ঘুণপোকা
সাহিত্যপ্রেমী “ভাবনা” উদার গলায় আবৃত্তি করতে ভালবাসতো। স্কুল জীবন থেকে নীতি, আদর্শের সাম্যবাদী রাজনীতিতে যোগ,
প্রচ্ছন্ন তৃপ্তি আর গর্বে উজ্জ্বল ভাবনা, রক্ত গরম
করা স্লোগানে গলা মেলাত। মুঠো ভরা অফুরন্ত জীবন,
হাতভরা অঢেল সময়। সাথে পায়ের তলে দাপিয়ে চলার মতো শক্ত মাটি।
-মেয়েদের এতো লাগাম ছাড়া চলতে নেই, পরের ঘরে যেতে হবে।
আতঙ্কিত মা বলতেন প্রায়ই,
রাজনীতির তার্কিক ঢং-এ অক্লেশে হেসে উড়িয়ে দিত ভাবনা।
হতাশ মা বলতেন, শেষে বুঝবি...
আরম্ভ হয়ে গেল শেষের শুরু। ভাবনার চাঞ্চল্য উদ্যমে মুগ্ধ অনুভব ব্যানার্জী গোধূলি লগ্নে
হাত ধরে তার। অনুভবের সমকালীন বর্তমান এবং আগামী
ভবিষ্যত পূর্ণ করতে গিয়ে ভাবনা তার নিজের ইচ্ছা গুলিকে কবে যেন হারিয়ে ফেলেছিল সংসারের
মানুষগুলি কেমন যেন অন্য গ্রহের মানুষ হয়ে গেল। সেটা বুঝতে বুঝতে সময় চলে গেল অনেকটা।
সেদিনটা ছিল ওদের প্রান্তিক
বিবাহবার্ষিকী। চলে গেল অনুভব।
ভাবনাকে করে দিয়ে গেল মূল্যহীন আর কেমন যেন অচ্ছুত অপরাধী।
কখন যেন সমস্ত রক্তক্ষরণ, হাহাকার, আর যন্ত্রণা
পরিণত হয় অসহায় অনুভূতিতে। বন্ধনহীন, সঙ্গীহীন মনে হতে লাগে নিজেকে। নিঃশব্দ চিত্কারে বলতে থাকে --- চুপ ! চুপ !
চুপ হয়ে না সে।
ভেতরের কে একজন বলতে থাকে ভাঙা
রেকর্ডের মতন, তোমার 'তুমিটা' কোথায় গেল
ভাবনা? মা-এর মুখ ভেসে ওঠে বেঠিক সময়ের চালচিত্র।
নিজেরই অলক্ষ্যে ঘূণপোকায় আক্রান্ত হয়েছিল ভাবনা।
কোজাগরীর মেঘ
সন্ধ্যা গড়িয়েছে অনেকক্ষণ...
কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারে
না শিষ্যা। অসহ্য মুহূর্তগুলোকে পার করিয়ে দেওয়ার একটা ছুতো খুঁজে পায় হাতের কাছে প্রিয়
কবির কবিতার বইটা নজরে পড়তেই কিন্তু না, কেমন যেন একটা অস্থির সময়...
সেল ফোনের স্ক্রিনে হিরণের
নামটা দপ্ দপ্ করতে থাকে যে নামটা এতদিন শিষ্যার সমস্ত সত্তা জুড়ে... মুহূর্তে গড়ে
তোলা স্বপ্নের অপচয় মনে হতে থাকে। প্রকৃতিরও
বিবেচনা আছে। কোজাগরী পূর্ণিমা রাতের চাঁদকে বুঝি আড়াল করে ঘন কালো একটা মেঘ। ফুরফুরে
হাওয়া উধাও হয়ে, মুহূর্তে একটা ভ্যাপসা গরম পরিবেশ তৈরি হয়। পায়ে পায়ে কখন যেন বে-আব্রু ছাদে চলে
আসে শিষ্যা। একটু আগে হিরণের উপস্থিতি আজ ভুলতে চায় সে।শুধু খানিকটা অন্ধকারে হাতরে
বেড়ানোর মতো সম্পর্ক মনে হচ্ছে যেন!
রোজকার মতো আজও গল্পে-আমোদে
ডুবে ছিল ওরা...। একটুখানি সময়েই,হিরণ শিষ্যার
সমস্ত শরীর আলিঙ্গনে আটকে ফেলে।আপত্তির মোড়কে
শিষ্যার মিষ্টি লাজুক মুখটা চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে হিরণের।
"তোমায় একটা কথা বলা হয়নি
শিষ্যা" -হঠাৎ বলে ওঠে হিরণ। "আমি মেয়েদের খুব ভয় পাই"। শিষ্যার বুকে মাথা রেখে বলে হিরণ। হিরণের শরীরের নিচ থেকে নিজেকে
আলগা করতে করতে শিষ্যা তাকায় তার দিকে।এলোমেলো চুল, কপালের টিপ, শাড়ির বিন্যাস
ঠিকঠাক করতে গিয়ে শিষ্যা কৌতুক ছলে বলে- "ওমা তাই! জানা ছিল না তো! হিরণ বলে-"মেয়েদের
বড় চাহিদা। আজ ভালবাসবে,কাল বলবে
তোমায় ছাড়া পারছি না,এসো আমরা একসাথে থাকি। এও বলতে শুনেছি, "এতদিনের সম্পর্ক,এবার আমায়
সিঁদুর পরিয়ে দাও,প্লিজ"।
মনে ভাবে শিষ্যা, এ তো আমারই
মনের কথা..!
পুরুষের চোখে নিজেকে ছোট করতে
পারে না। ঐ মুহূর্তে শিষ্যা। ধেয়ে আসা একটা দমকা হাওয়া ঝড়ের বেগে বলতে থাকে, হিরণের ঘরে যৌবন ছুঁই ছুঁই দুই মেয়ে।তারা ভুল করবে
না তো?
শূন্যতায় পূর্ণতার পথে চলেছিল
একা ভালোবাসার জন্যে। যেন একটা কুয়াশার স্তর এসে
ঢেকে দেয় সব কিছু...।
No comments:
Post a Comment