিক। কাজের ফাঁকে গোপনে সে একবার আমাদের দিকে তাকায় বলে মনে হয়৷ আবদুল ছাড়া আমরা সবাই বয়সে তার ছোট৷ আর সেজন্যই বোধহয় আমাদের পছন্দ হয় না তার৷ একটু তাকিয়ে আবার সে কাজে মনোযোগ দেয় পেছন ঘুরে৷ আবদুল ফিসফিস করে বলে দেখছিস, মাগির কোমর দেখছিস!
রোমানা যেহেতু বয়সে আমদের বড়, তাকে নাম ধরে সম্বোধন করা যায় না ৷ এমন শিক্ষা বাবা-মা আমাদের দেয়নি৷ তাই আবডালে তাকে আমরা ইজিবাইক আপা বলে ডাকতে থাকি৷ কেননা তার বাবাকে আমরা ইজিবাইক চাচা ডাকি এবং রোমানা নিজেও একটা ইজিবাইক৷ অতএব সে ইজিবাইক আপা ৷

মাসখানেক পর আবদুল আমাদের কাছে টাকা ধার চায়৷ তার ত্রিশ টাকার খুব দরকার৷ বন্ধুরা সবাই মিলে যেন ত্রিশ টাকার ব্যবস্থা করে দিই ৷ প্রথমে আমরা টাকা দিতে অস্বীকার করি৷ কারণ, আমাদের হাতে টাকা থাকে না৷ স্কুলে যাওয়ার আগে টাকার বায়না ধরলে মায়েরা আঁচল খুলে আমাদের হাতে দুই টাকার নোট গুঁজে দেয় এবং সেই টাকা দিয়ে আমরা মশলা মাখানো আমড়া কিনে খাই ৷ আমরা তখনো দুই টাকার পাবলিক৷ ত্রিশ টাকা কোথায় পাব! আবদুল তবু ছাড়ে না৷ সে কাঁঠালের আঠার মতো লেগে থাকে আমাদের পেছনে৷ বলে, আচ্ছা যা, ত্রিশ দিয়া লাগবিনেন, বিশ দে৷ দশ টাকা আমি নিজিই বেবস্থা করবনে ৷
আমরা এবার বলি, আচ্ছা তো, এতো টাকা তুই কী করবি আবদুল?
আবদুল জানায়তার ইজিবাইকি চড়ার শখ হইছে৷
ভালো কতা৷ ইজিবাইকির ভাড়া তো পাঁচ টাকা, ত্রিশ টাকা কী হবি!
আবদুল নববধূর লজ্জার হাসি হাসে এই ইজিবাইক সেই ইজিবাইক না ৷ এইডা হইল ইজিবাইক আপা৷ মানে রুমানা ৷
আমরা এবার সত্যি সত্যি বাজপড়া তালগাছ হয়ে যাই কয় কী ছ্যামড়া!
, ঠিকই কই ৷ তুরা আমার পিয়ারের দোস্ত তুরা আমার এই শকখেন পূরণের বেবস্থা করে দে!
হামিদুল বলে, কিন্তু ত্রিশ টাকা কী জন্নি লাগবি?
ত্রিশ টাকা রোমানার ইজিবাইকির ভাড়া ৷ ভাড়া ছাড়া তার গাড়িতি উটা যায় না ৷ একবের উটলি ত্রিশ টাকা ৷
হামিদুল বলে, তার বাপ নেয় মাথাপতি পাঁচ টাকা ৷ সে ত্রিশ টাকা
নিবি ক্যান?
আমি বলি, ইজিবাইক চাচা এক সাতে ম্যালা মানষির গাড়িতি তোলে সেই জন্নি কম ভাড়ায় পুষায়ে যায় ৷ কিন্তু ইজিবাইক আপা একসাথে ম্যালা মানষির তুলতি পারে না সেই জন্নি মনে হয় বেশি ভাড়া রাখে ৷
আবদুল আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে ঠিক ধরছিস ৷ এই জন্নিই তুই ফাস্ট হইস পরীক্ষায় ৷ এইবার আমার টাকাডা...

আমরা কতক্ষণ গালে হাত দিয়ে বসে থাকি ৷ আমাদের গালে হাত দিয়ে বসে থাকা দেখে অচেনা কেউ ভাবতে পারেআমরা বোধহয় জীবন-মরণ কোন সমস্যায় নিপতিত ৷ কিন্তু আমরা জানি, এই সমস্যা আবদুলের জীবনমরণ সমস্যা না৷ এটা তার শখ কিংবা নারী মাংসের লোভ ৷ ভাবতে ভাবতে আবদুলের লোভ ধীরে ধীরে আমাদের ভেতরেও সংক্রমিত হয় ৷ আমাদেরও ইচ্ছে করে ইজিবাইকে চড়তে ৷ তবে আমরা বুঝতে পারি, আবদুল পারলেও আমরা পারব না আমাদের সে বয়স হয়নি৷ অবশ্য আবদুলকে টাকা দিয়ে সাহায্য করে এই কাজের স্বাদ আমরাও পরোক্ষভাবে নিতে পারি৷ আর তাই আমরা বন্ধুরা বিশ টাকা যোগাড়ের মিশনে নেমে পড়ি এবং খুব শীঘ্রই সফল হই ৷


মুসল্লিরা অর্ধেক সন্তুষ্টি অর্ধেক অসন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে আসে যে যার বাড়ি। কিন্তু রোমানার নষ্টামি থামে না৷ দু-দিন পরপরই নতুন নতুন নষ্ট-কাহিনী আমাদের আড্ডাকে রোশনাই করে তোলে৷ আবদুল আমাদের আড্ডায় আর যোগ দেয় না৷ পথে-ঘাটে দেখা হলে আর ইজিবাইক আপার কথা জিজ্ঞেস করলে সে বালকের নামতা পড়ার মতো মুখস্থ গালি দিতে থাকে রোমানাকে”

ইজিবাইকে চড়ার রাতে বিকেল থেকে আবদুল ক্রমাগত ঘামতে থাকে ৷ কারণ, ইজিবাইকে চড়ার পূর্ব-অভিজ্ঞতা তার নাই ৷ আর অভিজ্ঞতা ছাড়া যে কোন কাজে নামার আগে মানুষ একটু আধটু নার্ভাস হয়৷ তবু আমরা ঠাট্টা করতে ছাড়ি না শালা এখুনি এ্যাম্মা ঘামলি আসল কামের সুমায় কী করবি হে!
আবদুল রেগে গিয়ে আমার হাতে টাকা ছুড়ে দিয়ে বলে তুই যা, দেখি তোর কতবড় কলিজা!
ওই টাকায় যেন বিদ্যুৎ মাখানো৷ আমার হাত স্পর্শ করার সাথে সাথে কেমন ঝনঝনিয়ে ওঠে ৷ আমি তাড়াতাড়ি টাকাটা আবদুলের হাতে গুঁজে দিয়ে বাঁচি আর বলি আমার অতো শক নি৷ তুই যা গা!
কাজ হবে সন্ধ্যা একটু গাঢ় হলে হারু চাচার পানের বোরজে৷ আবদুল ইজিবাইক আপার ঘরের পেছনে গিয়ে দুইবার হাততালি দেবে ৷ আপা বেরিয়ে আসবে ৷ তারপর আগে আগে আবদুল ঢুকে যাবে পানের বোরজে ৷ পেছন পেছন ইজিবাইক আপা ৷
আবদুল তো কাঁপেই, সন্ধ্যা নামলে আমরাও কাঁপতে থাকি উত্তেজনায়৷ আমরা যেহেতু টাকা দিয়ে সাহায্য করছি তাই আমাদের কিছু দাবিদাওয়া আছে৷ আবদুল বল, কী দাবিদাওয়া?
আমরা বলি, হারু চাচার পানের বোরজের সাথে যে বাঁশঝাড়, কামের সুমায় আমরা সেখেনে থাকপ ৷
আবদুল বলে, থাকতি পারিস, কিন্তু কুনু সাউন্ড করা চলবিনে ৷ ধরা খালি সবার একসাতে মরা লাগবি৷ তাছাড়া রুমানা টের পালি মাইন্ড করবি ৷ ওর মাইন্ড আবার খুব বেশি ৷
আমরা বলি, আচ্ছা৷ আমরা কুনু সাউন্ড করব না ৷
সন্ধ্যার পরপরই আমরা শিকারীর মতো ওঁৎ  পেতে বসে থাকি বাঁশবনে৷ শুরু সন্ধ্যাতেই  বাঁশঝাড়ের তলে অন্ধকার ঘনিয়ে আসে ৷ আমরা বারবার চোখ রগড়ে পানের বোরজের দিকে তাকাই ৷ আমাদের শিকার আবদুল আর ইজিবাইক আপা যেন চোখ ফসকে না যায় কোনভাবে৷ মশার কামড় খেতে খেতে আমরা অপেক্ষা করি ৷ পাছার উপর হুল ফুটিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা দেয়া মশাটাকে এক থাপ্পড়ে চ্যাপটা করতে যাব, তখনই দেখি আবদুল, পানের বোরজের উত্তরের বেড়া ফাঁক করে ঢুকে গেল ৷ আর তার পেছন পেছন ওড়নায় ঘোমটা টানা রোমানা, আমাদের ইজিবাইক আপা৷ আমরা পরস্পরের মুখের উপর হাত চাপা দিই এই চুপ চুপ!
আমাদের নীরবতায় মশার ডাক যেন স্বশব্দে আছাড় খেতে থাকে ৷ আমরা মশার উপর বিরক্ত হই ৷ কারণ, নিষিদ্ধ আওয়াজ শোনার আশায় আমরা বোরজের দিকে কান তাক করে আছি। অথচ মশার প্যানপ্যানানি সব ভণ্ডুল করে দিচ্ছে ৷
ফয়সাল গলায় কৃত্রিম চিন্তা ফুটিয়ে বলে, আমি হারু চাচার বোরজের চিন্তা করছি রে হামিদুল! আবদুলির পয়জনে পানগাছ মরে না যায়!
ফয়সালের কথায় আমরা না হেসে পারি না আমাদের হাসি থামার আগে বোরজের ভেতর থেকে কেমন আওয়াজ ওঠে৷ আমরা আবারও চুপ চুপ বলে কান খাড়া করি ৷ কান খাড়া করার সাথে সাথে আওয়াজও কোথায় যেন মিলিয়ে যায় ৷
ভেবেছিলাম ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করতে হবে ৷ ওমা! দশ মিনটি যেতে না যেতেই দেখি ইজিবাইক আপা, খুব দ্রুত অথচ পায়ে কোন শব্দ না তুলেই বোরজ থেকে বেরিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বাড়ির দিকে ৷ বুঝি, এই নিঃশব্দ হাঁটার ক্ষমতা একদিনে হয়নি । দিনে দিনে হয়েছে । আমরা হা করে তাকিয়ে থাকি আবছা অন্ধকারে নড়তে থাকা তার পেছনের দিকে ৷ ইজিবাইক আপা আমাদের দৃষ্টি থেকে মিলিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমাদের হুশ হয় ৷ ত্রিশ টাকার শোকে আমরা হায় হায় করে উঠি৷ এতো অল্প সময়ে ত্রিশ টাকার মেয়াদ শেষ হয়ে গেল! অথচ টাকাটা যোগাড় করতে বাড়িতে কত বড় বড় মিথ্যা কথা বলতে হয়েছে আমাদের!
একটু পর হাতির মতো হেলেদুলে বের হয়ে আসে আমাদের হিরো আবদুলউইকেট পাওয়ার পর বোলারকে যেমন ঘিরে ধরে বাকি খেলোয়াড়, উল্লসিত আমরাও সেভাবে ঘিরে ধরি আবদুলকে ৷ যেন সে মাত্রই মস্তবড় উইকেট ফেলে এসেছে ৷ আমরা কাছাকাছি হতেই আবদুল টান মেরে গায়ের গেঞ্জি খুলে ফেলে৷ পাখা বানিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাতাস খেতে থাকে৷ ঘামে ওর গা চপচপ৷
হামিদুল বলে, এত জলদি হয়ে গ্যাল!
আমি বলি, ক্যাম্মা লাগল রে!
ফয়সাল বলে, ফুল তিরিশ টাকাই নিলো? কম টম কিছু করল না!
আবদুল আমাদের কারোর কোন প্রশ্নের জবাব দেয় না। বাতাস খেতে খেতে সে বরং পাশ কাটায় আইজ খুপ গরম রে।
সেই যে আবদুল আমাদের পাশ কাটায় তারপর থেকে সে পাশ কাটাতেই থাকে ৷ আমরা তাকে ধরি, ছাই দিয়ে ধরি, জিগের আঠা দিয়ে ধরি, সে হাত ফসকে বেরিয়ে যায় ৷ শেষমেশ আমাদের সন্দেহ হয় সেই রাত্তিরি আবদুল আসলেই কি কিছু কত্তি পারিসলো!
দিন যায় ৷ গ্রামের মানুষের আলোচনায় ইজিবাইক আপা ক্রমেই পাখা বিস্তার  করে৷ শুধু আমাদের আড্ডায় না, সবখানেই তার নামরোমানা৷ নামের সাথে বিশেষণ হিসেবে যুক্ত থাকে মাগি অথবা খানকি অথবা অন্যকিছু ৷ যার যা বলার রুচি ৷ আমরা যেমন বলি ইজিবাইক ৷
অচিরেই ছুটিপুরের ধার্মিক মানুষেরা রোমানা ইস্যুতে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে৷ রমজান হাজির নেতৃত্বে নামাজিদের একটা দল মাতবরদের সাথে বৈঠকে বসে ৷ তারা প্রস্তাব রাখে রোমানার বাপের ইজিবাইক যেভাবে গ্রাম থেকে বের করে দেয়া হয়েছে, সেইভাবে এই নষ্ট মেয়েটাকেও গ্রামছাড়া করা হোক৷ নয়তো চ্যাংড়া পোলাপানের ধ্বংস অনিবার্য ৷
চ্যাংড়া পোলাপানের ধ্বংস যে অনিবার্য সেই ব্যাপারে একমত হয় মাতবররাও ৷ তবে রোমানাকে গ্রামছাড়া করতে তারা রাজি নয় ৷ কারণ, মেয়ে মানুষ আর ইজিবাইক এক নয় ৷ ইজিবাইক গ্রামছাড়া করা গেলেও মেয়ে মানুষকে গ্রামছাড়া করা যায় না৷ কাজটা অমানবিক এবং ঝুঁকিপূর্ণ ৷ তবে তারা মুসল্লিদের আশ্বস্ত করে রোমানার বাপকে কঠিনভাবে সতর্ক করা হবে, তার মেয়ে যেন গ্রামের ভেতর নষ্টামি না করে ৷
মুসল্লিরা  অর্ধেক সন্তুষ্টি অর্ধেক অসন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে আসে যে যার বাড়ি ৷ কিন্তু রোমানার নষ্টামি থামে না ৷ দু'দিন পরপরই নতুন নতুন নষ্ট-কাহিনী আমাদের আড্ডাকে রোশনাই করে তোলে ৷ আবদুল আমাদের আড্ডায় আর যোগ দেয় না ৷ পথেঘাটে দেখা হলে আর ইজিবাইক আপার কথা জিজ্ঞেস করলে সে বালকের নামতা পড়ার মতো মুখস্থ গালি দিতে থাকে রোমানাকে ৷ আমরা তাড়াতাড়ি কানে আঙুল দিয়ে সেই গালি থেকে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করি ৷ স্পষ্টতই আবদুলের সাথে আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরে ৷ তবু যখন দেখি মাতবরদের হুশিয়ারি সত্ত্বেও ইজিবাইক আপা তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে, আমরা বিস্মিত হই ৷ কারণ, গ্রামাঞ্চলে মাতবররাই মানুষের প্রভু ৷ বিশেষ করে দুর্বল মানুষের উপর তাদের খবরদারি দিনের বেলা সূর্য ওঠার মতোই পরিষ্কার৷ তবু কোন সে খুঁটির জোরে ইজিবাইক আপা তার কাজে অবিচল থাকে! আমাদের তখন আবদুলের কাছেই ফিরে যেতে হয়৷ এর আগে প্রতিটা গোপন বিষয় জানতে যেভাবে তার কাছে ফিরে যেতে হয়েছিল ৷ আবদুল প্রথমে বলতেই চায় না৷ ইজিবাইক আপার প্রসঙ্গ তুলতেই সে গালাগালির বিষে বাতাস দূষিত করে ফেলে ৷ অনেক অনুনয় বিনয়ের পর সে মুখ খোলে৷ সে যা জানায় তা এমন এবং তা আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়, রোমানার বড় খদ্দের হল এই মাতবররা ৷ এর আগে রোমানার বাপের ইজিবাইক মাতবররা নিষিদ্ধ করেছিল, কারণ, মাতবরদের মোটরসাইকেল আছে৷ রোমানার বাপের ইজিবাইকে চড়ে বাজারে যাওয়ার কোন গরজ তাদের নেই৷ কিন্তু রোমানা এমন এক ইজিবাইক, তাতে না চড়লে মাতবরদের রাতের ঘুম ম্যাড়ম্যাড়া হয়ে যায়৷ তাই নিজেদের প্রয়োজনেই রোমানাকে জল-হাওয়া-খাবার দিয়ে পরিচর্যা রে যাচ্ছে মাতবররা ৷ যতদিন না আরেকটা রোমানা তৈরি হয় ততদিন এই পরিচর্যা চলতেই থাকবে।

আবদুলের বড়দের মতো কথায় আমরা কতক্ষণ হতভম্ব হয়ে বসে থাকি। এবং এটা বুঝতে পারি, হারু চাচার বোরজের সেই আধো রাত আধো সন্ধ্যার ঘটনার পর থেকেই আবদুল কেমন বদলে গেছে ৷ কেমন অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে গেছে৷ ওকে আর আমাদের বন্ধু বলে মনে হয় না এখন। হতভম্ভভাব কাটলে সুযোগ বুঝে আবার আমরা সেই পুরনো প্রসঙ্গ তুলিরুমানারে সেই রাত্তিরি কিছু কত্তি পারিসলি, আবদুল?
আমাদের প্রশ্নে আবদুল তার ভাণ্ডারে সঞ্চিত গালাগালির বস্তার মুখ খুলে দেয়৷ আজ আর আমরা কানে আঙুল দিই না ৷