কোথায় কি!

04 February 2019

ফারিয়া তাবাসসুম — মনিমার বটবৃক্ষ


 
১.
আজকাল দূর গ্রামের কোন কুটির হোক বা প্রাচীন কোন রাজা বাদশাহদের মহল এর ঘর সবটাতেই রয়েছে ব্যক্তির ব্যক্তিতের ছাপ। সেটা চালের গুড়ো পানিতে মিশিয়ে কুটির এর গায়ে আলপনা আঁকা হোক বা নকশা কেটে মহলের দেওয়াল এর সৌন্দর্য্য সৃষ্টি করা হোক। সবটাতেই থাকে ব্যক্তির নিজস্ব মনোজগৎ এর প্রতিফলন বা সুন্দরতার দিক উঠে আসে। এই সময়ে ডিজাইনে ব্যপারে এতো কষ্ট করতে হয় না, হাতে মোটা অংকের কাগজের নোট আর ইন্টেরিয়র ডিজাইনার থাকলেই হল। এমনি একটা সুন্দর ঘর নিয়েই আজকের গল্প।

রাত ক’টা বাজে মনে নেই। যে ঘরটায় আমি বসে আছি সে ঘরের নতুন রঙয়ের কাজ শেষে হয়েছে, দুদিন হলো। ঘরে রঙয়ের গন্ধ নেই। এখন আর গন্ধ থাকে না রঙে। আমি আর মনিমা বসে কফি খাচ্ছিলাম। মনিমা বসে আছে উইনডো সিটে আর আমি মেঝেতে। মেঝে থেকেই বসে দেখতে ভাল লাগছিল বটবৃক্ষ এর ওয়াল পেইন্টিংটা।
আমার জিজ্ঞাসা এবং কৌতূহল মিটাতে অনেকটা অনিচ্ছায় বলতে হলো, কেন ঘর জুড়ে এমন ছেলেখেলা হলো। আমার সাথে বসা মনিমা সহজ মানুষ নয়; তাকে ভেঙ্গে কথা বের করা কঠিন। হয় সে নিজে বলবে, না হয় বিষয়টা চেপে যাবে। আমার আবার আগ্রহের কমতি নেই।



২.
মনিমা আমার কথার রেশ ধরে বলতে শুরু করলো, সে অনেককাল আগে আমাদের গ্রামের পেছনটায় নদী ছিল। নদীতে প্রতিবছর দুর্গাপুজোয় গ্রামের সকল দুর্গা মূর্তি ভাসানো হত। তবে ভাসান এর দূর্গামূর্তি গুলো নাকি ভেসে যেত না। তারা এক-একটা জলন্ত তাজা যুবতী হয়ে পাড়ে উঠে পরত। লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পায়ে আলতা ঘন কালো অমাবশ্যার মত লম্বা চুল কেউ কখন মুখ দেখতে পায়নি। এ পাড় থেকে ঢাকের আর উলুর শব্দে যখন জগৎ সংসার শুদ্ধ হত। তখন তারা দলগত হয়ে নদীটার ও পাড়ের ঘন জঙ্গল মিশে যেত। সে জঙ্গলে নাকি একটা বট গাছ ছিল। লোকমুখে শোনা যায়, তারা সবাই নাকি সেই বটগাছের কাছে আত্মহুতি দিত। এই আত্মত্যাগ এর চিহ্ন হলো বাতাসে দুলতে থাকা গাছের গা পেঁচিয়ে লালপাড়ের সাদা শাড়ি ।

সবই লোক মুখে শোনা। এই গল্পের বিশেষ কোন অর্থ আছে কী? মনিমা। বিশেষ অর্থ তো নেই তবে শোনা যায় কোন একবার ভাসান শেষ এ প্রতিবারের মত যখন সবাই ফিরে আসছিল তখন নাকি পুরো জঙ্গলে শঙ্খের শব্দে আকাশ মাটি এক হয়ে যাচ্ছিল আর কেউ একজন চিৎকার করে বলছিল এ জগৎ এবার শুদ্ধ হবে আবার অসুর বধ হবে। আবার নব সূর্যের উদয় হবে।

কথার মাঝখানে আমি বলে উঠলাম-
-ধূর এমন হয় নাকি।
- হুম হয় না।
তবে সেদিন রাতেই নাকি ঘটেছিল ধ্বংসের ঘটনা। পুরো গ্রামের ছেলে মানুষ গুলো কেমন কর্পূর এর মত উবে গেল। বাচ্চাবুড়ো-জোয়ান সবই কেমন করে নাই হয়ে গেল। সকালে উঠে কেবল দেখা গেল মেয়েরাই যে যার জায়গাতেই আছে।
-তার পর।
-তারপর যা শোনা যায় তা হলো, সে গ্রামে দূর্গাপূজা আর হয়নি কখন। তবে এখন নাকি সেই বটগাছে লাল পাড়ের সাদা শাড়ি বাতাসে দুলতে দেখা যায়।
 

৩.
গতরাত থেকে এম্বুলেন্স আর ফায়ার সার্ভিস এর শব্দ আর এলাকার সবার দৌড়ের আবছা প্রতিচ্ছবি মনে পরছে। হাসপাতালে শুয়ে কিছুতেই মনে করতে পারছি না কী ঘটেছিল। কী করেছিলাম আমি! ঘটনাটা ঘটার আগে। গুঞ্জন শুনে যা বুঝলাম আগুন লেগেছিল কোনভাবে আমাদের ঘরটায়।
এরপর মনে পড়লো আমি তো একা ছিলাম না, মনিমা ও আমার সাথে ছিল। মনিমা কোথায়? হাসপালে থাকা ইন্সপেক্টরকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল, ওখানে নাকি আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি কেবল আমাকেই ওরা উদ্ধার করেছে। মনিমার কী হলো? কোথায় গেল কেউ বলতে পারল না। আমি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা চলে গেলাম বাসায় মনিমার ঘরে। আগুনে সব পুড়ে ছাই হয়ে আছে। গত রাতের কোন চিহ্ন পাওয়া গেল না। চোখ পড়ল ধূসর ছাই আর মেটে রং মিশিয়ে বটবৃক্ষের অবয়বটি বাতাসে দোলতে থাকা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি। মনিমার বটবৃক্ষে তারই আত্মহুতি। কোথা থেকে যেন শঙ্খের ধ্বনি বেজে উঠল। আর নিজ মনেই বলাম এ জগৎ এবার শুদ্ধ হবে আবার অসুর বধ হবে। আবার নব সূর্য এর উদয় হবে।

No comments:

Post a Comment