কোথায় কি!

18 June 2016

দেবাশীষ মজুমদার



সুবর্ণরেখার ধার ঘেঁষে
যতোবার বাড়িয়েছি হাত, কেঁপেছো
শঙ্কায়। আলেয়ার আশপাশে ঠিকানা
ভেবেছ বলে অহং এর রঙ ধুয়ে
মুছে যায়, তবু ছায়া ও আমির জন্য
তোমার রোদ্দুরে ডুবে ডুবে থাকি। রোজ
চলে যাবার আগেঠিক কিশোরী সন্ধ্যাকালে
তুমি
মালতীর মত হাসতেই রোদ চেখে চেখে
ক্লান্ত
আমাদের মাঝামাঝি ঢেউগুলোর ভিতর
যাবতীয় আড়ালের মাখামাখি নিয়ে
আরও
অনেকটুকু কুঁকড়ে যাই।


তাব মরশুম শীতের নয়, হিমেরও
নয়, তবু কেন
সব সংস্কারের আড়ালে চাদর মুড়ি দিয়ে
এতোটা গুটিয়ে থাকো? যেন
খই উড়ছে, এগিয়ে
আসছে কথা না বলা ভবিষ্য -
একাকীত্বের
সমস্ত দিন, আমরাও কি তৈরি হচ্ছি খুব!

অবন্তিকা,
গা ভর্তি হামি হামি গন্ধমাখা শিশুর
লাল নীল প্লাস্টিক বল তোমাকেই
দেবো, নেবে? কিশোরের কাঠি ডাঁটি
নারকেল পাতার চশমা, বোম্বেটে
লাটিমের ঘূর্ণি, জোনাকির পিছে ছুটে
যাওয়া আহ্লাদও দেবো, এক বয়সে
ঘাসের দানায় লেখা টপ্পা যতো, আকাশজুড়ে
তারার কোলাজ, আঁচলে দেব বৈশাখ
কুচি, বর্ষাবাদল, টুপুর
ফোটা, আঁশটে শরীর, ঘামে ভেজা
এক্সপ্রেস বুক, স্নানঘরের ধোঁয়া ওঠা
এক পশলা গান যদি দেই?

হীরে মানিক হয়তো নয়, তবু
এখনো আমি বহু কিছু দিতে পারি -
এর চাইতে বেশী আজও পারেনি মানুষ।

নেবে?

15 June 2016

শর্মিষ্ঠা ঘোষ






অপেক্ষা কর
তুমি টেনশান কোরো না, বাবা। আমি এখন হারিয়ে গেলেও ফেরার জন্য পথ খুঁজতে পারি। হয়তো কানাগলিতেও ঢুকে পড়ি সময় সময়। হতাশ লাগে। আবার ফিরে যাই অকুস্থলে। নতুন দিকে এগোতে থাকি। হ্যাঁ, বাবা। রোদ্দুরে কষ্ট হয়। বৃষ্টিতে মিশে যায় এক্সটা নমক। শীতে তো জানোই আমার গলার প্রবলেম। আমি একহাতে ফোঁপানি আটকাই, আরেক হাতে মুঠি পাকাই। চশমার কাঁচ মুছি। কপালের ঘামে বিধিলিখন ধেবড়ে যায়। কালো অক্ষর লাল হয়ে যায় রগরাতে রগরাতে। তুমি ভাবছ, আমি ভয় পাচ্ছি? না, বাবা, আমার তো কিছু নেই যা কেড়ে নিতে পারে অন্য কেউ। ঝাড়া ঝাপটা। বাবা, না না, একদম কাঁদবে না তুমি। আমি পারবো। আমি ফিরতে পারবো। একটু দেরী হতে পারে। একটু কেটে ছঁড়ে যেতে পারে। আমি একটুও থমকাই না আজকাল এসবে। কত সময় মনেই থাকে না যন্ত্রণাবোধ। খালি একটা কোয়েস্ট দেখতে পাই আমি। পথ, একটা ফেরার পথ। তোমার কাছে যাবার। আবার দেখো, তোমার হাত ধরে ছোটবেলার মত বেড়াতে যাবো। তুমি আমাকে তারা চেনাবে। তুমি ফাইভস্টার নিয়ে আসবে আমি গুড গার্ল হয়ে থেকেছি বলে। আমি তোমার মাথায় বিলি কেটে দেব। আমি চায়ের কাপ আর মুড়ি এনে ডাকবো তোমাকে। তুমি গীতাঞ্জলিআর নৈবেদ্যথেকে কবিতা বলবে। আমি সঞ্চয়িতার। আমার ফেরার জন্য আর একটু অপেক্ষা কর বাবা। হ্যাঁ, আমার একটু দেরী হচ্ছে বটে, আমি কিন্তু ফিরবোই। ঘুমিও না প্লীজ। আমায় তবে গল্প বলবে কে? আমার গল্পগুলোই বা কে শুনবে, বাবা



মেলোডি
এবং তোমার বিটার লাগছে। ঘনিষ্ঠতম মুহূর্তে অতীতের কোনো তিক্ততা ঘাই মেরে যায় আমার জিভের ডগায়। বিষাক্ত তির বিঁধে পিগমি মানুষ রক্তাক্ত হতে থাকি। লাগামছাড়া ক্রোধ পাশুপাত অস্ত্রকেও হার মানায়। বরফিলি উপত্যকায় কোন গুহা মানবের পায়ের ছাপ একটা সংগ্রামের শেষ চিহ্ন রেখে গেছে ভাবতে ভাবতে ডারউইনবাদের ফলিত প্রয়োগ নিয়ে ঘিলু গোবর করে ফেলি। বোকামির ললিপপ চুষতে চুষতে বেশ ক্ষুদিরাম ফিলিং হয়। মুখপোড়া মনটা হ্যাংলার মত তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এ গল্পের উপসংহার হাস্যকর। একটা জোকার আর একটা বাঁদর দিনশেষে মুখোমুখি বসে থাকে। চুপচাপ। পিটপিটে চোখে দুজন দুজনকে মাপে। কাছে আসে। এ ওর নিঃশ্বাসের শব্দ গোণে। খিদে ভুলে যায়। তেষ্টা ভুলে যায়। কেউ গুনগুন করছে মহন্মদ রফির রোম্যান্টিক মেলোডি। গলা ব্যথা করে ওদের। গান গাইতে ঠোঁট ফাঁক করে। একটা গোঙ্গানির মত কিছু ছিটকে আসে। এ ওর পিঠে হাত রাখে। হু হু করে কান্না বেরিয়ে আসে। হাল্কা হয়ে যায় দুজনের মধ্যেকার পর্দা। পরিষ্কার দেখতে পায় ওরা একদম অবিকল দেখতে।




সম্পর্ক
যে গল্পের খালি বিস্তার থাকে সে গল্পের নাম তুমি
প্রতিটি সম্ভাব্য বিপর্যয়ের শব্দ থেকে ইউ টার্ন নাও
আমিও মনে করতে পারি না বিলীয়মান যতিচিহ্ন
আমাদের সম্পর্কে সকাল হয়ে যায় যখন তখন
বিশ্বজনপদে পা ফেলা আধা নামে ডাকা প্রিয়তা
কাঁধের তিল কিম্বা নাকের আঁচিলের মতই অবিচ্ছেদ্য
স্বভাবজাত হুজ্জুতি থেকে বের হতে সময় নিই অনেক
এর মানে এই নয় নোঙ্গর কেটে ভেসে গেছি আঘাটায়

অসমাপ্ত পড়ে থাকে আদরভাষ আরেকটা লাভামুখের জন্য



আসমা অধরা





There is nothing like a coincidence in this world... Some people say...
is that word coincidence mean anything new or special?

ভুমিকাহীন একটি বিন্দুর মতো বহুদিন পড়ে থাকার পর ক্রমিকানুযায়ী শ্বাস, খাদ্য আর যাবতীয় পার্থিব সব কার্যকারণ বোঝাই করে চোখ মেলে তাকানোর পর সে এক পৃথিবী হল। সাথে সাথে নূহ'এর নৌকো থেকে আগত ভীতিরা ভর করে অলিন্দ-নিলয়ে। শীত মেঘের গায়ে ব্যাপক রোদের অসুখ বলেই দাবানলে সৃষ্ট ছাই উড়তে শুরু করতেই পরিযায়ী মনোবৃত্তি- বিহঙ্গ রূপ পায়। বুকের প্রকোষ্ঠ খুলে ছেলেবেলা থেকে হাঁটতে শুরু করার পর বুঝেছি আকাশের অসীমতা বোঝার ক্ষেত্রে কি নগণ্য এক মানব জীবন
যতখানি পাপ বোঝাই হবার পর মৃত সমূদ্র হারায় ডোবানোর ক্ষমতা, ততটুকু ঔদার্যের স্বত্ব নাকি অদৃশ্য বিধাতা একাই অধিকার করে আছেন? আমি বুঝি পার্থক্যহীন আলিফ আর ওঁম ঋদ্ধ হয়ে যাবার পরেই মরুভূমিতে ফোটে এক আশ্চর্য কাষ্ঠল পুষ্প। তখনি প্রসব বেদনায় ছটফটে তরুণী নাভীমূলে হাতড়ে বেড়ায় ঐশ্বরিক মরিয়ম ফুল নামক কোন অলীক বিশ্বাস।

এযাব বিষে বাসনায় তীর্যক হয়েছে উদভ্রান্তকাল। যদিও বিবেচনা, বিনয় বা বিনম্রতায় আমার ঘরে নিয়মিত রয়েছে ব্রত উপবাস; সেও এক উপাসনারই নাম। খালি চোখে লালের সংক্রমন যা তীব্র রক্তবর্ণ - তাই সুস্পষ্ট হয় যাপন কালের প্রচ্ছন্ন আয়নায়।
উপেক্ষারা যখন আগুনের আঁচে জ্বলে যাচ্ছিল চতুর্মাত্রায়- গোচরে বা অগোচরে, সুবিবেচনায়; তখনই অনিবার্য হয়েছে দ্রোহ। কাঙ্খা বা মনে পড়া সুগন্ধটুকু/ সুগন্ধগুলো ভুলে গেছি ভাবতেই মনে পড়ে যায় উদগ্র ভাবসমগ্র ও ভাষাদের, যাদের আশ্রয় করে বদলে দিয়েছিলাম ঈশ্বরের নাম, ঠিকানা এবং জপমালা যাপন বেলার সায়াহ্নকৃত্য শেষে বুঝেছিলাম নিজের জন্যও আর অবশিষ্ট নেই সামান্যতম প্রীতির লেশমাত্র।
তাই তো পুজোয় খাদ থাকেনি, থাকেনি চাওয়া বা পাওয়ার আকাঙ্খাতেও। তথাপিও টললেন বিধাতা; এইসব ভাবনাদের ভুল প্রমানেই উপনীত হলেন যে প্রভু, তাকে দেখে চমকে উঠেছি, সে নিজেরই হুবহু প্রচ্ছায়া যা দর্পণে প্রকট হতে পারেনি একবারের জন্যও বিগত জীবনে।

বুঝলাম, মানুষ কখনোই ঈশ্বর হতে পারেনা। তবু নিজেকে কোন ভাষায়, ভঙ্গিতে স্বান্তনা দিই? যে জীবন কেটে গেছে তার বিদায়ের সিঁড়ি জুড়ে ছিলো বিছানো নিকষ অন্ধকার, আর উপকূল বিস্তীর্ণ নোনাজল ও আর্দ্র হাওয়া।
যা কিছু প্রশান্তি ভেবে বুকে মুখ গুঁজে পড়ে আছি সে কি ছুঁয়েছিল কোন জারুল অথবা কেওড়ার নাভীমধ্য সুগন্ধ? মনে পড়ে অন্ধকার এক ঘর অথবা গর্ভ নামক প্রত্যঙ্গ বিশেষ, যেখানে স্থাপিত হয়েছিল মায়ের সাথে প্রথম
বিনিময় ও আদান প্রদান। তারপরে চোখ, নাক, মুখ হলেই জন্মে গিয়ে নাড়ী ও নাভী চক্র বিচ্ছিন্ন হলো, সাথে আমিও যে ওই শরীরের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা সন্তান নামধারী এক জীব।
নাড়ী বিচ্ছিন্ন হলেই বিচ্ছিন্ন হয় মা। বেড়ে উঠলেই গর্ভ ভুলে যায় সন্তান। তেমনি, জেনে ও শুনে আসা বিজ্ঞমত বলে, প্রেম ও রতি শেখার পর প্রেমিকও বিচ্ছিন্ন করে চলে যায় প্রেমিকার আঁকড়ে রাখা হাত। এইখানে এসে নিরলসভাবে খুঁজতে থাকি একটি ব্যাতিক্রম আখ্যানশৈলী, অবিচ্ছেদ্য কোন প্রেমকাব্যকথা। পথের ঠিক এই বাঁকে এসেই আবার প্রমাণ হয়, coincidence সচরাচর মানবজীবনে ঘটে না।

এইরকম অনেক অনেক গল্পের শেষে একদিন- নিজেকে মানুষ ভাবার প্রথম প্রহর মাত্রে যেই রেটিনায় দর্পণ সম প্রস্ফুটিত হল অবয়ব; তার সম্মুখে দাঁড়াতেই দেখতে পেলাম, সেখানে দীর্ঘ ছায়া সমেত এক লেজ গুটোনো রোঁয়া ওঠা কুকুরের মুখ থেকে ঝুলে থাকা লালাঝরা জিভ। সেখান থেকে টপটপ ঝরে পড়ছে ষড় রিপু ও দ্বিগুণত্বে থোকাথোকা লোভ।

নিজের সামনে যদি নতজানু হতে শিখি, তাহলেই বেরিয়ে আসবে আভ্যন্তরীণ শ্বাপদ। দেখবে ললাটের ঠিক নিচে হায়েনার চোখের মত জ্বলছে দুই রেডিয়াম ফ্যাক্টরি...উপলব্ধির এ পর্যায়ে ফের একবার চাঁদের গায়ে ছুঁড়ে দেই আপামর দ্বীর্ঘশ্বাসের ছেঁড়া কাঁথা। মানুষ তার সীমার বাইরে যাবার সামর্থ্য রাখে না, পারে না বন্ধ ঘরে একাকী নিজের সামনেও নতজানু হতে। সেখানেও তার 'ইগো' নামক বস্তু 'ইজম' এর ন্যায় দর্পভরে কটাক্ষ করে নিজেকেই।
আর তাই মানুষ আর কখনোই ঈশ্বর হতে পারেনি এখানে, ধুলো মাটি অধ্যুষিত পৃথিবী নামক গ্রহে, এক আশ্চর্যের কারখানায়। যা ব্যতিব্যস্ত ও দুষিত; ফাঁপা ও উন্মুক্ত ছাদের মতন আকাশ ও রহস্যাবৃত পাতাল সম্বৃদ্ধ বিশাল ছায়াপথের বিন্দুসম অস্তিত্বে।

এতোসব ভাবতে ভাবতেই দিন আর রাতগুলো আলোকবর্ষের মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যায়। যাপনসমগ্র কেমন পলকেই কেটে যায় যেন ক্ষুদ্র পল, মিলি ও মাইক্রো সেকেন্ড। শূন্য শূন্য সব, অনন্ত শূন্যতার আখড়া। শ্বাসে বুকে মাথায় পৃথিবীর ওজনের চাইতেও ভারী কিছু চেপে থাকে।

যেন চলছেনা আর কিছুই, কালব্যপী স্থির তথাপি তাকিয়ে থাকা চোখে কোন দৃশ্য ধরা পড়েনা, কিছুই দেখিনা। অনেক চেষ্টার পরও একটিও ভাবনা নেই, মন ও মস্তিষ্ক ভুলে গেছে সচল ক্রিয়া বৈশিষ্ট্য। চারপাশের এতো এতো কোলাহল, তীক্ষ্ণ শব্দে কেবল হৃদপিণ্ড চমকে উঠে থমকে যাওয়া ছাড়া আর কোন অভিব্যক্তি নেই। এই আমিই মানুষ নাকি দানব তারও অনুভব নেই। ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, ঘুম নেই, হাঁটা নেই, চলা নেই, কথাও নেই। বলি না, শুনি না- কেবল শ্বাসকষ্ট তীব্র থেকে তীব্রতর হবার কিছুক্ষণ পরে নিয়মানুযায়ী জ্ঞান হারানো।

নিজের কাছেই আবার প্রমাণিত হয়, আদতে মানুষ ঈশ্বর হতে পারেনি, পারেনা বা সম্ভবপর ও না। এক অদৃশ্য কিম্বা অলীক অস্তিত্বকে হয়তো অজ্ঞান ও অন্ধবিশ্বাসে ঠাঁই দেয়া সম্ভব, কিন্তু তার স্বরূপ ধারণে পারঙ্গম নয়। কারণ মানুষ অনুকরণ ব্যাতীত অদৃশ্য কিছুর রূপদানে অক্ষম ছিল, আছে, থাকবে।



মুনিরা চৌধুরী





১.
মহাকালের ছবি দেয়ালে টাঙিয়ে ছিলাম সেই কবেকার ঘোরগ্রস্থ ভোরে, সেলাই করে করে...
সেইসব ছায়া-চেহারাগুলো এখন ঝাপসা হয়ে গেছে...
ছাদের উপর বৃষ্টির আঙুলগুলো ফেটে পড়ছে উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে না কি কান্নায়- ঠিক বুঝতে পারি না...
কৈশোরে কাগজের নৌকা ভাসিয়েছিলাম পুকুরে...
ভেবেছিলাম- নৌকাগুলো বড় হবে একদিন, দেখা হবে মেহেকসমুদ্রে...

আমার পাখিরা আর উড়াল দিলো না...
দূর অতীতে পাখিদের ডানা কেটে দিয়েছিলাম
পাখিদের ডানা রেখে দিয়েছিলাম ছোটবেলার অ্যালবামে...

 
২.
এখন নৈঃশব্দের শব্দরা ঘুমিয়ে পড়েছে...
চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছে...
মরুভূমিতে একা একা টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছি বালির নৌকো

দূরতম জানালার পাশে দেখি- চিরচেনা কারো ছায়া ভেসে ভেসে ডুবে যায়
আয়নাগুলো গলে গলে যায়...

চক্ষু খুলে দেখি- কোথাও চক্ষু নেই, ছায়া নেই, বিম্ব-প্রতিবিম্ব নেই
শূন্য কুঠরীতে পড়ে আছে
মৃত সব মুনিরামায়া আমার অগ্নিমায়া...


৩.
নরকের নীল আগুনের চারপাশে লেলিহান জিহ্বাগুলো উড়ছে
উড়ন্ত জিহ্বায় গেঁথে যাচ্ছে আর্তনাদের ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি
আমি যাই নি কোথাও
আমার পান্ডুলিপি থেকে সবগুলো লেখা চলে গেছে

হাতখানি যে রক্তে ডুবে আছে...
কী করে লিখি কথা ও মুনিরাকথা, নদী ও মেহেকানন্দার জল
তবু-
স্ফটিকের পাখি প্রত্নকলম তুলে দিচ্ছে হাতে

আমায় ক্ষমা করো পাখি, পাখির পালক, আমায় ক্ষমা করো নদী, নদীর দুইপাড়
আমায় ক্ষমা করো
ক্ষমা করো
ক্ষমা করো
ক্ষমা করো
ক্ষমা করো রক্তকরবী
আমি যে পাথর কুচি...


৪.
ভেবে নাও তুমি- মঙ্গলরূপ কিছুটা পুড়ে গেছে পুড়ে-যাওয়া জলের ছোবলে
ভোর বেলার আলোয় কোনো কমলা-রঙ নেই, ছাই-রঙা বালিকার গুড়া গুড়া শরীর ব্যতিরেকে
ভাঙ্গা মন্দিরের পাশে আমাদের ভাঙ্গা-শঙ্খের আওয়াজ ভাঙছে তো ভাঙছে
সখা হে, মমি হয়ে শুয়ে আছি অগ্নিঝর্ণার নিচে

আর জাগবো না
আর জাগবো না

কেনো জাগাতে চাও তবে
কেনো জাগাতে চাও ঘুমিয়ে-পড়া মৌমাছির ঝর্ণা

এই মমি আবার কি মানবী হবে মথুরা বৃন্দাবনে


নাজমুন নাহার




লোর চন্দ্রানী
লোর চন্দ্রানী লো 
কেন ক্ষেতের পাশে জমাইছিস প্রেম 
দক্ষিনের ঘরে 
পশ্চিমে নলখাগড়ার বনে-
তোরে পোড়ায় জমিরের বাপ 
সুচনার মা 
এলাকার জমিন 
সমাজের ইতর পোকা


বোষ্টমী
আজিব আদমি
পোড় খাওয়া আফিমে
বোইরাগি আকাশ
ঋতুকালীন সহবত
সব ভুলে গেছি
ভুকা নাগা সন্যাসী
তোর পিছে আমি
অর্ধশতাধিক বছর 
বোষ্টমী হয়ে আছি-
 

 অন্যরকম সুফী
তুমি তো অন্যরকম সুফী
মঞ্জিল জানো নাই
নাভীর গহ্বরে জন্ম নিলো যে মোহো
তারে কেনে তুমি প্রেম বলো নাই!




আজাজিল
যে আমি ডুবেছি সামুদ্রিক নুন জলে 
সেখানে কেউ পা রাখেনি আদতে 
অথবা ঘা হয়েছে তাদের জিভে 
যদি নেশা হয়ে যায় 
ছুঁড়ে দেয় মুঠোফোন এবং ইনবক্স
এবং জানালার শার্শিতে ফোটা ফোটা শিশির -
সেদিন নিও জেনে 
এ রাহের বিচূর্ণ সিরিঞ্জে 
এজাজত হয়েছে পেথিডিনে
আমার পিছমোরা বাহুতে 
লেগেছে দাগ কালশিটে
ব্যথায় জর্জর
উঠিয়ে নিলে এই মানবিক গ্রহ থেকে 
রুহের মাগফেরাত দেবে না আজাজিল 




মরফিন
রাতে ঘুমাতে গেলে বর্শির ঠোঁটে মিশিয়ে দিয়েছি কিছুটা মরফিন। 
এক একটা শিকার উঠে এলে রেখে দেবো উড়ে যাবার ঘর আর গেরস্থালী প্রমুখ । যতই রাখো ফিংগের ডানায় পাইন আর রাজন্য বর্গের আদেশনামা তবু সেই অন্ধকার রাতে রুমালের ভেতর ঘুমিয়েছিলাম সহস্র বসর-

আমাকে একটু বিষ এনে দাও হে আমার অপরাহ
মোহনার মুখে হাত ভাংগ এবং কোমড় 
তবু বলা হয়েছিলো ভালোবেসে তো কেউ দোষ করে না 

বাবুল হোসেইন




প্রস্থান পর্ব:
হিম বাতাসের গায়ে কাঁটা দেয়া ঘ্রাণ। সকালের ত্রস্ততায় তোমাকে বলিনি সেইসব অনাদি দৃশ্যের ভিতর বাহির। আমার জানলা খোলে রেখেছে কে যেনোদূরের ছায়াবন। শিস তোলা দোয়েলের গলায় ঠাণ্ডা মেজাজ। ছায়াবনে ঝিরিঝিরি সুরের মূর্ছনা। আর আমি জমে জমে একাকার সেই পাখিঘুম, সেই পাতাগানের কৌলীন্যের ভিতর। শীতের তীব্রতা ভেঙে যাচ্ছে কৌলীন্যের গহিন থেকে।
দূরে, ছায়াবনের ফাঁকে দোয়েলের মগ্ন শিসের ভিতর কে যেনো হারানো দিনের সিম্ফোনি গলায় তুলছে একা একা আমি তার রাখিনি খবর।




প্রস্থান পর্ব:
প্রত্মদিনের ভাঁজে হারিয়ে গেছে তোমার নাকফুল। বাতায়নে বসে তুমি হারিয়েছো কাজরের রঙ। ঘাতক সময়ের কাছে জমা রেখেছি আমাদের অস্ত্রবিদ্যার সকল চাতুরী। চষ্ণুতে অনাগত দিনের ভাবনা নিয়ে চড়ুঁইয়ের প্রস্থান। আমাদের সন্তানেরা দিনে দিনে থিওসফিস্ট হচ্ছে। স্টেথোস্কোপের মাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে ঊর্ধ্বগতিতে। তুমি কি মনে করতে পারো তোমার নাকফুলের নকশা কিংবা কাজরের গভীরে বেদনার অভিমানী চোখ।
কোথায়ও আমাদের যুগলবন্দি উল্লাস মনে পড়ে না, মনে পড়ে না, মনে পড়ে না।




প্রস্থান পর্ব:
কৃষ্ণবিবর কোথায় লুকিয়ে থাকে। কোনখানে বাস তোমার হে বিপ্রকর্ষ আন্ধার। আমাদের আলোহীন দিনের শেষে তোমাকে খুঁজে পেতে চাই প্রিয়তম রাত্রিকখনো মনে রাখিনি বৃদ্ধাশ্রমের স্মৃতিতে শোকপ্রস্থানঅন্ধকার জীবনের উল্টোপিঠে আলোকোসব শেষে তোমাকে খুঁজে পেতে চাই হে কৃষ্ণবিবর,হে অন্ধজনের সখা।



আবুল কাইয়ুম



কবি ডালিয়া চৌধুরী নীল গোধূলি’ : মগ্নচৈতন্যের কাব্য


 নীল গোধূলি’, তরুণ কবি ডালিয়া চৌধুরীর চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ। গত বইমেলা উপলক্ষে এই সুশোভন পেপারব্যাক গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ঢাকার অনুপ্রাণন প্রকাশন। শিল্পী চারু পিন্টুর নান্দনিক প্রচ্ছদ ও সুন্দর কাগজে ঝকঝকে ছাপা নিয়ে আটচল্লিশ পৃষ্ঠার এই ক্ষুদ্রাবয়ব কাব্যটিতে কবির মোট বিয়াল্লিশটি কবিতা স্থান পেয়েছে। এর আগে প্রকাশিত কবির কাব্যগুলো হচ্ছে – ‘অনুভবে সুখ’ (২০০৯), ‘মেঘময় নিকুঞ্জে রংধনু’ (২০১৩) ও জলজ কামনা’ (২০১৫)। ইংরেজী সাহিত্যে উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিতা এই কবি বর্তমানে সংযুক্ত আরব আমিরাতে বসবাস করছেন।
আমার কাছে মনে হয়েছে, ‘নীল গোধূলিকাব্যে কবি ডালিয়া মগ্নচৈতন্যের কবি। তিনি ঘোর লাগা মনের জটিল অনুভূতিগুলো তাঁর আত্মনিবিষ্ট ভাষায় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাঁর স্বাতন্ত্র্য শুধু ভাষিক বয়নের মাঝে নয়, তা বিষয়ের পরোক্ষ উচ্চারণের মাধ্যমেও কবিতার পর কবিতায় ছড়িয়ে পড়েছে। আধুনিক জীবন ও সমাজের যন্ত্রণা ও প্রত্যাশাগুলোর প্রাবল্য তাঁর চিত্রপটে যে সব প্রভাব ফেলে সে সবই শৈল্পিক মোড়কে তাঁর কবিতায় ধরা দেয়। জীবনের সুখ-দু:খ, মিলন-বিরহ, দ্রোহ-ক্ষোভ, বেঁচে থাকার তাড়না এ সব খণ্ড খণ্ড চিত্রে প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রেমের মাঝেও আছে বেদনা, প্রেমাকাঙ্ক্ষার পরাজয়। কখনো মনে হয়, এই প্রণয়-প্রত্যাশী কবির প্রেম যেন দ্বীপান্তরে চলে গেছে, কবি যেন দূরবীন চোখে দেখেন তাঁর আভাষ-
গভীর অন্ধকারের ঘূর্ণন থেকে ওঠে
আবেগের সৈকতে সফেদ সুর শোনার প্রাণন্ত চেষ্টা।
তবুও কিছু ভালো কয়েক ফোঁটা জল
বিভ্রম চোখে ছিটিয়ে দেখতে পাই দূরবর্তী প্রণয়।

কবি পরোক্ষে মনের কথা বলেন। এক সাথে অনেক কথা বলেন। এই সময়কে, সময়ের নানা যন্ত্রণাকে কবি তাঁর অন্তরে বিষের মতো শুঁষে যে সব অন্তর্দাহ প্রকাশ করেন সেখানেও পরাবাস্তবতার দাপট। যেমন দেখি এই কবিতাংশে-
সূর্যের সাথে নষ্ট সেৌন্দর্যের খেলা দেখে চলি
লোভ ঘিরে নিষ্ঠুর কামুক শহরে।
এখানে রোদ ঝরে অথচ ছায়া পড়ে না
বাতাস ব্যবচ্ছেদ করে ধূলির উড়ন্ত আক্রোশ
চন্দ্রালোকে বেহালা বাজায় অন্ধকারের জাদুকর
সুরের সাথে জড়ো হতে থাকা অগণিত সর্পের অবাধ স্বাধীনতা’।

কবি ডালিয়ার কবিতার পৃষ্ঠদেশে এক প্রকার চাক্ষুষ সৌন্দর্য’ আছে। আঙ্গিক ঠিক উত্তরাধুনিক কবিতার মতো ছাড়া ছাড়া বয়ন বা ছেঁড়া ছেঁড়া কথকতা দিয়ে গড়া নয়। আঙ্গিকের এই সেৌন্দর্য চমকার সব শব্দ-বিশেষণ ও দৃষ্টিনন্দন চিত্রকল্প প্রয়োগের ফল। তাঁর প্রবহমান গদ্যভঙ্গির পংক্তিগুলো পাঠে এই সেৌন্দর্য সম্ভোগের পূর্ণ তৃপ্তি হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। কারণ তাঁর কবিতার আপেক্ষিক উপস্থাপনের মাঝে খণ্ড খণ্ড বোধের ঝরণা ঝরে। আমার বিশ্বাস, এই বিশুদ্ধ কাব্যশিল্পীর কবিতা পাঠকদেরকে ভাবাবে এবং তাদের চিত্তে নানা বোধেরও জাগরণ ঘটাবে।
আমি এই নান্দনিক কাব্যগ্রন্থটির ব্যাপক প্রচার, বিপনন ও পাঠ কামনা করি।


[গ্রন্থ পরিচিতি : নীল গোধূলি’ (কাব্য)। লেখক : ডালিয়া চেৌধুরী। প্রকাশক : অনুপ্রাণন প্রকাশন, বি-৬৪ ও বি-৫৩ কনকর্ড এম্পোরিয়াম শপিং কমপ্লেক্স, কাঁটাবন, ঢাকা-১২০৫। প্রচ্ছদ শিল্পী- চারু পিন্টু। মূল্য : ৮০ টাকা।]