সিজোফ্রেনিয়া
বাবা নাম রেখেছিলেন দীপান্বিতা। হয়ে গেলো দীপা। গোলগাল মিষ্টি চেহারা। বাবার আদরের মেয়ে। তখনও বড় হয়নি। বড়বোন কেবল বড় হচ্ছে। তার বাবার বন্ধু মইনুল। লম্বা আর মিষ্টি কথা। জলের বোতল আনতো। বাবাকে দিতো। এগুলো অন্যরকম বোতল। এরকম বোতলের ছোট ছোট কিছু রূপও ছিলো। সেসব থেকে তার বাবা আর মইমুল কাকা জল মিশিয়ে খেতো। তারপর তারা পৃথিবীর অবোধ্য কোন এক বিষয়ে গল্প করতো। তাদের মা গল্পে যোগদান করে গল্পকে ভরাট করে তুলতো। তারপর বাবা ও মইনুল কাকাকে তাদের মা রাতের খাবার দিতো। তারা খেতো। এই সুখের সংসারে বাবা না থাকলেই মইনুল কাকা তাদের জন্যে জামাকাপড়সহ চমৎকার পুতুল গিফট করতো।একদিন দীপা দেখলো, তার মা বুকের কাপড় সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর মইনুল কাকা পেছন থেকে জড়িয়ে আছে।আরেক দুপুরে খোলা জানালা দিয়ে দেখলো তার বাবার মতোই মইনুল কাকা মায়ের বুকের উপরে মুখ রেখে নড়াচড়া করছে। বড়বোনকে দৃশ্যটা সে দেখাতেই সে চিৎকার করে উঠলো আম্মা! এরপর বাবা ফিরলে বড়বোন তাদের গল্পটা বললো গোপনে। এক বৈশাখের দুপুরে তার বাবা শান্ত মনে ঘর থেকে বাইরে গেলো। তারপর ঘর আলাদা করে কয়েক দিন থাকার পর মইনুল কাকার কথাতে বাবাকে তার মা তাড়িয়ে দিলো। সে স্বল্পবাক আদুর বাবা চলে গেলো দূরে। আর সকাল বিকেল ও রাতে কেবল মইনুল কাকা। বছর খানেক যা তা দেখার পর তারা একযোগে মইনুল কাকার আসাটা বন্ধ করতে গিয়ে দীপা মায়ের প্রচন্ড একটা চড় খেলো। এই স্মৃতি নিয়ে বহুদিন পরে বিয়ের বাসরে গেলে তার স্বামী মইনুল কাকার মতো তাকে চেপে ধরতেই অজান্তে সে গালি দিলো খবাব সব, pardon me, i am undone এরপর পর এই অক্ষমতা দীপার জীবনে প্রকট হলো। হায় মা। হায় মইনুল কাকা। আমি আর পারছি নে বাবা।এই বলে বাবার কাছে গিয়ে মনের কষ্ট বলে আসলো সে।বাবা বার বার নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইলে দীপা বাবাকে মস্ত একা চুমু খেয়ে ঘরে ফিরলো। সকালে লোকে জানলো দীপা আর নেই। নিজের জীবন সংহার করেছে। ডাক্তার বলেছিলো, সিজোফ্রেনিয়া। এমনটা ঘুরতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া এমন কি ঘটায়।
অনুভব
মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে যখন ছোট ছেলেটা মারা যায় এবং তারও ছয় বছর আগে তার স্ত্রী মারা যান তখন থেকেই থড়-বড় সংসারে সাত সন্তানের পিতা নুরুল ইসলামকে তার সাধের পালঙ্কের নির্ভেজাল ঘুম ছাড়তে হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর মরন রোগে ছেলে ভারতে চিকিৎসায় গেলে ঢাকায় তৃতীয় ছেলের বাড়িতে আশ্রয় নেন। সব ছেলেই তখন ছোটকে বাঁচানোর জন্যে চিকিৎসার ত্রুটি রাখছে না। সে কারণে যতোটা মন খারাপ তার, তার চাইতেও তাঁর নিরাপদ পালঙ্কের দীর্ঘজীবনের আয়েস ত্যাগের ব্যাপারটি তিনি মানতে পারছিলেন। সকল ছেলে মেয়ে ঢাকায় এলে কিভাবে কার কাছে নিরাপদ ঘুম পাবেন তিনি? তিনি ঘুম ও আপন জীবন নিয়ে বার বার এইসব ঝামেলা থেকে পালাতে চেয়েছেন। এ নিয়ে ছেলেমেয়েদের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি ফারুকের একটা গতি না হওয়া পর্যন্ত তোরা আমার বাড়িতে থাকার একটা ব্যবস্থা করবি নে ? সব শুনে বড় মেয়ে বললো, এ আল্লাহ, আব্বা বিয়ে করতে চায় যে। তখন নুরুল ইসলামের বয়েস ছিয়াত্তর বছর। এবং বিয়ের আগে বাবার কাছে, বিয়ের পরেও বাবার কাছে এবং তার বাবা কুড়ি বছর আগে মারা যাবার পর ছেলের কাছেই ঘরে থাকার নিরাপত্তা খুঁজেছেন তিনি। কিন্তু শেষ দশটি বছরে তিনি এ বাড়ি সে বাড়ি করে পাঁচ বছরের মাথায় অপারেশন করা ফারুককে নিয়ে ফের নিরাপদ পালঙ্কের স্বাদ দুটি বছর পেয়ে তৃপ্ত ছিলেন। দু-বছর পর তিনি ফারুককে হারিয়ে ফের পালঙ্কহারা হলেন। তখন থেকেই যাযাবর জীবনে তিনি তার বেঁচে থাকার বাকি পাঁচ বছর তার ভাষায় কেঁচোর জীবনে ঢুকে গেলেন। কিন্তু স্বাধীন মাটি পেলেন না। ছেলেরা বললো, আপনার অসুবিধে কোথায়? শুধু বড় মেয়ে বুঝেছিলো, সব বিপদ থেকে সরে থাকার জন্যে আশি বছর বয়সেও তার একজন স্ত্রীর দরকার ছিলো। এটি তিনি তখন বললেন, যখন ছোট ছেলে বললো, আপনি হজে যান আব্বা। তখন তিনি মোক্ষম কথাটি বললেন, হজ্বের চে বুড়ো বয়েসে আমার মতো বয়েসী মানুষের বিয়ে ফরজ, আমার বয়েসে বৌ মরলে তোরা বুঝবি।
গরু রচনা
আমার কপাল। তাই অল্প বয়েসেই রাখালের চাকুরীটা পেয়েছিলাম। সূত্র আমার মা। মহাজনের চাকরানির প্রধান। ভাত রাঁধে আর ছোট বৌ এর ফাই ফরমাইস খাটে। তাতে মহাজন আমাকে একটু আদর করে। যেদিন গরু নিয়ে বরেন্দ্র চরাতে যাবো সেদিন মহাজন আমাকে তিনটে কথা বলেছিলো, তুই হইলি হামার গরুর রাখাল। গরু ছাড়া আর কিছু দেখিবি না। বুঝিলে বুঝিবি, না বুঝিলে হামাকে পুচপাচ করিবি। আর ঘরের কথা পরকে আর পরের কথা ঘরকে বুলিবি না। তাকাবি, ফের চোখ ফিরাইবি। গরুর রাখালি শেষে তোকে কিষান করিবো। আমি মহাজনের কথা যথাসাধ্য মান্য করেই চলি। কিন্তু একদিন গরু খাদ্য বন্ধ করিলে মহাজনকে পুচপাচ করলাম। মহাজন বলে, ওরে খাবু কবিরাজের কাছে যা। এইভাবে গরু, গোবর, ও গরুর খাদ্য সম্পর্কে আমার জ্ঞান হলো। একদিন মহাজন হুকুম করলো, আইজ থাইকা গরু গাড়ির গাড়োয়ানের কাম করিবি। গরু গাড়িতে জুড়ে ডাহিনের বলদ ডাহিনে দিবি। বাঁয়ের বলদ বায়ে দিবি। কাদায় পড়িলে বলদ উলটা জুড়িবি। গাড়ি উঠিবে। ছোট বৌ এর কাছ থেইকে বিদায় লিয়ে যাবি আর ঐঠে যা দিবে যার জিনিস তার কাছে দিবি। কাহারো জিনিস অন্য কাহাকেও দিবি না। বুঝিলি? এভাবে গরু গাড়ি চালানো গাড়োয়ান হলাম আমি। মালিক বললো,এ্যার পরেই কিষান হবি। তো আমি মহাজনের কথামতো কাজ করতে করতে বুঝলাম গরু গাড়ি বানানোর নানা বুদ্ধি। চাক্কা লাগানোর আগে ধুরিতে পাট আর চর্বির তোলান দেয়াটাও শিখে গেলাম। জ্ঞান আমার বেড়ে গেলো। রাখালের কাজ তখনও ছাড়ি নি। ফলে ভোররাতে আমাকে গোয়ালঘরে যেতে হয় রোজ। হঠাৎ একদিন দেখি মহাজনের ছোট ছেলে গোয়াল ঘর থেকে বের হচ্ছে। পিছনে ঘোমটা টানা একটা মেয়ে। মাথা আমার ঘুরে গেলো। ঘোরলাগা চোখে মহাজনকে কথা বলতেই মহাজন আমার গালে এক চড় মেরে বললো,তোকে আগেই বুলিছি যে, গরু ছাড়া কিছু দেখবি না।তো এইটা দেখতে গেইলি ক্যানে রে গরুর বাচ্চা। মাথা ঠিক হইছে? আমি বললাম,হয়েছে। মহাজন বলে,যে লোকটাকে দেখিছিস সেইটা হামার ছোট ব্যাটা আর পিছনের মাইয়াটা তোর মা।কিন্তুক হামার বাড়ির চাকর যে হয়, তার কুনো বাপ থাকে না। মা থাকে না।তাইলে তুই কে ? আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলি, হামি গরু।মহাজন গায়ে আদর দিয়ে বলে এই তো বুঝিলি। কে বেশি দ্যাখে রে গরু। আমি বললাম, মহাজন দ্যাখে। মহাজন বললো, এই তো বুঝিলি। সামনে বছর তোকে কিষান করিবো।
ঘোর লাগা ঘোর
অতসী।নাকি অতশী। যাই হোক, নামটা ভুলতে পারি না আমি। কি করেই বা ভুলি? তার কবিতার নাম কান্না। গান তো জ্যোস্না চুঁইয়ে পড়ে। সেই রাতে বরেন্দ্রে মতি বাগদী যখন আমাকে পোয়ালের উপর দেয়া চটের সিংহাসনে বসিয়ে চুয়ানি গিলাতে গিলাতে ঘোরটা লাগিয়ে বললো, দাদা বাহিরের মাচায় শুয়ে পড়। দিদিমনি বাতাস দেবে। দিদিমনিটা কে রে হারামী মতি। মতি বলে, কেনে এমন বুলছো গো? সাতে কইরে বরিন্দে আনিলা। সাধ কইরে দিদিমনিটা ঘোর খাইলো, তখন অলরেডি আমি মাচানে পাশে ঐ অতসী। গলায় গুন গুন চলছে, হরি দিন তো গেলো সন্ধে হলো, পার করো আমারে। আহা! আহা! এ যে মধু। জ্যোস্না চোখে টলমল করছে, আর খাবেন? খান। সারারাত গান শোনাবো। আমি বলি, মইত্যা রে। আরেকটু দে বাবা, ঘোর না থাকিলে বাবা গানের ধাত ধরিতে পারিছি বটেক। মতি ফের চার গ্লাস চড়িয়ে দিয়ে বৌ আরতি নিয়ে মাচার পাশে বসলো। এর মাঝেই আরতি দু গেলাস অতসীর পেটে চালান দিয়েছে। গান কি আর থামে।গান আর কান্নাভরা কবিতা। ঘোরের ভেতরেই ভাবি, বিয়েটা করতে হবে। অতসী,তোমাকে ছাড়া আর বাঁচবো না। এটি শব্দে বর্ণিত হলে অতসী, বুকের পাঁজরে কেঁদে দিলো। মানা তৌ করি নি শ্যাম। আজই লাগাও। লাল শাড়ি দাও। হলুদ দাও। পুকুরে চান করে এসো মন্ত্র পাঠ করি। আমি বলি মইত্যা। আরো দে বাবা, শাড়ি হলুদ আন। আমাকে ফের চার আর অতসীকে দুই চালান দিয়ে মইত্তা উধাও।লাল শাড়ি ডিগরামের দোকান থেকে এলো। জমির কাঁচা হলুদ গায়ে পায়ে পড়লো দুজনের। তারপর হাঁটিয়ে পুকুরে নামালো। আরতি আর কটা বাগদীর বৌটা গান লাগালো। স্নান করে উঠোনে একটা বড় ধান পেটানো তক্তায় বসিয়ে দেখি পাশে লাল শাড়িতে অতসী বসছে। মতি আগুন জ্বালিয়ে সাক্ষি বানালো। কি সব বলে ধান দুর্বা দিয়ে বললো, মালিক এই অমৃত স্বর্গের। দুজনে খাও। খেলাম। অতসী খেলো। তারপর আমাদের ঘরের ভেতর খড়ের বিছানায় রেখে বললো বাসর করো। ভোররাতে এলোমেলো শাড়ি পরা অতসীকে হাতের নাগালে পেলাম। অতসী বললো, একি?
কাপড় পরি ক্যামনে?
আমি ভোরের বাতাসে তাকে জড়িয়ে আলে আলে ঘুরে এলাম।
শাড়ি ধানের আর ঘাসের শিশিরে ভিজে একাকার।অতসী ফিরে ঘরে এসে সমার্পিতা হলো। এদিন আর জীবনে ফিরবে না বিভু দাদা।আইসো।অতসীকে ভুলি কি করে। অতসী এলোমেলো অবস্থা গুছিয়ে জলে নামলো।আমি ঘরে ঘোরের ভেতর। একটু সূর্য উঠলে আরতি আমাকে ডেকে উঠানে বসালো।তখন আমার দাদার ইজিচেয়ারে অতসী গাল পেতে দিয়েছে। আর আরতি বাটিতে আনা শিশির সাদা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে তার গালে মেসেজ করে দিচ্ছে। অতসী বলছে আহা বৌদি, কি ঠান্ডা সুখ গো। হামি আর যাইবো না।এইঠে সংসার পাতিবো। ঘোর দাও।খায়। পৃথিবীর জ্বালা থেইকে বাঁচি।এই হলো আমার আর অতসীর ঘোরের সংসার।ভাংবে কি আর। অতসীকে ভুলি কি করে?
কারিগর
কাসা পিতল আর রাং। এই নিয়ে কাঁসার থালা বাটি আর বাসন কোসন। এলাকার সব লোকের খাবার আর সংসার করার জিনিসে জীবনে এইঠে এই কাঁসা পিতল লাগিবে। কিন্তুক কাঁসা পিতল আর রাং গলাইতে কুনটাই কতো তাপ দিবি? আর এক নম্বর মাল তৈরিতে কতোটুকু কাঁসার সাথে পিতল আর পিতলের সাঁতে রাং দিয়া গলাইবি। ততো তাপ দিবি? এইটা যখন শিখিবি তখন হইবি কারিগর। এখন কাম কর। লোক কাজ করে।পুরাতন কারিগরে নতুন মিস্ত্রি বানায়। মাল তো বানাইবি। এক নম্বরির দাম সবাই কি দিবে। তাইলে দু নম্বর আর তিন নম্বরের মিশালও জানিতে হইবে। তাইলে তুই পাকা কারিগর। এইটা মহাজনে শিখায়। তারপর হামরা। বুঝিলি বাবারা। ভোর রাতে উঠে কাঁসা পিতলে ঠোকাঠুকিতে এলাকার লোক বুঝতে পারে ফজর আসছে। সেই কতো শত বছর থেকে এই কাজের শুরু। এখন তামা পিতল রাং ভারতে দেদার সে চোরাচালানের পর মহাজনেরা ব্যবসা থেকে অন্য পেশায় সরে গেছে। শুধু এই গাজলী মাহাজনের গুষ্টি চৌদ্দপুরুষের টাকার উৎস কারখানা ধরে রেখেছে। তারই বড় ছেলে আজ মাহাজন হয়ে গদিতে বসে কারিগরকে সন্ধ্যায় বলে, খবিশ। সে ফের বললো খবিশ। সামনে থেকে মোটা কালো খালি গা লোকটা উত্তর না। কাজে চলে গেলো। আরেকজন এলো। হাতে তৈরি তার তিনটে কলস। এইটুকু? কলস নিয়ে আসা লোকটি বললো, এর চেইয়ে বেশি পারা যাইচ্ছে না। গরমে কাজ করা কঠিন। আকাশ আগুন। ফের কয়লার আগুন। ফের ভোররাইত থেইকে পিটুনি। সোজা করা। গলা ঠিক করা। সব তো হামার হাতে নাই। পাঁচটা কলস ফিনিসিং এ আছে। সবগুলান শেষ হইলে আটটা পুরিতো। যে লোকটা খবিশ বলেছিলো সে লোকটা মহাজন। গাজলি মাহাজন। তিনটের মজুরী দিয়ে কলসের মিস্ত্রীকে বললো, অর্ডার আছে দশটার। জবাব কি? হামি তো আটটাই ফিনিসিংকে দিয়াছি। আট টার টাকা পাবো। দশ না পুরলে হামি কাইল খরিদ্দারকে কি কহিবো? খবিশ।এ বড় জ্বালার কথা। খবিশ নয়। টাকা না পাওয়া। কারিগর গর গর করতে করতে বের হতে হতে বললো, তোমার কাজ আর করবো না। আলেপ মাহাজন ঠিক মতন টাকা দ্যায়। মাহাজন মুখে বললো, তো যা গা। তামা পিতল আর রাং এর মিশেলটা আলেপ জানে? কারিগর বললো, তোমার বাপ জানিতো। শিখিছি। এখন যাই গা। এর ভেতর মোটা খালি গা লোকটা গায়ে সার্ট ঝুলিয়ে এসেছে। সে বললো, সেলাম মহাজন। হামি যাইচ্ছি। কাইল আলেপ মহাজনের কাম ধরিবো। এভাবে ফিনিসিং এর লোকটা এসে কাজ বুঝিয়ে যেতে উদ্যোত হলে, মাহাজন বললো, তো হামি উঠিনু। এইঠে টাকা থাকিবে। কাম কইরে নিজের মজুরী লিয়া যাবি বাবারা।খাম শিখাইলো বাপে। আর এখন যাবি আলেপের কাছে। ইটা কি খবিশি হইলো না, কহা। কাইল ছোট বসিবে। তার কাছে টাকা লিস। তবু বাপের কাম হামি আলেপকে দিবো না। এ কথায় মিস্ত্রিরা চুপে গেলো। তারা চোখ চাওয়া চাওয়ি করে ঘরে ফিরলো। চোখে জল এলো। বুড়ো মাহাজনের কাছে শিক্ষা রাং পিতল আর তামার মিশাল যে জানে সে কারিগর হয়। কারিগর বানাইতে রক্ত পানি হয়। কতো তাপে রাং গলে আর কতো হাতুড়ির বলে তামা সোজা হয় এই শিক্ষা একজীবনে শিখা কঠিন। কারিগর যে বানায়, তার ঘর কি ছাড়া যাইবে? বড় কারিগর কে?
সামান্য একেলা
সমাজ তাকে ছেড়েছিলো।সেখানেই থেকে ষে পেলো স। সাহস করে একাকী বৌটা নিয়ে কিছুকাল খেলো। কেউ তার সাথে মেশে না। পাশের গাঁ এর লোকের কাজ তো কম ছিলো না। মজুরী দিয়েই তারা কাজ করাতো। সাধারণ। অতি সাধারণ কাজ। বেড়া বাঁধা ঘর ছাওয়া অথবা গোয়ালঘর পরিস্কার করা। এসব করে একাকী লোকটি এক ঘড়া জল নিয়ে বাড়ি ফিরতো। বৌটা চুপচাপ রেঁধে বেড়ে খেতে দিতো। খেতো। অতি সাধারণ একটা বৌ। ভীষণ সাধারণ। তাকে স্নান করতে যেতে হতো, হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর। মাথা নিচু করে সে সেটা করে একটা ময়লা জোলাতে গা আর কাপড়টা ধূয়ে ফিরে এসে দুটো চাল আর আসার সময় পর গাঁ থেকে কিছু সবজী তুলে এনে একা একা কেটে বেছে খেতো। লোকটার যেদিন কাজ থাকে না, পর গাঁয়ের ডোবায় কাদা খুঁচিয়ে চারটে টাকি মাছে ধরেও এনে বলতো, বৌ রে, তোর বড় কষ্ট। আজ মাছ এনেছি। কেটে দিই। তুই রাঁধ। বৌটা রেঁধে দিতো। যেদিন মাছ থাকতো সেদিন ভাতের কমতি। গলতি টা কি করেছিলো সে যে সমাজ ছাড়া করেছিলো লোকে? মানুষকে পাড়া সমাজটা খেতে দিক বা না দিক শাস্তিটা তারা দিতে পারতো। পুকুর কল চাল ডাল আগুন বন্ধ, তুই হিঁদুর বাড়ির কাজের বেটি এনেছিস ঘরে। ক্যানে? এটা ঠিক লয় বটেক। বৌ ছাড়। লোকটা সাধারণ। নগন্য সাধারণ হয়ে বলেছিলো, ওর কেহ নাই গো। ছাড়ি তো ছাড়ি কোনঠে? থাইকা গা। ক্ষ্যামা দ্যাও। গাঁ বললো, দ্যাকো তো। ইঁদুর বাড়ির কাজের বেটি। জাত আছে রে? নাই। আর তো বেজাইত্তা বাপে যে তোকে থুইয়া মরলো, দুকাঠা জমিতে ঘর আর উঠোন। ধান সিঁজিয়ে খেতে পারিস। তো কামে গেলি একা। আনলি হিন্দুর বাড়ির কামের বেটি। জাতে বাগদি। কে কাম দিবে? একঘরে হয়্যা থাক। এ গাঁ তোকে কামও দিবে না। আগুন পানিও দিবে না। হয়ে গেলো। তো এই জীবনটা সমাজের স টেকে ব্যথা নিয়ে বাপের ভিটায় কবে খায় আর কবে খায় না সেটা কেউ আর দেখে। এই মাছ হলো তো ভাত হলো না তার। সেটাই বা দ্যাখে কে? কেউ আগেও একটা আসতো না। একা থাকতো সে। একাকিত্ব কাটাতেই, ধান কাটতে গিয়ে, ধান কাটা বাগদি মেয়েটাকে দেখে, সেও বড় চুপচাপ। খেদি বুঁচি চেহারা। ধান কাটা শেষে কয়েক মন ধান আর মেয়েটিকে যখন বললো, যাবি কোনঠে? মেয়েটা বললো যাইবার তো জাগা নাই। পরের পাড়িতে কাম কইরে উঠানে থাকিবো। আহা! এ কথাটা মনে লেগেছিলো তৈমুরের। গাড়ি উঠ বলে তাকে তুলে ভোর রাতে গাঁয়ে নেমেছিলো। সকালে পাড়ার মেয়েরা দেখলো পুকুরে একটা সিঁদুর পরা মেয়ে। তাতে গাঁ রটলো। গাঁ রাতেই বললো, দোষ করেছিস। থুয়ে আয়। কোনঠে যাইবে? থাইক। বলে সমাজের সব ছেড়ে একা হতে হলো তাকে। এই ভাতহীন মাছ আর আগুনহীন চুলাও ঠিক ছিলো তাদের। চলার মতো না হলেও অতি নগন্য তৈমুর আর আরতি মিলে দু কাঠা বাপের ভিটেতে চলে যাচ্ছিলো। তাতেও দুজনে পাড়ার ভিতর বিজনে, সে বৌকে জিজ্ঞেস করছিলো, হামার লাগি কষ্ট হয় রে ? চুপচাপ বৌটা বলেছিলো। বেশি চাহি নাই। ঠিক আছে। এই যে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা, এটাও পাড়া প্রধান মানে কি করে? রোজ তো পর পাড়াতে কাজ জোটে। ধান কাটার মৌসুমে দুজনে ধান কেটে খায়। ভিটেটা আর থোয়া যাইবে না বলে ঘরে থাকা আরতি রেখেই যখন বাঁশ বনে তৈমুর গেলো, আগুন জ্বলে নিমেষেই ঘর পুড়লো, কটা ধান বের করার চেষ্টা করতে গিয়ে গরে আটক হয়ে বৌ পুড়ে মরলো। স এর স আর বৌ এর ব। সব হারা তৈমুর ভিটেতে ফের একটা চালা বানালো। এবার সে শোবে। ফের আগুন লাগলে, বাইরে এসে তৈমুর দেখলো, মোড়লের লোক। একশো টাকা দিয়ে বললো, ভিটে মোড়লের। টিপ দিয়া এই টাকা লিয়ে পাড়া ছাড়। তৈমুর কিছুই নিলো। কিছুই দিলো না। শুধু লাঠির আগায় একটা লুঙ্গির পোটলা বেঁধে সে ভিটে ছেড়ে একেলা পথ ধরলো। ঐ পোটলাতে ছিলো, আরতি দুটো সাদা শাঁখা।