11 May 2019

সিন্ধু সোম—আবর্তেসু



শহুরে পাট ভেঙে ম্যানহোলের ঢাকনার মতোই খানিকটা হাঁ দিয়ে মুখের ওপর দুম করে বন্ধ হয়ে গেল গৃহশিক্ষকের গৃহ দরজা। ওই দরজার ভেতর টুকু ওনার এক্তিয়ার। বাইরেটা ছাত্র ছাত্র নিজেরাই সামলে আসছে। বুনো রামনাথের পদবী এনারা যথেষ্ট সিরিয়াসলি নিয়েছেন। বেড়া ভাঙা বকুলের ছায়াস্তব্ধ সেই পাঁচিল ঘেঁসে অজগরের মতো শুয়ে থাকা জমাট চাপ চাপ উদাসীনতার গলিতে সাইকেল নিয়ে সদ্য বেরিয়ে এল দুটি ছেলে। সতেরো আঠেরো বছরের খর যৌবন মুখের হালকা লোমে তুলি দিয়েছে। একজনের মুখটা একটু ভাঙা তোপসানো চওড়া, অন্য জনের নিটোল গোল। বড় বড় আয়ত চোখে প্রথম যৌনতা ও শিকড়ের সরলতার যুগপৎ ছাপ একটা আলো আঁধারি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছে। ব্যভিচারী ভাবের মতোই তার সঙ্গে মিশেল ধরিয়েছে কানপাতা দায়িত্ব, নেশাতুর স্বপ্ন, গোপন উৎকণ্ঠা আর অসবর্ণ বিদ্রোহ। মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট পাখাটানা বকের মতোই ঝিমিয়ে আছে। মফস্বলের অঙ্কশায়িনী গ্রাম তার নিদ্রার শমন এখনও জারি রেখেছে ধুঁকে ধুঁকে। সেই আলোকিত অভ্যাসের মধ্যে হঠাৎ ঢুকে পড়া চামচিকের মতোই গতির প্রয়োজন গোঁৎ খায় মাঝে মধ্যেই। যে সময়ের কথা গোকুলপাসরী গ্রাম তখন আড়মোড়া ভাঙ্গছে শহরের কণ্ঠলগ্ন হয়ে! 

থম মেরে থাকা আহত আকাশকে অগ্রাহ্য করে ছেলে দুটি সাইকেল ছেড়ে দিয়েছিল মিনিট পাঁচেক আগে। ঝর ঝর করে একটা চেনের আওয়াজ আসছিল কোনও একটি সাইকেল থেকে! সেও যেন এই গুমখুনে পরিবেশ নিতান্ত বয়সের ভারেই কেটে কেটে এগিয়ে চলেছে। লোকালয় ছাড়িয়ে ওরা যখন ফাঁকা টাঁড়ের রাজত্বে উঠে এসেছে ঠিক তখন কড়কড় শব্দে একটা বাজ পড়ল। অজান্তেই ছেলে দুটির সাইকেলের স্পিড গেল বেড়ে। প্যাডেলের উপর একটা হ্যাঁচকা পাঁজর-ভাঙ্গানি চাপ শেষ করে ঢালে সাইকেলটা ছেড়ে দিয়ে বুবাই একটু বিরক্তি মাখা গলায় বলে উঠল, “আজ স্যার এত দেরী করে ছাড়ল কেন কে জানে! মানুষটার আক্কেল নেই কোন! এতটা রাস্তা এখন ফিরতে হবে এই জলে!” শোভন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। ওর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না! সাইকেল চালানোর সময় ও চলচ্চিত্রের মতো অবিরত সরে যাওয়া চলন্ত দৃশ্যগুলো ডটের মতো উপভোগ করতে ভালোবাসে। তবে আজ ওর মনের মধ্যে একটা দ্বিধা শুন্দ-উপশুন্দের মতো লড়ে যাচ্ছে নিজেই নিজের সঙ্গে। আজ সকালে বুবাইদের দ-মার্কা সিঁড়ির নীচে ফুলে ওঠা বেড়ালের মতো ওকে আঁচড়ে দিয়েছিল রাণু দি। তারপর ঝুঁকে আসা মুখে ওর মুখের উপর একমুখ নিশ্বাস ফেলায় ওর দম প্রায় আটকে গিয়েছিল কিছুক্ষণ। চোখে চোখআটকে গিয়েছিল যেন! কী বুকচেরা চকিত দৃষ্টি! অদ্ভুত একটা মাদল মাদল গন্ধ আসছিল শোভনের নাকে। কয়েক সেকেণ্ড মাত্র! জটিল একটা আবর্তে গলা অবধি যেন ডুবে গিয়েছিল ওর। রাণুদি সেই বাদুড়ের মতো গা শির শির করা কড়িবরগা হাসিটা হেসে চলে গিয়েছিল বটে কিন্তু তারপর থেকে ঘটনাটা মনে পড়লেই ওর শ্বাস আটকে আটকে আসছে! এক একটা ঘটনা যখন হড়পা বানের মতো নীতির বালিবাঁধ উড়িয়ে নিয়ে যায় তখন কিছু ভ্রূণভ্রষ্ট চেপে রাখা ঘটনার স্রোত বর্ষার অজয়ের মতোই ফেঁপে ফুলে বোল ধরায়। ওর ঝিলিক ঝিলিক মনে পড়ছে কাবেরী পিসিকে ডাকতে একবার ফুলু পিসেদের কুয়োপাড়ে চলে গিয়েছিল ও। তখন অবিশ্যি আরো ছোট। থামার অতো জ্ঞান ছিল না। বুক চিড়বিড়ে ফোস্কা পড়া শুকনো একরাশ গরম গায়ে তখন সবে মগ তিনেক হয়তো জল চাপিয়েছে কাবেরী পিসি! ওকে দেখেই আঁচলটা টেনে নিয়েছিল গায়। কিন্তু ভিজে পাতলা কাপড় বড্ড সরল। জলভরার ছাঁদের মতো শাঁসছাপটা রয়ে ততক্ষণে উঠে গিয়েছে শোভনের মনে। আর একবার আল ভেঙে ফেরার সময় একটা আকন্দ ঝোপের ভেতর কানুদা আর………কিন্তু শোভনের দোষ ছিল না! ওরা বড্ড শব্দ করছিল যে! বিনা বাতাসের দুলুনি ঝোপে কিরকম প্রাণ টানে তা শোভন বুঝবে কি করে! ওরা অবিশ্যি শোভনকে দেখতে পায় নি! কিন্তু গহীনে গোপনতা নিষিদ্ধ ছাপের আগুন। অপরাধবোধের আগুন পুড়ে পেকে পোক্ত হয় দাগ। একবার লাগলে উঠতে চায় না! কিন্তু রাণুদির মতো ইচ্ছে করে অমন বেকায়দায় কোনোদিনই ফেলে নি কাবেরী পিসি। বরং কাবেরী পিসি বলতে এখনও একটা জমাট বাঁধা মা মা উষ্ণ অন্ধকার বুকে টের পায় ও। রাণুদিটা কেমন যেন। মজা পায় বারবার ওকে ঘাবড়ে দিয়ে! এসব ভাবতে ভাবতেই শুধুমাত্র ঘাড় নাড়ানোর বেশি মনোযোগ খরচ করে নি শোভন বুবাইয়ের কথায়।

বাড়ি এখনও মিনিট তিরিশেক। সদর শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ওদের গ্রামদূর থেকে এগিয়ে আসা দুর্যোগের প্রতিপক্ষ হিসেবেই যেন রাস্তার উল্টোদিক থেকে একটা বাইক সোঁ করে ওদের পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল কোলিয়ারির দিকে। এই দুই ধার সমাকীর্ণ ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা মাইলের পর মাইল টাঁড়ের একদিকে বলগা রেললাইন। মাঝে মাঝে বিষম গর্জনে কানে তালা লাগিয়ে ছুটে যায় মানুষের লোভ ঘৃণা বিস্ময় আধিপত্য! সেই লাইনের চৌকাঠ পেরোলেই চিরপরিচিত ওসিপির চেরা চিহ্ন বুকে বহন করছে গাভীন অফসলা জমি। চন্দ্রাহত হয়ে সেই জমির রাতজাগা চোখের কোল চিকচিকে ইতি উতি পুকুরগুলো আজ ঘুমিয়ে পড়েছে তাড়াতাড়ি। মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানিতে ওরা যেন চমকে চমকে উঠছে ঘুমের ঘোরেই। এত রাতে লাইনের ওদিকের রাস্তার ব্যভিচারিণী খাদ অন্ধকারের উষ্ণতায় পিচ্ছিল হয়ে উঠেছে। ঘটমানতা শৃঙ্খলাবদ্ধ। ঘটমানতা চক্রাকার। মানুষেরই চড়ক চাহিদার হাঁ মিটাতে একটা দুটো মানুষ খসে পড়ে টুপটাপ সেই ওসিপির গুহ্যের ভেতর মাঝে মধ্যেই। যেন ওঁত পেতে থাকা মায়ের গর্ভ! শোভন অবাক হয়ে বুবাইকে বললে, “এতরাতে এই অন্ধকারে ওদিকে যাচ্ছে রে! সাহস আছে!” বুবাই মাথাটা একটু হেলিয়ে চকচক করে ওঠা চোখে বললে, “বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করছে হয়তো!” কথাটা একরকম শোভনের উদ্দেশ্যেই! অন্যসময় হলে ও তেড়ে যেত, মুখ খারাপ করত। কিন্তু এই বিরাট লোডশেডিং সম্বলিত ভুসোকালি মাখা মহাকালের মূর্তির মতো পরিবেশে অন্যমনস্ক হয়ে থাকায় ইয়ার্কিটা শোভন ধরতে পারলে না! ওরা দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে পাহাড়টা একবার দেখবার চেষ্টা করল। দিন দিন বেড়ে ওঠা খাদের সংলগ্ন এই তোলা মাটির পাহাড় বেড়ে উঠছে স্তুপের ওপর স্তুপ বুকে নিয়ে। কালো ঘন আকাশের তলায় মিশেল খেয়ে ছদ্মবেশ নিয়েছে সে। ধরাচূড়া কিচ্ছু আলাদা করা যাচ্ছে না! হালকা একটা বিদ্যুতের রেখায় আলাদা করে তার বিপুল অস্তিত্ব খাঁজবাহী ভারের আড়ালে ফুটে উঠল। বিপুল তবে তুবড়ে এসেছে শরীর দীর্ঘদিন গ্রাফাইট কার্বনের সঙ্গে দেহবেসাতির ফলে। তাই কেমন পড়ে আছে দুশ্চিন্তার আরামে! একটা আদিম যুগের সরীসৃপের মতন। লেলিহান জিভের শিখা যেন চেরা সাদা আলো বুকে মেঘের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। এই রাত্রি প্রথম প্রহরের গর্জন যেন তারই অমীমাংসীত লোভাতুর চোখের আক্ষেপ বহন করে নিয়ে আসতে চাইছে মাইলের পর মাইল। জন্তুটার সুদীর্ঘ লেজের আঘাতে মাটি বুঝি এই কেঁপে উঠল জ্বরে ভোগা কৃশ কাবেরী পিসির মতোই। চোখের তলায় কালি পড়ে যেত তখন কাবেরী পিসির। কিন্তু চোখ দুটো অস্বাভাবিক জ্বলত। এমনিতে জ্বর জ্বালা হত না কাবেরী পিসির। কিন্তু যেদিন ফুলু পিসে খুব রেগে থাকত সেদিন বহু রাত অবধি কঁকিয়ে ওঠার আওয়াজ আসত ওদের ঘর থেকে। বাঁশঝাড়ের ক্রমাগত ডেকে যাওয়া ঝিল্লির এক ঘেয়েমি ভেঙে চুরমার হয়ে যেত। মাঠের একপাশে বেলফুলের ম ম করা গন্ধ ছেড়েছে সদ্য তখন। শীতের রাতে তারই মধ্যে ওই চিৎকার আকুতি আর্তনাদে পাঁচমেশালি শব্দ কেটে কেটে বসত চাবুকের মতো! পরদিন দল বেঁধে শোভনের বাবা কাকা, বুবাইয়ের বাবা সবাই যেতেন। পাঠশালা বসত। সবাই সুবোধ, সবাই গোপাল কারণ তখন আলো ফুটেছে। সপ্তাহ খানেক সব ঠিকঠাক! আবার বাঁধা গতে পুনরাবর্তন হত সেই একই ঘটনার। পুলিশে যেতে নাকি কাবেরী পিসি নিজেই দিতেন না! সব ব্যাপার খোলসা নয়! বাবা কাকারা তাকে বলতো না খোলসা করে। সেই আলো আঁধারির ছোয়ায় শোভনের এক মূহুর্তের জন্য কেমন জানি মনে হল ওই অন্ধকারব্যপী সরীসৃপটার সঙ্গে ফুলু পিসের কেমন একটা ঘনত্ব কুড়িয়ে পাচ্ছে ও! অন্ধকারটা ক্রমশ তাদের পিছনে ঘন হয়ে ঢেকে আসছে। রাতের বেলা কালো চাদর মুড়ি দিয়ে কেও যেন নিজেকে মিশিয়ে দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা করছে সেই আঁধারে! কিন্তু কেন? কিসের প্রত্যশায়? কিসের লোভে? সে কি শোভন নিজেই? শোভনের অচেতনে মূহুর্মূহু হর্ষিত কোনো সত্ত্বার বোধ কি চেতনকে লজ্জায় অন্ধকারে মিশিয়ে দিতে প্ররোচনা দিচ্ছে না ক্রমাগত? তবে এই কি মৃত্যুর রূপ? গুহা আবিষ্কারের পরেও তো মানুষ যাযাবর য়েছে! কিসের টানে? শুধুই কি প্রাণের প্রয়োজন? পরমুহূর্তে শোভনের মনে হল এই মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখার এবং তাতে ভেজার একটা নেশা আছে। মানুষের গতিশীলতার পিছনে খানিকটা হলেও এই মৃত্যুর চুম্বন অপেক্ষা করে থাকে।


হাওয়াটা খানিকটা বেড়েছে তবে খুব বেশি না। এর থেকে বেশি বাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। একটা দুটো এখনও পর্যন্ত পাকা রাস্তায় যে গাড়ি ঘোড়া দেখা যাচ্ছে গ্রামের ঢালাই রাস্তা ধরার পর সেটাও আর দেখা যাবে না। প্রায় সাড়ে নটা বাজে। মিনিট পনেরো সাইকেলের চাকার সঙ্গে গড়িয়ে এল বোধহয়। ওই যে শঙ্করী মোড় দেখা যাচ্ছে। এখান থেকেই ঢালাই রাস্তা ধরবে ওরা বাঁদিকে। মোড়ের মাথায় সুবলদার দোকান। একটা সিগারেট পেলে ভালো হত। একথা ওকথা ভাবতে ভাবতে গলা অবধি একটা ধোঁয়ার তেষ্টা টের পাচ্ছে শোভন। রিন রিনে অনুভূতি নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে গলার স্নায়ুতে বিদ্যুৎ। ও মুখ খোলার আগেই বুবাই বলল, “ওধারে নে, একটা ধরাই!” বাজটা একদম কমে এসেছে কখন খেয়ালই করেনি শোভন। অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “অ্যাঁ?” বুবাই একটু অবাকই হল। রোজ একটা করে বাঁধা ওদের ফেরার পথে। সাইকেল আচমকা থেমে গিয়েছিল দুজনেরই। “বলছি, হাওয়াটাও কমেছে, বাজ টাজ পড়ছে না, খেয়েই যাই!” তাই নাকি? হাওয়া কমেছে? তবে যে শোভনের কেমন জানি মনে হল বেড়েছে? ধুর মাঝে মাঝে কী একটা হয়ে যাচ্ছে আজকে! সিগারেটটা ধরিয়ে দু তিনটে ছোট ছোট টান দিয়ে হালকা ধোঁয়ার কুয়াশা এঁকে বুবাই খুব ক্যাজুয়ালি শোভনকে বলল, “দেখ ভাই, তুই স্কুলের ব্যাপারটা নিয়ে অত ভাবিস না! মাধব মিত্তির তোকে সবার সামনে বানচোত বলেছে খিল্লি করার জন্যই! আসলে ও দিদিকে লাইন মারে! দেখি তো বাড়ির সামনে দিয়ে আসতে যেতে মদ্‌নার ঘাটেরমড়ার মতো একহাত জিভ! তোকে দেখে কোন কারণে…তুই তা নিয়ে অত ভাবছিস কেন?” শোভন মুখ নামিয়ে হাসল একটু। দুধসাদা রঙ ধোঁয়ার ধর্ম না, ধোঁয়ার ধর্ম ধোঁয়াটে। কিন্তু সদ্যজাত ধোঁয়াশার ফাঁক দিয়েও শোভনের চোখের দ্যুতি বুবাইয়ের চোখে পড়ে গেল। বললে, “আর তোর দেশের বাড়িরটার কি হল? ভাগিয়ে দিয়েছে?” এবার শোভন তেড়ে উঠল, “ভাগ শালা! বোন হয়!”

-সে কি আর আমি জানি না গুরু! মাধো শালা খুব ভুল বলে নি দেখছি!

বুবাইয়ের এই মিটিমিটি হাসিটা শোভনের কাছে আরো অস্বস্তির কারণ। কিই যে আন্দাজ করছে তা ওর মুখ দেখলে বোঝা যাবে না! বুবাইকে কথাটা বলতে না পেরেও ও হাঁফিয়ে উঠছে। কিন্তু বলা যায় না! বুবাইয়ের নিজের দিদি রাণুদি। কি মনে করবে তার ঠিক আছে! শান্তির ছেলে মাধোটার চোখে ধরা পড়ল কী করে? যাক গে মরুক গে! আজকের করতে দেওয়া অঙ্কগুলোর মধ্যে রাণুদির মতোই বেয়াড়া একটা অনেকক্ষণ ভুগিয়েছে! ও এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে ব্যাপারটা কাটানোর জন্য সেটা নিয়েই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ ধোঁয়ার রঙটা উজ্জ্বল বেগুনী হয়ে এল। সেই বেগুনী ধিকি ধিকি জ্বলতে জ্বলতে মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে! ঠিক যেভাবে রাণুদিকে আজ দেখেই শোভনের ভেতরটা দপ করে উঠেছিল। তারপরেই প্রচণ্ড কড়কড় শব্দে আকাশ ভেঙে পড়ল যেন। আচ্ছন্ন হয়ে এল সমস্ত কিছু। এক মূহুর্তের জন্য আবার শোভনের মনে হল জন্তুটা খুব কাছে চলে এসেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় বুবাই হতভম্ব হয়ে গলায় ধোঁয়া টোঁয়া আটকে চোখ মুখ লাল করে ফেলল। আর ঠিক সেই সময়েই দোকানের ঝাঁপটা ঝড়ং ঝড়ং করে প্রচণ্ড আপত্তি শুরু করল। ঠিক যেন গুমটিটার পিছনেই সমস্ত অন্ধকার একটা চিতার গুঁড়ি মারা লোলুপতা নিয়ে ঘনিয়ে বসেছে। শুনশান রাস্তার ধারে তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত তার লালায় ভিজে উঠেছে। এক চোখ গাঢ় সবুজ মৃত্যু নিয়ে ঠাবা চাটছে বারে বারে সেই অন্ধকার। আর গুমটির ঝাঁপ ঠিক পাখির ভীত অসংলগ্ন ডানার মতো আগাম তার খবর পেয়ে সতর্কবার্তা জারি করছে সামনের রাস্তাকে। রাস্তা নির্লিপ্ত। সে রোদ থেকে থুথু সমস্ত ধারণ করে। রক্তও! শোভনের গায়ের প্রতিটা লোম খাড়া হয়ে উঠেছে। লোমকূপ সাপের মতোই ফণা ধরে। একটা আদি ঢাকেশ্বরী প্লাস্টিক দূত হয়ে উড়ে এল গুমটির পিছন থেকে। মূহুর্মূহু গর্জন চারিয়ে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা প্রচণ্ড দাপুটে হাওয়া। ধূলোর ঝটিতি ঝাপটে চোখ মুখ কিচকিচ করে উঠছে সবেদার মতো! বুবাই বললে, “যাশ্‌শালা! আবার ঝড় উঠল।” ঠিক কেউ যেন কবেকার প্রতীক্ষায় ছিল। চড়াম করে একাকী একাক্ষরী বিভীষিকার উপস্থিতি জানিয়ে আছড়ে ছেটা আরেকটা বাজের সঙ্গে সঙ্গে ধূসর হয়ে এল দিগন্ত। গুমটির টিনের চালে পটাপট পটাপট ঠিস ঠাস শব্দ। এবার সুবলদার গলা পাওয়া গেল, “দাদাবাবুরা ভিতরে এইসে বসবে? লাকি দোকাইন্দরব? ঝাঁপ ট তো বেশিক্ষণ খুইলি রাখতে লাইরব গ!” শোভন চটকা ছেড়ে উঠল। না ভেতরে বসা যাক কিছুক্ষণ!

আধ ঘণ্টা কেটে গিয়েছে বৃষ্টি কমবার নাম নেই! বরং উত্তর উত্তর হাওয়া আর বৃষ্টির তোড় বেড়েই চলেছে। সুবল অনেকক্ষণ উশখুশ করছে! এরপর এই ওয়েদারে আর খদ্দের আসবে না! চুতমারানি মেঘেরও আর খেয়েদেয়ে কাজ নাই! আলু তোলার সময়! সব আলু পচে শেষ হয়ে যাবে! ঘরে তুলবে কি? নিজের অস্থি? গজগজ করতে করতে সুবল জানাল এখন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লে বাড়ি গিয়ে গরম গরম ভাত খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে পারবে! ভোরে উঠে কাল আবার মালপত্তর আনতে যেতে হবে সদরে! ওর উশখুশানির ছোঁয়া এবার বুবাই আর শোভনেরও দোলা লাগল! ওরা সুবলের কাছ থেকে একটা প্লাস্টিক নিয়ে বইখাতা গুলো ভালো করে বেঁধে ব্যাগে পুরে ব্যাগ সাইকেলের হাতলে ঝুলিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রাস্তায়। এই ঝোড়ো হাওয়ায় সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে হবে। চালানো যাবে না।  অন্ধকার চিরে রাধার পদাঙ্ক অনুসরণকারী এই দুই পথিকের ভয়ার্ত চোখের নীচেই জ্বলছে দুটো সিগারেট। মৃত্যুর পিপাসা! জ্বলন্ত পিপাসা। গাঁয়ে লোক ভয় পায়, কিন্তু দ্বিধা করে না। ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে আসা যাওয়াটা উদ্বেগের হলেও আশ্চর্যের নয়! ঢালাই রাস্তা। কুলকুল করে মাঝে মাঝেই পার্শ্ববর্তী ধানের জমি থেকে জল বয়ে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে। বহুদিন নিরন্তন শুষ্কতার খাপ ছেড়ে নমনীয়তার আশ্বাসে ব্যাঙেদের সমস্বরে উল্লাস গুঞ্জিত হচ্ছে চারিদিকে। গঁক গঁক করে এত আনন্দ ওরা মিলনের মিশকালো রাতে চারিয়ে দিতে কোথায় শিখেছিল? দুজোড়া খালি পা ছপ ছপ করে কনক্রিট আঁকড়ে এগিয়ে যাচ্ছে লক্ষভেদের আশা নিয়ে। ধূ ধূ করে খালি বুক ব্যথায় বেগুনী করে মেলে ধরছে প্রকৃতি। বার বার কাঁচুলি তার খুলে নিচ্ছে কেউ। যতদূরে পলক যায়, ততদূর ধানের উত্তাল ঢেউ। আর শোঁ শোঁ করে সেই আদিম জন্তুটার দীর্ঘশ্বাস। কানের অতি কাছ থেকে কানান্তরে আঁতুড় খুঁড়ছে। খুঁড়েই চলেছে। ধমনীর সমস্ত রক্ত ওই আল না মানা নালার ফেনোচ্ছলতায় চাপ চাপ থোকা বেঁধে ছড়িয়ে যাচ্ছে! সামনের একটা পাকুড় গাছ চমকে উঠল যেন নিজের অস্তিত্ব টের পেয়ে হঠাৎ। জন্তুটার শ্লেষ্মা জড়ানো ভারী ঘড়ঘড়ে শব্দের মতো মেঘের কম্পনে কেঁপে কেঁপে উঠছে শোভনের সাইকেলের হাতল। জামাটা চিট হয়ে এসেছে গায়। মুখের ওপর দিয়ে অবিশ্রাম ঝরনার মতো চুঁইয়ে নামছে ভেজা ভেজা অনুভূতি। ইচ্ছের বিরুদ্ধে জলের স্রোত। নিশ্বাস নিতে আবার কষ্ট হচ্ছে ওর! রাণুদির মুখের মতোই কাছাকছি যাপনের একটা অস্বস্তি ক্রমশ কাবেরী পিসির লাল ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভেঙে যাচ্ছে। হাত দিয়ে বার মুখটা মুছেও অস্বস্তিটা কাটানো যাচ্ছেনা। অদ্ভুত ভাবে কিন্তু শোভনের সিগারেটটার উপরে এতক্ষণ একটাও ফোঁটা পড়ে নি। ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই ঝুপ করে ঠোঁট আর জ্বলন্ত প্রান্তের মাঝখানে একটা ফোঁটা পড়ল। যেন চেতন অচেতনের বেড়াটা দুহাতে উপড়ে ফেলতে চাইছে কেউ। সে কি শোভনকে ভাবতে বারণ করছে? সিগারেটটা নিভল না, কিন্তু ধোঁয়াটা ভারী হয়ে এল।

ভিজে জামা লেপ্টে থাকার দুর্বোধ্যতা কাটাতে ওরা দুজনেই জামা খুলে ফেলল। হাওয়াটা আবার তেজি ঘোড়ার লেজের মতো ঝাপট দিচ্ছে। কামড়ে আঁচড়ে ক্ষত বিক্ষত করতে চাইছে প্রতিপক্ষ দুজনকে। প্রতিটা পদক্ষেপে মনে হচ্ছে যেন হাজারে হাজারে কাঁটা বুক আর মুখের চামড়ার ভেতর পর্যন্ত গিয়ে গেঁথে থাকছে। বড় বড় ফোঁটা ভেসে এসে ত্যারছা ভাবে আকার হারাচ্ছে ওদের সুগঠিত শরীরের বাইরের খাঁচাটাতে ছোটখাটো ঘটনার মতো। ভেতরটা নীঃশব্দে আঘাতের চিহ্ন বহন করে চলেছে জীবনের ঐতিহ্য মেনে! ফুলে ফেঁপে উঠেছে আলের শয্যাসঙ্গী নালাগুলো। একটানা উত্তেজনার ছায়ায় শীত করছে। শীত করছে। হাত পা গুলো অবাধ্যের মতো কাঁপছে। মুঠো পায়ের পাতা কুঁকড়ে আসছে। আবার একটা বিদ্যুতের শিখা জ্বালিয়ে দিল ধাঁধার ছন্দ অনুরণন। সামলাতে সময় লাগে। তবে ততক্ষণে পাথরকালীর মোড়টা দেখা গিয়েছে। আর মিনিট দুয়েক বুবাইয়ের বাড়ি। শোভনকে যেতে হবে আরো মিনিট ছয়েক। বুকে বল আসা উচিত ছিল। কিন্তু শোভনের কেমন যেন গা গুলিয়ে উঠতে লাগল! বুক থেকে নাভিমূল অবধি হালকা হয়ে এসেছে ভীষণ রকম! একি ভয়? একি অবিশ্বাস? কার ওপর? না, শোভনের স্পষ্ট মনে হচ্ছে সেই প্রচীন নিশাচর জন্তুটা একদম ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। নিশ্বাসে হলকার ছোঁয়াচ পাচ্ছে একরকম ও। বিদঘুটে গন্ধও যেন পাচ্ছে খানিকটা! মোড়ের ঠিক মাথায় একটা বহু পুরনো আমগাছ রয়েছে। লতায় জটাপটি একটা বিরাট আদিম জটার মতো দেখতে লাগে তাকে। এই মহান্ধকার কালরাত্রি ঘোষিত বিচিত্রকায় সেই মহীরুহের সামনে শোভনের মনে হল, কেউ কি তবে জেনে ফেলেছে? কানুদা আর কাবেরী পিসির ব্যাপারটা শোভন আর বুবাই ছাড়া আর কেউ জানত না! কাউকে বলে নি ওরা! দাঁতে দাঁত চেপে না বলাটা সহ্য করে গেছে! এক ধরনের বুনো কুয়োর মতো হাঁ করা তৃপ্তি পেয়েছে। সেই তৃপ্তির চাঁই আরো বেড়ে উঠেছে ঠিক এই আমগাছটারই মতো। কেউ জানে না, কিন্তু ওরা জানে। কি অদ্ভুত তৃপ্তি! সে সমস্ত সাপে নেউলে ‘কেউ’-এরা জানল মাস দুয়েক আগে যেদিন ওই আমগাছের ডাল থেকে কষ ফাটা কাবেরী পিসির কাঠ শরীরটা নামানো হল। মর্গের রিপোর্টে লিখেছিল পোয়াতি! সেই টুপ টুপ আলতার মতো গড়িয়ে আসার পরেও হঠাৎ শুকিয়ে যাওয়া কালচে রক্ত বিন্দু গুলো কি মানিয়েছিল! আহা! আচ্ছা কাবেরী পিসি কি গাছটার সঙ্গে মিশে যেতে চেয়েছিল? নাকি পিটিয়ে কেউ বা কারা ঝুলিয়ে দিয়ে গেছিল গাছটায়? অতিথির মতো? অথবা বিয়ে আসা নতুন কনের মতো? কি সুন্দর লাগছিল কাবেরী পিসিকে! একদম রাণুদি! চোখ আর ঘর বন্ধ করে রাণুদি যখন আওয়াজ করে একটানা তখন নিশ্চয়ই ওর চোখ এরকম অর্ধেক বুজে আসে? কতবার ভেবেছে শোভন! ফুলু পিসেকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি। তাতে গাঁয়ের লোক পুলিশ সবাই একটা সিদ্ধান্তে এসে গিয়েছিল। যেন ওরা কতদিন ধরে সবটাই জানত! অথচ শান্তির ছেলেরা ঐরকম প্রবল জীবনটা বেঁচে থাকতে কিচ্ছু করতে পারে নি! কাবেরী পিসিকে এই মুহূর্তে খুব রাণুদি বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে শোভনের! ডাকবে? ডাকুক না! কালীপদ খুড়োর চিৎকারে যখন এক দুজন করে লোক ছুটে আসছিল হাউসফুল সার্কাসের টিকিট কেনার মতো তখন শোভন ওপাশের বড়োমাঠে খেলছিল! ও দেখেছে বৈ কি! রাণুদির শরীরটা একদম উদোম ঝুলছিল! বড় বড় বুকের বোঁটার উপরে কেউ নক্সা করে অল্প আলতা দিয়েছিল। ওটা সিঁদূরও হতে পারত তো? না সিঁদূরের ওপর একটা চাপা রাগ আছে আছে শোভনের! আরামদায়ক কিন্তু চাপা জন্তুর মতো! যখনই ভাবে রানুদির কাবেরী পিসির মতোই বিয়ে হবে একদিন কেমন অসহ্য যন্ত্রণা কুরে কুরে খেতে থেকে ওর সমস্ত সত্বাকে! ঠিক এখন যেমন ভয় কুরে কুরে শেষ করে ফেলছে ওকে! নিজের পুরুষাঙ্গটায় প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে ও! স্ফিত অস্তিত্বের অন্যতম ও একঘেয়ে দাবি! ওর মনে হচ্ছে ওর বুক আর কাবেরী পিসির মরা উদোম বুক মিশ যাচ্ছে একে একে! না! ও রাণুদির বুক বলবে। শুনতে কি ভালো লাগে! কপালের শির দুটো রগ রগ করছে! একদিকে রাণুদির মরা শরীরের ঠাণ্ডা আরেকদিকে ওর সহজিয়া উদ্দাম ফুঁসছে যেন একে অন্যের জিভে জিভ রেখে! সেদিনও লোডশেডিং ছিল! আজও তাই! রাণুদির ঝুকে আসা মুখটা এত কাছে কখন এল! জিভ বাড়ালেই যেন ছোঁয়া যাচ্ছে! যখন তখন লোডশেডীং এদিকের গ্রামের চিরাচরিত বৈশিষ্ট্য। লাইন থাকে খুব কম সময়। এই বিপুল আঁধারের প্রেক্ষাপটে মসিলিপ্ত হয়ে যখন চোখ থেকে মুছে গিয়েছে সমস্ত পৃথিবী তখন ওই একটা মাত্র জায়গায় যেন আলাদা করে অন্ধকার ভিড় জমিয়েছে বেশি। আমগাছটা কিছু একটা ইঙ্গিত দিচ্ছে! অন্তত শোভনের রক্ত ওঠা ভাসানো দৃষ্টিতে তাই মনে হল। কয়েক জন্মের মাতৃ জঠরের নিরঙ্কুশ অন্ধকারের সমাবেশ ঘটেছে ওখানে! পোয়াতি যেন বিয়োচ্ছে! মাথার ভেতরে একটা প্রচণ্ড ঘোর নিয়েও ওর মনে হল বুবাই, রাণুদির ভাই, ওর প্রাণের বন্ধু, ওকে সাবধান করে দিতে হবে! শোভন ঘড়ঘড়ে কামার্ত স্বরে চেঁচিয়ে বুবাইকে বললে, “একটু দাঁড়িয়ে যা! এখনই যাস না!” বুবাই ওর গলার স্বরে চমকে উঠল। কোথাও একটু কেঁপে গিয়েছিল ওর গলার কাছটা! মাছি তাড়ানো গরুর মতো! শোভনের কাছে এসে বিস্ময় আর ভয় মাখা চোখে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? কীরে? অমন করছিস কেন?” কখন সাইকেলটা রাস্তার ওপর ফেলে দিয়েছে শোভন খেয়াল করতে পারছে না। ওর হাত পা বিশ্রী” রকম ভাবে কাঁপছে। চোখ দুটোর পিছনে একরাশ শূন্যতা! একদম যেন গর্তে বসে গিয়েছে এক মূহুর্তে! হাত দুটো আড়াআড়ি বুকের ওপর জড়ো হয়ে এসেছে ঠাণ্ডায় কাউকে জড়িয়ে ধরার মতো করে। বুবাই তাড়াতাড়ি সাইকেলটা রাস্তায় শুইয়ে রেখে ওর হাত ধরলে। ঠিক সেই সময়! ঠিক সেই সময়! প্রচণ্ড একটা শব্দের ধাক্কায় ধক করে লাগল দুজনের বুকেই। আর চড় চড় করে একটা মিহি আওয়াজ তার পাশাপাশি। প্রচণ্ড আলোয় চোখ আপনি বুজে এল! সঙ্গে সঙ্গে গোটা আমগাছটা দাও দাও করে জ্বলে উঠল ওই ভারী হাওয়া বৃষ্টি সমস্তকে তুচ্ছ করে। চারিদিকের বেশ খানিকটা এলাকা আলোয় আলো হয়ে ক্রমশ কমে এল। যেন ভুল হয়ে গিয়েছে ভীষণ রকম! গলগল করে একমুঠো জ্বলন্ত জীবনলাভা বেরিয়ে যাওয়ার অস্ত্বিত্ব অনুভব করল শোভন! অনুতাপে লজ্জিত আগুন ছায়ার আঁকিবুকি গুলো কাঁপতে লাগল। ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে বসে পড়েছিল মূহ্যমানের মতো। মাত্র হাতকয়েক দূরে। শোভন দাঁড়াতে না বললে এতক্ষণ দুজনেই মিশে যেত অন্ধকারে। পোড়া গন্ধে চারদিক থমথম করছে। শোভন যেন হাজার হাজার পুড়তে থাকা চিতার গন্ধ পাচ্ছে! আমগাছের গায়ে আগুনের সারি সারি ছায়ার ফাঁকে দোল খাচ্ছে হাজার হাজার দড়ি। প্রত্যেকটা দড়ির নীচু প্রান্তে একটা উদোম স্তনভারাতুর লাশ! রাণুদির মুখের আদল। শোভনের হঠাৎ মনে হল বুবাইয়ের মুখটাও একদম রাণুদির মতো দেখতে! বৃষ্টির প্রবল তোড়ে বুবাইয়ের চোখ বোজা পলকের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। ফোঁটায় ফোঁটায়। গড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আবার ফোঁটায়। কই! আগে তো খেয়াল করে নি! প্যান্টের চটচটে আঁঠা এই প্রবল তমশাছন্ন তরলার মাঝেও নিজস্ব তরল অস্তিত্ব আলাদা ভাবে জানান দিচ্ছে। শোভনের হলকা নিঃশ্বাস ক্রমশ নেমে যাচ্ছে! পুরুষাঙ্গ ‘দ’-এর নির্জীবতা নিয়ে গুটিয়ে এতটুকু! ফাঁড়া যেন কেটে গেছে মনে হচ্ছে! আরামের দীর্ঘশ্বাসের পথে বাধা পড়ে শোভনের ঠোঁটটা নড়ে বেরিয়ে এল হালকা হিসহিসে শব্দ, “একদম কল্পনা মাসির চিতার মতো! দেখ বুবাই!আমগাছের পুড়তে থাকা ডালের দিকে শোভনের একদৃষ্টে চেয়ে থাকা দৃষ্টি অনুসরণ করে বুবাইও কেমন ঘোঁট পাকানো মাংস পোড়া গন্ধ পেল! বুবাইয়ের তখনও বাহ্যবোধ ছিল! ও শিউরে উঠল আরেকবার। সেই লোডশেডীং-এর রাতের পর আরেকবার! এই কি শেষ?

___________________________________________________________

No comments:

Post a Comment