31 March 2016

আবুল কাইয়ুম


এ জীবন যেন রক্তাক্ত চন্দনের ধূপ, নীলনদ এক, সন্দিগ্ধ বর্ষায় ভাঙে জলকেলি, দীর্ঘ আয়োজন


কবি বীরেন মুখার্জীর কাব্য হেমন্তের অর্কেস্ট্রা
অমর একুশে বইমেলা -২০১৬ উপলক্ষ্যে কবি প্রকাশনী, ঢাকা কর্তৃক প্রকাশিত হলো কবি বীরেন মুখার্জীর (জন্ম-১৯৬৯) অষ্টম কাব্যগ্রস্থ হেমন্তের অর্কেস্ট্রাএর আগে প্রকাশিত তাঁর অন্য কাব্যগুলো হচ্ছে- উদ্বাস্তু সময়’(১৯৯৮, কলকাতা), ‘প্রণয়ের চিহ্নপর্ব’ (২০০৯), ‘প্লানচেট ভোর কিংবা মাতাল বাতাস’ (২০১১), ‘নৈ:শব্দের ঘ্রাণ’ (২০১২), ‘পালকের ঐশ্বর্য’ (২০১৩), ‘মৌনতা’ (২০১৩) এবং জলের কারুকাজ’ (২০১৪)। এছাড়া তিনি চারটি প্রবন্ধ/গবেষণা গ্রন্থ ও একটি ইতিহাসগ্রন্থের লেখক। কিছু ছোটগল্প ও নাটকও লিখেছেন। সাংবাদিকতা তাঁর মূল পেশা। তিনি বর্তমানে ঢাকার দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কর্মরত আছেনএর পাশাপাশি দৃষ্টিনামে একটি শিল্প-সাহিত্য বিষয়ক ছোট কাগজের সম্পাদনা করে আসছেন। তাছাড়া গণমাধ্যম পরামর্শক, বিজ্ঞাপনের কপিরাইটার ও টিভি প্রোগ্রামের ধারাভাষ্য-লেখক হিসেবেও তিনি কাজ করে থাকেন। কর্মজীবনের এত সব ব্যস্ততার মাঝেও কবি বীরেন মুখার্জী তাঁর উজ্জ্বল সৃজনকর্মের দ্বারা ইতোমধ্যে সাহিত্যাঙ্গনে নিজের একটি আলাদা অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

হেমন্তের অর্কেস্ট্রাকাব্যের একটি বড় অংশ জুড়ে দেখি, জগজ্জীবনের আলোকে বিদীর্ণ করে হন্তারক অন্ধকারের উত্থান কীভাবে অর্জন ও প্রত্যাশাকে বিনষ্ট করছে সে সম্পর্কে কবির নানা অভিব্যক্তি। এই প্রকাশের মাঝে এবং এর বাইরেও কবি উপজীব্য করেছেন দেশপ্রেম, ইতিবাচক মানবিক চেতনা ও ঐতিহ্যসংলগ্নতা। তবে সব কিছু ছাপিয়ে সেই ঐতিহ্যের রোদেলা দিন’, যা ছিল হৃদয়ের অনুপম প্রাপ্তি, হারানোর যন্ত্রণাটিই কবির অন্তরাত্মাকে প্লাবিত করে। সূচিত উজ্জ্বল সময়টি ক্রমান্বয়ে মৃত্যুময়তার কালো গর্ভে নিপতিত হওয়ার ঘটনাপুঞ্জ তাঁকে করেছে যেন হতবাক ও নৈরাশ্যকাতর । এই দু;সময় কবিমানসে রোদের কঙ্কালহয়ে ধরা দিয়েছে। তিনি অন্তরে শুঁষে নিয়েছেন প্রগতিমৃত্যুর বেদনা। এই ক্লেশটি তাঁর কবিতায় কখনো এভাবে মূর্ত হয়ে ওঠে-
সময় ব্যর্থ হয়ে যায়, এই জলকণা, এই দীর্ঘ ইতিহাস
মেধার মন্দির থেকে নেমে যায় রক্ত, লোহিতকণিকা
একাকী রাতের কাছে- এই অব্যক্ত হাওয়ায়
অবিরাম লতার কৌশলে ঝরে -জীবনের জল!
-সন্দিগ্ধ বর্ষায় ভাঙে জলকেলি

সময়ের অন্ধকার কবিকে বিপন্নতা ও বিমর্ষতায় ‌আচ্ছন্ন করে তোলে। তিনি উচ্চারণ করেন-
যখন সঘন অন্ধকার, একে একে গলে যায় অন্ত:পুর
কতিপয় আরশোলার হুল ছুঁয়ে যায় তৃষ্ণার ঠোঁট
নিজেকে খুঁজে পাই কাঁচের ভগ্নস্তুপে
আমি কী মৃত্যুর খোলস ঢাকা রয়েছি অনাদিকাল!
-মৃতের খোলস

এভাবে কবিকন্ঠে শুনি প্রতিক্রিয়াশীলতার নখদন্তে আহত এই সময়ের কড়চা। তবে এর মাঝেও কবি যে আলোসন্ধানী তা বুঝতে আমাদের অসুবিধে হয় না। আর সেই আকাঙ্ক্ষিত আলোটি হলো শান্তিময় ও বাসযোগ্য স্বদেশ-পৃথিবীর আলো। স্বাধীনতা ও মানবিকতার বিপর্যয়ের দারুণ ছবি আঁকেন কবি-
আমাদের স্বপ্ন, ঘুড়ি আর ওড়ার স্বাধীনতা
ক্লান্ত হয়ে মিশে যায় ঘূর্ণিস্রোতে
বাণিজ্যবাতাস গায়ে মেখে
আমরা হয়ে উঠি সময়ের ক্রীতদাস।
-মাথার ভেতর অন্ধঘুড়ি ওড়ে

সত্য যে, পরিপার্শ্বের এই বিপন্ন দশাগুলো থেকে কবিমনে নৈরাশ্যবোধ জন্মায় ও তা একপ্রকার শূণ্যবোধও বয়ে আনে। সমকালীন বাস্তবতার নিরিখে এ ধরনের চৈতন্যের উপস্থিতি খুবই স্বাভাবিক। স্বদেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা থেকেই এর উদ্রেক। দেশ, দেশের মাটি, মানুষ, নিসর্গ ও লাল-সবুজ পতাকা কবির প্রাণে কতটা মহিমময় অবস্থান জুড়ে আছে তার প্রমাণ এই কবিতাংশ-
পৃথিবীর উর্বরতম এ মাটি আমার পবিত্র স্বাধীন ভূমি
এখানে ঘুরপাক খায় প্রতিদিন সহস্র গানের কলি
সুরের ছোঁয়ায় জেগে ওঠে কুলি ও মজুর
তাদের চেতনার ভাঁজে এ মাটি বহমান জন্মের সমান্তরাল;
এই হলুদ মাঠ আর শীতপ্রবণ ঘাসের পাঠশালা
দিয়ে যায় পিঠা-উ
সব, লাল-সবুজ পতাকার
গৌরব জড়ানো দিন...
          -পউষের কবিতা

কবি বীরেন মুখার্জী
কবি বীরেন মুখার্জীর কৃতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিকটি, আমার মনে হয়েছে, তাঁর চিত্রকল্প নির্মাণ-কুশলতা। তাঁর চিত্রকল্পগুলো সরল চিত্রীর আঁকা প্রত্যক্ষ ছবি নয়। দৃশ্যমান শ্রেণীর চিত্রকল্প অনেকের কবিতাতেই থাকে, কিন্তু তাঁর কবিতায় এটা নেই। তাঁর চিত্রকল্পগুলো গভীর অন্তর থেকে উঠে আসা এমন ছবি যাতে রয়েছে অন্তরেরই পুরো ছাপ,-অর্থা শুধু বাস্তবের রংয়ে নয়, অনেকাংশে হৃদয়ের রংয়ে আঁকা। প্রাণ থেকে উসারিত এ সব ব্যতিক্রমী ছবিই তাঁর কবিতাগুলোর অধিকাংশ এলাকা জুড়ে। চিত্রকল্পগুলো খুব তরতাজা, স্বাদু, দৃষ্টিনন্দন এবং ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অনুভব্য। আমি বলবো, এগুলোর সব শুধু বিমূর্তই নয়, কিছু আছে পরাবাস্তবও। তাঁর নান্দনিক চিত্রকল্পমালা থেকে কিছু উদাহরণ তুলে আনছি-
১. শীতকাল ফুটে থাকে কুয়াশাপ্রচ্ছদে
২. চুম্বনক্লান্ত ভোরের মখমলে গতিশীল ঘোড়ার টগবগে ওড়ে লাল ধুলো
৩. অবচেতনের জল ঠোঁটে নিয়ে উড়ে পাচ্ছে মেঘ/ কাশবনের ধার ঘেঁষে
৪. পূর্বনির্ধারিত বিকেলগুলোর ডানা ভেঙে রোদ/ তুলে ধরে বুকের ঐশ্বর্য; বানান ভুলতে থাকা/ কামপ্রবণ চোখেরা ঢুকে পড়ে ধ্রুপদী নাচশালায়
৫. অবশেষে হাতের তালুতে দেখি পাতাঝরা শীত
৬. ঠোটেঁ প্রসঙ্গ মাখে শিল্পের শিশির
৭. নির্বোধের মতো অনুরণিত স্ক্রিপ্ট খুলে/ বেড়িয়ে আসে ঘোরানো সিঁড়ি, কাঠের ঘোড়া/ মাটির পরী- যুগপ
ছায়া ও নারী

কবি শুধু নিসর্গ থেকেই নয়, মিথ ও ঐতিহ্য সহ জীবনের নানা ভূমি থেকে আহরণ করেছেন তাঁর কবিতার ছবির অনুষঙ্গ। আর সেগুলোকে সাজিয়েছেন গাঢ়বদ্ধ বাণীবন্ধে। ভাষিক বিন্যাসের দিক দিয়ে তাঁর সবগুলো কবিতাতেই রয়েছে দারুণ আধুনিকতার ছাপ। তাঁর শব্দগুলোও ব্যঞ্জনাপূর্ণ, শক্তিমত্তাময়। তিনি প্রচুর অর্থবোধক, বিশুদ্ধ যুগ্মশব্দ নির্মাণ করেছেন। তাঁর ভাবনাগুলো একনাগাড়ে ভাষায় গড়িয়ে চলে, থমকে দাঁড়ায় দাঁড়ায় না কোথাও। এই প্রবমানতা একবারেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর প্রতিটি কবিতাই আপন ছন্দের মাধুরি মাখা। তিনি অক্ষরবৃত্তের অসমপর্বিক কবিতা যেমন লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন গদ্যছন্দ ও মুক্তগদ্যের কবিতা। যে কোনো বিচারে কবিতাগুলো শিল্পোত্তীর্ণ হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। আমি গ্রন্থটির বহুল প্রচার ও বিপনন কামনা করি।


[গ্রন্থ পরিচয়:- হেমন্তের অর্কেস্ট্রা (কাব্য)। লেখক- বীরেন মুখার্জি। প্রকাশক- কবি প্রকাশনী, ৪৩ কনকর্ড এম্পোরিয়াম বেজমেন্ট, এলিফ্যান্ট রোড, কাঁটাবন, ঢাকা-১২০৫। ভারতে পরিবেশক : অভিযান পাবলিশার্স, ৬৪/১ কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা, ভারত। প্রচ্ছদ শিল্পী- তৌহিন হাসান। মূল্য- ১৪০ টাকা।]



রোকসানা লেইস



ছায়াপথের সীমানায়

সোনালী সময়গুলো কেমন উজাড় হয়ে যায়।
জলের ধারা উজানে যায় যেমন, সুদূর অতিত সাথে।
প্রতিবার ঘাস ফড়িং ও শালিকের ধানী রঙ মেখে, নেমে যাই অরণ্য গন্ধ হ্রদে।
শীতল ধারায় ধুয়ে নেই না বলা কথা।

কখনো মেখলা আকাশ হয়ে যাই তোমার বুকে মুখ রেখে।
আর্কিমিডেসের সূত্রের মতন ছলকে যায় অনেক কথন।
ইউরেকা শব্দে প্রাণবন্ত হয় শান্ত জগত।

বসন্ত সমিরণ বয় খাঁ খাঁ পথ জুড়ে।
রাত্রির নিরবতা মুখর করে ঘুঙ্গুর, কেউ হাসে কেউ কাঁদে।
আমি দু চোখ ভরে তুলে নেই শব্দের জোড়াল জোয়াল, কখনো চাষ করব বলে।
একলা বসে থাকে পথিক জনারণ্যে।

ইডিপাস ভাবনা অথৈ অতল, স্বর্গীয় ঐশ্বর্যপূর্ণ অথচ মলিন।
জরাজীর্ণ বিলীন পম্পেই নগরী অথবা তাহোকু আঘাত ।
ভয়ধরা শিরদাঁড়া সব হারানোর ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে।

তবু চলমান ধাতব শব্দের মতন ক্রমাগত বয়ে যায়।
ভাবনার সুগভীর চাকা ক্লান্তিহীন তাড়িয়ে নেয়, সূর্যদোয় থেকে অস্তরাগে
প্রতি মূহুর্তের নিঃশ্বাসের মতন, বহমান জগ সংসার, ভালোবাসা সুনীল স্বপ্নে।
মিলে মিশে থাকে অবিচল।



ঠিক বারোটায়

কবিতা শুনতে খুব ইচ্ছে করছে কিন্তু না তুমি এখন বিদ্রোহি তান ধরো না।
আমি এটু আবেগী কিছু শুনতে চাই।
আবেগ সেতো বিদ্রোহীতেও আছে অথবা মৃত্যু উপত্যকায় কিংবা কিংবদন্তি
যদি ছূঁতে পারে হৃদয়।
আছে তবে তা নয়। কিছুটা ভেজা নরম শিউলি রঙ কিছুটা জোছনার মতন।
আঁধো আলোছায় যদি কখনো জলের গানের মতন মৃন্ময়ি কঙ্কন বেজে উঠে।
ঠিক তুমুল নয়; যেন নীল শর আকাশ রক্ত করবী।
রক্ত করবী! তুমি ঠিক জানো তো তুমি কি চাও?
জানি, তবে মাঝেমাঝে এলোমেলো হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
ভাগটা ঠিকঠাক রাখতে হবে।
যদি না রাখি।
যদি কৃষ্ণ বরণ কুন্তাকিন্তে বা মহাজনের মাঝি রাণীর প্রসাদ বা ভ্যাটিকান সিটি এক করে ফেলি।
তবে কি আমাকেই একা কোনো দূর দ্বীপে পাঠিয়ে দিবে তোমাদের এই সচেতন সমাজ?
দিতে পারে। তাই সাবাধান থেকো।
মায়াবী মুখের মতন চাঁদ যখন দেখি, তোমার কথা ভাবি। জান্নাতের হুর পরী আর তুমি মিলে মিশে যাও।
মক্তবে শিখা বয়ান, ফুলসিরাতের পুল তখন বড় বেশী যন্ত্রণা দেয়।
জারুলের বনে বেগুনী ফুলের নাচন দেখে, কৃষ্ণ হয়ে বাঁশি বাজাতে ইচ্ছে করে তমুল
রাধার মতন তুমি ছুটে আসবে জীবনে, এই ভাবনাই বেশী ভালোলাগে।
তুমিও মিলিয়ে দিচ্ছো সব। ভেবে বলছো তো!
হৃদয় উসারিত স্রোতের নদী নিয়ে ঠিক বারোটায় দাঁড়িয়ে থাকা।
ক্লান্তি খরনের পথ বেয়ে চলে যায় বহুদূর। মেঘের মতন মিশে আকাশের গায়।
ঠিক বারেটা, তুমি করিড়োরে অপেক্ষায় চাতক, দুপুরের সূর্য মধ্য গগনে ঠিক বারোটা
তোমার আকণ্ঠ অপেক্ষা পারদের উঠা নামা শরীর ও মনে দুজনের
অথচ পথ চলে যায় দুই দিকে।
কত বছর বাদে?
বারো
আবারও বারো? যুগের প্রভাব রয়ে গেলো এখনও আমাদের ঘিরে। সনাতন অথবা আধুনিক
কোন ভুবনে আমাদের বাস? কোন জটিল সীমারেখা জড়িয়ে রাখে, ক্লান্তির ঘামে নুয়ে দিতে চায় নিকানো উঠান।
তোমাকে নিয়ে যেতে চাই এক জায়গায় যাবে?
কোথায়, কতদূর?
দূরে নয় বাড়ির কাছে আরশি নগর, ভাবনার দ্বর খুলে লালনের কাছে,
সেখানে না হয় খুঁজব দুজনে, কি জাত এই সংসারের...কতটা ভেবে বলতে হবে কথা।

 কেন হৃদয়ের কছে থেকেও এই দূরে থাকা।

নাজমুন নাহার



রোদচশমা
তেহরানের খরা জমিনে লাগিয়েছি মুদ্রা গাছ
কোন একদিন ঘাস এবং বৃক্ষের পাতা গজালে
মারিয়ামের সন্তানের একটা খড়ের ঘর হবে
এ রকম ভাবনা যকিঞ্চি থাকতেই পারে-

তবু ঘোর লাগা বেষ্টনী তুমি দিলে
গত দিনের কিছু হৃদয় বিহীন মুঠোফোন
রোদচশমার আদলে একটা প্লাস্টিকের জার
এবং জাফরান-
শুনো নিকেশ এর কিছু ব্যপার থাকে-
এখন যেমন আমি দুধের দীঘিতে ডুবলে পাবো না
উল্টানো আঙ্গুর  গাছ
আনারের জমি এবং
হং টং বলে ছুটে আসা কিছু রাক্ষসের পা-

অথচ এই মেঘবিহীন রাতে তুমি  বলো  
তুমি এখন চশমা পরো না
ব্যান্ড বিহীন  ঘড়িটাও
টেবিলের কোনায় পড়ে থাকে-
শুধু একজোড়া চোখ
গোল গাল চশমার আংটায়
সেখানে তার অথবা আমার নিকেলের রক্ত
তোমাকে তো পাইন গাছের কথা বলিনি
সেও আজ থাকুক
সব কথা সকল সময় বলা  হয় না


অবিনশ্বর
নশ্বর নগরীতে দিলাম অবিনশ্বরীয় লীলা
তবু হাহাকার
গেঁথে ফেলো বর্শা দিয়ে ইরাবতী নদী
কোরাল গ্রামের জিয়ল মাছ মরছে
নীল সাপের বিষ ফনায়

সারারাত ক্ষুন্নিবৃত্তি
ইটালীর রুনের বিকেল কাটে এপেলোর সাথে
শিথিল হয়েছে রংচটা গাউন-

তবু অচেনা বিন্যাস
কেনো টানছে মৃত্যু

এক গাদা উপগাঁথা ম্লান হয়েছে

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য


ফুলচিঠি

একখানিপথ এসে পড়ে আছে পায়ের কাছে। পথের নাম নীলতোয়া হাওয়া। হাওয়ার শরীরে ধূলিগন্ধ ইতিহাস। আমাদের ইতিহাস ঢাকা পড়ে আছে। পুরনো চাদর ভাঁজ করা আছে। কার্পেটের নকশায় পতঙ্গ বিলাস। আমার চুলে নিমিঝিমি কাশ। কাশবনে শাদাপথের গল্প। এইপথ এসে অন্ধ হয়েছে ধ্যানে। আমাদের হাত ধরে সে ঝড়ের হবে। আমরা আমাদের খোঁজে মুগ্ধ আর অধীর। আমরা আমাদের খোঁজে ভেঙে যাবো সকল ভিড়। এইভাবে অনেকদিন লিখেটিকে শেষ করি অ্যামিবার কাল। যা হলোবোতল আর তৃষ্ণা অসুখ। যা হলোদুধ আর শাদা টলোমলো স্তূপ। উপত্যকার ফাঁদে ডুবে গেলো ঘ্রাণের বিবর। দুহাতে চোখ নিয়ে দৃশ্য খুঁড়ে যাই, দৃশ্য খুঁড়ে যাই। খাদের একটু পরেই নীল প্রতীক্ষা দোলে আনত অভিমানে। ফেনায়িত শামুকের গতি হয়েছে বাচাল। শামুক, কাছিম আর কেঁচোর মিছিল আছে, অ্যামিবার একটু কাছে। তার পাশে শুয়ে আছে অজানিত গহ্বর। গহ্বরে কেউ আছে। ভাবছো, উড়ে যাচ্ছি! কাকের শাদা পালকে জেগে আছে আমাদের অভিলাষ। তুমি থার্মোমিটারের ভিতর পারদের বন্দীত্ব দেখে ভেবো না তাকে ছোঁয়া যায়। অচেনা উত্থানে ভেসে গেছে নির্জলা আধার। আর তুমি দীর্ঘশ্বাসে দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছো আমার চোখের বিবর। বিবরে কেউ নেই, কেউ নেইআছে শুধু নিঃশ্বাসবিবরে একা আছে তোমাদের বসবাস। নিজেকে একটা শাদাকাক ভেবে আমি মনে মনে সুর করে বলি, কাকপাখি সুন্দর, কাকপাখি সুন্দর। মাঘরাতে জাগে ফুল, লিখে চিঠি বাতাসের। কাকপাখি ওড়ে এসে নেমে পড়ে এলোচুলে। কাকপাখি সুন্দর, বাতাসের উত্তর। ফুলচিঠি ফুল হাতে প্রিসলিন উড়ে যায়, কাকপাখি তাহাদের বাসনায় ডুবে যায়।

তাকে বলি আমি চুপিচাপ, ছায়া ছায়া থাকো ঘুমের পাশে। ফুল ফুরিয়ে যাক জলে হাওয়ার কাঁপনে। রাত আরো নামুক পায়ের পাতায়। কিছুই জানি না আমি, তবে বুঝতে পারি। হয়তো রক্তের ভিতর টের পাই। যেমন তুমি গাছ, অরণ্য, নদী, নারী, ফুল, পাখি, মাছির পেখম, মাছের চোখ আর চলন, হরিণের ছুটেচলা, জিরাফের গ্রীবা, নিজের চোখ, ওষ্ঠাধর, স্তন, হাসি ও আনন্দ, রক্তের ভিতরকার যন্ত্রণা, রাত্রি, প্রজাপতি, ঝিঁঝি, জুনিপোকা, গান আর বর্ষণ ভালোবাসো। আর এইসব আমিও ভালোবাসি। তোমার সুন্দর চোখে যাকিছু দেখে তুমি মুগ্ধ হও, চঞ্চল হও, ভালোবেসে ফেলো, আমিও তেমন। কেননা আমার চোখও তোমার মতোই সুন্দর। তোমার চোখেরই যমজ সহোদর। বিস্তারিত গতকাল নামিয়েছে শরীরে যা আছে সুন্দর ও আপ্তসত্য। ক্ষয়ের পাশে আঁতিপাতি খুঁজে ফিরি পূর্বাপর সকরুণ।

বেগুনি সুতোতে জোনাক গেঁথেছে এই জন্মান্ধ চোখঘর, উঠান আর পাহাড়ের ওপার জেগেই থাকে, নির্ঘুম নির্ঘুম। ভাঁটফুল ক্ষেত উলম্ব দিগন্তচুর হয়েছে লাল অসুখ। একটি গাছের ডালে বসে একটি শাদা কাক। কাক কেমন করে শাদা হয়? কলসিতে ছয়মাস রেখে দাও শাদা হবে কাক। শূন্যতার ওষ্ঠাধরে আচঞ্চু চুম্বনে সে বাজাবে রাতে দীর্ঘরাতের শাঁখ, শাঁখের করাত। দীর্ঘশ্বাসের পাশে আমি চুপিচাপ বসে থাকি চিরদিন। ইদানীং বাতাসও আসে সিজোফ্রেনিয়াক সিটিজেন। তার পাশে শুয়ে থাকি আমি দৃশ্যখোদক। দৃশ্য খুঁড়তে খুঁড়তে নীরবতা নামে ধানক্ষেতে, জাগে গূঢ় নক্ষত্রের দাগ। পতঙ্গ কারো বুকের ভিতর সুমসাম উড়ে। ওখানে দুলছে আলোর নিষাদ। আলোর গন্ধে আর খড়ের আগাছায় ছেয়ে আছে তোমাদের মাঠ। শুক্লচোখে দেখি চাঁদ পুড়ে ছাই। এই চাঁদ রূপজীবার ত্বকে পুড়ে গেছে; এই চাঁদ ভিক্ষার নেশায় পথ হনন করে। আমরা ফিরে যাই গোরের নদীস্বর। তার মানে ধানক্ষেতে তার গূঢ় সর্বনাম, স্ট্রবেরির গোপন রুমাল। রুমালের ভাঁজে লুকোয় বাতাস। আমি সবকিছু কেচে দিয়ে বাতাস ছিঁড়ে ফেলি। পাশাপাশি ক্যানভাস সাজানো, ছড়ানো রং আর ব্রাশ। রং চিনি একা পূর্ণিমার পরে। যে গেছেসে স্তনহীনপুষ্পের চির দুর্গন্ধ পাতালেসুন্দর সবকিছু আছে, পাশে ও প্রবাসে। প্রবাস পাহাড়ের ওপারে। আমি পাহাড়ে থাকি, আমরা থাকি। আমাদের দেহে রোদ শুকিয়ে যায়। ইদানীং সবকিছু কেচে দিয়ে বাতাসে শুয়ে থাকি। সে আর সে আসে। তারা ধ্বংস হলে খুঁজি বাতাসের ছাই। তারা কখনো থাকে না আর। থাকে বইয়ের ভিতর মৃদু পোকাস্বর, কিছুটা টারমাইটে, কিছুটা অক্ষরের দেহে। ত্রিমাত্রিক স্বরবর্ণ জেগে ওঠে, জেগে উঠে প্রবীণ জনপদ আর নদ। নদের কঙ্কালে মাটি। সে আর সে আসে, এইভাবে আসে বাতাসের ছাইয়ে। তারপর একটি বেদানাগাছের ডালে বসে থাকে একটি শাদা কাক। আচঞ্চু সে কাকে করে চুম্বন, বাজায় রাতে দীর্ঘরাতের শাঁখ, শাঁখের করাত? 



সৌমিত্র চক্রবর্তী



বিমূর্ততায়


সারা পার্বত্য জীবন জুড়ে বাঁশির আত্মহনন
জলপিপি নেবে উজ্জ্বল ছটপটে
কিশোরী বয়স ককটেলে গুলে দেব
ধূ ধূ শূন্য সরষের ক্ষেতের মাঝে আঁকাবাঁকা রাস্তায়
রূপোলী ফ্রেমে প্রেম এঁকে দিলে
চুলের দুপাশে আল্পসয়ের বরফ বেছে নিও,
অস্থির পশ্চিমে ফেলে রাখা পেগের ভেতর
 
মুছে যায় সিঁদুরের রঙ...
আমি তো জানি গ্যালাক্সি বিছানো
সযত্ন আদর তুলে রাখা গ্রহানুপুঞ্জের ভাঙাচোরা লাশেদের ফাঁকে,
দিন থাকে যান্ত্রিক দিনলিপি ত্বকে,
ঠোঁট রাখি উচ্চকিত সুতনুকা ঠোঁটে
 
হারালেই ফের খুঁজে বসত গড়ি জংলা নিষাদভূমিতে।

শিপা সুলতানা


পালকের ব্লাউজ

বুলবুলির পুচ্ছের লাল একগাছি রোম গেঁথেছিল জুনিয়া গাছের কাঁটার আগায়, হাত বাড়িয়ে অতি সাবধানে পালকগাছা অক্ষত তুলে আনে কমল। বামহাতের মুঠোর ভেতর শালিকের তিনগাছা পালক, বশিরদের শিমুল গাছের আগা থেকে কুঠা দিয়ে নামানো তোতাপাখির ডানার একগাছা, বিমানদা'দের লিচুগাছের খোড়ল থেকে কাঠঠোকরা পাখির লেজের আরেকগাছা, দক্ষিনপাড়ার ছয় চৌধরীদের আমবাগান থেকে কুড়ানো মুনিয়া পাখির বুকের নরম দুইগাছা পালক মুঠো করে ধরা, সারা পাহাড় ঘুরে ঘুরেও একগাছা ময়ূরের পালক পেল না সে! লাল রোমখানি আলতো করে বুকপকেটে রাখে কমল, পালকগুচ্ছের মাথায় লাল রোম গাছা রিবনের মত বেঁধে দিলে কেমন করে যে জ্বলে উঠবে আফিয়া...

ছড়ার পানি এক লাফে পেরিয়ে পাহাড়ে উঠতে গিয়েও ফের এপারে ফিরে আসে কমল, ছড়ার কাছ ঘেঁষে কাকড়া-ছুবার গোড়ায় ধবল সাদা একটি নুড়ি পাথর, ছোটবেলায় তারা বলত দুধপাথর, পালকের গুচ্ছ সাবধানে রেখে পাথরটি তুলে আনে সে, তারপর উরুর কাছে লুঙ্গিতে মুছে কোমরের ভাঁজে লুকিয়ে রাখে, এখন দুপুরের আগে আগেই যদি কোনাকুনি মেরে উত্তরপাড়ার গোরস্থানে যাওয়া যায়, দু’একগাছা ডাহুকের পালক পেলে পেয়েও যেতে পারে

-তুমি হাসর ফৈড় দিয়া কিতা করতায় আফিয়া?
-জমাইতাম, জমাইয়া একটা ব্লাউজ বানাইতাম, আর হুনো কমল ভাই, তুমার সবতাত কেনে অত আগ্রহ? খালি বেটিনতর মাতো থাকো, বাড়িত যাও!
বাড়িত যাও বললেও রেশমি রোমালের উপর সুপারগ্লো দিয়ে কাঁচপাথর বসাতে থাকে আফিয়া।
-আমি তুমারে হাসর ফৈড় আনিয়া দিমু আফিয়া, তুমি ফৈড়র ব্লাউজ বানাইবায়।
-পাগল!

পাখির পালক খুঁজতে পাহাড়ে বেরিয়ে ফাইনাল সেমিস্টারের পরীক্ষায় বসা হলো না আজ, এইসব বৈষয়িক বিষয়আশয় কত আসবে যাবে, আফিয়া একটা সখ করেছে এটাই বড় কথা। পাথরটি কোমরে ঠিকঠাক গুঁজে আবার ছড়ার পানিতে উবু হয় কমল, সাদা বলির উপর এক গাছা বালিগড়া মাছ রোদ মাথায় দুপুরের ঘুম সেরে নিচ্ছে, অদূরে এক ঝাঁক ডানকিনে মাছের ছানাপোনা ডুব সাঁতার ডুব সাঁতার খেলছে, আরেকটু দূর খাবারদাবারের প্রতি প্রবল অনীহা দেখিয়ে লুকটি বনের মাথায় বসে আছে এক কিশোরী মাছরাঙ্গা। কমল ঝুঁকে এক আজলা পানি মাথায় দেয়, আফিয়া সাঁতার শিখেছিল তার কাছে, 'কমল ভাই, দেখিও আমারে ছাড়িও না, ছাড়লে আমি ডুবি যাইমু'! আফিয়ার ছোটো চাচা হাল ছেড়ে দিলেন, এত বয়সে বোকা ছাড়া কেউ সাঁতার শিখে! কমল যেন আফিয়াকে পেয়ে গেল, বিবিজি পুকুর ঘাটে সুপারি কুঠনি নিয়ে বসতেন আর রাজবাড়ির রাজহংসীর মত তার বুকের কাছে সাঁতার কাটতো আফিয়া। বিবিজি বলতেন, 'ও বইন, পানি থাকি উঠিয়া আও।’
কমল আর এক আঁজলা পানি তুলে মুখে দেয়, অনেকক্ষণ ধরে দূরে কোথাও থেকে একটা কাঠঠুকরার ঘর বানানোর শব্দ আসছিল, কমল আন্দাজ করে সেটা কতদূর!
-আফিয়া, তুমার লাগি পিঙ্গলা পাহাড়র মাথাত ঘর বানাইমু, বটর ডালে কাঠর ঘর, দিন রাইত তুমি আর আমি কাঠর ঘরও বইয়া আসমান আর আসমান দেখমু!
-কেনে? মাটিয়ে তুমারে তার উপরে আর জায়গা দের নায় নি?
-তুমারে লইয়া মাটিত ঘর বানতে মন চায় না, তুমি মাটিত বাস করার মানুষ নি!
-কিতা যে কও পাগলর লাখান! বাড়িত যাও কমল ভাই।

পুবের কুঠে তুকমা বন পেঁকে ঠেছে, বাড়ির ছেলেমেয়েরা যার যার কাস্তে আর ডালা নিয়ে ঢুকেছে বনের ভেতর, আফিয়াও তার ভাগের তুকমা ডাল কেটে এনে কমলের পায়ের কাছের ডালায় রাখছিল, রেখেই আবার ঢুকে যাচ্ছে বনে, পাঁকা তুকমা খোসা থেকে বেরিয়ে যেন জড়িয়ে ধরেছে আফিয়ার জামা, রেশম চুল, ঠোটের পাশে দেখো কেমন তিলের মত কামড়ে আছে একটি কালো বিচি! তুচ্ছ একটি তুকমা বিচিরও কী ভাগ্য!
-আমি তোড়া কাটিয়া দেই আফিয়া?তুমারতো গরম লাগি যার।
-চুপচাপ যেখানো আছ, বই থাকো, তাইন আমারে হেল্প করতা!
ফের বনের ভেতর ঢুকে যায় আফিয়া, কমলও উঠে, দা দেও আফিয়া, তুমি গাছর তলে গিয়া বও।
-চকুর সামনে থাকি যাও চাই কমল ভাই, আর হুনো, সারাদিন খালি পিছে পিছে ঘুরো কেনে?মানষে দেখলে কিতা কইবো?
তুকমা কাঁটা মাথায় উঠে আফিয়ার, হাত ভারী হয়ে আসে, বনের ভেতর পা ছড়িয়ে বসে, কমল ভাই সামনে এসে ঘুরঘুর করলেও ভালো লাগে না, আবার হোস্টেল থেকে কোনো এক শুক্রবারে যদি বাড়ি আসে না, সারা স্বর্ণপাশা গ্রামখানি যেন বিদ্রুপ করে তাকে নিয়ে, কমল ভাইও যতই যাও যাও বলে, তার যেন কানে তালা, দেখো কেমন হাসি হাসি মুখ করে কাঁঠাল গাছের গুড়ায় বসে আছে, ডাল কাটা শেষ হলে ডালা বাড়ি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে, বারান্দায় বসে বিবিজির কুঠনি থেকে কুঠা সুপারি খেতে খেতে তার ডাল ঝাড়া থেকে বয়ামে ভরা পর্যন্ত চোখের নজর সরাবে না।

-তুমি ইখান থাকি যাও, হাতের চিকন রামদা খানা শক্ত মাটির উপর ঠুকতে থাকে আফিয়া।
-তুমি আমার লগে ইতা করো কেনে? আমার ভিতর পুড়ি যায়, আমিতো তুমারে ছাতাইয়ার না, বই থাকছি, তুমি তুমার কাম করো।

কমলের ভেতরটা যেন বনপোড়া শালকাঠের মত চড়াত চড়াত করে ফাটতে থাকে। বাড়ি আসা, সেটাতো শুধু আফিয়ার জন্য। আজ পর্যন্ত দশটা দিন একনাগাড়ে শহরে থাকতে পারেনি সে, সেই ছোটো বেলায় তার পায়ের নীচ থেকে মনফলের কাঁটাটাও দাঁত দিয়ে তুলে এনেছে কমল! আফিয়া কি কোনদিন আর শৈশবটা এনে গাঁথবে না আজকের সাথে?
-তুমার লাগি এখতা আনছি, কক্সবাজার গেছলাম।
-তুমার জিনিস আমি কেনে নিতাম? যাও ইকান থাকি।
-সামান্য একটা জিনিস, নেও না প্লিজ?
-কিতা যন্ত্রণা করো খালি? যাও কইলাম!
-দেখলেই খালি যাও যাও করো কেনে? একদিন কই থাকি কই জায়মুগী দেখিও!
-কই আর যাইবায়? আইজ কাইল লন্ডন আমেরিকাও বাড়ির বাল্লাত!
-আরো দূরই! নিবায় নি তে?
-দেখি জিনিস কিতা?
-সেন্টমার্টিন গেছলাম, কোরাল মাছর একটা দাঁত আনছি, লকেট বানাইছি টাউন থাকি, আর কয়টা লাল রঙ্গর পাথর।
-মাছর দাঁত? তাও সুনা দিয়া লকেট? তুমার পড়ার টেবিলো রাখিও, শক্তি পাইবায়।

কমলের চোখের ভেতর পানি জমতে শুরু করে, দাঁতটি সে সারাটি পথ বুকপকেটে করে এনেছে, ঘুম লেগে গেলেও ছাত করে উঠে দেখেছে যে দাঁতটি ঠিকটাক আছে কিনা, আর পাথর নিয়ে বন্ধুদের কি রসিকতা! তার কেবলই মনে হচ্ছিলো আফিয়ার দুধরাজ সাপের মতো ধবল চিকন গলায় সোনার চিরল সুতায় বাঁধা কোরাল মাছের কালো দাঁতটি লম্বা একটা জরুলের মতো সেঁটে থাকবে কামিজের ভেতর।

তিন আঁজলা পানি খেয়ে ছড়ার ওপারে এসে পাহাড়ে উঠতে থাকে কমল, গ্রামের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে বড়পুতার মুকাম, পাথুরে সিঁড়ির দুপাশে ঘন ফনীমনসার ঝুপ, ঝুপের মাথায় কুণ্ডলি পাঁকিয়ে ঘুমিয়ে আছে একটি পাটোয়া সাপের বাচ্চা, মাজারের উঠানে উঠে পা থেকে জুতো খুলে চারপাশে চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর বড় ঝামা পাথরখানার দিকে এগুতে থাকে, কঠিন মানতের মুকাম বড়পুতা, হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্ট যাওয়া যাবে না, গেলেও মামলা জেতা অনিশ্চিত, সেখানে বড়পুতা, পাঁচ বন্ধুর এক আস্তানা, চারজন মুসলমান, একজন হিন্ধু, এমন গরম মাজার এই ইউনিয়নে আর নাই, হেজিপাজি দাবি নিয়া কেউ আসে না এই মুকামে, কতজন ভয়ে অজু নষ্ট করে বাড়ি ফিরে গেছে জোড় অজগর দেখে, জোড় অজগর দেখাই ভাগ্য, এক পলকে কপাল খুলে যায় তার দেখা পেলে, তাই বারে বারে আসে কমল, আজও মাথার উপর বটের ঝুরিতে সরসর শব্দ শুনে মুখ তুলে তাকায় সে, দূরে শরিফা গাছের মাথায় কি যেন মেঘের মতো! শূন্য পাথরখানায় জোড়সাপের অস্থিত্ব কল্পনা করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে কমল, সে হয়ত দেখছে না, সাপযুগল তাকে দেখছে, যদি দয়া হয়, একটিবার ইশারা করে, আফিয়া আর দূর দূর করে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দেবে না তাকে, একদিন ঠিকই স্বপ্নে দেখবে সে ছাড়া আর কোনো ঠিকানা নাই কমলের।

যে পথে উঠেছিল সেই পথ বাদ দিয়ে বনের পথ ধরে কমল, দুপুরের নিঝুম বনে দু’এক কাঠবিড়ালি, ছড়ার পারে কেয়াবনের ভেতর ছানাপোনাসহ এক বনমুরগি, ডালে ডালে কিছু বাঁদর। বাদবাকি সব ভাতঘুমে কাতর, ছায়া দেখে চিকন একটি ছড়াতে পা ডুবিয়ে বসে কমল, বোশেখ মাসের গরম যেন মাথার মগজ গলিয়ে দেবে। পায়ের পাতার উপর ডানকিনে মাছের ঝাক হামলে পড়েছে, সে ঘুমানোর চেষ্ঠা করে, সিঁড়ির উপর হেলে পড়েছে বুড়ো একটি তেজপাতা গাছ, সেই গাছে পা ঝুলিয়ে বসেছে আফিয়া, তাকে উপরে উঠে আসতে দেখে ডাল ধরে ঝাকুনি দেয়, সুগন্ধি পাতারা কমলের নাকমুখে কোন এক অদেখা জগতের যেন দুয়ার খুলে ধরে, এরই মাঝে দেখে সে আশ্বিন মাসি একজোড়া চাঁদ গড়িয়ে নামছে হেলেপড়া তেজপাতা গাছ থেকে, চকিতে লুফে নেয় সে, কী ঠান্ডা কমল পেলব, যেন ভেনাসের মুকুট থেকে খসে পড়া একজোড়া মুক্তা পাথর! জোড়া চাঁদের কোমলতা তার হাত বাহু কন্ঠ হয়ে ছুটাছুটি করতে করতে নাভিমূল সহ পেছিয়ে ধরে।

-তুমি ইলা গাছর ডালও বইও না আফিয়া, কুনদিন পড়ি যাইবায়।
কমল দুধরাজ সাপের মত ধবল গ্রীবার নিচে ভয়ে ভয়ে তাকায়, তারপর সিঁড়ির নিচ্ হয়ে ফের দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে আফিয়ার জোড় চাঁদের দেশে,
-চিন্তা করছি আর পড়াশোনা করতাম নায়, গাউ ছাড়িয়া দূরই যাইতে ভালা লাগে না, তুমি কিতা কও?
-আমি তুমার কে যে কইমু? তুমার হাতও কিতা?
-তেলর বিচি।
কমল এক মুঠো তেলবিচি আফিয়ার হাতে দেয়, গ্রামে এখন একমাত্র তাদের বাড়ি তেলগাছ অবশিষ্ট আছে, লম্বা চেপ্টা রক্তরঙ্গা চকমকি বিচি কোচড় ভরে এনে বারান্দায় বসে খেলত আফিয়া, কমল দিনভর গাছের দিকে তাকিয়ে থাকত কখন ঝুপ ঝুপ করে পড়বে বিচিগুলো,
-তেলর বিচি? দূর ইতা দিয়া আমি কিতা করতাম!
মুঠোভর্তি তেলবিচি বাড়ির বাল্লায় ছুঁড়ে ফেলে আফিয়া।

ধড়ফড় করে উঠে বসে কমল, ঘুমের ভেতর কি একজীবন পার হয়ে গেছে? উঠতে চেষ্টা করে, কালঘুমকে প্রশ্রয় দিতে নেই, পা দুখানা ভারী হয়ে গেছে, এমনিতে ছড়ার পানি জগতের সবচেয়ে ঠান্ডা পানি, কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল কে জানে, কিন্তু বনের মাথায় যেই সেই রোদ, অনেকক্ষণ ঘুমালে রোদের উপর পর্দা থাকত, তাহলে হয়ত ঘুমায়নি সে, কি যে হয়েছে আজকাল, জেগে থাকলে মনে হয় আফিয়া চুরি হয়ে গেছে, বুক ধড়ফড় করে, ঘুমিয়ে থাকলে মনে হয় আফিয়া চুরি হয়ে যাবে, তাই উঠে গিয়ে তাদের বাড়ির সিঁড়ির নিচে বসে থাকে
বন থেকে বেরিয়ে দেখে এখনো সেই বাচ্চাগুলো ছড়ার ভেতর মাছ খুঁজছে, মুকামের উপর থেকে দেখেছিল পরনের লুঙ্গি, গায়ের জামা খুলে হাটু পানিতে মাছ খুঁজছে, এখনও আছে যখন, তখন গোরস্থানে যাওয়া যায়, ঠিকঠিক দুপুর বেলা চরতে ফিরতে আসে এক জোড়া ডাহুক ডাহুকি, খেলতে খেলতে দুএক গাছা পালক যদি ফেলে যায়! পালকের ব্লাউজ বানাবে আফিয়া, নরম কোমল!

পনেরোটা দিন থেকে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে এর কোনো কূলকিনারা করতে পারছেনা কমল,
-তুমি হাছা হাছা আমার কলিজা চাওনি আফিয়া?
-কিতা কও পাগলর লাখান? হুনলেউ ঘিন করে!
-ঔদিন নু কইলায়?
-কুনদিন? কুনসময় ঢং করি কিতা কইছি, মনো আছেনি?
-তুমি আমারে চাও না আফিয়া?
-কিতা করো কমল ভাই? হাত ছাড়ো কইলাম...
-সরি আফিয়া, একটা বার খালি কও তুমি আমারে চাও...
-বাড়িত যাও।

বাড়িত যাও, বাড়িত যাও, বাড়িত যাও- পালক ধরা হাতে কপাল চেপে ধরে কমল, অগ্রান মাস, এরই ভেতর বন ফাঁকা হাওয়া লেগেছে, আজও মুকামে এসেছিল, জোড়সাপের দেখা মিলল না, যতদিন না মিলছে, আফিয়াকে পাওয়া হবে না তার! শীতের খবর বুঝতে না বুঝতে দেখো নাবতলার পানিতে টান ধরেছে, পাহাড় ভর্তি নাবতলাতে, দিনভর পানির ঝিরি ঝিরি শব্দ, সারা পাহাড় জোড়ে সুতানালি সাপের মত ছড়িয়ে আছে পানির ধারা, সমতলে জড়ো হয়ে ছড়ার যেন হাট বসিয়েছে, অথচ খাবার মত পানি মিললনা কমলের।

ধবধবা চন্নি রাত, এমন রাতে মাথার দিকের জানলা খুলে রাখে আফিয়া, সেই জানলার সামনে দাঁড়িয়ে কেঁপে উঠে কমল, জানলা বন্ধ, আজ আফিয়াদের বাড়ি আসতে আসতে মাঝরাত হয়ে গেলো, মাঝরাতের আগে কোনোদিন জানলা বন্ধ করে না আফিয়া, মনাদাদার কবরের কোনায় গিয়ে সেই যে শুয়েছিল ঘাপটি মেরে, দুপুর গিয়ে সারাটা বিকাল চলে গেলো মাথার উপর দিয়ে উড়ে উড়ে, সাথে কি স্বন্ধ্যাও? সন্ধ্যারাতে চাঁদের গুড়া গায়ে মেখে মেখে ডাহুকের মেয়েগুলো যৈবনবতী হয়ে ওঠে, নাচতে নাচতে যদি দু-একগাছা পালক ফেলে যায়! পাহাড় ভরা বন বাদাড়, ছড়া, কোথাও একখানা ময়ূরের পালক পেল না যে আফিয়ার পাটোয়া সাপের মত কালো পিচ্ছিল চুলের বিনুনিতে একগাছি পালক গুঁজে দেয়, এখন যদি একগাছা ডাহুকের পালক না নিয়ে যায়, আফিয়ার সামনে দীনহীন অধম ভিখারী মনে হবে নিজেকে, কাঠবাদাম গাছের তলায় বাদাম খেতে কাঠবিড়ালি এলো, শেয়ালের সাড়া পেয়ে খরগোসের ছানাটি এসে লুকালো মতি দাদার কবরের ফাটলে, বাকি রাত কাঁধে নিয়ে উড়ে গেলো বিরাট মেঘের চাকতি তবু না মিলল একগাছা নরম পালক!
-আফিয়া, আফিয়া

ফিসফিস করে জানলায় ঠোকা দিতে থাকে কমল,
-আফিয়া

ধীরে ধীরে জানলার পাল্লা যেন আফিয়ার দুবাহু মেলে ধরা ডানা তাকে জড়িয়ে ধরার জন্য এগিয়ে আসছে, এমন ভাবে খুলে যায়,
-তুমি?
কমল বুঝে না এতটা অবাক হওয়ার কি আছে?
-তুমার লাগি ওই দেখো কিতা আনছি?
-অতো রাইত তুমি এখানো?
-তুমার লাগি পাখির ফইড় আনছি, ডাহুকর ফইড় পাইলাম না আফিয়া!
-ফইড়? ইতা দিয়া আমি কার শিন্নি করতাম?
-তুমিনু কইলায় ব্লাউজ বানায়তায়? কমল মরিয়া হয়ে উঠে কথাটা মনে করিয়ে দিতে,
-কুনদিন কইছি?
রাগে কি ঘামতে শুরু করেছে আফিয়া! কিন্তু এতটা রাগবেই বা কেন? কমল কি একটা ব্লাউজ বানাতে সাহায্য করতে পারে না তাকে?
-আইজ সকালেনু কইলায়?
-কমল ভাই, আইজ পচিশদিন বাদে তুমি আমরার বাড়িত আইছও, অখন যাও, কেও দেখলে সর্বনাশ অইব!
কমলের বুকের পাড় ভাঙ্গতে থাকে হুড়মুর করে,
-তুমি ভুলি গেছ আফিয়া?
-আচ্ছা ভুলছি, অখন ইখান থাকি যাও
-তুমি ব্লাউজ বানায়তায় নায়? কত পাহাড় থাকি তুকাইয়া আনলাম...
-না বানাতাম নায়,

সারাদিনের কুড়ানো পালকের গুচ্ছ জানলার নিচে রেখে হাঁটু গেড়ে বসে দেয়ালে মাথা ঠেকায় কমল,
-যাইয়ার, তুমার লাগি আমার বুক ফাটবো গো আফিয়া, আমার কবর ফাটবো...


কয়েক মুহূর্ত যেন নি:শব্দ শুনশান মনে হলো আফিয়ার, কি যেন একটি অলক্ষুণে শব্দ কানের পাশে ঘুরে গেল! ধীরে ধীরে ফের জানলা খুলে সে, কে জানে কি হয় অগ্রানের চাঁদে, শরীর ভেদ করে আলো এসে ঢুকে পড়ে রক্তের ভেতর, জানলা বন্ধ করার মুহুর্তে কমল ভাইয়ের রক্তের ভেতর কি যেন এক ছায়া চোখে পড়ল তার, কিন্তু কমল ভাই কই? ঐযে আলোর ভেতর শিমুল তুলার মত উড়ে উড়ে ভরশূন্য হেঁটে যাচ্ছে যে আলো, ওটা কমল ভাই? কিন্তু কোথায় ছুটে যাচ্ছে সে! আফিয়া নিজের ভেতর মরণ চিত্কার দিয়ে উঠে, হাঁটু ভেঙ্গে মেঝেতে বসে পড়ে, কমল যে রেখা ধরে হেঁটে যাচ্ছে, তার কোনো গন্তব্য নেই, ভিটামাটি নেই, ভাঙ্গা বাসন, বাতিল টিন লোহা লক্কর ফেলার তিন সাড়ে তিনশ ফুট এক গভীর খাদ...

মনোজিৎকুমার দাস


সোনার আংটি বাঁকাও ভাল 
এক
হবু বর ও বরের ভগ্নিপতিরা শিবানীকে পাকা দেখা দেখতে এলে ইন্দুবালা প্রথম হবু নাতজামাই ব্রজগোপালকে দেখে কেন যেন অস্বস্তি বোধ করে। সাত ক্লাসে উঠার আগ থেকেই প্রভাত ও তার বউ মিনতি তাদের বড় মেয়ে শিবানীর বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। ইন্দুবালা ভাবে এহনকার দিনি এতটুহু মিয়্যার কেউ বিয়ে দেয়? আমাগেরে কালে না হয় এটা ছ্যাল। মুইর বিয়ে তো হইছেলো এগারো বছর বয়সে। কার্তিক মন্ডলের বাবা মুইকে পণ দিয়ে বেটার বউ করে ঘরে তুলিছিল।
পরক্ষণেই সে আবার ভাবে- এতটুহু বয়সে বিয়ে না দিয়েই বা করবি কী পিরভাতে। ছাওয়াল হবি হবি করে পিরভাতের বউ চারডা মিয়্যা বিয়োইছে। পিরভাতে এডা ওডা করে যা কামাই করে তাতে ওদের সংসারই তো চলে না। একটুহু বয়সে বিয়ে না দিয়ে কীবা করবি পিরভাতে।
তার সোয়ামী কার্তিক মন্ডল তার বউ ইন্দুবালাকে বলল- এখন আইন হইছে মাইয়্যার বয়স ১৮ আর ছাওয়ালে বয়স ২১ এর কম হলিপারে বিয়ে দিয়া বেআইনী।
- পিরভাতের মাইয়্যা শিবানী তো মাঘ মাসে বারো থিকে তের বছরে পরিছে।
-ঠিকই কইছো পিরভাতের বাপ। হবু নাত জামাই ব্রজগোপালের বয়স তো শিবানী হতি তিন গুণ বেশি হবেনে। তার মানে ওর বয়স সাইত্রিশ থেকে উনচল্লিশ বছরের মত হবি মনে হয়।
- তুমার লগে মুইর বিয়ে ন’বছর বয়সে হলিপারেও তুমি কিন্তুক ছিলে একুশ বছরের জোয়ান ছাওয়াল। পিরভাতের মাসি শাশুড়ি কদমবালা আর তার মাইয়্যা পরেশের বউ সোন্দরী আধবুড়ো ছাওয়ালের লগে ফুলির কুঁড়ির নাহাল মুইর নাতনিডার সব্বোনাশ করার জন্যি লাগিছে। সে সময় ইন্দুবালা আধা বয়সী ছাওয়ালে সঙ্গে শিবানী বিয়েতে অমত করলে পরেশের বউ সোন্দরী তাকে বলেছিল, চাওয়াল হল সোনার মতো। মাওই মা জানেন না সোনার আংটি বাঁকাও ভাল                                         
                                           
 
দুই

এতদিন পরেও ইন্দুবালার মনে পড়ে, কয়েক যুগ আগে অজপাড়া গ্রাম হানুগঞ্জের জোয়ান মরদ কার্তিক মন্ডলের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, তখন ইন্দুবালার বয়স আর কতো! দশ থেকে এগার হবে আর কী! তখনো তার সোয়মীর লগে এক বিছনার শুয়ার বয়স না হওয়ায় কার্তিক মন্ডল ফিরানি ভাঙতে যেয়ে বউকে বাপের বাড়িতে রেখে একাই হানুগঞ্জে ফিরে যায়।
কার্তিক মন্ডল একা বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় সে প্রথমে ঠাকুমাশাশুড়ি মোক্ষদা ঠাকুরাণীকে প্রণাম করলে সে তার নাত জামাইকে বলল, মুই’র নাতনি ইন্দু এহনো নাবালিকা, সাবালিকা হলি পারে তোমার লগে দুতিকে বিয়ের পরই তুমি ওরে বাড়ি নিয়ে যাইবা। ঠাকুমা শাশুড়ির কথা শুনে কার্তিকের মনে পড়ে তার নিজের বোন ললিতেকে সাবালিকা হওয়ার পর দুতিকে বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার কথা।
সত্যি কথা কইতে দুতিকে বিয়ের আগে ইন্দুবালা তার সোয়ামীর সাথে তেমন ভাবে মেলামেশা করতে পারেনি। কনে পাকা দেখার আগে দিন ইন্দুবালার ঠাকুমা মোক্ষদা ঠাকুরাণী নাতনিকে বলেছিলেন, ওলো ইন্দু, আড়ে আবডালে তুই কিন্তুক নাতজামাইয়ের মুকটা দেহে মুইরে বলবি তোর পছন্দ হইছে কেনা?  শুভদৃষ্টির সুময়ও সোয়ামীরে ভাল করে দেখবি কিন্তুক।
ইন্দুবালা এত বছর পরেও ভাবে আমাগেরে আমলে কী আর একালে মত ছ্যালো। পোলাপান না হওয়ার আগ পর্যন্ত দিনির ব্যালা সোয়ামীর লগে দেহা করার নিষেধ ছ্যালো।রাতির ব্যালা সোয়ামী শুবার ঘরে গ্যালি পরে শব্দ না করে দরজার খিল দিতি হতো, শব্দ শুনে শ্বশুর-ভাশুররা য্যানো জানতি না পারে সোয়ামী লগে শুতি যাছে লতুন বউ।

ইন্দুবালা ফোকলা দাঁতে হেসে মুখে হাসি ফুটিয়ে মনে মনে বলে, সে কী দিন ছ্যলোরে বাবা! সে বয়সের ভাবনার কথা সত্তর বছর বয়সে ভেবে ইন্দুবালার হাসি পায়। এত বড় বাড়ির কাউকে ছ্যাড়ে সে একা কোথায়ও থাকেনি। শ্বশুরবাড়িতে একপাল মানষের মধ্যি সে একা ভাবতিই ইন্দুবালার প্রাণটা ছ্যাত করে উঠিছিল।

লোকে বলে, বিয়ের জল গায়ে পড়লি মাইয়্য মানস্যির ডাগর হতি কয় দিন লাগে। এক বসন্ত ঘুরে আর এক বসন্ত যেয়ে শ্রাবণ আসতি না আসতিই ইন্দুবালার শরীর স্বাস্থ্য ডাগর হয়ে ওঠে। পঞ্জিকা থেকে দিনক্ষণ স্থির করে অগ্রাণের প্রথম সপ্তাহে কার্তিক ও ইন্দুবালার দুতিকে বিয়ের পর ইন্দুবালা শ্বশুরবাড়ি হানুগঞ্জে যাওয়ার আগে ঠাকুমা মোক্ষদা ঠাকুরাণী নাতনিকে বলল, লো নাতনি, নাতজামাই তো সত্যি সত্যি যেন কার্তিক ঠাকুর ঠাকুমার কথা শুনে তার মনটাতে খুশির বান ডাকে।
ইন্দুবালা শ্বশুর বাড়িতে এসে বুঝতে পারে হানুগঞ্জ সত্যি সত্যি অজপাড়া গাঁও। সে যে সময় শ্বশুর বাড়ির আসে সে সময় ছিল না মাটির রাস্তা, ছিল না স্কুল। তাদের গ্রামের মত অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়েথা হয় ধারে কাছের গ্রামের বয়স্ক ছেলেদের সঙ্গে। পায়ে হেঁটে, ঘোড়ার গাড়িতে, নৌকোয় না হয় পাল্কিতে চড়ে বর আসতো সে সময়ে।ইন্দুবালার মনে পড়ে হানুগঞ্জে শ্বশুর বাড়িতে এসেছিল নৌকায় চড়ে। 

শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাসুর, দেওর-জা আর তাদের ছেলেপেলে নিয়ে তার সোয়ামী কার্তিক মন্ডলদের বাড়ি। এত বড় একটা এজমালী পবিবারে বউ হয়ে এসে ইন্দুবালা যেন হাঁপিয়ে ওঠে। তার স্বামী কার্তিক মন্ডল লোকটা ভালই মনে হয় ইন্দুবালার। গ্রামটাতে জলের খুবই অভাব, জলের জন্যে হানুগাঙের জলই ভরসা। ইন্দুবালার বাপের বাড়িতে জলের কষ্ট থাকলেও বাজারের পাশে সরকারী ইদারার জল সারা গ্রামের তেষ্টা মেটাতো। গ্রামগুলোতে কলেরা,পক্স আর ম্যালেরিয়া মহামারীতে কত লোক যে সাবার হয় তার ইয়ত্তা ছিল না।

তিন
সোমত্ত বয়সী বউ হয়ে আসার দুবছর পর ইন্দুবালার কোল আলো করে ছেলে জন্মাল, মন্ডলবাড়ির সবাই এতে বেজায় খুশি। খুশির একটা কারণও ছিল ইন্দুবালার ছাওয়াল জন্মাবার আগে ওই বাড়িতে তখন পর্যন্ত তার জাদের কারোই কোল আলো করে ছাওয়ালের জন্মেনি।
সেদিনের কথা ইন্দুবালার স্পষ্ট মনে আছে, শ্বশুর বাড়ি থেকে সাধ খেয়ে সাত মাসের পেট নিয়ে সে তার বাপের বাড়ি কুসুমপুরে আসে। বাবা মা ও পদ্ম পিসি এর আনন্দ আর ধরে না। ইন্দুবালা জ্ঞান হওয়ার পর থেকে নি:সন্তান পদ্মপিসিকে তাদের বাড়ির হর্তাকর্তা হিসাবে দেখে আসছিল।

একদিন পদ্মপিসি বাবাকে বলল-নিত্য, তোর জ্ঞানগম্মি কি দিনকে দিন নোপ পাতিছে। পদ্মপিসির কথা শুনে বাবা বলল- কী কতা কইছো, পদ্মদি।
- ম্যাইয়ডা আট মাসে পরিছে, ওর গতরডা দেহে বুঝতি পারতিসি না একডা আঁতুরঘর বানাতি হবি! বলিহারি যাই তোর বউয়ের বুদ্ধিসুদ্ধি দেহে। 

বাঞ্চা ঘরামী তার ছাওয়াল ট্যাংরাকে সঙ্গে নিয়ে এসে একদিনের মধ্যেই  আঁতুর ঘর বানায়ে ফেলল। মাস খানেক পরে ইন্দুবালার মা হওয়ার সময় হল। জলঝড়ের এক রাতে ইন্দুর প্রসব বদনা উঠল মাঝ রাত থেকে, ছোট ভাই ভুবনকে সঙ্গে নিয়ে হ্যারিকেন হাতে নিত্য ছুটল দাইমার বাড়িতে। আল্লাদী দাইমার নাম ডাক আছে, তা এলাকার সবাই জানে। আল্লাদী দাইমা এসে পোয়াতির অবস্থা দেখে বলল- পদ্মপিসি, এতডা দেরি করে মুইকে ডাকলি! পোয়াতির পেসব বেদনা দিনির ব্যালায় উঠিছে, তুমার ছাওয়ালপল না হলিপারেও তো তুমার এদিকে জ্ঞানগম্মি ছ্যাল বলেই জানতি পারিছিলাম পিয়ারির বেডার বউয়ের পোলা হওয়ার আগে। এহন দ্যাখতিছি পোয়াতির পেসব করাতি মুইরে জান শ্যাষ করতি হবিনি।  যমে মানুষের টানাটানি চলতে লাগল। সে রাত গেল, পরদিনও গেল। কার্তিক তার মাকে নিয়ে পরদিন কুসুমপুরে এলো। বাড়িতে কান্নারোল পড়ে গেল। আল্লাদী দাইমা কিন্তু হাল ছাড়লো না। দিন শেষ হয়ে গেল, রাত যেতে প্রভাতের দিকে আঁতুর ঘর থেকে ট্যা ট্যা শব্দ শোনা গেল। তখন ইন্দুর জ্ঞান ছিল না। এক সময় ইন্দু চোখ মেললো। ইন্দু’র মা ও শাশুড়ি আঁতুর ঘরেই ছিল। এক সময় তারা পাঁচবার উলুধ্বিনি দিয়ে উঠলে ইন্দু বুঝলো তার ছেলে হয়েছে।

এতদিন পরেও সে রাতের কথা ইন্দুবালার মনে আছে। বাবা দৌড়ে এসে আঁতুর ঘরের দরজায় উঁকি দিয়ে আল্লাদির কোলে ফুটফুটে ছোট্ট খোকামণি দেখতে পেয়ে আনন্দের আত্মহারা হয়ে বলে উঠল- আমার দাদু ভাইয়ের নাম রাখলাম প্রভাত। সকাল হলে পদ্মপিসি কার্তিককে বলল- কার্তিক বাপ,  বিয়েন তোমারে বলেনি বাপকে ছাওয়ালের মুখ দেখতি হয় পেত্থমে রূপোর টাহা দিয়ে।
– হু, মা মুইকে কইছে।
 -তাহলি পারে তাই করো।
তারপর দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়। ইন্দুবালার তারপর আরো দুটো ছেলে একটা মেয়ে হল। তার জাদেরও ছেলে মেয়ে হল। এক সময় হানুগঞ্জের মন্ডলবাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে ভাঙন দেখা দিল। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে মন্ডলবাড়ি ছেলেরা যার যার মত হয়ে গেল। জমিজমা ভাগ হওয়ার পর কার্তিক মন্ডল যা পেল তার আয় থেকে তার পরিবারের ছয় ছয়টা মুখকে খাওয়ানো পরানো কার্তিক মন্ডলের পক্ষে কষ্টকর হয়ে পড়ল। মেয়েটার বয়স কয়েক মাস মাত্র। কার্তিক মন্ডলের ইচ্ছে ছিল তিনটি ছেলেকে লেখা পড়া শেখানোর। শেষ পর্যন্ত হল না। পিঠেপিঠে জন্মানো তিনটি ছেলে দিনে দিনে বড় হয়ে উঠল।  ওরা প্রাইমারী স্কুলের লেখা পড়াও শেষ করতে পারল না। ওদের বাবার শরীরটাও ভাল না। 
ইন্দুবালা মনে মনে ভাবে- পিরভাতে ছাড়াও তার আর দুই ছাওয়াল গনসা ও মঙলারও লেহাপড়া হল না। দেখতি দেখতি ছাওয়ালগুলো বড় হয়ে উঠল। তখন ছাওয়ালগুলো এটাওটা করে দুএক টাহা রোজগার করতি লাগল। পিরভাতের এতটকু বয়সে বিয়ে দিবার দরকার ছ্যাল না। কিন্তুক ইন্দুবালার শাশুড়িঠাকরোনের ইচ্ছেতে পেত্থমে পিরভাতের বিয়ে দিতি হেলো।

প্রভাতের বিয়ের আড়াই বছর পরে প্রভাতের বউ শিবানীকে জন্ম দিল। প্রভাতের বাবা কার্তিক মন্ডল বেশদিন থেকেই জ্বর আর কাশিতে ভুগছিল। শোয়ার ঘরের দাওয়ার থেকে স্বামী কার্তিক মন্ডলের কাশির আওয়াজ শুনে ইন্দুবালা সোয়ামীর বুকে তেল মালিশ করে দিলে তার কাশির প্রকোপ কিছুটা কমলো। সে ফিসফিস করে বউকে বলল- শরীলডা একডু ভাল হলিপারে গনসা ও মঙলার জন্যি মাইয়্যা দেখতি বের হতি হবি পরিমল খুড়োর লগে। সোয়ামীর কথা শুনে ইন্দুবালা রেগে বলল- মুখ টিপলিপারে দুদ বেরোনো ছ্যাওয়াল দুডোর বিয়ের জন্যি তুমার মনে রঙ ধরতিছে–দেখতি পাচ্ছি! পিরভাতের থিকে বড় ধুমসো মাইয়্যার সাথে বিয়ে দেহি তুমার সাদ এহন মেটেনি। - যুগ পাল্টে গেছে ওদুডোকে বিয়ে না দিলি কুথায় কী করে বসবিনি তার তা কী তুমার হঠাৎ করে তার কাশি উঠায় কথা শেষ করতে পারলো না।

গনসা ও মঙলা কাজকর্ম ছেড়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে লাগলে এবার সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পরলো ওদের মা ইন্দুবালা। এক সময় সে ভবলো যে তার সোয়ামীর কথাই ঠিক। গনসা বয়স আঠারো আর মঙলার বয়স কুড়ি। গনসার চেহারা ফর্সা আর শরীর স্বাস্থ্যে মঙলার চেয়ে বড় দেখায়। কার্তিক ইন্দুবালাকে বলল- মুই দুটো ছাওয়ালের বিয়ে এক লগে দিব।
সোয়ামীর কথা শুনে ইন্দুবালা বলল, তুমার যা মোতলব তাই করো। কার্তিক মন্ডল পরিমল খুড়োর সাথে নিয়ে আগে গনসার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে বের হলো। দুটো মেয়ে দেখার পর পছন্দ না হওয়ায় পরিমল খুড়ো বলল- কত সুন্দোর ছাওয়াল তুমার গনসা ও মঙলা তারা দুজন মিলে গনসা ও মঙলার জন্য মেয়ে দেখেই চলল, কিন্তু মেয়ে পছন্দ না হওয়ায় তারা চিন্তায় পড়ল

গনসার মেয়ে দেখে বেড়ানোর জন্যে গনসার বড় দাদা মঙলা নিজের বিয়ের উদ্দেশে যেন পাগল হয়ে উঠল। মঙলার বন্ধু মদনা। মদনার ভাল নাম মদনগোপাল। একদিন মদনা তার বন্ধু মঙলাকে বলল- তোর বাপ আর মা ধাপ্পাবাজবড় ছাওয়ালের বিয়ে না দিয়ে তোর ছোট ভাই গনসার বিয়ের জন্যে পাগল হইছে। মঙলা তোর বিয়ের ভার মুইর ওপর ছ্যাড়ে দে তো দোস্ত। তোর জন্যি মুই মামাবাড়ির দ্যাশে একডা মাইয়্যা দেহে রাহিছি আমি।
- তুই মুইর জন্যে মাইয়্যা দেহিছিস, তা আগে তো তুই মুইকে কইসনি!
- এবার মুই তোগেরে দুটো ভাইকেই বিয়ে দিবোই দিবোই।
মঙলার বন্ধু মদনের কথার মধ্যে মিথ্যা কিছু ছিল না। আসলেই মদনের কাজ ঘটকালী করা, তার কাছে অনেক মেয়েরই খোঁজ ছিল। কার্তিম মন্ডল আর ইন্দুবালার বাকী দুই ছেলে গনসা ও মঙলার বিয়ের ব্যবস্থা করে মদন গোপাল তার ঘটকালী পেশার কেরামতি দেখাতে কসুর করলো না। ইন্দুবালার তিন ছেলের বিয়ে সুসম্পন্ন হওয়ায় সে ও তার স্বামীকার্তিক মন্ডলের মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে গেল।
                                           
চার

কয়েক বছর যেতেই বউদের যুক্তি শুনে তিন ছেলেটা যার যার মত আলাদা হলে গেল। ছোট মেয়েটাকে নিয়ে ইন্দুবালা ও কার্তিক মন্ডল এখন ছেলেদের থেকে আলাদা। কার্তিকের বয়স হয়েছে, ইন্দুবালার বয়সও আগের মত নেই। তিনটি প্রাণীর সংসার চালাতে গিয়ে তাদেরকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রভাতের মেয়েটা এবার সাত ক্লাসে উঠেছে। সামনের পরীক্ষার পর আট ক্লাসে উঠবে। গনসা ও মঙলা দুটো করে মেয়ে, তার সবে প্রাইমারী স্কুলে যাচ্ছে। ইন্দুবালা ভাবলো- তিনটে ছাওয়ালের একটাও ছাওয়াল না হলিপারেও ওরা যদি মাইয়্যাগুলিকে লেহাপড়া শেখায় তা হলি ভালই হবি। দিনকাল বদলাছে। মাইয়্যা পেলারাও এহন লেহা পড়া শিখতিছে।
ইন্দুবালার ইচ্ছেটা পূরণ হবে না সে কয়েকদিন পরেই বুঝতে পারলো। মদন ঘটক মাঝে মধ্যেই তাদের বাড়িতে আসছে দেখে ইন্দুবালার মনে খটকা লাগল।
একদিন ইন্দুবালা বড়বৌমাকে বলল- মদন ঘটক পিরভাতে, আর তুমার সাথে কী বলতি একদিন পর পরই আসতিছে। ইন্দুবালা প্রভাতের বউয়ের কাছ থেকে জানতে পারল ওদের বড় মেয়ে শিবানীর জন্যে একটা ছেলের খোঁজ নিয়ে এসেছে। বড়বৌমার মুখ থেকে কথাটা শুনে ইন্দুবালা অবাক হয়ে বলল- এতটুকু মাইয়্যার বিয়ে! তোমরা কি পাগল হইছো? শ্বাশুড়ির কথা শুনে শিবানীর মা একটা কথাও বলল না।

কয়েকদিন পরে মদনগোপাল শিবানীর বাবা প্রভাত ও তার ভাইরা ভাই পরেশকে নিয়ে শিবানীর বিয়ের জন্যে ছেলে দেখতে যাবে এমন কানা ঘুষা ইন্দুবালার কানে গেল। প্রভাত তার মাসতোত শালিকা সোন্দরীকে নিজের পাড়ার পরেশের লগে বিয়ে দিয়ে গ্রামে একজন কুটুম করেছে নিজের শক্তি পাকাপোক্ত করার জন্যে। তিন ভাইয়ের মধ্যে মিল মহব্বত থাকলেও তিন বউতে মধ্যে মোটেই মিল নেই, প্রায় প্রায়ই তারা চুলোচুলি করে এটাওটা নিয়ে। অন্যদিকে পাড়ার কারো সঙ্গে ঝগড়া লাগলে তিন জা এক হয়ে তাদের সঙ্গে চুলোচুলি করে মাজায় কাপড় পেঁচিয়ে। ওদের শাশুড়ি ইন্দুবালাও কিন্তু ঝগড়াটে কম নয়। কারো সাথে ওদের ঝগড়া লাগলে বেটার বৌদের সাথে ঝগড়ায়  ইন্দুবালাও যোগ দেয়। বেটার বৌয়েরা ইন্দুবালাকে গন্নিমান্নি না করলেও কিন্তু ছেলেরা মাকে ভয় করে, আবার কোন রাগের মাথায় মাকে গালিগালাজও করে।

ফটকি নদীর ওপারে গোসাইগাঁও এ শিবানীর বিয়ের জন্যে ছেলে দেখতে যাওয়ার আগে প্রভাত মাকে প্রণাম করে বলল- শিবানীর জন্যি ছাওয়াল দেখতি যাতিছি। প্রভাতের কথা শুনে প্রতিবাদ করার ইচ্ছে ইন্দুবালার মনে জাগলেও শুভকাজে যাত্রার সময় ব্যাগড়া দিতে তার মন সায় দিল না। সে শুধু বলল- আচ্ছা, ভালয়-ভালয় আসগে। ছেলে দেখে ফিরে এসে প্রভাত যতটা ছেলের বাড়ি, ছেলের মা ও বোনের প্রশংসা করল তার চেয়ে বেশি গুণগান করল প্রভাতের ভায়রা পরেশ আর মনদা ঘটক। প্রভাত তার মাকে শুধু বলল- ছাওয়ালের বয়স একডু বেশি, তাহলি পারে কিন্তুক জমিজিরেত আর ব্যবসাপাতি অঢেল। বোনডার বিয়ে হয়ে গেলিপারে সব কিচুরই মালেক সুধা বাবাজি। সেখানে প্রভাতের ভায়রা পরেশ ও পরেশের সোন্দরী ছিল। প্রভাতের কথা শুনে সোন্দরী তার ভগ্নিপতি প্রভাতকে বলল-  ছাওয়ালের আবার বয়স বোলে কিছু আছে নাকি, সোনার আংটি বাঁকাও ভাল।

এবার ছেলে পক্ষের মেয়ে দেখতে আসার পালা হলেও তার কিন্তু প্রথমে এলো না। ইন্দুবালার বাড়ির বউরা প্রভাতের শালি পরেশের বউ সোন্দরীরা এবার দলবল সহ গোসাইগাঁও গেলেও তাদের  শ্বশুরশাশুড়ি কার্তিক ও ইন্দুবালাকে যাওয়ার কথা কিন্তু বলল না। এতে কার্তিক মন্ডল  মনে কিছু না নিলেও ইন্দুবালা মনে মনে গোসা করলো । কিন্তু কিছুই কাউকে বলল না। বউরা ফিরে এসে হবু জামাই ব্রজগোপাল, তার মা ও বোনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।  প্রভাতের ভায়রা পরেশের বউ মানে প্রভাতের শালি সোন্দরী সারা গ্রাম ঘুরে ঘুরে হবু জামাই ব্রজগোপালদের কত যে প্রশংসা করল! সোন্দরীকে গ্রামের লোকেরা বিশেষ করে মহিলারা গেজেট বলে ডাকে, সে তার মাজা ব্যাঁকা শাশুড়ি বুড়ির দিয়ে রান্নাবান্না থেকে যাবতীয় কাজকর্ম করিয়ে নিজে পাড়ায় পাড়ায় গল্প করে বেড়ানোই তার কাজ।
সোন্দরীর শাশুড়ি কমলাসুন্দরী তাকে বলল- পরেশরা বলতিছিল ছাওয়ালের বয়স নাহি বেশি, শ্বশুর জামাই এক জায়গায় দাঁড়ালে জামাইকে শ্বশুর আর শ্বশুরকে জামাই মনে হবি। শাশুড়ির কথা শুনে কথা শুনে পরেশের বউ সোন্দরীর আবারও বলল- সোনার আংটি বাঁকাও ভাল, পুরুষ মানুষের আবার বয়স!

হবু জামাইয়ের প্রশংসায় সবাই পঞ্চমুখ। তারপর ব্রজগোপাল বন্ধুবান্ধব নিয়ে শিবানীকে দেখতে এল। শিবানী স্কুলের ইউনিফরম আর জামা পাজামা ছাড়া পরেনি। ওই দিন তাকে শাড়ি পরে ছেলে পক্ষের সামনে বসতে হল। ছেলের মামা শ্যামসুন্দর ব্রজগোপালের গার্জিয়ান। শ্যামসুন্দর মনে মনে ভাবল- ভাগনের বিয়ে দেওয়ার জন্য কম চেষ্ট করেনি। এত বয়সী ছেলে সাথে বিয়ে দিতে কোন বাবা মাই মাইয়্যা দিতি রাজি হয় না। সে এবার ভাবল মেয়েটি বাচ্চা হলেও বিয়ের জল গায়ে পড়লে বড় হতে কয়দিন। দুই পক্ষ রাজি হওয়ায় শিবানীর বিয়ে দিন ক্ষণ স্থির হল। ছেলেকে আশীর্বাদ করতে  প্রভাত ভায়েরা পরেশ, পরেশের বউ সোন্দরী এবং শিবানীর মা ও তার জাদের গোসাইগাঁও গেল ।গ্রামের দুএকজন মাতবরকেও সাথে নিল।  শুধু সঙ্গে নিল না  তার বাবা ও মাকে।
কয়েক মাস পরে শিবানীর বিয়ে। ছেলে পক্ষ এর মাঝে দশ বার আত্মীয়স্বজন ও মাতবর সঙ্গে করে এসে শিবানীকে আর্শীবাদ করে গেল। বিয়ের আগ থেকেই বর ও কণে না পক্ষের মধ্যে আত্মীয়ের সম্পর্ক গড়ে উঠল। দুর্গা পুজোর আগে ব্রজগোপাল পুজোর তত্ত্ব মানে সবার জন্যে কাপড়চোপড় নিয়ে একরাত হবু শ্বশুর বাড়িতে থেকেও গেল। নিরিবিলিতে হবু বউ শিবানীকে আদর করতেও ব্রজগোপাল কসুর করলো না। বাচ্চা বয়সী শিবানী এতে লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। তারপর একদিন ঘটা করে  শিবানীর বিয়ে ভাল ভাবেই হয়ে গেল। কিন্তু শিবানীর বিয়ের পর কয়েকদিন যেতে না যেতেই থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়ল। 

পাঁচ

ইন্দুবালার মনে সংশয় লেগে ছিল তার নাতনি শিবানীর হবু বরকে দেখার পর থেকেই। তার একটাই ভাবনা এত বছর বয়সী নাতি জামাই তার নাতনি শিবানীকে মানিয়ে নিতে পারবে তো! সে মনে মনে ভাবল যে শিবানী সুখী হলেই তাদের সুখ। প্রভাত এক মাইক্রোবাস ভর্তি করে আত্মীয়স্বজনদের কে নিয়ে শিবানীর বউভাতে গেল। এবারও ইন্দুবালা ও কার্তিক মন্ডলকে শিবানীর বাড়িতে নিয়ে গেল না প্রভাত। কিন্তু প্রভাত এবারও পরেশের বউ সোন্দরী,  শিবানীর মা, তার জাদের সাথে গ্রামের মাতবরদের নিয়ে গেল বউভাতে। প্রভাতের ছোট ভাইয়েরা, মদন গোপাল ঘটকও তাদের সাথে গেল। আশীর্বাদের সময় না যাওয়া সোন্দরীর মাসি  কদমবালা মানে প্রভাতের মাসি শাশুড়ি মহিলাদের মধ্যে এবারই প্রথম শিবানীর শ্বশুড়বাড়ি গোসাইগাঁও এসেছে।

আসলে প্রভাত তার কর্তা নয়, কর্তা তার বউ মানে শিবানীর মা। শিবানীর মায়ের ইচ্ছে ছিল বউভাতের পর শিবানী ও ব্রজগোপাল জামাইবাবাজীকে নিয়ে আসবে তাদের ওখানে ফিরানি ভাঙতে। শিবানী বুঝল ব্রজগোপালের বাড়ির আসল কর্তা তার বোন হেমাঙ্গী। হেমাঙ্গীর হাবভাব দেখে মনে সোন্দরীর মাসি কদমবালা মোটেই ভাল ঠেকল না। হেমাঙ্গী ব্রজগোপালকে বলল- দাদা,ফিরানি ভাঙার পরে দিনই বউকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবি কিন্তুক। সে সময় কদম মাসি হেমাঙ্গীর কথায় প্রতিবাদ করে  বলল- নতুন জামাই আবার ফিরানি ভাঙতে য্যায়ে শ্বশুর বাড়ি একদিন থ্যাকে নোতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফেরে তাতো বাপের জম্মে কহন শুনিনি।
-এবারে জামাইয়ের দৌলতে শুনে রাখুন ।শিবানীর কলেজে পড়া  ননদ  হেমাঙ্গী কদম মাসিকে বলল। কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে কদম মাসিও কিন্তু কম যায় না। নতুন কুটুম বাড়ি ভেবে সে আর কথা না বাড়াতে চাইলেও তবুও সে হেমাঙ্গী বলল- এ বাড়ির হত্তাকর্তা কি তুমি। ব্রজগোপালের কলেজে পড়া একডা অবিয়েত্তো বোন আছ বিয়ের আগে জানতি পারলি এত বছর বয়সী ছাওয়ালের সঙ্গে শিবানী দিদিভাইয়ের বিয়ে দিতে দিতাম না। কদমবালার কথা শুনে হেমাঙ্গী ও তার মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। কদমবালাকে যাচ্ছেতাই বলে গালিগালাজ করতে দ্বিধা করল মা ও মেয়ে।                                                                             

ব্রজগোপাল ফিরানি ভাঙতে এসে তার বোন হেমাঙ্গীর কথা মত ফিরানি ভাঙার পর দিনই শিবানীকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। কদম মাসি সোন্দরীকে বলল- এত বয়সী ছাওয়ালের সাথে নাবালিকা শিবানীর বিয়ে দিতে আমার মন সায় দ্যায়নি। তুই গেয়ে বেড়াতে লাগলি ছাওয়ালের বয়স হইছে তাতে কী! সোনার আংটি বাঁকাও ভাল!

শিবানী ফিরানি ভেঙে শ্বশুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর থেকেই শিবানীর উপর আসল খেল শুরু করল। শাশুড়ির চোখে বেটার বউ মন:পুত নয় শিবানী শাশুড়ির কথাবার্তায় দু’চার দিন গেলেই বুঝতে পারল। ব্রজগোপালে মা ও বোন হেমাঙ্গীকে গুজুরফুসুর করতে দেখে শিবানী কিছুই বুঝতে পারল না। তার নিজের বাবার বয়সের চাইতে বড় স্বামীকে আসলে শিবানী ভয় পায়। পরদিন থেকে বাড়িতে হুলুস্থুল কান্ড শুরু হল। হেমাঙ্গী এর গলার সোনার হার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বেটি ও মা সব জায়গায় হারটা খুঁজে খুঁজে হয়রান। তারা শিবানীর বাক্স পেটরা খুঁজে পেতে দেখতেও তারা কসুর করল না। হেমাঙ্গী প্রথমে কথাটা বলল- কালুখালীর গদাগুণীনের কাছে গেলে কে আমার সোনার হার নিয়েছে জানতে পারা যাবে, মা। মা বেটি ছাড়াও অনেকেই জানে গদাগুণীর একজন ধাপ্পাবাজ।

শিবানী দিদিমা কদমবালার ওপর হেমাঙ্গীর রাগ তখনো পড়েনি। সে ও তার মা যুক্তি করে ঠিক করল শিবানীর কদম দিদিমাকে জব্দ করতেই হবে। কালুখালীর গদাগুণীনকে কাজে লাগিয়ে কদমবালাকে নাকানী চুবানী খাওয়াতে আর শিবানীর বাবার কাছ থেকে একটা সোনার হারের  টাকা আদায় করতে হবে।

পরদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে হেমাঙ্গী গদাগুণীনের বাড়ি যেয়ে তার সহকারী বঙ্কাজী সাথে দেখা করে তার সোনার হার চোরের হদিস দেওয়ার কথা বললে বঙ্কাজী বলল- আপনি কাহাকে সন্দেহ করিতেছেন তাহার তাহার নাম আমাকে লিখিয়া দিন । কে আপনার হার চুরি করিয়াছে তাহা আপনি প্রকাশ করিতে পারিতেছেন না সেই নামটি গুণীনবাবাজী জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়া দিবেন।
বঙ্কাজী সাধু ভাষায় কথা বলেন আর সবাইকে আপনি বলে সম্বোধন করেন। গলায় জবাফুলের মালা। কপালে সিঁদুরের লম্বা টান। ছেলেটির  বয়স একুশ থেকে পঁচিশের মধ্যে হবে। ফর্সা আর সুঠামদেহী খুব সুন্দর বলে ছেলেটিকে হেমাঙ্গীর মনে হল। এমন সুন্দর চেহারা ছেলেটি ধাপ্পাবাজি কাজের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছে তা হেমাঙ্গী ভেবে  পেলে না। কলহপ্রিয় হলেও হেমাঙ্গী নিজেও কিন্তু সুন্দরী কম নয়।
ছেলেটি ভেবে অবাক হল গুণীনজীর আখড়ায় এমন সুন্দরী মেয়ে তো কখনোই আসে না, আসে যত বদখত বুড়োথাড়া মহিলা কিংবা পুরুষেরা। সে উৎসুক দৃষ্টিতে হাসি হাসি মুখে হেমাঙ্গীর পানে তাকে বলল, আগামীকাল মঙ্গলবার, ভাল দিন। আপনাদের বাড়িতে যাওয়া আসা করিয়া থাকে কিংবা দুই একদিন অবস্থান করিয়াছে এমন জনা কয়েক লোকের নামের একটি তালিকা  এবং  তাহার সাথে একান্নটি টাকা  আপনি আগামীকাল দ্বিপ্রহরের আগে আমার মাধ্যমে গুণীনজীর কাছে জমা দিবেন।  তবে একটি কথা হইতেছে যে এখানে আসিবার সময় গ্রামের অথবা পাড়ার মোড়লমাতুব্বর ,মেম্বার ও পণ্যমান্য লোকজনদেরকে সাথে নিয়া আনিবেন। 
গদাগুণীজীর সহকারী বঙ্গাজীর হাতে কদমবালার নামটা জমা দিয়ে হেমাঙ্গী বাড়ি দিকে পা বাড়ালে ছেলেটি পেছন থেকে ডাক দিয়ে বললেন- ওই তালিকায় কিন্তু এই নামটি অবশ্যই থাকে।
- ঠিক আছে।
- এতক্ষণ আপনার সঙ্গে কথা হইল, কিন্তু আপনার নামটি আমার শোনাই হইল না। হেমাঙ্গী তার নামটি তাকে বলে ওখান থেকে বাড়ির পথ ধরল।

এর মাঝে শিবানী ফোন করে তার মাকে জানাল আমারে ননদের সোনার হার হারিয়ে গেছে। তা দিয়ে এখানে গোন্ডগোল পাকিয়ে উঠেছে। পরদিন হেমাঙ্গী, তার মা এবং ব্রজগোপাল মোড়ল মেম্বার ও গ্রায়ের লোকজনদের কে নিয়ে গদাগুণীনের বাড়ি যেয়ে হাজির হলো। হেমাঙ্গী গদাগুণীনজী সহকারী বঙ্কাজীর হাতে সন্দেহভাজন চোরদের নামের তালিকার সঙ্গে একান্ন টাকা জমা দেবার সময় হেমাঙ্গীর মনে হল ছেলেটি যেন একটু  বেশিই সাজগোজ করেছে। হেমাঙ্গী তার গা থেকে চন্দনের গন্ধ পেল।
- গুণীনজী ভেতরে পুজো করতিছেন। এখনই তিনি বাইরে আসবেন।
একটু পরেই গদাগুণীনজী বাইরে এলেন, হাতে পুজোর ফুল। ঘরের বারান্দায় আসন পেতে রেখেছে। গদাগুণীজী সেই আসনে বসে বঙ্কা নামের ছেলেটির কাছ থেকে সন্দেহভাজন চোরদের নামের তালিকার হাতে নিয়ে ধ্যানস্থ হলেন। ঘন্টা খানেক পরে তার ধ্যান ভাঙাল। এক সময় তিনি হেমাঙ্গীর দেওয়া তালিকার উপর চোখ রেখে বলে উঠলেন। কদমবালা।

হেমাঙ্গীদের সঙ্গে আসা ইউনুস মেম্বার সহ গ্রামের লোকেরা এক সঙ্গে বলে উঠল- ব্রজগোপাল, কদমবালা আবার কে? ব্রজগোপাল জবাব দেওয়ার আগেই হেমাঙ্গী কদমবালার পরিচয় দিল। ইউনুস মেম্বার এলাকার খুব প্রভাবশালী,গুণীনজীর বুজুর্কী জানতে তার বাকি নেই। সামনে ইলেকশন তাই এ সব বুজুর্কীর কথা  জেনেও ইউনুস নিশ্চুপ!
বাড়ি ফিরে হেমাঙ্গী ও তার মা প্রচার করে দিল নতুন বউয়ের দিদিমা কদমবালাই হেমাঙ্গীর সোনার হার চুরি করেছে। শিবানীর বিশ্বাস হল না তার কদম দিদিমা এটা করতে পারে। শিবানীর শাশুড়ি তার মা ও বাবাকে ফোন করে জানাল হেমাঙ্গীর সোনার হার তাদের কদম মাসি চুরি করেছে। ভাল ভালয় যেন ওটা ফেরত দিয়ে যায়। খবরটা শুনে কদমবালা তো হতবাক!
তারপর থেকে ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন আসতে লাগল। শিবানীর মা তার জামাই ব্রজগোপালকে ফোন করে আসল বিষয়টা জানতে চাইলে জামাইবাবাজী ফোনটা রিসিভ করে আমতা আমতা করে কী যেন বলে ফোনটা তার বোন হেমাঙ্গীর কাছে দিল। হেমাঙ্গী যে ভাষায় যা বলল তা ভাষায় ব্যক্ত করার নয়।
শিবানী বাবা মা ও পরেশ অনেক চেষ্ট করেও জামাই ব্রজগোপালের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করতে না পেরে শিবানীর সঙ্গে কথা বললে সে বলল- তোমরা এসে এর ফয়সালা করে যাও নইলে আমাকে নির্যাতন... এইটুকু বলে সে ফোন কেটে দিল। ওখানকার ইউনুস মেম্বার প্রভাতের পরিচিত, তাই আসল ঘটনা জানার জন্যে তাকে ফোন করে জানতে পারল যে এ সব ধাপ্পাবাজী, সামনে ইলেকশন সে নিজে কিছু বলতে পারছে না। তিনি শেষে বললেন- আপনার আসেন, আমি থেকে একটা ফয়সালা করে দেব। এবার শিবানীর বাবা হেমাঙ্গীর কাছে ফোন করে জানিয়ে দিল তারা কয়েকজন তাদের ওখানে যে কোনদিন যাবে বিষয়টার ব্যাপারে। প্রভাত ভাবল জামাই বাড়ির আসল কর্তা জামাই নয়, আসল কর্তা জামাইয়ের সুন্দরী বোন হেমাঙ্গী ও তার মা। সে ইউনুস মেম্বারকে শুধু ওখানে যাওয়ার তারিখটা জানিয়ে রাখল।

কলেজ থেকে ফেরার পথে গদাগুণীনের বাড়ি কাছাকাছি এলে হেমাঙ্গী শিবানীর বাবার ফোন পেয়ে একটু অস্বস্তিবোধ করে এগিয়ে যেতেই গদাগুণীনের সাকরেদ বঙ্কা নামের ছেলেটিকে দেখতে পেল বকুল গাছটার নিচে প্যান্ট পরে বসে আছে। হেমাঙ্গী তার কাছাকাছি হলেই সে সেখান থেকে উঠে তার দিকে এগিয়ে এসে বলল- হ্যালো হেমাঙ্গী, কলেজ থেকে ফিরছো? এভাবে ছেলেটিকে দেখে আর এভাবে কথা বলায় হেমাঙ্গী তো অবাক! –তোমার ফোন নম্বরটা না রেখে ভুল করেছিলাম। ছেলেটি তার ফোনটা প্যান্টের পকেট থেকে বের করে বলল, এখন তোমার নম্বরটা দাও তো দেখি। তোমার ফোনে একটা মিস কল দিয়ে আমার নম্বরটা তোমাকে দিয়ে দেই।
হেমাঙ্গী ভাবল- ভালই হল ছেলেটির সঙ্গে আলাপ জমানো যাবে। হার চুরির বিষয়ে যে ভাবে ঘোট পাকিয়ে উঠছে তাতে ওর পরামর্শ নেওয়াও দরকার।  হেমাঙ্গী বাড়ি ফিরে খাতাটা টেবিলের পর তার বিছনায় গা এলিয়ে কেন যেন ওই ছেলেটির কথাই ভাবছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে তা তার খেয়াল নেই। হঠাৎ বালিশের পাশে রাখা ফোনটা বেজে উঠতেই হেমাঙ্গীর চোখ থেকে তন্দ্র ছুটে গেল । কল রিসিভ করতেই ও প্রান্ত থেকে একটা ছেলের কন্ঠ ভেসে এল- আমাকে চিনতে পারছো। আমি বড় ধাপ্পাবাজের সঙ্গী আর ছোট ধাপ্পাবাজ । তোমার সোনার হার...
তা কথা শেষ করার হেমাঙ্গী বলল- ওহ! তুমি, ধাপ্পাবাজ গুণীনের ধাপ্পাবাজ সাগরেদ। হার চুরি না গেলেও তোমরা আমার সন্দেহের মহিলার নাম বলে দিলে একান্ন টাকা বিনিময়ে। এখন তো বিষয়টা নিয়ে ঘোট পেকিয়ে উঠবে বলে মনে হচ্ছে।
ওপ্রান্ত থেকে উত্তর এল- নাজেহাল হতে চাইলে তুমি তোমার চুরি না যাওয়া হারটা আর লুকিয়ে রেখ না।
ছেলেটার কথা হেমাঙ্গী মনে ধরল। হারটা লুকিয়ে রেখে কদমবালাকে জব্দ করা যাবে না। সেদিন সন্ধ্যায় কালুখালী বাজারে ইউনুস মেম্বার ব্রজগোপাল বলল যে তার শ্বশুররা আগামীকাল আসছে।
-তোরা সবাই কিন্তু বাড়ি থাকিস। ব্রজগোপাল বাড়ি ফিরে ইউনুস মেম্বারের বলা কথাটা মা ও বোনকে বলল। সে তার বউ শিবানীকেও তার বাপমাদের আসার কথাও বলল। হেমাঙ্গী ও তার মা ঘুজুরঘুজুর ফুসুর ফুসুর করার পর তারা দুজনেই শিবানীকে গালমন্দ করতে শুরু করল। শিবানী গালমন্দ খেয়ে কাঁদতে শুরু করল।

ব্রজগোপাল ইয়ারবন্ধুদের সাথে তাস খেলতে গেছে বটতলায়। শিবানী রাতে ভাবল বাপমা এলে এবার সে এখান থেকে তাদের সঙ্গে চলে যাবে। পরদিন প্রভাত শিবানীর মা, তার মাসি কদমবালা, পরেশ, পরেশের বউ সোন্দরীকে নিয়ে শিবানীর শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে টেম্পুতে ওঠবার সময় শিবানী শাশুড়ির ফোন পেয়ে প্রভাত তো অবাক! শিবানীর শাশুড়ি বলল যে হেমাঙ্গীর সোনার হার পাওয়া গেছে তার নিজের আলমারীতে, ও ভুল করে ওটা রেখেছিল। আপনারা আসেছেন
প্রভাত রাগের চোটে ফোন কেটে দিয়ে ইউনুসকে মেম্বারকে ফোন করে সব কথা খুলে প্রভাত। শিবানীর দিদিমা কদমবালাকে চোর অপবাদ দিয়ে জব্দ করতে না পারায় হেমাঙ্গী ও তার মা শিবানীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালাতে থাকে। আর তাকে বলে, তোকে আমরা জীবন থাকতে বাপের বাড়ি পাঠাবো না। 

কয়েকদিন যেতে না যেতেই শিবানীদের পাড়া প্রতিবেশিরা কানাঘুষা শুনতে পায় শিবানীর শ্বশুর বাড়ি থেকে মেম্বার মাতুব্বর আসছে শিবানীর বাপের বাড়িতে কাদের দোষ আর কাদের গুণ যাচাই করার জন্যে তাদের সঙ্গে প্রভাতের জামাই মেয়েও আসবে। প্রভাতের ভায়রা ভাই পরেশ বলে বেড়াতে থাকে যে ব্রজগোপালের মা ও হেমাঙ্গীও আসছে। এবার বিচার কাকে বলে দেখতে পাবে বাছাধনরা।
সত্যি সত্যি ইউনুস মেম্বার ব্রজগোপাল, শিবানী ও গ্রামের মাতুব্বর মোড়লদের নিয়ে এক টেম্পু ভরে প্রভাতদের বাড়িতে আসে, তারা কিন্তু শিবানীর শাশুড়ি ও হেমাঙ্গীকে সঙ্গে আনতে পারে না। খাওয়া দাওয়ার পরে বিচার বসলে প্রথমে শিবানীর জবানবন্দী নিলে প্রকাশ পায় ব্রজগোপালের আসকারার তার মা বোন নাবালিকা শিবানীর ওপর যারপর নেই অত্যাচার চালিয়েছে। এমনকি প্রায় রাতেই শিবানীকে তার স্বামী বজ্রগোপালের সাথে শুতে দেয়নি। শিবানীর কথা শোনার পর ইউনুস মেম্বার ব্রজগোপালকে জিজ্ঞেস করে এ সব কথা সত্যি কিনা। ব্রজগোপাল কোন জবাব না দেওয়ায় ব্রজগোপালের সম্পর্কে মামা গোলক মোড়ল ব্রজগোপালকে একটা চড় কশে দেয়। ওখান থেকে আসা সবাই ব্রজগোপালকে গালমন্দ করে রায় দিয়ে যায় যে ব্রজগোপালকে শ্বশুর বাড়িতে সাতদিন থেকে তার বউ শিবানীর সঙ্গে ঠিকঠাক মত মেলামেশা করতে হবে এবং শ্বশুর শাশুড়ির সেবাযত্ন করার পর তারা খুশি হলে তার সঙ্গে শিবানীকে শ্বশুর বাড়িতে পাঠাবে।

ব্রজগোপাল সালিশের রায় মেনে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে থেকে যায়। কিন্তু ভোর রাতের দিকে ব্রজগোপাল কাউকে এমনকি তার বউ শিবানীকে কিছু না বলেই পালিয়ে যায়, শিবানীর কাছ থেকে খবর জেনে বাসস্ট্যান্ড থেকে ব্রজগোপলকে প্রভাত ও পরেশ গিয়ে পাকড়াও করে আনে। কিন্তু ব্রজগোপাল তার মা ও বোনের সঙ্গে ফোনে কথা বলে পরদিন আবার চম্পট দেয় । শিবানী ও শিবানী কান্নার শব্দ শুনে এগিয়ে আসে ইন্দুবালা, কদমবালা, সোন্দরী ও পাড়া প্রতিবেশিরা।

ইন্দুবালা প্রথমে মুখ খোলে- যত দুষ মুইর নাতনি শিবানীর। সোয়ামীকে বশে রাখতে পারেনি মুইর নাতনি। বউয়ের কোলের মধ্যি থিকে মরদ সোয়মী পালায় তাতো মুই জীবনে শুনিনি। কদমবালাও নাতনিকে দুষতে থাকে। গ্রামের গেজেট নামে পরিচিত পরেশের বউ সোন্দরীও মুখ খোলে। ইন্দুবালা দুচোখে সোন্দরীকে দেখতে পারে না।
-থাম সোন্দরী, মুইর বাচ্চা বয়সী নাতনিটার সব্বনাশ তুই আর তোর সোয়মী পরেশ করিছিস। মুখ টিপলি দুধ বেরায় এমন সোন্দরী নাতনিডার লগে চল্লিশ বছর বয়সী ধুমসো মিনশের বিয়ে দিলি তোরাই তো। আমি বারণ করলি তুই কইছিলি না -ছাওয়ালের বয়োস আবার কী! ছাওয়াল বলি কতা, একডু বয়স হইছে তাতে কী। ছাওয়াল হল সোনার মতো, নোকে কয় শোনেন নি সোনার আংটি বাঁকাও ভাল! সোন্দরী ও পরেশের মুখ থেকে টু শব্দ বের হল না। সপ্তাহ যেতে না যেতেই পাড়া প্রতিবেশিরা দেখতে পায় নাবালিকা শিবানী হাতে শাঁখা আর সিঁথিতে সিন্দুর কোনটাই নেই।     

লেখক: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক,গল্পকার ও কবি