বুকের উত্তাপে রেখে দেওয়া সুখ-দুঃখের ফর্দখানা
উল্টেপাল্টে দেখে নিয়ে ওরা প্রত্যেকে এক একটা নতুন গল্প বলবে বলে ঠিক করে। তারা, মানিক,
মিতু, সবুজ আর তিতির। ওদের বয়স বাইশ-তেইশ বা এর চেয়ে মাস দু’য়েক কম বেশি। এই বয়সে গল্প
বা কল্পগল্প বলতে কাউকে ঠেলাঠেলি করতে হয় না। বরং কথার তোড় বন্ধ করতে মিনতি করা লাগে।
তবে হার্ড পয়েন্টের আজকের পরিবেশটাই অদ্ভুত। মায়াময়। এই মায়ার বিভ্রমে পড়লে কথা ফুরিয়ে
যায়। খুব জরুরি কথাগুলোও তখন বলা যায় না।
মানিকের
দেরি দেখে মিতু ওর গায়ে ধাক্কা দেয়,
-কীরে
কথা বলছিস না যে? তুই বিষয়টা প্রস্তাব করলি, তুই’ই প্রথম শুরু কর।
মানিক
ওদের ক্লাসের একজন ধন্যি ছেলে। পড়ালেখার পাশাপাশি হলের সেরা বিতার্কিক সে। কোথাও বলার
সুযোগ পেলে ও ঠিক লুফে নেয়। কায়দা করে কথা বলার ভঙ্গির জন্য বন্ধুরা ওকে নিয়ে মজাও
করে খুব। মানিকের গলা কণ্ঠশীলনের তৈরি। মিতুর তাগিদ পেয়ে ঠিক কবিতা পাঠের মতো মানিক
বলতে শুরু করে,
-আমার
জীবনে তনিমা নামের একটা মেয়ে এসেছিল। কাউকে কখনো বলিনি ওর কথা। একবার মুগ্ধ চোখে ওকে
দেখতেই আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। একদিন টের পেলাম ও ছাড়া আমার কিছুই নেই, কেউ নেই।
তারপর হঠাৎ কী হলো! ও যেমন আচমকা এসেছিল তেমনই আচমকা চলে গেল।
সবুজ
মানিকের পিঠে সজোড়ে থাপ্পড় মারে,
-শালা
ভাব দেহাও? সোজা ভাষায় কথা ক শালা, পিরিতে মজছিলি, মাইয়াডা তোমারে ছ্যাঁকা দিয়া গ্যাছে।
খিকজ। এইসব ভাব মারানি গালগপ্পে আমি নাই। আসল ঘটনা বল। ওই মাইয়ারে নিয়া কই কই গেছিলি,
কী কী করছিলি।
বলতে
বলতে সবুজ হাসে। মানিকের জলে ভেজা মুখটা আবছা অন্ধকারে কেউ দেখতে পায় না। হয়তো এটা
ওর জন্য ভালোই হয়। মানিক ভেজা বাতাসের আর্দ্রতায় বুঁদ হয়ে নিরুত্তর বসে থাকে। এবার
সবুজ হাসি থামিয়ে ক্ষেপে ওঠে।
-আমি
ঠিক জানতাম তোরা এমনই সব ল্যাদল্যাদা কাহিনী শুরু করবি। আমি শালা এই সবে নাই। আমি গেলাম।
তোরা গপ্পো কর।
সবুজ
এমনই। একরোখা, জেদি। কথায় কথায় অশ্লীল খিস্তি করবে, দুম করে রেগে উঠবে। ওদের বন্ধুত্বের
সাথে সবুজকে আপাতদৃষ্টিতে মানানসই না লাগলেও কেমন করে ও যেন ঠিকই মানিয়ে যায়। কারণ
সবুজই একমাত্র ছেলে যে বন্ধুর বাবার জন্য রক্তের প্রয়োজনে পরীক্ষার দিন সকালে লোপাট
হয়ে যায়। মিছিলের সম্মুখভাগে থাকা সবুজ শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত করে ক্যাম্পাস,
‘যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই, ফাঁসি চাই, ফাঁসি চাই।’ আবার নিজের খাতা খুলে বন্ধুকে দেখাবার
জন্য ফুল অ্যান্সার দেবার সময় না পেয়ে হাসতে হাসতে পরীক্ষার হল থেকে বেরিয়ে আসে। আসলে
সবুজ একটা আগুনের ফুলকি। ওদের প্রিয় বন্ধু।
সবুজের
চলে যাওয়া দেখে মানিক মুখ অন্ধকার করে বসে থাকে। তারা এবার ছটফট করে,
-তুই
মন খারাপ করছিস কেন মানিক? সবুজ তো এমনই। একটু পরে দেখবি ঠিকই চলে আসবে। সিগারেট ফুঁকতে
গেল বোধহয়। শালা এক নম্বরের বদ।
মানিক
শান্ত গলায় বলে,
-আসলে
ওর কথা বলতে গেলে আমি সোজাসুজি কিছু বলতে পারি না। তনিমার সাথে কাটানো সেই মুহূর্তগুলোই
আমার জীবনের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় ঘটনা।
তিতির
চুপ করে বসে আছে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো। যদিও যমুনার গন্ধ মেশা বাতাসের এই শহরটা ওর চিরচেনা।
তবু ও যখনই শহররক্ষা বাঁধের এখানে আসে তখনই অবাক পথিকের মতো নিশ্চল হয়ে যায়। অন্ধকারে
যমুনার তীর ঘেঁষা সৌন্দর্য তিতিরকে কেমন যেন বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছে। ফাইনাল পরীক্ষা
শেষে বন্ধুরা যখন বললো, ওর শহরে বেড়াতে আসবে, তিতির খুব খুশি হয়েছিল। সিরাজগঞ্জ জেলার
সব দর্শনীয় স্থান ঘোরা শেষে ওরা ওদের সবচেয়ে ভাললাগার জায়গা যমুনার তীরে আজ চতুর্থ
ও শেষবারের মতো এসেছে।
আগামীকাল
সকালে ওদের ঢাকায় ফেরার ট্রেন। এই কথা মনে পড়তেই তিতির নিজের মধ্যে ফিরে আসে। অতিথিদের
দেখাশোনার দায়িত্বটা ওর ওপর বর্তায় বলেই তিতির কাতর গলায় মিনতি করে,
-তোরা
যাবার আগে আর তর্কে মাতিস না প্লিজ। আসলে মানিক তুই কিছু মনে করিস না, আমারো ঠিক প্রেমের
গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে না। সবুজ তো ঠিকই বলেছে। তুই একটা অন্যরকম গল্প বল। আজ আমরা
সেসব গল্প বলবো, যেগুলো একেবারে বুকে এসে বিঁধবে, যেসব গল্প এর আগে আমরা কখনো কাউকে
বলিনি।
সবুজ
কখন যেন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
-বোঝো
এবার। আমি বললেই দোষ। এখন তোদের হোস্টই বলতেছে। বাদ দে এইবার। এসব নেকুপুষুমুনুর গপ
আর না। বাদাম ভাজা খা আর আমার গপ্পো শোন। রগরগা গল্প। হাহাহা।
“আমাকে যে কোনো ছেলে মানসিক বা শারীরিকভাবে
আকর্ষণ করে না তা আমি প্রথম টের পাই যখন আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। তখন আমাদের বাড়িতে রোজ
পাশের বাড়ির রেখাদি আসতো। দিদিকে দেখলে আমার ভেতরে কী যে হতো! আমি তোদের বলে বোঝাতে
পারবো না। সেই থেকে শুরু।
এখন...তারার গল্প ফুরোবার আগেই মিতু দুই
এখন...তারার গল্প ফুরোবার আগেই মিতু দুই
কানে
দুই তর্জনী ঢুকিয়ে চিৎকার করে ওঠে”
গল্পের
গন্ধ পেয়ে হার্ড পয়েন্টের পাথরের ব্লকে ওরা পাঁচজনই এবার পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে। সবার আগ্রহী
চোখ আর হাত এখন সবুজের দিকে। ওদের হাতে বাদাম দিতে দিতে সবুজ লম্বা করে একটা শ্বাস
নেয়। তারপর নির্ভার হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে গুম হয়ে বসে থাকে। ওরা সবাই অপেক্ষা
করছে। যেন কোনো ব্লক ব্লাস্টার সিনেমার সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য দেখার অপেক্ষায় আছে
সবাই। অপেক্ষা করতে করতে একসময় ওদের প্রত্যেকের নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসে। যখন কেউ একজন
এই নীরবতা ভাঙবে বলে ঠিক করে তখনই ওদেরকে হতবাক করে দিয়ে প্রমিত বাংলা উচ্চারণে সবুজ
বলে ওঠে,
-আমার
গল্পটা খুব ছোট। এক লাইনের গল্প। অণুগল্প বা ঊণগল্পও বলতে পারিস। শুনে কেউ আবার অজ্ঞান
যাবি না কিন্তু! হাহাহা।
তুমুল
রহস্য তৈরি করে সবুজ ওর সেই বিখ্যাত খিকজ মার্কা হাসি হাসে। তারার ইচ্ছে করে বদমাশ
ছেলেটার পিঠে একটা রাম ঘুষি মারে। তারা ওকে তেড়ে যাবার আগেই সবুজ দুম করে ওর গল্পটা
বলে ফেলে।
-আমার
মাকে আমি আমার চাচার সাথে এক বিছানায় দেখেছি, তখন আমার বয়স আট।
সবুজের
গল্প শুনে বাতাস ভারি হয়ে আসার কথা কিন্তু ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে বাতাসে কামিনী
ফুলের মিষ্টি সৌরভ ভেসে আসে। প্রকৃতি অপার রহস্যময়। পুরো পরিবেশ ঢেউয়ের মতো দ্রুতগতিতে
বদলাচ্ছে। যেন ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে আড়াল করে দিচ্ছে গল্পের নিষ্ঠুরতা। আস্তে আস্তে জোছনা
অন্ধকারকে গ্রাস করে নিচ্ছে। বড় অপূর্ব সৌন্দর্যদর্শনের এই ক্ষণ! চারপাশের মায়াবী সৌন্দর্যে
ওরা বিষাদী পাঁচজন আবার ঘোরে পড়ে যায়। বুকের ভেতর অজস্র কথার বুদবুদ অথচ ওরা কেউ কোনো
কথা বলে না। একটা কথা বললেও যেন সুন্দরের প্রাচীরে ধস নামবে।
কারো
কান্নার শব্দ শোনা যায়। সবুজ কি কাঁদছে? ফোঁপানির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মিতু কাঁদছে।
মিতুর কান্নার বদঅভ্যাস আছে। ওরা কেউ কোনো কথা বলে না। শব্দেরা যেন হাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছে।
মিতু
মিনতি করে বলে,
-আর
গল্প বলে কাজ নেই, চল এবার বাড়ি ফিরি। তিতির ওঠতো। চল, চল।
কেউ
ওর কথায় সাড়া দিচ্ছে না দেখে মিতু ডুকরে কেঁদে ওঠে,
-কাল
সকালেই তো আমাদের ট্রেন। চল, চল।
-না,
এবার তোর গল্প বল মিতু।
সবুজের
কথা শুনে মিতু আর্দ্র গলায় বলে,
-তোদের
শোনানোর মতো আমার জীবনে অদ্ভুত কোনো গল্পও নেই। খুব সাদামাটা জীবন আমার।
সবুজের
ক্ষ্যাপা গলা শোনা যায়,
-আমার
গল্প শ্যাষ। ভাল চাস তো বাকিরা তাদের গল্প শেষ কর। নইলে...
কথা
শেষ করে না সবুজ। ওর গলায় কপট রাগ। তারা মিতুর হাত চেপে ধরে অদ্ভুত গলায় বলে ওঠে,
-নারে,
সবাইকে তো বলতেই হবে, এমনই তো কথা ছিল। তোরটা এবার থাক, আমার গল্প বলি এবার।
মিতু
তারার দিকে ভীতু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারার চোখের মণি একটু কটা, অন্ধকারে সেই চোখজোড়া
বিড়ালের চোখের মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। ঘাবড়ে গিয়ে মিতু তারার হাত খামচে ধরে। তারা সেদিকে
ভ্রুক্ষেপ না করে বলতে শুরু করে,
-আমাকে
যে কোনো ছেলে মানসিক বা শারীরিকভাবে আকর্ষণ করে না তা আমি প্রথম টের পাই যখন আমি ক্লাস
নাইনে পড়ি। তখন আমাদের বাড়িতে রোজ পাশের বাড়ির রেখাদি আসতো। দিদিকে দেখলে আমার ভেতরে
কী যে হতো! আমি তোদের বলে বোঝাতে পারবো না। সেই থেকে শুরু। এখন...
তারার
গল্প ফুরোবার আগেই মিতু দুই কানে দুই তর্জনী ঢুকিয়ে চিৎকার করে ওঠে,
-আমি
কিছুতেই আর কারো গল্প শুনবো না। না, না। তোদের পায়ে ধরি, তোরা এবার থাম। আমি আমার কোনো
গল্পও বলবোও না। শুনবোও না।
চারপাশের
নিস্তব্ধতা ভেদ করে সবুজ বিকট শব্দে হেসে ওঠে,
-বোঝো
ঠ্যালা! এতো তাড়াতাড়ি কী রণে ভঙ্গ দিলে চলে? এখনো তো তোর আর তিতিরের গল্পই শোনা হইল
না! নে, এবার শুরু কর।
তিতির
মিতুর দিকে তাকিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসে। অন্ধকারের আবছায়াতে সেই হাসি খুব ক্রুর দেখায়।
-কীরে
এখন তুই বলবি? না আমি বলবো?
সবাইকে
অবাক করে দিয়ে মিতু বলে,
-ঠিক
আছে, এবার আমি বলবো।
সবুজ
আবার বাতাস কাঁপিয়ে হেসে ওঠে। এই হাসিতে তীব্র কটাক্ষ মাখা। মিতু এই হাসির শব্দ শুনে
দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। তারপর বিড়বিড় করে বলে ওঠে,
-ইয়ার
ফাইনালের আগে মানিকের ইনটেলেক্চুয়াল প্রপার্টি অ্যাক্টের যে অ্যাসাইনমেন্টটা হারিয়েছিল
সেটা আমি নিয়েছিলাম।
আলো-আঁধারির
মায়া বিদীর্ণ করে মানিকের গলায় অস্ফুট আওয়াজ শোনা যায়,
-আহ্!
তুই! কত যে খুঁজেছি। অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার আগের রাত জেগে থেকে আবার সেটা তৈরি করতে
হয়েছিল আমাকে।
মিতু
জবাব দেয় না। তিতির সবার নীরবতা পরখ করে বলে,
-হুম,
আজকের গল্পগুলো সব ভুলে যাওয়াই ভাল। ভুলে যাবার আগে এবার তাহলে আমার পালা।
চারজোড়া
চোখ এবার তিতিরের দিকে ঘুরে যায়।
-ঠিক
কোথা থেকে যে শুরু করি।
তিতিরের
কণ্ঠস্বর রহস্যময় লাগে। ও এবার সময় নেয়। এক মিনিট। দুই মিনিট। তিন মিনিট। যেন সবচেয়ে
আকর্ষণীয় আর ঐশ্বরিক উন্মাদনায় ভরপুর গল্পটা বলবে বলে তিতির এমন সময় নিচ্ছে। আচমকা
অন্ধকারের নিস্তব্ধতা ভেদ করে তিতির বলতে শুরু করে,
-আমার
সেরকম কোনো গল্প নেই। আবার এটা গল্প ধরলে গল্প।
তিতির
থেমে যায়। পথশিল্পীর একতারার সুর এখন কান্নার মতো শোনাচ্ছে। করুণ সেই সুরের তালে তালে
তিতিরের গলা কেঁপে ওঠে।
-জানিস,
ভার্সিটিতে ভর্তির আগে মা আর আমি প্রতি শুক্রবারে এই হার্ড পয়েন্টে বেড়াতে আসতাম। দুজনে
পাশাপাশি হাত ধরে দাঁড়াতাম এই বাঁধের ওপরে। এখনো ছুটিতে আসলেই আমরা দুজন এখানে চলে
আসি। মা-মেয়েতে চুপচাপ বসে থাকি রাতের অপেক্ষায়। আমাদের অবাক করে দিয়ে কোনো কোনোদিন
আজকের মতোই অন্ধকার ছাপিয়ে আলোতে ভরে যায় চারপাশ। ঐ দেখ, দেখ, কী মিষ্টি আলো! নারে?
দেখেছিস তোরা?
তিতির
চুপ করে যায়। কেউ ওর কথার উত্তর দেয় না। প্রশ্নও করে না। বলেও না, তোর গল্প কই? কারো কোনো তাড়া নেই। সবাই নিশ্চুপ বসে থাকে। সবাই
যেন বুঝে গেছে বুকের গভীরে লুকানো গোপন বিস্ময় আজ উজার করতে বাধ্য তিতির।
তিতির
আবার বলতে শুরু করে,
-জানিস
আমার জন্মদাতা মানে আমার বাবা আমেরিকা থাকে না। আমি তোদের মিথ্যে বলেছি। আমি রোজ তোদের
মিথ্যে বলি। মা ছিল আমার জন্মদাতার দ্বিতীয় স্ত্রী। কোন ফাঁদে পড়ে মা ঐ লোকটাকে বিয়ে
করেছিল সে আরেক গল্প। এখন আমার জন্মদাতা আর মা আলাদা থাকে। আমার বয়স যখন দশ তখন তাদের
ডিভোর্স হয়েছে।
তারা
তিতিরের হাত চেপে ধরে। বন্ধুত্বের মমতায় ওকে আশ্বস্ত করে। তিতিরও তারার হাত আঁকড়ে ধরে
বলে,
-জানিস
তোরা আমার জন্মদাতা রাজাকার ছিলো। রাজাকার! কী ঘেন্না! কী ঘেন্না! আমার রক্তই ঘেন্নার!
আমার জন্মই ঘেন্নার। মানিক আমাকে কত করে ডাকে তবু ব্লাডফ্রেন্ডের ডাকে আমি রক্ত দিতে
যাই না। রাজাকারের রক্ত যে! বুঝবি না তোরা, এ যে কী ঘেন্না! কী ঘেন্না! তোরা বুঝবি
না। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে হাতের শিরা কেটে এই নোংরা রক্ত আমার শরীর থেকে বের করে
দিই।
তিতির
কাঁদছে। বড় গ্লানিময় সেই কান্নার সুর। ওরা সবাই তিতিরকে কাঁদতে দেয়। একসময় তিতির থেমে
গেলে একটা অখ- নীরবতা চারপাশ ঘিরে ধরে। আশেপাশে লোক সমাগম কমে গেছে। পথশিল্পীর সুরের
জাদু এখন স্তিমিত। সুনসান নীরবতায় নদীতীরে কেবল ঢেউয়ের শব্দ ভেসে আসে। ওরা পাঁচজন নিশ্চুপ
বসে থাকে আর নদীর জলে চাঁদের আলো-আঁধারির লুকোচুরি খেলা দেখে। ধীরে ধীরে জোছনার ঝলমলে
আলোয় রাত্রির রূপ পাল্টে যায়। দেখে মনে হয় ওদের অ-কথার স্তূপ ঢাকতে আকাশের ঝুলন্ত চাঁদ
তার সবটুকু আলো নদী তীরে বিছিয়ে দিয়েছে।