30 May 2016

সুলতানা শিরীন সাজি


বাঁচলে জীবন
কিভাবে পুড়ে যাচ্ছে দেখো সব।
গাছ পুড়ছে
ফুল পুড়ছে
স্মৃতি পুড়ছে।

আমরা পালাচ্ছি।
ঘরথেকে দুরে
বাঁচবো বলে
হাসবো বলে।

বাঁচলে জীবন ঘর লাগে।
ঘরের ভেতর পর লাগে।
পরের সাথে জ্বর লাগে।

বেঁচে থাকলে একদিন আগুন থেকে বের হয়ে আসে 
শু্দ্ধস্বরের প্রাণ।
শুধুমাত্র বেঁচে থাকলেই একদিন কাক ডাকা ভোরে
তোমার সিঁথানে আমার ঘ্রাণ।





বেহিসাবী ভালোবাসার জীবন
জীবন এমনি।
জীবন হলো ঝিরঝির বাতাসে দোলা সবুজ পাতার দোল।

তোমাকে বলছিলাম না ? বাঁচো।
ভালোলাগা যা কিছু গুছিয়ে নাও ব্যাগের ভিতর।
তারপর হাঁটতে শুরু করো।
সত্যিকারের ভালোবাসার কাছে পৌছাতে কারো কারো পুরো জীবন কেটে যায়।

সত্যি!
সত্যি জীবন এমনি।
শিশিরের মত টুপটাপ ঝরে যাওয়া দিনের দিকে তাকিয়ে দেখো।
কিছু থাকেনা বাকি।
কিছুই কি থাকে বলো আর?
এই যে পাতাবাহার,
ফুল,পাখিদের নিয়ে ভালোলাগা মূর্ছণা।
ফুলেদের দিকে তাকিয়ে দেখো।কাল ছিল ।
আজ শুধু সুরভীটুকু বাকি।
আজ শুধু ঝরা পালকেরা বিষাদ ছড়ায় বাতাসের কানে কানে।

কিছুই থাকেনা আর।
শুধু ফিরে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে ব্যাকুল চোখ।
ভালোবাসা জেগে ওঠে তারপর।
অনেকদিন চলে গেলে আবারো বিষাদের কাছে ফিরে আসে চোখ।

ভালোবাসা বেহিসাবী ভালো।
ভালোবাসার কাছে বারবার ফিরে আসা ভালো।
ভালোবাসায় অবহেলা জুড়ে গেলে
পাখিরা উড়ে চলে যায়।
ফুলেরা ঝরে যায়।
আর-
চোখের নদীতে জমা হয় চিরকালের শ্রাবণ!





অন্তপুরের বেড়াল
(যার জন্য প্রযোজ্য)

ঘুমহীন চোখ বেড়াল
চেয়ে থাকে অন্তপুরের দিকে।
হৃদ্যতা হলোনা তার সাথে।
ও হলো বন্ধুর পোষা বিড়াল।
তোমার বাড়ি বেড়াতে এসে অবধি
শান্তি পায়নি একতিল।
তোমার বাড়ির পোষা খরগোস ও স্বস্তিতে নেই ।
ভালোবাসার ভাগ দিতে মানুষ পারেনা 
আর বিড়াল বা খরগোশের কি দোষ!
কুড়ি বছর পরেও  ভালোবাসা বুকের ভিতর প্রতিদিন পুষে রাখে যে মানুষ।
তাকে নিয়ে কষ্ট পেয়োনা।
বিড়ালের চোখের মত
তার চোখেও প্রার্থণা ঝরে।
আদর এর কাঙালপনা শুধু বিড়ালের নয়।
মানুষেরও হয়।

দুর থেকে দুরে আরো বহুদুরে যেতে যেতে যেতে
ভুলে যেতে যেতে যেতে আবার ফিরে আসে মানুষ
অন্তপুরের বেড়ালের মত,
চুপিসারে!
তাকে আদর দিও।
তাকে প্রেম দিও। প্রিয় মানুষ!




কতদিন পর আবার তুমি এবং আমি
কতদিন পর আবার কুয়াশামাখা ভোর! ঝুমতলিতে দেখা হবার পর কেটে গেছে কত দিন! রেলষ্টেশনে রেলগাড়ি থামলো যখন,আকাশ তখন সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে। ষ্টেশন বিল্ডিংটার দিকে তাকিয়ে ছবিতে দেখা পিওনগিয়ান ষ্টেশনতার কথা মনে এলো। প্লাটফর্ম এ এ নেমে সামনে এগোতেই দেখি তুমি এগিয়ে আসছো। লম্বা একটা ওভারকোট পড়েছো,মাথায়-কানে বাদুর টুপি। মনে ভাবি,দেশটা কি রাশিয়া হয়ে গেলো নাকি? হাত বাড়িয়ে দিলে তুমি।হাতের উষ্ণতা ছড়িয়ে গেলো হৃদয় পর্যন্ত।

প্লার্টফর্মের এক কোণে বসলাম আমরা। দূরে চায়ের দোকান থেকে দু'কাপ ধোঁয়াওঠা চা আর একটা প্লেটে কয়েকটি বাকরখানি দিয়ে গেলো একটি কিশোর ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে গেলাম আমি। অদ্ভুত মায়াময় এই মুখ আমি আগেও দেখেছি।নিমেষেই মনে পড়ে গেলো। এর সাথে দেখা হয়েছিল সেইবার, তোমার সাথে যে'বার গৌহাটির সরাইঘাট ব্রীজ এর কাছে ষ্টিমারে এ দেখা হলো।
দোল পূর্ণিমার রাত ছিলো সেটা। একটা ছেলে জাহাজের ডেকে বসে অদ্ভুত সুন্দর বাঁশি বাজিয়েছিল।
বাঁশিবাদককে দেখবো বলে ওর দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম। মগ্ন কিশোর চোখ মেলে তাকায় আর নিমেষেই মাথানীচু করে চোখের আড়ালে চলে গিয়েছিল।
অবাক আমি ফিরে আসি কথাটা তোমাকে বলতে। অথচ কোথায় তুমি!

গতবার তোমার সাথে দেখা হলো প্যারিসের ডাউন টাউনে উইলিয়াম আর গ্রান্ড্ররিভার এর কর্ণার এর কফি শপটার কাছে। মন বলছিলে তুমি আসবে। রাস্তার পাশের একটা কফিশপের চেয়ারে বসে একটা স্কিনি ক্যাপাচিনোয় চুমুক।
বজ্যু মাদমোয়াজেল,চমকে তাকিয়ে দেখি তুমি।
তুমি কি ইলুউশনিষ্ট মুভ্যির নায়ক এর মতন ম্যাজিশিয়ান?
তোমার অদ্ভুত চোখের দিকে তাকালে কোন কথা বলতে পারিনা। অথচ কত প্রশ্ন,কত কৌতূহল! 
তুমি বললে,চলো হাঁটি।
তোমার পাশে হাঁটার সময় আমার খুউব ইউক্যালিপটাসের কথা মনে হয়।
তুমি প্রশ্ন করলে,সবুজ পাতার গন্ধ পাচ্ছো?
তোমার দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ঢুকে পড়লে একটা গিফট শপ এ।
আমরা অজস্র প্রজাপতির ভীড়ে হারিয়ে গেলাম। এই দোকানের সবকিছুতেই প্রজাপতির ছাপ!
একটা রুপালী ব্রেসলেট কিনলাম তোমার জন্য। তোমাকে হাত এ পড়িয়ে দেবো বলে সারা দোকানে তোমাকে খুঁজি তন্ন তন্ন করে ।কোথাও তুমি নাই! অথচ পুরো দোকান জুড়ে তখনো ইউক্যালিপ্টাসের গন্ধ!

তুমি কি সত্যি কখনো ছিলে আমার সাথে অথবা তোমার সাথে আমি?
আমি কি তোমাকে চিনি অথবা তুমি কি আমার চেনা? এভাবে কতবার তোমার সাথে লুকোচুরি দেখা হওয়া ক্ষণ?

দোল পূর্ণিমার বিশাল চাঁদটাকে দেখলেই তোমার কথা মনে পড়ে। অথবা ভীষন ভীড়ে মাঝে একলা হলে। মনে হয় তুমি আছো,কাছাকাছি কোথাও! হয়তো গীটার হাতে পথের ধারে দাঁড়িয়ে স্যাম হান্ট এর মত করে অদ্ভুত সেই গানটা “টেইক ইয়োর টাইম” গাইছো।
হয়তো একদিন ঝুম বৃষ্টি নেমেছে বাফেলো শহরে। আমি সৌখিন পর্যটকের মত ঘুরছি। ছবি তুলছি। তুমি একমনে বসে কারো ছবি আঁকছো। যাযাবর মনটা  আমার এভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছে তোমার পিছে পিছে। আর তুমি পরিযায়ী পাখির মত উড়ছো এক আকাশ থেকে অন্য আকাশ!
হয়তোবা তুমি হেঁটে হেঁটে আমায় খুঁজছো নেপালের ভূমিকম্প বিধ্বস্ত কোন গ্রামে।  আর আমি  হয়তো অদ্ভুত সুন্দর শাদা ফুলের বাগান থেকে বের হয়ে আসছি। যেনো এখানে কোন বিপর্যয়ই ঘটেনি ।আমি অবাক তাকিয়ে তোমাকে দেখছি।বৌদ্ধ ভিক্ষুর মত দেখাচ্ছে তোমাকে। আমি তোমার জন্য একগোছা সাদা ফুল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।
বেঁচে থাকার অদ্ভুত খেয়ালীপনায় কেউ কেউ হয়তো এভাবেই বেঁচে থাকছি আমরা।

কখনো স্বপ্নতে, কখনো সত্যিতে, কখনো শাদা ফুল মূর্ছণায়!

বৃতি হক


একটি হারিয়ে যাওয়া সবকিছুর তালিকা, বিজ্ঞপ্তি নয়

মেঝেয় বসে পা ছড়িয়ে শক্ত ঝুঁটিদুটো বেঁধে 
ঝাঁপি যখন উপুড় করে
 
খুব ঝাঁকিয়ে
 
পৃথিবীটা বাইরে আনি
 
জানি, আর এ মনই জানে-
হারিয়ে গেছে পাঁচটি তারা, তেপান্তরের 
মাঠটি আমার, বুনোফুলের গন্ধমেশা সাতটি ভুবন।
হারিয়ে ফেলায় ভীষণ পটু, হারিয়েছি আমার ঢাকা (শুধুই ঢাকা, এক মহাদেশ বলতে পারো),
লালচে চুলের ঝিলিকমাখা এরিয়েলের স্বপ্নচোখে সাগরতলে 
মুক্তো খোঁজা, মামদোভূতের ভয় দেখানো ভাইয়ের হাসি,
 
রুমালচোরের সইগুলো সব, রূপকথা এক- অবিনাশী,
 
বারবি পুতুল,
 
সিন্ডারেলা কাঁচের জুতো, টম সয়্যার আর
 
হাকলবেরি ফিনের সাথে সন্ধিশেষে আমার অধীন রাজ্য যতো,
 
লালাবাইয়ের মন্দ্রঘোরে সুরেসুরে আঁধারবন্দী রাত্রি মুছে মায়ের হৃদয়ছোঁয়া চুমু।
বাবার সাথে তাসপেটানো একটি দুপুর,চায়ের আমেজ, সবুজছায়ায় দোলনাচেয়ার, 
একটি পুকুর, হিমসকালে ভাপা পিঠার নরম মোহ, বাদলাদিনের আড্ডাশেষে
 
সর্ষে ইলিশ আর খিচুড়ী, তাথৈ নাচের ছন্দ রুয়ে ঘুঙুর পড়ে
 
আকাশ ছুঁয়ে বৃষ্টি আনার দিনগুলো সব,
 
রংধনু এক,
 
আড়ং কিংবা রাপা প্লাজায় রূপোর দুলের অলকঝরায়
 
দীঘল চুলের অরণ্যতা, বনলতায় নিজকে দেখা, পাখির নীড়ের
 
চোখটি তুলে সেই তরুনের প্রতীক্ষাতে দোদুলমনের প্রশ্নরেখা...কোথায় ছিলেন?
হারিয়েছি মাতালপ্রহর, চৈত্রদিনের শুষ্কখরায় তোমার পরশ, স্নিগ্ধ আবেশ, 
আমার জারুল চোখের ছায়ায় তোমার বসত, চৌরাসিয়ার
 
বাঁশির সুরে তোমার সাথে ভুবনপাড়ির তীব্র নেশা,
 
বুকের ভেতর ধুকপুকে এক নষ্ট কাঁপন,
 
একটি চিঠি-
 
নীলচে সুরের মূর্ছনাতে অজানা সেই কষ্ট শুধু,
 
নিঝুম রাতের কান্নাভেজা প্রিয় বালিশ, স্বপ্ন দেখার স্বপ্নটুকু,
 
তোমার বুনোগন্ধমাখা খামের ভেতর শুকনো ফুলের পাপড়ি ছুঁয়ে তোমার ছবি,

আর তোমাকে।

রিক্তা চক্রবর্তী



আনন্দধারা
অ্যাকাডেমিতে চিত্রকলার এক্সিবিশন
অচেনা সময় জুড়ে মানদন্ডের রেষারেষি
আক্রোশী খুনজখমে ইতিকথার মৃত্যু
___

জীবন জুড়ে বৈরিতা
ঘৃণার লেভেলে এভাবেই ষোলকলা পূর্ণ
___

"আনন্দধারা বহিছে ভুবনে
দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি
যায় অনন্ত গগনে॥
পান করি রবে শশী অঞ্জলি ভরিয়া
-সদা দীপ্ত রহে অক্ষয় জ্যোতি"
___

বসন্তের শহরতলি তে
মারনাস্ত্রের পরাজয় , মুগ্ধতার জয়



ব্যাসার্ধ
তেমন কোন পূর্বাভাস ছিলোনা
প্রতিদিনের অভ্যাসবশত কবিতা লিখতে বসেই
চোখ গেলো আকাশের দিকে
____
কবিতা বুঝিনা আমি
বুঝি, বিষণ্ণ নীলাকাশ জুড়ে ডার্ক সার্কেলের আঁকিবুঁকি
বুঝি, শিমুল পলাশের ঝরে পড়া স্কেলিটন জুড়ে
প্রকৃতি খেলা করে
____
হেমন্তের ফসল, শালিক চড়ুইয়ের খুনসুটি
রাতের উজ্জ্বল তারা, অভিমানী জোনাকি
কবিতার খাতায় রূপোলি ঝিনুক খেলা করে
____
কবিতা বুঝিনা আমি
শুধু বুঝি, সব শূন্যতার ছবি আঁকা যায়না
কেঁপে যাওয়া স্বরও কলমের সহায়তায়
আদুরে কবিতা হয়ে ওঠে



অপরাজিত
ইচ্ছে-কথার মৃত্যু
চেষ্টা করেও আজকাল আর লিখতে পারি না
অন্ধ সময়
চেষ্টা করেও আজকাল আর পড়তে পারি না
____
আক্রোশী জীবনের প্রতিনিয়ত খুন-জখমে
পড়াশোনা, লেখালিখি প্রায় বন্ধ
____
বসন্তের পলাশ রঙ মেখেই
২১ শে ফেব্রুয়ারী এলো-
মধুমতী এ মাসের সমস্ত অনুভব মেখে , ভালবেসে
ভাষা দিবস পালন করি
____
তবু দেখো
অভিযোগে , হাহুতাসে , অনুযোগে
'বাংলা' ভুলে গেছি
____
অথচ-

সকাল গড়ায় চৌরাস্তার সূর্য -বন্দনায়
আমার কাছে 'বাংলা ভাষা' বেঁচে থাকে অপরাজিত প্রনামে

সুজয় চক্রবর্তী



ওরা

-কার সাথে শুস? আমারে আর ভালো লাগে না?
-কি যা তা বলছো! ছেলে রয়েছে পাশের ঘরে।
-যা তা? আমি গায়ে হাত দিলে তোর কাঁপন ধরে না! সব রস মিটে গেছে?
-ছেলে বড়ো হয়েছে। আজ বাদে-কাল উচ্চমাধ্যমিক দেবে। তোমার কি লজ্জা নেই?
-লজ্জা? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা।
কোনও রকমে ঘষটে ঘষটে বাইরে বেড়িয়েছে সে। বুকের কাপড়টা সরিয়ে বোধনের মা’কে দেখিয়েছে। কামড়ে, আঁচড়ে ক্ষত-বিক্ষত করে দেওয়া জায়গাটায় হাত বোলাতে বোলাতে সে বলেছে, "আচ্ছা মাসিমা, স্বামী কি ধর্ষক হতে পারে?"

উত্তর দেয়নি মাসিমা। শুধু বলেছিল,"তোর চিকার করা উচি ছিল বন্দনা। মেয়ে মানুষের চিকারে 'ওরা' ভয় পায়।"

29 May 2016

রুমী ইয়াসমীন




তুমি রোজ আসো আমার দুঃখের কাঁচ জানালার ঐ প্রান্তে
সুখ মন্ত্রের পেয়ালা হাতে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকো রাত্রিময়!
 
আমি বিমর্ষ হয়ে তাকিয়ে কেবলই দেখি তোমায়
তুমি এক এক করে উন্মোচন করো তোমার বাহাদুরি।
 
এ দিলে বুঝি তুমি শুভ্র বাতাসের মন্ত্রের পরশ!
আমার কাঁচ জানালা যে বড্ড বেসামাল
তবুও চির অটল হৃদয়; বুক ফাটেতো মুখ ফোটেনা...
 
এরপর এই দিলে বুঝি বৃষ্টির মন্ত্র!
 
শুদ্ধতার অবগাহনে পোড়ানো ক্ষতও বাড়ে দ্বিগুণ...
 
নিভে না যে তোমার মন্ত্রের বারি ঝড়ে!
 
তারপরও মন্ত্র পেয়ালা হাতে কেন ঠাঁয় থাকো দাঁড়িয়ে?
 
আমার কাঁচ জানালা যে নিরবে পুঁড়ে হবে অঙ্গার!
 
তুমি কি বুঝনা! একটুও না?
 
আর কতো পোড়ালে যে গলবে কাঁচমন!
 
তাতো তুমি জানবে না কভুও...
 
কতোটা নিবিড় করে যে ভালোবাসি তোমায়!
 
রোজ তিমির অন্ধকারেও দেখাও তুমি মায়াময় মন হরণকারী জোছনা ;
 
আমার কাঁচ জানালার দেয়ালে তা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ে!
 
তবুও কি তুমি বুঝবেনা; তোমার সুখ মন্ত্রের পেয়ালায়
 
আমার কাঁচ জানালা যে বড্ড বেসামাল!
 

28 May 2016

তৌকির হোসাইন


বৈশাখের বাঘ কিংবা বেড়ালের গপ্পো

।। ।।

দাদা, দেখ দেখ! কত্ত বড় ঘুড়ি!’
কই রে পাগলি? কই?’ 
ওই যে ওই গাছটার উপরে দেখ!’
তারা দৌড় লাগায়। হাত ধরে। খুব জোরে। সময়কে পাল্লা দেয়। হার মানবে নদীর সচ্ছ স্রোত। একটা সময় হাঁপাতে হাঁপাতে বটগাছের লম্বা জটার একটার নিচে তারা এসে দাঁড়ায়।
দেখসস কত বড় ঘুড়ি?’
খাড়া আমি লইয়া আনি।
এই বলে লিপু শতবর্ষজীবী গাছের মাঝে সাঝে জেগে ওঠা ফোকড়গুলোতে সদ্য কৈশোর পেরুনো শক্ত পা দিয়ে দিয়ে বাঁ দিকের একটা শাখাতে চড়ে বসে ওইতো ওদিকেই! হাত বাড়ালেই পাওয়া না পাওয়ার আশা ফুরোয়।
হাতখান বাড়ায় দে দাদা!’
না! এইডা হাত দিয়া অইব না।
লিপু এক পায়ে ভর করবার সাহসের মনস্থির করে নেয়
যা হয় হোক গা! আল্লাহ সাহায্য কইরো
লিপু হাত ধীরে ধীরে বাড়াতে থাকেএক পায়ে ভর। আরেক পা প্রায় শূণ্যে দুলছে
আয়রে চাঁদ! চাঁদ আয় নাগালে
নিচে দাঁড়িয়ে থাকা লিপি চোখ ঢাকে

খরস্রোতা নদীর বয়স হয়েছে। ভারী বয়স। কুঁজো হয়ে গিয়েছে। চলাচল করতে পারে না। কথা বলতে পারে না। ভগ্নদেহের একটা ফিতার মতো পানির স্রোত বইয়ে দিয়েছে মাঝ দেহ বরাবর। তা দেখে পাড়ে বসে থাকা লিপু আর লিপি উপহাস করে। হাসে। নদী চুপচাপ শুনে। কষ্টগুলো ভেতরেই রেখে দেয়। বড় হতে থাকে ভ্রূণীয় সন্তানের মতো

‘ওই! কালা রংটা এক্কেরে খারাপ না। কি কস?
‘কিন্তু দাদা এই জায়গাত ঘুড়ি কইত্তুন আইলো তো? এইখানেত  সরকারি তো আমার আর তোর? তাইলে?
আঠারোতে পা দেওয়া লিপু দাদাসুলভ কাঁচা গোফ গজিয়ে ওঠা নাকের নিচে আঙ্গুল বুলিয়ে কিছু একটা ভাববার চেষ্টা  করে।

‘কে জানে! উপর থেইক্কা আইসে মনে লাগে
‘উপর থেইক্কা? ক্যামনে?
‘আরে বেডি চুপ থাক। ঘুড্ডি দেখসস? কত্ত বড়! দুই হাত অইব কমসে কম
চল উড়াই

লিপু কালো ঘুড়িটার লেজ ধরে থাকে। লিপি ধরে সামনের মাথা। দেখে সুতা নেই। তাতে কি! সে হাত বাড়ায়। একটা নাটাই আসে। লিপি আবার হাত বাড়ায়। এবার এক বান্ডিল কালো সুতা। আবার হাত মেলে ধরে। ঘুড়ি আসে। লিপু সুতো গুটায়। মাঞ্জা মাখায়। 
লিপিকে বলে, ‘ওই দিকটা ধর

নাটাই এর সুতো টানটান করে নিয়ে যেতে যেতে নদীর পাড়ের মরা প্রান্তে এসে থেমে যায় লিপু
ছাড়! ছাড়!
ফুড়ড়ড় করে উপরের দিকে উঠতে থাকে ঘুড়ি। 

ঘুড্ডি ওড়! ওড়!
লিপি খুশিতে হাততালি দেয়। লাফায়
ফুড়ড়ড় করে আরো কয়েক ফুট উপরে উঠে যায় ঘুড়ি
বেডি বেশী লাফাইস না। খাড়া। আরো উপরে তুলুম
নদীর সরু মরে যাওয়া পাড়ে দুটো ছায়া ঘুড়ি ওড়ায় আর লাফায়!

।। ।।

টং এর বেঞ্চিতে বসে সিগারেট টানে লিপু। মাত্র শিখেছে। পাশের বস্তির ফজলুর মতো রিং ছাড়তে পারে না ওভাবে। তবু চেষ্টা করে
লিপু মহা বিরক্ত। ঘরের মধ্যে আচালি ক্যাঁচাল দিনকে দিন অসহ্য হয়ে ঠেকছে। ঘর বলতে এক মা আর এক বোন। বোন আর ভাইয়ের সম্পর্ক অটুট রাখতে দুজনের নামের মধ্যে যে স্থূল মিলটি পাওয়া যায় তা লিপুর কাছে বিরক্তিকর। আজকের বৈশাখ সবকে অজুহাত ধরিয়ে লিপি এখন মেলায় যাবে। টাকা চায়। লিপু এসব খুব ভালো বোঝে। টাকা চাওয়ার ফন্দিফিকির। সকালে এই নিয়ে দুই চারটা শক্ত শক্ত কথা শুনিয়ে দিয়ে এসেছে। মাথার পেছনের চুল ধরে থাপ্পড়ও কষিয়েছে একটা। পেছন থেকে মা এসে শুরু করে গালিগালাজ
লিপু কাঠের নড়বড়ে বেঞ্চিতে বসে মনে মনে মাকে গাল পাড়ে

গালিগালাজ শিখসে! টাকার গাছ লইয়া ঘুইরা বেড়াই তো আমি। জামা পিইন্দা পিইন্দা ঘুর তুই। মানা করসি আমি। আমার কাছে ক্যান। ধিঙ্গি ছেমড়ি কয়েক ঘরের বেড়াতে গিয়ে বস না। লোকজন তোরে দেইখ্যাই টাকা দিয়া দিব
পিচ করে থুথু ফেলে মাটিতে
‘কিরে লিপু, বইসা বইসা খই ভাজস নাকি? দে সিগারেট
হঠা উদয় হওয়া সলিম লিপুর সিগারেটটা মুখ হাত থেকে এক টান দিয়ে ছিনিয়েই নেয় বলতে গেলে। ঠোঁটে চেপে ধরে নি:শব্দে টান দেয় একটা
দোকানি বসে বসে কেটলির নিচের আগুনটাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। সলিমের দিকে তাকায়। ভয়মেশানো দৃষ্টি। 
‘বয়ামত্তুন একটা বিস্কিট দে দেখি। অই মায়ের পোলা খুল না বয়ামটা
ষোল বছরের কিশোর দোকানি দ্রুত বয়ামটা বাড়িয়ে দেয় সলিমের দিকে। নিজে খুলে না
বয়ামটা খুলতেই গোল মেটে রং এর বিস্কিটটা মুখে চালান হয়ে গেলো
‘মুখ কালা ক্যান? কিছু হইসে?
লিপু তাকায় সলিমের চোখ বরাবর। কিছু বলে না
‘না, কি আবার অইবো

সিগারেটটা দ্রুত একটানে শেষ করে ফেলে সলিম। বলে, স্টেশনের দিকে যাবি? রাসেলরা আইব
লিপু টাকা না দিয়েই উঠে দাঁড়ায়। 
‘কালকে নিস বাটলু বিস্কুট আর চায়ের ট্যাহা
সলিম আর লিপু এক বস্তিতে থাকে। পকেট মারা ওদের পেশা। পেশার থেকে অভ্যাসই এক প্রকার বলা যায়। লিপুর ব্যক্তিগত গুরু বলতে গেলে সলিমই। কিভাবে দুই আঙ্গুল দিয়ে পকেটসাফাই করতে হয়, কিভাবে চলাচলরত পথিকের বুক বরাবর ধাক্কা খেয়ে বুক পকেটের দামি কলম, পেছনের বেড়ালের থলে দুটোই সাফ করে দেওয়া যায়, কিভাবে বাসে বসে পাশের লোককে ঝালমুড়ি খাইয়ে বেঁহুশ করে দেওয়া যায় এসবে হাত পাকানোর পেছনে ভূমিকা যে একমাত্র ব্যক্তিটির তা হচ্ছে তার সামনে চলতে থাকা সলিম গুরুরই প্রায় দুই বছর থেকে সলিম লিপুকে তার কাজে সঙ্গী করে নিয়েছে। লিপুর তড়ি বুদ্ধি তার প্রিয়।

‘আজকে মাঠের অইদিক কী হইতেসেরে? জানস কিছু?
‘বৈশাখের মেলা লাগসে যে অইজন্যে
‘বৈশাখ আয়া পড়সে? এত্ত তাড়াতাড়ি
‘হ
‘মেলাত যাবি? ভালো পাবলিক পামু
পাবলিকের কথা চিন্তা করতেই একটা ক্ষীণ আলো যেন অন্তরে দেখা দিয়ে লিপুর মোহনীয় আশার জায়গাটার ঊন্মেষ ঘটায় পাবলিক মানেই টাকা, টাকা মানেই চিল্লাচিল্লি পুরোপুরি বন্ধ হওয়া। সে বলে,
‘আগে রাসেলগো লগে দেখা কইরা আই?

প্লাটফর্মে পৌঁছে দুইজন রেললাইনের দিকের এক প্রান্ত ধরে হাঁটে। একটু আড়াল হতে হবে। আড়ালেই তাদের স্বভাবগত বসবাস
স্টেশনের একটা পুরোনো মালগাড়ির ওপর জনা চারেক ছেলে বসে আছে। একজনের হাতে গঞ্জিকা দন্ড। আর তিনজনের হাতে তাসের বান্ডিল। তিনজনের একজন তাদের দিকে হাত নাড়ে 
‘কিরে পলান? সক্কালেই টানতাসস? সারা দিন চলবি ক্যামনে?
‘এই পলানরে লইয়া চালাইতে পারুম না।  কাজ কামে হাত নাই। হুদাই টানাটানি। 
সলিমের মনে রাসেলের উত্তরটা খুব করে গাঁথে। নিজের ভাগটা বেড়ে যাবার আভাসে ভেতরটা কেমন কেমন করে ওঠে। রাসেলের দিকে আরেকজন তাকায়। 
‘আইজকা মাল ভালো। দুই কিসিমেরই আছে! মালও আছে, পকেটও আছে
কোন মাল সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় নি লিপুর। সে কথা ভেবে কেমন ইঁদুর মেরে যায় চোখ। কোনওদিন ওসব মাল চেখে দেখে নি সে। স্বপ্ন, কুস্বপ্ন, কল্পনা, আড়ি পাতা, দুই হাজারের মোবাইল- সেসবেই আটকে ছিলো সেসব। এখন সরাসরি প্রস্তাবে আঠারো বছর বয়েসের বুক ধড়ফড় করে উঠে। সলিম ওর দিকে ভ্রূকুটি করে
‘ওই ভালা বউয়ের পোলা। শরমাস ক্যান?’

এরপর একটা খুব শক্ত করে গাল পাড়ে লিপুর দিকে। রাসেল সবার দিকে তাকায়
‘এই গাঁজাটারে লইয়া যাওয়া যাইব না। সিস্টাম বিগড়ায় দিব অই’ 
‘ঝিম মাইরা পইড়া আছে দেখস না? পলাইন্যা! শুনতেসস
সলিম ধাক্কা দেয় পলানকে। লাল ঘোলাটে চোখ গুলগুল করে তাকায় গাঁজা। 
‘ক তো তোর সামনে কেডা খাড়ায় আছে? তোর বাপ না বউ?

গাঁজা খাওয়া পলান খুব কষ্ট করে চিন্তা করে। আকাশের দিকে একবার তাকায়। কান পেতে থাকে। গোলাপি, লাল ফেরেশতা ফেরেশতা লাগে যে! ফেরেশতা কও না? কে এইডা? আমার বাপ না আমার বউ। 
লাল গোলাপি ফেরেশতা তাকে কিছু দেখায়। পলানের মুখ হাসি হাসি হয়ে উঠে। নানাসাহেবের তেজ বুকে খোঁচা দেয়। 
‘এইডা আমার বউ
সলিম কষে একটা থাপ্পড় মারে। গাঁজা পলান উল্টে পড়ে যায়। আরেকটু হলেই মালগাড়ি থেকে সোজা নিচে পড়েই উপরে উঠে যেত। লিপু সময় সময়ে তাকে ধরে ফেলে
‘এই আকাইম্মারে এখানেই রাখ। রাসেল
মালগাড়ির উপর থেকে পাঁচটা ছেলে লাফ দেয়। পাঁচটা ছেলের গায়ে ছেঁড়া, তালি মারা সুতোর নকশা সূর্যের সাথে সাথে অত উজ্জ্বল হয়ে উঠে না। বেলা গড়াচ্ছে। সূর্যের তীব্রতা তীব্রতর হচ্ছে। সুতোগুলো আরো পুরোনো হচ্ছে
লিপু মাটিতে পড়ে যাওয়া গঞ্জিকাদন্ডে জোরে লাথি মারে।

।। ।।

‘তেলাপোকা
তৃষা চিকার দিয়ে উঠে। 
‘তেলাপোকা! পান্তাভাতের ভেতর তেলাপোকা!
পাশে বসা তিথী উঁকি দেয়। ওর চিকারে দোকান আর আশপাশের বেশকিছু মানুষ তাদের বসার কোনাটার দিকে তাকায়
‘গাধী, ওইটা লাল পোড়া মরিচের বোঁটা
‘ওইটাই। খাইতে পারব না আমি এটা। তুই খা
সামনে বসা রোদষী ভেঙ্গায়। 
‘নবাবের বেটি তিনি। লাল মরিচ দিয়ে ভাত মুখে রুচবে না। এই অকম্মাটাকে কোন দু:খে আনলি রে?
তিথী বলে, ‘অকম্মা বলিস না। অকম্মাগিরি কাটানোর জন্যেই তো আনালাম
‘এইসব মেয়ের জন্ম হয়েছে শুয়ে শুয়ে ঘুমানোর জন্যে, আর রাত জেগে প্রেম করবার জন্যে। এদেরকে নিয়ে আসিস তুই বৈশাখে? বৈশাখ নষ্ট করবার জন্যে?
নিজের মাটির হাঁড়ির তলানির পানিটুকু সুড়ু করে টেনে নেয় রোদষী। তারপর তৃষার দিকে আঙ্গুল তুলে নিজেকে দেখায়
‘এটাকে বলে বাঙালিপনা!
‘রাখ তোর ন্যাশনালিটি। আমি খাইতে পারব না এগুলো
‘সেটা তোর ব্যাপার। নিজের ইচ্ছায় খাইতে বসছিলি তুই। মাছটা কামড়ে ওঠ। আরো জায়গায় যেতে হবে
তিথী আর রোদষী নিজের নিজের পার্স থেকে টাকা এনে গুছায়। একশ টাকার নোটগুলোর পাশে কয়েকটা খুচরো পয়সা। পয়সাগুলো সরিয়ে রাখে। টাকাগুলো ভাঁজ করে। তারপর তাড়া দেয় একটু স্বচ্ছজল চোখের মেয়েটিকে

দোকান থেকে বেরিয়ে আসতে রোদষী বলে প্রচন্ড রোদের কথা। রোদ তার কথা পাত্তা দেয় না। দেয় না বাকি মেয়ে দুটিও। তারা লোকারণ্যের সমুদ্রের মাঝে হাঁটতে থাকে। তীর খুঁজতে চায়। পায় না
‘এই তিথী! ওই মাটির পুতুলগুলোর পাশেই দেখ, ঝুলন ধরা জিনিসগুলো
‘কী জানি? নাম জানি না
‘এক্সেসরিজ ঝুলিয়ে রাখে বোধহয়। চল না একটা কিনি

তৃষা, তিথী দোকানটার কাছে গিয়ে ভেড়ে। দরদাম করে দুটো পাটের থলে নিয়ে পালাপালি করে। রোদষী দাঁড়ায়। অপেক্ষা করে। মনে মনে গানের সুর ভাঁজে। 
"নোনা স্বপ্নে গড়া তোমার স্মৃতি
শত রঙে রাঙিয়ে মিথ্যে কোন স্পন্দন...

সুরের সাথে কল্পনা এসে যোগ হয়
হলুদ পাঞ্জাবি পরিহিত কেউ তার পাশে এসে দাঁড়াবে। হাতে হাত জড়িয়ে তারা ফুটপাথের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত হেঁটে যাবে। নিজেদের কথা একে অপরকে সুধোবে। এমন স্বপ্নে সে বিভোর হয়। কড়া রোদ, মানুষের ঘাম, বাঁশির উচ্চচড়া শব্দ সেই স্বপ্নের শব্দগুলোকে আটকাতে পারে না

"আলোর নিচে যে আঁধার খেলা করে
সে আঁধারে..."

তৃষা আর তিথী পাশাপাশি বটমূল থেকে আরো খানিকটা দূরে দূরে হাঁটছিলো। রোদষী তাদের আরো একটু সামনে। দেখা যায় না। হারিয়ে ফেলছে মাঝেসাঝেই। বরং হরেক কিসিমের মাথার পেছনের কালো চুল থেকে থেকেই দৃশ্যপট ভরিয়ে দিচ্ছে। কালো আবছায়ায়। 
তৃষা হঠা থমকে দাঁড়ায়। তিথীকে হারিয়ে ফেলেছে সে। এত মানুষের মাঝে ডানদিকটাতে খুঁজলেই হয়তোবা সুবিধা হবে। এমনটা মনে করতেই পিঠের দিকটাতে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল যেন
‘মা গো!
এক টানে তার কামিজের বোতামগুলো ছিঁড়ে গেলো ফড় ফড় করে। ভেতরের ব্রা ধরে কেউ যেন টান দিতে থাকে অনবরত। 
‘তিথী! রোদষী! মাগো!
তৃষা ঘুরে দাঁড়াতে গেল। ওদিকে পাশ থেকেই বড় সড় অবয়বের লোকটার ধাক্কায় একেবারে মাটিতে পড়ে গেলো সে। তার উপর দুটো হাত একেবারে জাপটে ধরে রেখেছে যেন

কে যেন খামচি দিচ্ছে পিঠে। সামনের দিকেও হাত সরসর করে আসছে যেন। সে আরো শক্ত করে মাটিতে সেঁধিয়ে যেতে চায়। না! কোনভাবেই সে সামনের দিকে হাত আসতে দিবে না
কোনভাবেই না
‘আব্বু! অই যে অই লাল রঙ্গেরটা! বাঁশিটা কিনব! প্যাঁ পোঁ!
‘ভাইয়া, লইয়া যান। লইয়া যান। দশ টাকা, দশ টাকা
"এসো হে বৈশাখ, এসো এসো!
তাপস নি:শ্বাস বায়ে
মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
সরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক
এসো এসো।"

বটমূলের ওদিক থেকে ভেসে আসে গুরুগম্ভীর ব্যক্তিত্বের গমগমে স্বর,
‘আজ আমরা নববর্ষের প্রেরনা ভুলতে বসেছি। আমাদের দরকার আরো উদ্যম। আরো শক্তি। উদ্যম, শক্তি জোগাতে পারে কেবল তরুণরাই। তাই তরুণদের প্রতি আমার আহ্বান, তোমরা নববর্ষের জয়গানে মিলিত হও। নৌকার হাল তোমাদেরই টানতে হবে


।। ।।

লিপু ওসব শোনে না। একটু আগেই মোটাসোটা মানিব্যাগ হাতড়ে পেয়েছে সে। মোটাসোটা বেড়ালের মোটা সোটা থলি। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে লেবুর শরবত খেলো সে। ওটার ভেতর স্যালাইনের খানিক চিমটে থাকায় আরো জোশ এসেছে মনে। শরবতের দাম দিতে গিয়ে একবার ভাবলো, এর দাম তার মানিব্যাগের দামের তুলনায় কিছুই না
‘ওই ভালা মানুষের পোয়া! দাঁড়ায় দাঁড়ায় কি খাস এগুলা! মুরগী খাওয়াব তোরে 
মুরগীর কথা শুনে চকচক করে উঠলো লিপুর চোখ দুটো। 
‘কন্ডে?
‘এইদিক দিয়া আয়

সলিমের পেছন পেছন সে ভিড় ঠেলে এগুলো। মাঝে মাঝেই সলিমের মাথা হারিয়ে যাচ্ছে। আরো একটু খুঁজে নিতে চাচ্ছে। কই রে কই! দোকান টোকান তো এদিকে নাই। এদিকে গানবাজনার দিকে সলিম টানতেসে ক্যান?
প্রশ্ন করে মনে মনে।
‘এইখানে খাড়া। দ্যাখ কি কইরা মুরগী খাইতে হয়
লিপু একটা পাথরের বেঞ্জির ওপর দাঁড়ায়। বেঞ্চি ঠিক না। পাথরের ঢিপি একটা। প্রবেশ গেটের এক পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে দেখে সলিম সুরসুর করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে। তারপর?

ওইদিকে সে মুরগী কই পাবে?
ওই দমবন্ধ করা ভিড়ের ভেতরই বাঘের মতো সলিম ঝাঁপ দেয় একটা মহিলার দিকে। মহিলার হাতে ধরা একটা বাচ্চা। কিন্তু বাচ্চা আছে তো কি হয়েছে? রং করা মেকআপ ওয়ালা মুখের সাথে সলিমের কি সম্পর্ক? অতকিছু লিপু বুঝে না। মহিলার ব্লাউজ ছিঁড়তে দেখে লিপু। ভেতরে হাত সেঁধিয়ে দেয় সলিম। কোমর জড়িয়ে কিছু কায়দা করবার চেষ্টা করে। লিপু দেখে। ভালো করে দেখে। অত ভিড়ের মধ্যে মানুষজন ওই দূর্ঘটনা লক্ষ্য করে না। কাপড় ছিঁড়ে গেছে, বাচ্চাটাকে ধরা অবস্থায়ই মহিলাটা দু একটা হাতের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। সলিম চালাকচতুর। পিছলে পিছলে যায়। শেষমেষ ভালোই মজা লুটে লিপুর মাথা শ্রদ্ধায় দুই ইঞ্চি নিচে নেবে গেল। আহ! এই না হলে গুরু! সলিমকে কার্যসিদ্ধি করতে দেখে তার বুক কেমন যেন ধড়ফড় করে উঠলো বাচ্চাটা বোধহয় একটা ছেলে। চিকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। মানুষগুলো কেমন যেন কানা। অন্ধ লোকের দৃষ্টি থাকে। এদের দৃষ্টি বটমূলের দিকে আর নিজের দিকে। 
লিপু ভালো করে দেখে। শিহরন খেলে যায় শরীরে। লাফ দিয়ে নামে। 
বাচ্চাটা তখনো মহিলার হাত থেকে ছুটে যেতে পারে নি। ক্রমাগত কেঁদে যাচ্ছে। দুইজনেই

।। ।।
ওইটা কেমন হবে? ভালো ঘরের মেয়ে মনে হয়। না। এইটাকে নেওয়া যাবে না। ভালো দাঁও দিতে হবে। প্রথমেই ধরা খেয়ে গেলে লজ্জার অন্ত থাকবে না। লিপুর মনে পড়ে যায় প্রথম পকেটমারার স্মৃতি
সেটা অবশ্য পকেট ছিলো না। ছিল মেয়ে মানুষের পার্স। ভেতরে অনেককিছুই বাগিয়েছিলো সে। 
এক জোড়া ইয়ার রিং, একটা স্যামসাং বড় স্ক্রিণওয়ালা ফোন, এক বান্ডিল টাকা
মুখে আবার হাসি ফোটে লিপুর
এই পেছন থেকে এই মেয়েটাকে ধরা যায়। শ্যামলা গড়নের ওপর হলুদ কামিজ মানিয়েছে বেশ। চেহারা দেখতে পাচ্ছে না। তাতে কী! সলিমের মতো পেছন থেকে সেঁধিয়ে দিলেই হয়। রাসেলও একটাকে বাগিয়েছে। সে বসে থাকবে কেন?

এদিকটাতে ভিড় আরো বেশী। মানুষজন যেন সব উদভ্রান্ত হয়ে গিয়েছে আনন্দের চোটে। একটা মেয়েকে সে খাচ্ছে না কি করছে এসব দেখার সময় আছে কারো? সময় না থাকলেই ভালো। 
লিপু ধীরে ধীরে ভিড় ঠেলে মেয়েটার দিকে ঘাগু শিকারীর মতো অগ্রসর হয়। পরনের পোশাক আশাক অত ভালো পরিবারের না। বোঝা যায়। কিন্তু সোহরাওয়ার্দীর কুঞ্জের মেয়েগুলো থেকে ভালো গড়ন
এই সুবিধে! নিচা পরিবার হলে ক্ষতি টতি হলেও কোন সমস্যা নাই। চেঁচামেঁচি করতে পারবে না

শিকারের চেহারা দেখতে বাঘ বড় উশখুশ করে। শিকার যে উল্টোমুখে ঘুরে আছে! বাঘ একাগ্রদৃষ্টি দিয়ে চোখে চোখে রাখে। সময়ের অপেক্ষা করে
শিকার হেলছে, দুলছে, হাঁটছে। ঘাড়ের কেশর চকচক করতে বাঘের জলপাইরঙ্গা চোখও চকচক করে উঠে
শহুরে বাঘ এক মুহূর্ত ভাবে। ওরকম গড়ন কি সে এর আগে দেখেছে? কখনো এরকম মাংসল শিকার হাতের কাছে পেয়েও ছেড়ে দিয়েছে? হলুদ রঙা চামড়াওয়ালা দোপেয়ে কখনো সামনে এসেছে বলে তো মনে পড়ে না। ওসব চিন্তা শেষ মুহূর্তে করা যায় না। ঝেড়ে ফেলে ক্ষণিক পরেই। রোজ রোজ একই মাংস থেকে নতুন মাংস পাবার নেশা, উত্তেজনা তার মস্তিষ্ককে গরম করে দিয়েছে। নতুন কিছু ভাবতে চায় না
সময় ফুরোলে এইবার শহুরে বাঘ সন্তপর্ণে এগোয়
এক লাফে ঝাঁপ দেয়। কামড় বসিয়ে দেয় হরিণের ঘাড়ে
হরিণ চমকে উঠে
বাঘের দাঁত আরো শক্ত করে বসে যায় হরিণের ছোপ ছোপ রঙা ঘাড়ে। হরিণ ডাক ছাড়ে। বাঘ শুনে না। থাবা লাগায়ে দেয় পিঠ বরাবর। দুই দুইটা শক্ত থাবা শিকারকে বাঘের মুখের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। শিকারের গন্ধে, গায়ের গন্ধে, শ্যাম্পু করা চুলের গন্ধে ততক্ষণে বাঘ বিভোর বাঘের চোয়াল ঝুলে পড়ে। দাঁত খসে যায়। থাবার নখগুলো চুরচুর হয়ে মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে
হরিণের দৃষ্টি বাঘের ওপর। বাঘের দৃষ্টি হরিণের ওপর
বাঘ পেছনের দিকে দৌড় দেয়। ততক্ষণে বাঘ ছোট হতে হতে বেড়ালে পরিণত হয়েছে। বাঘ কিংবা বেড়াল পালিয়ে বাঁচে

।। ।।

লিপি আবার চোখ বোজে। একমনে সে কল্পনা করার চেষ্টা করে। সেই নদী তীর। যেখানে সরকারি তার আর দাদার। দাদা তুই কই?
লিপি দৌড় দেয় বটগাছের দিকে। দাদা দাদা! গাছের উপর বসে আছিস তুই? একটু দেখা দে না
দাদাকে সেখানে না পেয়ে মরা নদীর মরা পাড়ের দিকে দৃষ্টি দেয়

এক দৌড়
কালো কালো আবছা বস্তুটি সেই ঘুড়িটার। কালো ঘুড়ি। তার আর দাদার কালো ঘুড়ি
লিপির ঠোঁট খুশিতে ঝিলমিল করে ওঠে। কিন্তু দাদা কই?
দাদা তুই ফির‍্যা আয় না? এইখানে আমি একা দৌড়ামু ক্যান? ঘুড়ি লইয়া খেলুম কার লগে? বটগাছত নিয়া যা না আমারে?
লিপির চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি কল্পনার নদী আর কল্পনার সরকারকে মিলিয়ে দিতে থাকে আস্তে আস্তে। তার নদী হারায়, বটগাছ হারায়, ঘুড়ি হারায়। সে ঘুনধরা খাটের চৌকির ওপর বসে বসে একমনে কাঁদে

ধার করে আনা হলুদ জামাটিও কাঁদে
লিপির অশ্রুজলে ভিজতে থাকে

ওটা তার কোলের ওপর রাখা