বৈশাখের বাঘ
কিংবা
বেড়ালের
গপ্পো
।। ১ ।।
‘দাদা, দেখ দেখ! কত্ত বড় ঘুড়ি!’
‘কই রে পাগলি? কই?’
‘ওই যে ওই
গাছটার উপরে
দেখ!’
তারা দৌড় লাগায়।
হাত ধরে।
খুব জোরে।
সময়কে পাল্লা
দেয়। হার
মানবে নদীর সচ্ছ স্রোত। একটা সময়
হাঁপাতে হাঁপাতে
বটগাছের লম্বা
জটার একটার
নিচে তারা
এসে দাঁড়ায়।
‘দেখসস কত
বড় ঘুড়ি?’
‘খাড়া আমি লইয়া
আনি।‘
এই বলে লিপু
শতবর্ষজীবী গাছের
মাঝে সাঝে
জেগে ওঠা
ফোকড়গুলোতে সদ্য
কৈশোর পেরুনো
শক্ত পা
দিয়ে দিয়ে
বাঁ দিকের
একটা শাখাতে
চড়ে বসে। ওইতো ওদিকেই! হাত বাড়ালেই
পাওয়া
না পাওয়ার আশা ফুরোয়।
‘হাতখান বাড়ায়
দে দাদা!’
‘না! এইডা হাত
দিয়া অইব
না।‘
লিপু এক পায়ে
ভর করবার
সাহসের মনস্থির
করে নেয়।
যা হয় হোক
গা! আল্লাহ সাহায্য
কইরো।
লিপু হাত ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকে। এক পায়ে ভর।
আরেক পা
প্রায় শূণ্যে
দুলছে।
আয়রে চাঁদ! চাঁদ আয়
নাগালে।
নিচে দাঁড়িয়ে থাকা
লিপি চোখ
ঢাকে।
খরস্রোতা নদীর বয়স
হয়েছে। ভারী
বয়স। কুঁজো
হয়ে গিয়েছে।
চলাচল করতে
পারে না।
কথা বলতে
পারে না।
ভগ্নদেহের একটা
ফিতার মতো
পানির স্রোত
বইয়ে দিয়েছে
মাঝ দেহ
বরাবর। তা
দেখে পাড়ে
বসে থাকা
লিপু আর
লিপি উপহাস
করে। হাসে।
নদী চুপচাপ
শুনে। কষ্টগুলো
ভেতরেই রেখে
দেয়। বড়
হতে থাকে
ভ্রূণীয় সন্তানের
মতো।
‘ওই!
কালা রংটা
এক্কেরে খারাপ
না। কি
কস?’
‘কিন্তু দাদা এই
জায়গাত ঘুড়ি
কইত্তুন আইলো
ক তো? এইখানেত সরকারি তো
আমার আর
তোর? তাইলে?’
আঠারোতে পা দেওয়া
লিপু দাদাসুলভ
কাঁচা গোফ
গজিয়ে ওঠা
নাকের নিচে
আঙ্গুল বুলিয়ে
কিছু একটা
ভাববার চেষ্টা
করে।
‘কে জানে! উপর থেইক্কা
আইসে মনে
লাগে।‘
‘উপর থেইক্কা? ক্যামনে?’
‘আরে বেডি চুপ
থাক। ঘুড্ডি
দেখসস? কত্ত বড়! দুই হাত অইব
কমসে কম।
চল উড়াই।‘
লিপু কালো ঘুড়িটার
লেজ ধরে
থাকে। লিপি ধরে
সামনের মাথা।
দেখে সুতা
নেই। তাতে
কি! সে হাত
বাড়ায়। একটা
নাটাই আসে।
লিপি আবার
হাত বাড়ায়।
এবার এক
বান্ডিল কালো
সুতা। আবার
হাত মেলে
ধরে। ঘুড়ি
আসে। লিপু
সুতো গুটায়।
মাঞ্জা মাখায়।
লিপিকে বলে, ‘ওই দিকটা
ধর।‘
নাটাই এর সুতো
টানটান করে
নিয়ে যেতে
যেতে নদীর
পাড়ের মরা
প্রান্তে এসে
থেমে যায়
লিপু।
ছাড়!
ছাড়!
ফুড়ড়ড়ৎ করে উপরের দিকে
উঠতে থাকে
ঘুড়ি।
ঘুড্ডি ওড়! ওড়!
লিপি খুশিতে হাততালি
দেয়। লাফায়।
ফুড়ড়ড়ৎ করে আরো কয়েক
ফুট উপরে
উঠে যায়
ঘুড়ি।
বেডি বেশী লাফাইস
না। খাড়া।
আরো উপরে
তুলুম।
নদীর সরু মরে
যাওয়া পাড়ে
দুটো ছায়া
ঘুড়ি ওড়ায়
আর লাফায়!
।। ২।।
টং এর বেঞ্চিতে
বসে সিগারেট
টানে লিপু।
মাত্র শিখেছে।
পাশের বস্তির
ফজলুর মতো
রিং ছাড়তে
পারে না
ওভাবে। তবু
চেষ্টা করে।
লিপু মহা বিরক্ত।
ঘরের মধ্যে
আচালি ক্যাঁচাল
দিনকে দিন
অসহ্য হয়ে
ঠেকছে। ঘর
বলতে এক
মা আর
এক বোন।
বোন আর
ভাইয়ের সম্পর্ক
অটুট রাখতে
দুজনের নামের
মধ্যে যে
স্থূল মিলটি
পাওয়া যায়
তা লিপুর
কাছে বিরক্তিকর।
আজকের বৈশাখ
উৎসবকে অজুহাত ধরিয়ে
লিপি এখন
মেলায় যাবে।
টাকা চায়।
লিপু এসব
খুব ভালো
বোঝে। টাকা
চাওয়ার ফন্দিফিকির।
সকালে এই
নিয়ে দুই
চারটা শক্ত
শক্ত কথা
শুনিয়ে দিয়ে
এসেছে। মাথার
পেছনের চুল
ধরে থাপ্পড়ও
কষিয়েছে একটা।
পেছন থেকে
মা এসে
শুরু করে
গালিগালাজ।
লিপু কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে মনে
মনে মাকে
গাল পাড়ে।
গালিগালাজ শিখসে! টাকার গাছ
লইয়া ঘুইরা
বেড়াই তো
আমি। জামা
পিইন্দা পিইন্দা
ঘুর তুই।
মানা করসি
আমি। আমার
কাছে ক্যান। ধিঙ্গি ছেমড়ি কয়েক ঘরের
বেড়াতে গিয়ে
বস না।
লোকজন তোরে
দেইখ্যাই টাকা
দিয়া দিব।
পিচ করে থুথু
ফেলে মাটিতে।
‘কিরে লিপু, বইসা বইসা
খই ভাজস
নাকি? দে সিগারেট।‘
হঠাৎ উদয় হওয়া সলিম
লিপুর সিগারেটটা
মুখ হাত
থেকে এক
টান দিয়ে
ছিনিয়েই নেয়
বলতে গেলে।
ঠোঁটে চেপে
ধরে নি:শব্দে টান দেয়
একটা।
দোকানি বসে বসে
কেটলির নিচের
আগুনটাকে বাড়িয়ে
দিচ্ছে। সলিমের
দিকে তাকায়।
ভয়মেশানো দৃষ্টি।
‘বয়ামত্তুন একটা বিস্কিট
দে দেখি। অই
মায়ের পোলা
খুল না
বয়ামটা।‘
ষোল বছরের কিশোর
দোকানি দ্রুত
বয়ামটা বাড়িয়ে
দেয় সলিমের
দিকে। নিজে
খুলে না।
বয়ামটা খুলতেই গোল
মেটে রং
এর বিস্কিটটা
মুখে চালান
হয়ে গেলো।
‘মুখ কালা ক্যান? কিছু হইসে?’
লিপু তাকায় সলিমের
চোখ বরাবর।
কিছু বলে
না।
‘না, কি আবার
অইবো।‘
সিগারেটটা দ্রুত একটানে
শেষ করে
ফেলে সলিম।
বলে, স্টেশনের দিকে
যাবি? রাসেলরা আইব।
লিপু টাকা না
দিয়েই উঠে
দাঁড়ায়।
‘কালকে নিস
বাটলু বিস্কুট আর চায়ের
ট্যাহা’।
সলিম আর লিপু
এক বস্তিতে
থাকে। পকেট
মারা ওদের
পেশা। পেশার
থেকে অভ্যাসই
এক প্রকার
বলা যায়।
লিপুর ব্যক্তিগত
গুরু বলতে
গেলে সলিমই।
কিভাবে দুই
আঙ্গুল দিয়ে
পকেটসাফাই করতে
হয়, কিভাবে চলাচলরত
পথিকের বুক
বরাবর ধাক্কা
খেয়ে বুক
পকেটের দামি
কলম, পেছনের বেড়ালের
থলে দুটোই
সাফ করে
দেওয়া যায়, কিভাবে বাসে
বসে পাশের
লোককে ঝালমুড়ি
খাইয়ে বেঁহুশ
করে দেওয়া
যায় এসবে
হাত পাকানোর
পেছনে ভূমিকা
যে একমাত্র
ব্যক্তিটির তা
হচ্ছে তার
সামনে চলতে
থাকা সলিম
গুরুরই। প্রায় দুই বছর থেকে সলিম লিপুকে তার কাজে
সঙ্গী করে নিয়েছে। লিপুর তড়িৎ
বুদ্ধি তার প্রিয়।
‘আজকে মাঠের
অইদিক কী হইতেসেরে? জানস কিছু?’
‘বৈশাখের মেলা লাগসে
যে অইজন্যে’।
‘বৈশাখ আয়া পড়সে? এত্ত তাড়াতাড়ি’।
‘হ’
‘মেলাত যাবি? ভালো পাবলিক
পামু’
পাবলিকের কথা চিন্তা
করতেই একটা
ক্ষীণ আলো
যেন অন্তরে
দেখা দিয়ে
লিপুর মোহনীয় আশার জায়গাটার ঊন্মেষ ঘটায়। পাবলিক মানেই
টাকা, টাকা মানেই
চিল্লাচিল্লি
পুরোপুরি বন্ধ হওয়া। সে
বলে,
‘আগে রাসেলগো লগে
দেখা কইরা
আই?’
প্লাটফর্মে পৌঁছে দুইজন
রেললাইনের
দিকের এক প্রান্ত ধরে হাঁটে।
একটু আড়াল
হতে হবে।
আড়ালেই
তাদের স্বভাবগত বসবাস।
স্টেশনের একটা পুরোনো
মালগাড়ির ওপর
জনা চারেক
ছেলে বসে
আছে। একজনের
হাতে গঞ্জিকা
দন্ড। আর
তিনজনের হাতে
তাসের বান্ডিল।
তিনজনের একজন
তাদের দিকে
হাত নাড়ে।
‘কিরে পলান? সক্কালেই টানতাসস? সারা দিন চলবি
ক্যামনে?’
‘এই পলানরে লইয়া
চালাইতে পারুম
না। কাজ কামে হাত নাই। হুদাই টানাটানি। ‘
সলিমের মনে রাসেলের
উত্তরটা খুব
করে গাঁথে।
নিজের ভাগটা
বেড়ে যাবার
আভাসে ভেতরটা
কেমন কেমন
করে ওঠে।
রাসেলের দিকে
আরেকজন তাকায়।
‘আইজকা মাল ভালো।
দুই কিসিমেরই
আছে! মালও আছে, পকেটও আছে।‘
কোন মাল সেটা
বুঝতে অসুবিধে
হয় নি
লিপুর। সে
কথা ভেবে
কেমন ইঁদুর
মেরে যায়
চোখ। কোনওদিন
ওসব মাল
চেখে দেখে
নি সে।
স্বপ্ন, কুস্বপ্ন, কল্পনা, আড়ি পাতা, দুই হাজারের মোবাইল-
সেসবেই আটকে
ছিলো সেসব।
এখন সরাসরি
প্রস্তাবে আঠারো
বছর বয়েসের
বুক ধড়ফড়
করে উঠে।
সলিম ওর
দিকে ভ্রূকুটি
করে।
‘ওই ভালা বউয়ের
পোলা। শরমাস
ক্যান?’
এরপর একটা খুব
শক্ত করে
গাল পাড়ে
লিপুর দিকে।
রাসেল সবার
দিকে তাকায়।
‘এই গাঁজাটারে লইয়া
যাওয়া যাইব
না। সিস্টাম
বিগড়ায় দিব
অই’
‘ঝিম মাইরা পইড়া
আছে দেখস
না? ঐ পলাইন্যা! শুনতেসস’।
সলিম ধাক্কা দেয়
পলানকে। লাল
ঘোলাটে চোখ
গুলগুল করে
তাকায় গাঁজা।
‘ক তো তোর
সামনে কেডা
খাড়ায় আছে? তোর বাপ না
বউ?’
গাঁজা খাওয়া পলান
খুব কষ্ট
করে চিন্তা
করে। আকাশের
দিকে একবার
তাকায়। কান
পেতে থাকে।
গোলাপি, লাল ফেরেশতা
ফেরেশতা লাগে
যে! ও ফেরেশতা
কও না? কে এইডা? আমার বাপ
না আমার
বউ।
লাল গোলাপি ফেরেশতা
তাকে কিছু
দেখায়। পলানের
মুখ হাসি
হাসি হয়ে
উঠে। নানাসাহেবের
তেজ বুকে
খোঁচা দেয়।
‘এইডা আমার বউ।‘
সলিম কষে একটা
থাপ্পড় মারে।
গাঁজা পলান
উল্টে পড়ে
যায়। আরেকটু
হলেই মালগাড়ি
থেকে সোজা
নিচে পড়েই
উপরে উঠে
যেত। লিপু
সময় সময়ে
তাকে ধরে
ফেলে।
‘এই আকাইম্মারে এখানেই
রাখ। চ রাসেল।‘
মালগাড়ির উপর থেকে
পাঁচটা ছেলে
লাফ দেয়।
পাঁচটা ছেলের
গায়ে ছেঁড়া, তালি মারা সুতোর
নকশা সূর্যের
সাথে সাথে
অত উজ্জ্বল
হয়ে উঠে
না। বেলা
গড়াচ্ছে। সূর্যের
তীব্রতা তীব্রতর
হচ্ছে। সুতোগুলো
আরো পুরোনো
হচ্ছে।
লিপু মাটিতে পড়ে
যাওয়া গঞ্জিকাদন্ডে জোরে লাথি মারে।
।। ৩ ।।
‘তেলাপোকা’
তৃষা চিৎকার দিয়ে উঠে।
‘তেলাপোকা! পান্তাভাতের ভেতর
তেলাপোকা!’
পাশে বসা তিথী
উঁকি দেয়।
ওর চিৎকারে দোকান
আর আশপাশের
বেশকিছু মানুষ
তাদের বসার
কোনাটার দিকে
তাকায়।
‘গাধী,
ওইটা লাল
পোড়া মরিচের
বোঁটা।‘
‘ওইটাই। খাইতে পারব না
আমি এটা।
তুই খা।‘
সামনে বসা রোদষী
ভেঙ্গায়।
‘নবাবের বেটি তিনি।
লাল মরিচ
দিয়ে ভাত
মুখে রুচবে
না। এই
অকম্মাটাকে কোন
দু:খে আনলি
রে?’
তিথী বলে, ‘অকম্মা বলিস
না। অকম্মাগিরি
কাটানোর জন্যেই
তো আনালাম।‘
‘এইসব মেয়ের জন্ম
হয়েছে শুয়ে
শুয়ে ঘুমানোর
জন্যে, আর রাত
জেগে প্রেম
করবার জন্যে।
এদেরকে নিয়ে
আসিস তুই
বৈশাখে? বৈশাখ নষ্ট
করবার জন্যে?’
নিজের মাটির হাঁড়ির
তলানির পানিটুকু
সুড়ুৎ করে টেনে
নেয় রোদষী।
তারপর তৃষার
দিকে আঙ্গুল
তুলে নিজেকে
দেখায়।
‘এটাকে বলে বাঙালিপনা!’
‘রাখ তোর ন্যাশনালিটি।
আমি খাইতে
পারব না
এগুলো’।
‘সেটা তোর ব্যাপার।
নিজের ইচ্ছায়
খাইতে বসছিলি
তুই। মাছটা
কামড়ে ওঠ।
আরো জায়গায়
যেতে হবে’।
তিথী আর রোদষী
নিজের নিজের
পার্স থেকে
টাকা এনে
গুছায়। একশ
টাকার নোটগুলোর
পাশে কয়েকটা
খুচরো পয়সা।
পয়সাগুলো সরিয়ে
রাখে। টাকাগুলো
ভাঁজ করে।
তারপর তাড়া
দেয় একটু
স্বচ্ছজল চোখের
মেয়েটিকে।
দোকান থেকে বেরিয়ে
আসতে রোদষী
বলে প্রচন্ড
রোদের কথা।
রোদ তার
কথা পাত্তা
দেয় না।
দেয় না
বাকি মেয়ে
দুটিও। তারা
লোকারণ্যের সমুদ্রের
মাঝে হাঁটতে
থাকে। তীর
খুঁজতে চায়।
পায় না।
‘এই তিথী! ওই মাটির
পুতুলগুলোর পাশেই
দেখ, ঝুলন ধরা
জিনিসগুলো’।
‘কী জানি? নাম জানি
না’।
‘এক্সেসরিজ ঝুলিয়ে রাখে
বোধহয়। চল
না একটা
কিনি’।
তৃষা,
তিথী দোকানটার
কাছে গিয়ে
ভেড়ে। দরদাম
করে দুটো
পাটের থলে
নিয়ে পালাপালি
করে। রোদষী
দাঁড়ায়। অপেক্ষা
করে। মনে
মনে গানের
সুর ভাঁজে।
"নোনা স্বপ্নে গড়া
তোমার স্মৃতি
শত রঙে রাঙিয়ে
মিথ্যে কোন
স্পন্দন...
সুরের সাথে কল্পনা
এসে যোগ
হয়।
হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত
কেউ তার
পাশে এসে
দাঁড়াবে। হাতে
হাত জড়িয়ে
তারা ফুটপাথের
এপ্রান্ত থেকে
ওপ্রান্ত হেঁটে
যাবে। নিজেদের
কথা একে
অপরকে সুধোবে।
এমন স্বপ্নে
সে বিভোর
হয়। কড়া
রোদ, মানুষের ঘাম, বাঁশির উচ্চচড়া
শব্দ সেই
স্বপ্নের শব্দগুলোকে
আটকাতে পারে
না।
"আলোর নিচে যে
আঁধার খেলা
করে
সে আঁধারে..."
তৃষা আর তিথী
পাশাপাশি বটমূল
থেকে আরো
খানিকটা দূরে
দূরে হাঁটছিলো।
রোদষী তাদের
আরো একটু
সামনে। দেখা
যায় না।
হারিয়ে ফেলছে
মাঝেসাঝেই। বরং
হরেক কিসিমের
মাথার পেছনের
কালো চুল
থেকে থেকেই
দৃশ্যপট ভরিয়ে
দিচ্ছে। কালো
আবছায়ায়।
তৃষা হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।
তিথীকে হারিয়ে
ফেলেছে সে।
এত মানুষের
মাঝে ডানদিকটাতে
খুঁজলেই হয়তোবা
সুবিধা হবে।
এমনটা মনে
করতেই পিঠের
দিকটাতে ঠান্ডা
স্রোত বয়ে
গেল যেন।
‘মা গো!’
এক টানে তার
কামিজের বোতামগুলো
ছিঁড়ে গেলো
ফড় ফড়
করে। ভেতরের
ব্রা ধরে
কেউ যেন
টান দিতে
থাকে অনবরত।
‘তিথী!
রোদষী! মাগো!’
তৃষা ঘুরে দাঁড়াতে
গেল। ওদিকে
পাশ থেকেই
বড় সড়
অবয়বের লোকটার
ধাক্কায় একেবারে
মাটিতে পড়ে
গেলো সে।
তার উপর
দুটো হাত
একেবারে জাপটে
ধরে রেখেছে
যেন।
কে যেন খামচি
দিচ্ছে পিঠে।
সামনের দিকেও
হাত সরসর
করে আসছে
যেন। সে
আরো শক্ত
করে মাটিতে
সেঁধিয়ে যেতে
চায়। না! কোনভাবেই সে
সামনের দিকে
হাত আসতে
দিবে না।
কোনভাবেই না।
‘আব্বু! অই যে অই লাল রঙ্গেরটা! বাঁশিটা
কিনব! প্যাঁ পোঁ!’
‘ভাইয়া,
লইয়া যান।
লইয়া যান।
দশ টাকা, দশ টাকা’।
"এসো হে বৈশাখ, এসো এসো!
তাপস নি:শ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা
দূর হয়ে
যাক যাক
এসো এসো।"
বটমূলের ওদিক থেকে
ভেসে আসে
গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বের
গমগমে স্বর,
‘আজ আমরা নববর্ষের
প্রেরনা ভুলতে
বসেছি। আমাদের
দরকার আরো
উদ্যম। আরো
শক্তি। এ উদ্যম, শক্তি জোগাতে
পারে কেবল
তরুণরাই। তাই
তরুণদের প্রতি
আমার আহ্বান, তোমরা নববর্ষের
জয়গানে মিলিত
হও। নৌকার
হাল তোমাদেরই
টানতে হবে।‘
।। ৪ ।।
লিপু ওসব শোনে
না। একটু
আগেই মোটাসোটা
মানিব্যাগ হাতড়ে
পেয়েছে সে।
মোটাসোটা বেড়ালের
মোটা সোটা
থলি। খানিকক্ষণ
দাঁড়িয়ে লেবুর
শরবত খেলো
সে। ওটার
ভেতর স্যালাইনের
খানিক চিমটে
থাকায় আরো
জোশ এসেছে
মনে। শরবতের
দাম দিতে
গিয়ে একবার
ভাবলো, এর দাম
তার মানিব্যাগের
দামের তুলনায়
কিছুই না।
‘ওই ভালা মানুষের
পোয়া! দাঁড়ায় দাঁড়ায়
কি খাস
এগুলা! মুরগী খাওয়াব
তোরে’।
মুরগীর কথা শুনে
চকচক করে
উঠলো লিপুর
চোখ দুটো।
‘কন্ডে?’
‘এইদিক দিয়া আয়।‘
সলিমের পেছন পেছন
সে ভিড়
ঠেলে এগুলো।
মাঝে মাঝেই
সলিমের মাথা
হারিয়ে যাচ্ছে।
আরো একটু
খুঁজে নিতে
চাচ্ছে। কই
রে কই! দোকান টোকান
তো এদিকে
নাই। এদিকে
গানবাজনার দিকে
সলিম টানতেসে
ক্যান?
প্রশ্ন করে মনে মনে।
‘এইখানে খাড়া। দ্যাখ
কি কইরা
মুরগী খাইতে
হয়।‘
লিপু একটা পাথরের
বেঞ্জির ওপর
দাঁড়ায়। বেঞ্চি
ঠিক না।
পাথরের ঢিপি
একটা। প্রবেশ
গেটের এক
পাশে বসিয়ে
দেওয়া হয়েছে।
সে দেখে
সলিম সুরসুর
করে ভিড়
ঠেলে এগিয়ে
যাচ্ছে। তারপর?
ওইদিকে সে মুরগী
কই পাবে?
ওই দমবন্ধ করা
ভিড়ের ভেতরই
বাঘের মতো
সলিম ঝাঁপ
দেয় একটা
মহিলার দিকে।
মহিলার হাতে
ধরা একটা
বাচ্চা। কিন্তু
বাচ্চা আছে
তো কি
হয়েছে? রং করা
মেকআপ ওয়ালা
মুখের সাথে
সলিমের কি
সম্পর্ক? অতকিছু লিপু
বুঝে না।
মহিলার ব্লাউজ
ছিঁড়তে দেখে
লিপু। ভেতরে
হাত সেঁধিয়ে
দেয় সলিম।
কোমর জড়িয়ে
কিছু কায়দা
করবার চেষ্টা
করে। লিপু
দেখে। ভালো
করে দেখে।
অত ভিড়ের
মধ্যে মানুষজন
ওই দূর্ঘটনা
লক্ষ্য করে
না। কাপড়
ছিঁড়ে গেছে, বাচ্চাটাকে ধরা
অবস্থায়ই মহিলাটা
দু একটা হাতের
প্রতিরোধ করার
চেষ্টা করে।
সলিম চালাকচতুর।
পিছলে পিছলে
যায়। শেষমেষ
ভালোই মজা
লুটে। লিপুর মাথা
শ্রদ্ধায় দুই
ইঞ্চি নিচে
নেবে গেল।
আহ! এই না
হলে গুরু! সলিমকে কার্যসিদ্ধি
করতে দেখে
তার বুক
কেমন যেন
ধড়ফড় করে
উঠলো। বাচ্চাটা বোধহয়
একটা ছেলে।
চিৎকার করে কাঁদতে
শুরু করেছে।
মানুষগুলো কেমন
যেন কানা।
অন্ধ লোকের
দৃষ্টি থাকে।
এদের দৃষ্টি
বটমূলের দিকে
আর নিজের
দিকে।
লিপু ভালো করে
দেখে। শিহরন
খেলে যায়
শরীরে। লাফ
দিয়ে নামে।
বাচ্চাটা তখনো মহিলার
হাত থেকে
ছুটে যেতে
পারে নি।
ক্রমাগত কেঁদে
যাচ্ছে। দুইজনেই।
।। ৫ ।।
ওইটা কেমন হবে? ভালো ঘরের মেয়ে
মনে হয়।
না। এইটাকে
নেওয়া যাবে
না। ভালো
দাঁও দিতে
হবে। প্রথমেই
ধরা খেয়ে
গেলে লজ্জার
অন্ত থাকবে
না। লিপুর
মনে পড়ে
যায় প্রথম
পকেটমারার স্মৃতি।
সেটা অবশ্য পকেট
ছিলো না।
ছিল মেয়ে
মানুষের পার্স।
ভেতরে অনেককিছুই
বাগিয়েছিলো সে।
এক জোড়া ইয়ার
রিং, একটা স্যামসাং
বড় স্ক্রিণওয়ালা
ফোন, এক বান্ডিল
টাকা।
মুখে আবার হাসি
ফোটে লিপুর।
এই পেছন থেকে
এই মেয়েটাকে
ধরা যায়।
শ্যামলা গড়নের
ওপর হলুদ
কামিজ মানিয়েছে
বেশ। চেহারা
দেখতে পাচ্ছে
না। তাতে
কী! সলিমের মতো
পেছন থেকে
সেঁধিয়ে দিলেই
হয়। রাসেলও
একটাকে বাগিয়েছে।
সে বসে
থাকবে কেন?
এদিকটাতে ভিড় আরো
বেশী। মানুষজন
যেন সব
উদভ্রান্ত হয়ে
গিয়েছে আনন্দের
চোটে। একটা
মেয়েকে সে
খাচ্ছে না
কি করছে
এসব দেখার
সময় আছে
কারো? সময় না
থাকলেই ভালো।
লিপু ধীরে ধীরে
ভিড় ঠেলে
মেয়েটার দিকে
ঘাগু শিকারীর
মতো অগ্রসর
হয়। পরনের
পোশাক আশাক
অত ভালো
পরিবারের না।
বোঝা যায়।
কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর
কুঞ্জের মেয়েগুলো
থেকে ভালো
গড়ন।
এই সুবিধে! নিচা পরিবার
হলে ক্ষতি
টতি হলেও
কোন সমস্যা
নাই। চেঁচামেঁচি
করতে পারবে
না।
শিকারের চেহারা দেখতে
বাঘ বড়
উশখুশ করে।
শিকার যে
উল্টোমুখে ঘুরে
আছে! বাঘ একাগ্রদৃষ্টি
দিয়ে চোখে
চোখে রাখে।
সময়ের অপেক্ষা
করে।
শিকার হেলছে, দুলছে, হাঁটছে। ঘাড়ের
কেশর চকচক
করতে বাঘের
জলপাইরঙ্গা
চোখও চকচক করে উঠে।
শহুরে বাঘ এক
মুহূর্ত ভাবে।
ওরকম গড়ন
কি সে
এর আগে
দেখেছে? কখনো এরকম
মাংসল শিকার
হাতের কাছে
পেয়েও ছেড়ে
দিয়েছে? হলুদ রঙা
চামড়াওয়ালা দোপেয়ে
কখনো সামনে
এসেছে বলে
তো মনে
পড়ে না।
ওসব চিন্তা
শেষ মুহূর্তে
করা যায়
না। ঝেড়ে
ফেলে ক্ষণিক
পরেই। রোজ
রোজ একই
মাংস থেকে
নতুন মাংস
পাবার নেশা, উত্তেজনা তার
মস্তিষ্ককে গরম
করে দিয়েছে।
নতুন কিছু
ভাবতে চায়
না।
সময় ফুরোলে এইবার
শহুরে বাঘ
সন্তপর্ণে এগোয়।
এক লাফে ঝাঁপ
দেয়। কামড়
বসিয়ে দেয়
হরিণের ঘাড়ে।
হরিণ চমকে উঠে।
বাঘের দাঁত আরো
শক্ত করে
বসে যায়
হরিণের ছোপ
ছোপ রঙা
ঘাড়ে। হরিণ
ডাক ছাড়ে।
বাঘ শুনে
না। থাবা
লাগায়ে দেয়
পিঠ বরাবর।
দুই দুইটা
শক্ত থাবা
শিকারকে বাঘের
মুখের দিকে
ঘুরিয়ে দেয়।
শিকারের গন্ধে, গায়ের গন্ধে, শ্যাম্পু করা
চুলের গন্ধে
ততক্ষণে বাঘ
বিভোর। বাঘের চোয়াল ঝুলে
পড়ে। দাঁত
খসে যায়।
থাবার নখগুলো
চুরচুর হয়ে
মাটিতে ছড়িয়ে
ছিটিয়ে পড়ে।
হরিণের দৃষ্টি বাঘের
ওপর। বাঘের
দৃষ্টি হরিণের
ওপর।
বাঘ পেছনের দিকে
দৌড় দেয়।
ততক্ষণে বাঘ
ছোট হতে
হতে বেড়ালে
পরিণত হয়েছে।
বাঘ কিংবা
বেড়াল পালিয়ে
বাঁচে।
।। ৬ ।।
লিপি আবার চোখ
বোজে। একমনে
সে কল্পনা
করার চেষ্টা
করে। সেই
নদী তীর।
যেখানে সরকারি
তার আর
দাদার। দাদা
তুই কই?
লিপি দৌড় দেয়
বটগাছের দিকে।
দাদা দাদা! গাছের উপর
বসে আছিস
তুই? একটু দেখা
দে না।
দাদাকে সেখানে না
পেয়ে মরা
নদীর মরা
পাড়ের দিকে
দৃষ্টি দেয়।
এক দৌড়।
কালো কালো আবছা
বস্তুটি সেই
ঘুড়িটার। কালো
ঘুড়ি। তার
আর দাদার
কালো ঘুড়ি।
লিপির ঠোঁট খুশিতে
ঝিলমিল করে
ওঠে। কিন্তু
দাদা কই?
দাদা তুই ফির্যা আয়
না? এইখানে আমি
একা দৌড়ামু
ক্যান? ঘুড়ি লইয়া
খেলুম কার
লগে? বটগাছত নিয়া
যা না
আমারে?
লিপির চোখ থেকে
ফোঁটা ফোঁটা
পানি কল্পনার
নদী আর
কল্পনার সরকারকে
মিলিয়ে দিতে
থাকে আস্তে
আস্তে। তার
নদী হারায়, বটগাছ হারায়, ঘুড়ি হারায়। সে
ঘুনধরা খাটের
চৌকির ওপর
বসে বসে
একমনে কাঁদে।
ধার করে আনা
হলুদ জামাটিও
কাঁদে।
লিপির অশ্রুজলে ভিজতে
থাকে।
ওটা তার কোলের
ওপর রাখা’।