আজ হাতের সামনে যা পাব, তাই
নিয়েই ছুটে যাবো ৷ ঝ্যঁটা, খুন্তি, জুতো, ঢিল-পাথর-নুড়ি যা হোক ৷ আজ আর সহ্য
করতে পারছি না ৷ অজানা অচেনা এক আক্রোশ আমায় পেয়ে বসেছে ৷
আমি বাঙালি ৷ লোকের ভাষায়
"ভেতো বাঙালি" ৷ এই কি আমার পরিচয় ? শুধু এইটুকু ? ভাত, মাছ, শুক্তোর
বাইরে-ও তো একটা জগৎ আছে ৷ কিন্তু সেই জগতে, আমার অর্থ্যাৎ বাঙালির স্থান কোথায় ?
হাতে বাজারের থলি আর পায়ে অজন্তার চটি, এই ছবিই কি আমাদের আসল রূপ ?
রবিঠাকুর-বঙ্কিম-সত্যজিৎ, আর
কতদিন যে আমাদের মুখ রক্ষা করবেন, তা আমি জানি না ৷ কতদিন আর পুরনো চাদরে গা ঢাকব
আমরা ? সে শতছিদ্র চাদরে যে আর সন্মান রক্ষা হচ্ছে না, তা কি আমরা জানি না ? তবু
বাঙালি নতুন চাদর বুনতে, বারবার পিছু হটছে ৷ "চলছে যখন চলুক না ! আর একটা শীত বেরিয়ে যাবে ৷" এই মনোভাব যে
আমাদের একান্তই কাম্য নয়, তা কি আমারা বুঝি না ?
"তবু-ও আমি চলতে
দিচ্ছি,
দেখলে, মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছি—
বলছি নিজেকে- ও কিছু নয়
৷"
অবহেলার চোখে দেখে সে
ভিক্টোরিয়া, শহিদ মিনারকে ৷ "ও যে পুরোনো, ওর গায়ে মরচে ধরেছে ৷" আসলে
মরচে ধরেছে আমাদের এই ঘরকুনো মানসিকতায়, মরচে ধরেছে আমাদের ঠুনকো বিশ্বাসে, মরচে
ধরেছে আমাদের কখন-ও না রাখতে পারা প্রতিজ্ঞায় ৷ চেনা গন্ডিটা পেরোতে হবে, পুরোনো
চৌকাঠ ডিঙোতে হবে, টপকাতে হবে মনের মধ্যে গড়ে ওঠা, টুকরো ইটের পাঁচিলটা ৷
আজ আমি প্রস্তুত ৷ আসন্ন যুদ্ধের
দামামা, আমার কানে স্পষ্ট বাজে ৷ ঝাঁপিয়ে পরব রণক্ষেত্রে, চিড়ে ফেলব শত্রুর
তলপেট ৷ হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে আমি ছুটে যাচ্ছি, আর ছুটতে-ছুটতে সবাইকে বলছি
"এসো, এসো, বেরিয়ে এসো ! আর সহ্য করনা ৷ এই যুদ্ধ হবেই ! বেরিয়ে এসো
৷"
কিন্তু হায় ! কোথায় আমার যুদ্ধক্ষেত্র
? কোথায় আমার শত্রুপক্ষ ? খোলা মাঠে আর কত তলোয়ার ঘোরাবো আমি? তবে কেন এই
প্রস্তুতি ? কেন এই জমে থাকা ক্ষোভ ? আজ খুব বেশি করে মনে পড়ছে, অঞ্জন দত্তর
গানের সেই লাইন গুলো—
"করব যে আর কত
ঘেন্না
নিজেই নিজের ছায়াটাকে
করব যে আর কত অপমান
আবার তো সেই আষ্টেপৃষ্টে
জড়িয়ে নিজের নরকটাকে
গাইব আমি ভালোবাসার গান
... পারো যদি দেখে যেও
বেঁচে থাকা কারে বলে
এসো আমার শহরে একবার ৷"
বাঙালি ভুল করছে! পদে-পদে
করছে, যেনে-বুঝে করছে৷ ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে, সে ঘৃনা করছে নিজের ছায়াকে৷ বলছে
না! ও, আমি হতেই পারে না৷ নিজের অপমানে, নিজেই হাততালি দিচ্ছে বাঙালি৷ সুন্দর
স্টেজ বানিয়ে, নিজের শোকসভার আয়োজন করছে সে৷ বলছে "লজ্জা? কোথায় লজ্জা?
এতে তো কোনো লজ্জা নেই৷"
"আমার শহর
ছিন্নভিন্ন
মানুষ তার মৃত প্রায়—
ক্রিয়া তার থেমে গেছে কবে,
পরে শুধু অব্যয় ৷"
আমার আজকের আন্দোলন ব্যর্থ
নয়৷ এ আন্দোলন হল চেতনার আন্দোলন, নিজের অন্তরের চেতনার৷ এই চেতনার মাধ্যমেই
বাঙালির পুনর্জন্ম হবে৷ বাঙালি বুঝবে নিজের ভুল, অস্বীকার করবে না তার নিজের
ছায়াকে৷ আমি বাঙালি বিরোধী নই, আমি শুধু স্বপ্ন দেখি, এক "আরো ভালো"
বাঙালির৷ যে বাঙালি দু-ফোঁটা বৃষ্টিতে, অফিস কামাই করে না৷ যে বাঙালি
সংক্রান্তিতে, বাড়ির ভেতর বসে থাকে না৷ যে বাঙালি মনে করে না, অমাবস্যায় বাতের
ব্যথা বাড়বে৷ "আমি নিজেই কাঁটা, নিজের পথের; তাই আজ সরে দাঁড়ালাম৷" এ
যুদ্ধ নিজের সাথে, নিজেকেই হারিয়ে জিততে হবে ৷ আর আমি জানি এই যুদ্ধে বাঙালি
জিতবে, কারণ "এই বাঙালি যুদ্ধ জানে ৷"
No comments:
Post a Comment