28 December 2015

আরিফুন নেছা সুখী




সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই দৈনিক পত্রিকার শিরোনাম দেখা প্রতিদিনের রুটিন কাজল সাহেবের। কিন্তু আজকের দিনটা প্রতিদিনের চেয়ে একটু আলাদা। কারণ আগামীকাল তার বিয়ে। এই তার মানে স্বয়ং কাজল সাহেবের। আর তাই হিসেব মতো আজ তার গায়ে হলুদ। তবে গায়ে হলুদের কোন আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন নেই। বাড়িতে লোকজনের আনাগোনাও তেমন নেই। তবুও আজ সারাটা রাত ঘুম হয়নি। যতসব আবোল-তাবোল ভাবনা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

কাজল সাহেব একটা সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। এম এ ক্লাশে তার পড়ানোর বিষয় রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস যোগাযোগ। আগামীকাল ক্লাস নিতে হবে। তাই খবরের কাগজ না দেখে যোগাযোগে চোখ বোলাচ্ছেন। চোখ যোগাযোগের পাতায় হলেও মনটা তার ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে ওখানে। নানা ভাবনায় মাথাটা ভরা। কিন্তু কাল তো উনার বিয়ে। এখন পর্যন্ত কাউকে বলা হয়নি। এমন কী ছুটিও নেয়া হয়নি। বিয়ে নিয়ে উনার কোন মাথা ব্যথা নেই। এমন ভাব উনার বিয়ে উনিই জানেন না। মনের ভেতর কেমন যেন অজানা একটি ভয় তাকে তাড়া করে ফিরছে। সব সময় মনের মধ্যে অন্যরকম একটা চিন্তা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। সেই চিন্তাটাই সব সময় মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। বিয়ে হবে, কার সাথে বিয়ে হবে, বিয়ের পর কি হবে, তার জীবনটা কেমন চলবে, বিশেষত যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে কেমন হবে, এইসব নানা ভাবনা তাকে গ্রাস করছে।

এইতো সকাল বেলাতেও তিনি যখন যোগাযোগ উপন্যাসটি পড়ছিলেন তখনও কুমুদিনীকে কেমন বেশ শান্ত নরম মনের মনে হয়েছিলো। কুমুদিনীর দুঃখে মনটা ভার হয়ে উঠেছিল আর ঘৃণা জন্মেছিল মধুসূদনের উপর। শুধু তাই নয় মেয়েদের তিনি বেশ ভালোই মনে করেন। কলিগ থেকে শুরু করে পাড়াতো ভাবী আর পরিবারের মা-বোনেরাতো আছেনই সবার সাথেই কাজল সাহেবের বেশ সখ্যতা। অথচ এখন কেন যে সেই বিশেষ একটি নারীর প্রতি তার এতো ভয়। এই সব আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে বিছানাটাকে আপন করে নেন...।
কলিং বেলের শব্দ বিছানা ছাড়তে বাধ্য করে, উঠে গিয়ে দরজা খুলেন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকে খাবার দিয়ে যাওয়া কিশোরী মেয়েটি। অথচ তিনি দেখতে পান সেই বিশেষ রমনীকে...। যার সাথে তার বিয়ের হওয়ার কথা। টেবিলের উপর খাবারের টিফিন বাটিটা রেখে আবার যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় মেয়েটি। আকস্মিক কাজল সাহেব বলেন- অনেকক্ষণ হলো এসেছো, এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে
-না ভাইজান। বলেই মেয়েটি চলে যায়।

এবার যেন জ্ঞান ফিরে পান কাজল সাহেব। মাথায় আলতো করে বাড়ি দেয় আর মনে মনে বলে কি যা তা ভাবছি। বলেই টিফিন বাটিটা খুলতে যায় কিন্তু এ এক আজব ঘটনা। তিনি দেখেন খাবারগুলো সুন্দর করে টেবিলের উপর পরিবেশন করা। এবং কে যেন বারবার তাড়া দিচ্ছে খেতে বসার  জন্য। সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। তাগাদা শুনে তিনি বাধ্য হয়ে খেতে বসলেন। পাশে বসতে না বসতে একটি সুললিত মেয়ে কন্ঠ  বলল-
খেতে এত দেরী করো কেন? শরীর খারাপ করবে না, তখন কে দেখবে? আর এখন থেকে গরম গরম খাবার খেয়ে নেবে। কোন অনিয়ম চলবে না।
আবার যেন সব গুলিয়ে ফেলছে। কে কথা বলছে তার সাথে! পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে কারো দেখা পেলেন না। এবার মনের ভেতর ভয় ঢুকে গেল। গা ছমছমে একটা ভাব তার উপর ভর করে। আবোল-তাবোল ভাবতে ভাবতে ফ্রেস হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকলেন। সেখানেও শুনতে পেলেন কেউ যেন বলছে-
কি খেলে না যে?
বেশিক্ষণ বাথরুমের ভেতরে থাকতে পারলেন না। কোন রকম শাওয়ার নিয়ে বের হয়ে একেবারে বাইরে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। দরজা খুলতেই স্পষ্ট শুনতে পেলেন কেউ যেন বলছে- কি খেলে না যে। খাবারগুলো কি নষ্ট হবে? আর বেশিক্ষণ দাঁড়ালেন না, মানে দাঁড়াতে পারলেন না। বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে গেলেন।
গিয়ে বসলেন মোড়ের চায়ের দোকানে। বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন কাজল সাহেব। দোকানি চায়ের কাপটা হাতে দিতেই চায়ে চুমুক দিলেন। চুমুক দিতেই শুনলেন-
দুপুরের খাবার না খেয়ে এই অবেলায় চা খাচ্ছো যে?
কথাটা কানে আসতেই হকচকিয়ে গেলেন তিনি। চায়ের কাপটা প্রায় পড়ে যাওয়ার জোগাড়। তবুও কয়েক চুমুক দিয়ে চায়ের দোকান ছাড়লেন। রাস্তা ধরে হাঁটছে তো হাঁটছে, শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। দুপুরে খাওয়া হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে বাসায় ফিরলেন। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন। শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়লেন...।

কেউ একজন তাকে বলছে কেন আমাকে এত খারাপ করে তৈরী করলে, আমি তো এভাবে তৈরি হতে চাইনি। কুমুদিনী আমার কাছে মনটা তৈরীর জন্য একটু সময় চাইলো বলে কেন বলালে-  সময় দিলে কী সুবিধে হবে! তোমার দাদার সঙ্গে পরামর্শ করে স্বামীর ঘর করতে চাও। তোমার দাদা তোমার গুরু... এমন হাজারো প্রশ্নে জর্জরিত করছে তাকে। প্রশ্ন শুনে কাজল সাহেব বুঝলেন এ মধুসূদন। তিনি বারবার তাকে বোঝাতে চাচ্ছেন তিনি তাকে তৈরি করেননি, তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নয়। এ কথা শুনে সে আরও ক্ষেপে যাচ্ছে। বলে কি না আমাকে কেন এমন বাজে করে তৈরি করলে? আমি তো এভাবে তৈরি হতে চাইনি। কেন এমন করে তৈরি করলে... তারপরও আমি বলিনি কি আমাকে মাপ করো আমি দোষ করেছি... তুমি কেন আমাকে বাজে ভাবে উপস্থাপন করো। আর সব সময় কেন কুমুদিনীকে ভালো ভাবে উপস্থাপন করো। সত্যিই কি কুমুদিনীর কোন দোষ ছিল না। তুমি একজন পুরুষ হয়ে নারীর পক্ষ নিলে...
এমন বাকবিতণ্ডার মাঝে কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভাঙলো। তড়িঘড়ি করে বিছানাতে উঠে বসলেন। আবার কলিং বেলের শব্দ শুনে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে সেই কিশোরী মেয়েটি রাতের খাবার নিয়ে হাজির। ঘড়ির দিকে না তাকিয়েই বুঝলেন আটটা বেজে গেছে। এখন আনা খাবারের টিফিন বাটিটা টেবিলের ওপর রেখে দুপুরের টিফিন বাটিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল মেয়েটি।

ফ্রেস হওয়ার জন্য বাথরুমে ঢুকলেন, বেরিয়ে দেখেন খাবার গুলো দুটো প্লেটে সুন্দর করে পরিবেশন করা। মাথার ভেতর আবার মধুসূদনের ভূত ঘোরাফেরা করছে। ভাবছে মধুসূদন কি তবে তার জীবনে কুমুদিনী রূপে এসেছে। তবে কি মধুসূদন বোঝাতে চাইছে সত্যি তার কোন দোষ ছিল না। এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে এক সময় খেয়াল করলেন তিনি খাবারের প্লেটের সামনে বসে আছে। খেতে খেতেই কেউ একজন বলছে খাওয়া শুরু করো। খাবার সামনে নিয়ে বসে আছো কেন। বলেছি না খাবার সবসময় গরম গরম খাবে। তার পাশের প্লেটের খাবার গুলো আস্তে আস্তে সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি তো পুরোদস্তুর হতভম্ব। এমন সময় আবারো কলিং বেলের শব্দ। এখন আবার কে এলো? দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকলো কাজল সাহেবের দুই বন্ধু। তারা কোথা থেকে শুনেছে তার বিয়ে। তাই এসেই ইর্য়াকি ফাজলামিতে মেতেছে বন্ধুদ্বয়। কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছেন না তিনি। ভাবছেন যে এখানে বসে খাচ্ছিল মুর্হূতেই সে কোথায় গেল। এমন কী প্লেটটা পর্যন্ত নেই। তবে এটা ভেবে একটু আশ্বস্ত হলো যে তবুও তো ঐ ভূতের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। তাই বন্ধুদের সাথে তিনিও আড্ডায় মাতলেন।
কেমন করে যে সময়টা কেটে গেল বুঝতেই পারলেন না। এক সময় বন্ধুদের চলে যাওয়ার সময় হয়ে গেল। তারা ঘরের দরজা পার হয়েছে কি হয়নি, ওমনি সেই নারী চরিত্র হাজির। 

এসেই শুরু করলো জেরা-
-কি! এতো রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়া। আজকেই শেষ, ইচ্ছে হলে আরও কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে নিতে পারো। বিয়ের পর আড্ডা দেয়ার কথা মুখেও আনবে না। সে যাই হোক, খাবারগুলো ঠান্ডা হয়ে গেল না। এসো খেয়ে নাও। কই এসো।
কাজল সাহেবের চোখ দুটো পুরো ছানাবড়া। কি হচ্ছে এ সব? বিয়ে করতে চেয়ে সে তো মহাবিপদে পড়ে গেছে। এমন সময় সে টের পেল কেউ একজন তার হাতটা ধরে হেঁচকা টান দিয়ে তাকে বিছানায় ফেলে দিল। পাশে বসে আছে সেই রমনী। পুরো অগ্নিমূর্তি চেহারা। একেবারে কালী চন্ডীকেও হার মানায়। তাড়াতাড়ি করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলেন। ভাল করে চোখ রগড়ে দেখেন বাড়ি ভরা মানুষ, হলুদের আয়োজন চলছে। সেই অগ্নিমূর্তি রমনী বোনের মেয়ে লাবণ্য পাশে বসে ডাকছে-

ছোটমামা চলো, সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। ও ছোটমামা চলো, ওঠো, ওঠো বলছি। এতো ঘুমালে চলবে...।   

রাজীব চৌধুরী






মেয়েটাকে একবার সামনে থেকে দেখার জন্য মনটা আকুলি বিকুলি কেটে চলেছে পাঁজরের খাঁচায়। একবারের জন্যেও আমি তার মুখখানি দেখতে পাইনি। একটা শাড়ি একজন মানুষকে মানুষ থেকে পরীত্বে তুলে ধরতে পারে সেটা আজকেই প্রথম উপলব্ধি করছি। এত সুন্দর করে কেউ হাঁটতে পারে? হাঁটার দমকে পায়ের পাতা থেকে দুলুনি শুরু হয়ে নিতম্ব ছেড়ে চুলে দোলা দিয়ে চলেছে। বাসের হর্ন, রিকশার টুং টাং ছাপিয়ে আমার ভেতর শুধুই সে। কিচ্ছু শুনতে পাচ্ছিনা আমি। একটা ফেরিওয়ালা এদিক থেকে ওদিক যাবার সময় আমার সাথে প্রায় ধাক্কাই খেলো। অথচ আমার বিকার নেই। আমি উদ্ভট নয়ন মেলে তাকিয়ে আছি। আর উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটছি।
সে কি অপ্সরা?
ইন্দ্রসখি?
ইন্দ্রসভা ছেড়ে ভুল করে চলে এলো আমার সামনে?
ওর শাড়িটা সাদা। সাদা আমার প্রিয় রঙ। কাশফুল আমার ভালোলাগে। ভালোলাগে কাশফুলের সাগরে ভেসে বেড়াতে।কিন্তু সে তো শরতে। আজ ও শর নয়। আজ বরষা। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি বয়ে যাচ্ছে আমার সামনে। আমি তুলোরঙা কন্যার তুলো মাখা শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটার শাড়িতে সুক্ষ সাদা রঙের ফুল আছে। সুতোর ফুল। ফুলগুলোর মাঝে সাদাটে জরির কারুকাজ। আহা কি মাধুরীমা সেই জরির কারুকাজ। আমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল।
এর মাঝে সে দুবার রাস্তায় থেমেছে। একবার থেমে হাতে পড়া সাদা হাতঘড়ি দেখেছে। আরেকবার থেমে রাস্তায় চলন্ত বিলবোর্ড দেখেছে। আমি দুবারই তার সামনে যাবার চেষ্টা করেছি। পারিনি।
ওর ব্যাগটা ও সাদা।
সে কি আজ সাদা দিবস পালন করছে? সাদা কি কারো মনের রঙ হতে পারে?
পারে কি প্রিয় রঙ?
একজন নারী কতটা শুদ্ধ হলে সাদা পড়তে পারে?
সে এখন আমার ঠিক হাত পাঁচেক সামনে দাঁড়িয়ে একটা ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ম্যাগাজিন দেখছে। হায় কপাল আমার- তার কালো কুন্তলা চুলগুলো আমায় ওর মুখখানা দেখতে দিলোনা। আমি ওর চুলের মাঝে হারিয়ে গেলাম। মুখ ঢাকলো চুলে। আমি ঢেকে গেলাম ঘনকালো কালিমেঘে। ওর ছাতাটা ও সাদা। দুধেআলতা গায়ের রঙে সাদাটে কন্যাকে আমি এর মাঝে একবারের জন্যেও
আমি দেখতে পারলাম না।এ কি কপাল আমার?
আমি দুবার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু আমি ওকে পেরিয়ে যেতে পারিনি। পেরোতে পারিনি রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ভিখিরির জন্য। পেরোতে পারিনি ওপাশ থেকে আসা মানুষের জন্য। ওকে দেখে সব মানুষ ঠাই দাঁড়িয়ে গেছে কোথাও কোথাও। কোথাও ওর দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারছেনা তরুন যুবা। এক বৃদ্ধকে দেখলাম শরীরের গোপনাঙ্গে বিচ্ছিরিভাবে চুলকে চুলকে ওর রুপসুধা গিলে চলেছে।
হতচ্ছারা!
ওর পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে মানুষের স্রোত।
এত মানুষ কেন আজকে। এত মানুষ কেন রাস্তায়? মানুষগুলো এই বৃষ্টিসকালে বেরোলো কেন? ওদের কি এত কাজ? ওদের জন্যেই আমি মেয়েটাকে একবার ও দেখতে পেলাম না। আমার মরনের পরেও আমি অতৃপ্ত থেকে যাবো মেয়েটাকে একবার দেখিনি বলে।
ওর হাঁটার পথে বন্ধুর অংশগুলো আমার চোখ রাঙ্গানি শুনছেনা।
ও থামছে না।

হাঁটার গতি আরো বেড়েছে। ওর দমক দমক চলাচল আমার হৃদপিন্ডে সাইক্লোন বইয়ে চলেছে।
বুকের ভেতরটা ধুকপুক করছে।
ঠোঁটগুলো কেমন ওর?
মোটা নাকি পাতলা?
সে কি টিপ পড়েছে?
কেমন টিপ?
সাদা?
কেমন ওর নাকফুলটা? কানের দুলগুলো ও তো চুলে ঢাকা। কেমন ওগুলো?
খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।ওর হাতের ব্যাগটা সাদা। ও কি সাদা কানের দুল পড়ে আছে? ওর নাকফুলের পাথরটা ও কি সাদা? ওর হাতের আংটিটা ও কি সাদা পাথুরে? ওর ঠোঁট দুটো নিশ্চিত সাদা নয়। গাঢ় লাল? টকটকে আগুনরাঙ্গা ঠোঁট দুখানি? নাকি গোলাপী মাসরুম? কোমল লাল গোলাপ?
ও কি আইশ্যাডো মেখেছে? চোখ দুখানি কেমন দেখতে? ওর চোখের ভেতর কি চোরাবালি আছে?
এভাবে পুরুষগুলো গিলছে কেন ওকে? সবাই হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে চক্ষুধর্ষন করছে। আমি পেছন পেছন হাঁটছি।
দেখতে পাচ্ছিনা।
পাচ্ছিনা।
পাচ্ছিনা।
প্রতিটি পদক্ষেপে মনে হচ্ছে ও আমার চাইতে দূরে চলে যাচ্ছে। দূরে যাচ্ছে অযাচিত ট্রেন। সাদা ক্যানভাস। রুপের ডালি খেলা কন্যার দল। বাতাসী লেবুর ঘ্রাণ। ওর পারফিউম টা অসাধারণ। আমাকে এর মাঝেই মাতাল করে দিলো।

আরে আরেহ!
একটা দুষ্টু লোক ওর প্রায় হাত ছুঁয়ে চলে গেল তারপর আমার ও! লোকটা কি দেখেনা? নাকি ওকে একবার ছোঁয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সবাই? ও কি আজকেই পৃথিবীতে এসেছে? ওর দিকে সবাই এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? আরে হ...
ও হটাত করেই পেছন ফিরেছে।আর আমি দেখতে পেয়েছি ওকে।আমার চোখ দুটো আটকে আছে। আমি চোখ সরাতে পারছিনা। সময় থেমে গ্যাছে যেন। আমি স্টাচু হয়ে পড়েছি পথের বাঁকেই। একটা কাক উড়ে গেল। কা কা শব্দ কানে ঢুকছেনা। অনেক দূরে একটা বাস হর্ন চেপেছে তো চেপেছেই। আমি শুনছি তার ব্যর্থ ধীরলয়ের শব্দ। কয়েকটা লোক দৌড়ে যাচ্ছে বাসের দিকে। কিন্তু সেই দৌড় যেন ভয়াবহতম ভাবে ধীর। স্লো মোশনে কিছু পাখি উড়ে গেলো। একটা সুর্য আরো ধীরলয়ে ধীরে ধীরে নেমে যাচ্ছে পশ্চিমের দিকে। আমি তবুও তাকিয়েই আছি। তো তাকিয়েই আছি। আমি তাকিয়েছি আর মনে হল আমি যেন লাল কেল্লার পৃথক স্তম্ভ। বয়সী বটের মত অচঞ্চল ফলধারী বৃক্ষ। জটাজুটধারী ঋষি। 

আমি ঠিক কতোক্ষন তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে? জানিনা। ওর মুখের একপাশ দেখেছি আমি। ঝলসানো সেই মুখের সবকিছুই আছে। শুধু কোনকিছুই ঠিকমতো নেই। কুকড়ানো চামড়ার মাঝে আমি একটা নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখ দেখে স্তবির হয়ে গিয়েছিলাম অনেকক্ষণ! এর পরেই আমি হাঁটা শুরু করেছি অফিসের পথে। আজ অফিসে অনেক কাজ। এভাবে মেয়েদের পেছনে ঘুরলে চলবে? শুধু শুধু সময়টাই নষ্ট হয়...#


আবু রাশেদ পলাশ




আমাদের পাড়ার প্রকাণ্ড আমগাছটা বিরুদের। আদিগাছ। ওর জন্মের হদিস দিতে পারে এ পাড়ায় সাধ্যি কার? জন্ম থেকে আমরা কেবল স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ওকে। ওটা কথা কয় জান? মামুদপুর গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে সজল দৃষ্টি ওর। সকালের কাক যখন ওর মগডালে বসে কা-কা আওয়াজ করে বোধকরি সবাই শুনে সে ধ্বনি। সংসারের ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে আহালু আর নঙ্ক যখন কলহ করে তখন সে চোখ রাঙায় নিশ্চয়। রতনের ঘরে জোড়া সন্তানের আগমনবার্তা শুনে সেও আহ্লাদী হয়। দখিনা বাতাসে পাতাগুলো দোল খায় তখন।
বিরুদের আমগাছটার পাশেই তাদের প্রকাণ্ড ফলের বাগান। তাতে মৌসুমি ফলের নৃত্য সমাহার। এগুলো ঘিরে কত স্মৃতি আমাদের। সময়গুলো ঝাপসা হয়ে যায় দিনে দিনে, মুছে যায়না নিজ থেকে। গাঁয়ের ঘরে ঘরে সন্ধ্যায় বউয়েরা খড়ের গাদা পুড়িয়ে রাতের খাবার প্রস্তুত করে। তাদের সৃষ্ট ধোঁয়াগুলো শূন্যে এসে সমবেত হলে জোটবদ্ধ মেঘের রূপ নেয়। আমাদের মুহূর্তগুলো ও এখন তদ্রূপ। 
মামুদপুর গ্রামে বিরুদের বাড়ী রায়ের বিল হতে উত্তরে। শুকনো মৌসুমে বিল পেরিয়ে আসতে সময় লাগে বেশ। আষাঢ়ে বানের জলে যখন গ্রাম ভাসে বিলের ভাসা জল তখন আমগাছটার গোড়া ছোঁয়। এ পাড়ার বাড়িগুলোতে সাদা জল লুটোপুটি খায়, বিরুদের বাড়ীতে সে দৃশ্য গবেষণার ব্যাপার। ওদের দহলিজটা বেশ উঁচু, ঘরগুলো আরও। মাঝিপাড়ার জেলে গুলো বন্যায় ঘাট হিসেবে ব্যবহার করে আমগাছকে। ওর গোড়ায় কত কত নৌকা ভাসে তখন!
মাঝি বাড়ীতে মানুষ মোটে দুজন । বয়স্ক হবিরন বিবি ভাল করে চোখে দেখেনা দিনে, রাতে তো নয়ই। বিরুর বাপ গুনাই মাঝিকে আমরা চোখে দেখিনি কেউ। নাম শুনেছি কেবল। গুনাই মাঝি যখন পরবাসী এ পাড়ায় হয়তো আমাদের আগমনী বার্তা বাজেনি তখনও। আমাদের আগমন গুনাই মাঝির উত্তরসূরি হয়ে, এখনতো গাঁয়ে আমরাই বর্তমান ।

হবিরন বিবি কিন্তু মানুষ ভাল। পাড়ায় আমরা কোনদিন কলহ করতে দেখিনি তাকে। যেচে কারো সাথে কথা বলতেও যায়না সে। মরার আগে স্বামীর রেখে যাওয়া আবাদি জমিগুলো বর্গা দিয়ে সংসার চলে তার। মৌসুমি ফল বিক্রির টাকাও যসামান্য নয়। ফলে বিরুদের অভাবের মুখোমুখি হতে হয়না কখনই। বরং এ গাঁয়ে আর সবার থেকে দাপটে চলে তারা। ঘটা করে উসব পালন করে বিভিন্ন। গুনাই মাঝির মৃত্যু দিবসে পাড়ায় ঘরে ঘরে ভোগ দেয়। হা-ভাতে ছেলেগুলোও বছরে একদিন ভাল মন্দে উদরপূর্তির লোভ করে দিনকে দিন। এতকিছুর পরেও মনে কোথাও যেন দুঃখ ছিল হবিরন বিবির। সংসারে একমাত্র ছেলে যে তার অন্য দশটা ছেলেদের মত নয়, হয়তো এটা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দিত সে। যাহোক বিরু কিন্তু জন্মেই এমন ছিলনা। গাঁয়ের মক্তবে ছোটবেলায় যখন কায়দা পড়েছি আমরা তখন ওর বয়স যখন পাঁচ কি ছয়। কি এক অসুখে পড়েছিল ও। তারপর সুস্থ হয়েছে সত্যি তবে কথা হারিয়েছে মুখে। মনের ভাব প্রকাশ করতে গেলে এখন কেবল অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সে। মুখে লালা ঝরে সারাদিন। বুদ্ধিটাও বোধহয় আটকে আছে শৈশবেই। বয়সের ভারে কেবল দেহ বেড়েছে তার বুদ্ধি বাড়েনি মোটেও ।
পাশের বাড়ীর নজুখাঁর বউ হাঁসুলি বিকেলে পাড়া ঘোরার বাহানায় হবিরন বিবির সাথে খোশগল্পে মাতে। পানের বাটাটা এগিয়ে দিলে মুখে পান চিবোয় সময় ধরে তারপর বলে-
-একখান কতা মুনে আহে, কমুনি চাচি? হবিরন বলে, শরমাও যে, কও হুনি?
-বিরু ভাইনি জন্ম পাগল?
-অমুন কইরা কও যে, পুলা মোর পাগলনি? হুগনা বাতাস নাগচে মালুম অয়।
পরক্ষণে কথা বাড়ায়না হাঁসুলি। সে তো জানে এ পাড়ার সবাই যখন বিরুকে পাগল বলে সাব্যস্ত করে কেবল হবিরন বিবি সত্যটা মানতে নারাজ। উত্তর পাড়ার নয়াব আলীর ষোল বছর বয়সী মাথা পাগল ছেলেটা, কথা বলতে পারেনা সেও। নিজের খেয়াল রাখতেও অপারগ সে। অসচেতন হলে হয়তো গোপন অঙ্গ প্রদর্শিত হয় জনসম্মুখে। কই, বিরুর মধ্যে তো এমন হাবভাব নেই। তাহলে পাগল সে নয় নিশ্চয়ই। হবরন বিবি বিশ্বাস করে একদিন ভাল হবে ছেলে। কিন্তু কবে? কেবল সে দিনটাই জানা নেই তার।
রায়ের বিলের তীর ঘেঁষে যে কাঁচা সড়কটা বাজারমুখী ধাবমান তার কূল ঘেঁষে আমাদের বাড়িটা। প্রত্যহ সওদা করে ফেরার পথে বিরুদের বাড়িটা পাশ কাটিয়ে আসতে হয় আমাকে। সুযোগ পেলে সপ্তাহে এক দুইবার যাওয়া হয় সেদিকে। হবিরন বিবি পুলকিত হয় তাতে। আমার আগ্রহ না জানি এতেই। হবিরন বলে, বিন্দেনি, দুস্তেরে দেকতে আইলি মুনে কয়?
-হাঁচা, হগগল ভালানি চাচি?
-ভালা, শিগগির যাসন্যা আইজ। খাসীর বেনুন রানছি বিরুর লগে দিমুনে।
ইচ্ছে না হলেও নিষেধ করা হয়না সহসা। সাহসেও কেমন ঘাটতি পড়ে যেন। মাঝে মাঝেই রাতের খাবার খেয়ে আসতে হয় আমায়। মাঝি বাড়ী গেলে বিরুটা কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আচমকা দৃষ্টি গেলে ভেতরে কোথাও ব্যথা হয় যেন।

অগ্রহায়ণের গোড়া অথবা পৌষের শুরুতে বিয়ের ধুম পড়ে মামুদপুর। নতুন ফসলের আগমনে ঘরে ঘরে নবান্ন উসব করে মেয়েরা। কামলা গোছের উড়নচণ্ডী ছেলেগুলো কাঁচাপয়সা উপার্জনের মুহে পড়লে ঘরে নতুন বউ আনার পাঁয়তারা করে। বিরুর বয়সী গেঁয়ো ছেলেগুলো সংসারি হয় এক এক করে। বছর ঘুরতেই কারো কারো ঘরে নবজাতকের কান্নার আওয়াজ পাওয়া যায়। বিরুর ক্ষেত্রে সে দৃশ্য কল্পনাতীত। ওরও বয়স হয়েছে বেশ। অন্তত যে বয়সে গাঁয়ের ছেলেরা সংসার মুখী হয় তার চেয়ে বেশীই। কিন্তু মনে বিয়ের কোন গোপন মোহ নেই বিরুর। দুনিয়ার হদিস জানেনা যে, অ্যাঁ অ্যাঁ করলে মুখে লালা ঝরে তাকে মেয়ে দিবে কে? কিন্তু হবিরন বিবি সে সত্য মানতে নারাজ। এ কূলে ছেলে তার একটাই। মরার পর এ সংসারে হাল ধরতেও মানুষ চাই তার। বিরুর উপর ভরসা কই? ইয়ার বন্ধুরা সংসারি হলে তাই ঘরে ছেলের বউ আনার পাঁয়তারা করে হবিরন বিবি। গাঁয়ের বউয়েরা খোশগল্পের বাহানায় সমবেত হলে একদিন মনোবাসনা খুলে বলে সে।
-হুনছনি বুজান, পুলার বউ দেহার খায়েশ অয় দিলে। এক দুই কথায় বাঁধ সাধে কেউ কেউ। বউনি, পাগলারে মাইয়্যা দিব কেডা কও তো?”
তখন প্রতিবাদ করে হবিরন-মুখ সামাল দেও বুচির মা, পুলা কই পাগল না।
-হাঁচানি, বিয়া কইরে ভাত দিব পুলা?
-নিয্যস ।
হবিরনের কথা মিথ্যে নয়। এপাড়ায় মাঝি বাড়ীর প্রতিপত্তির কথা অজানা নয় কারও। সংসারে অভাবের ছিটেফোঁটাও খোঁজে পাওয়া দায়। কামলা গোছের অভাবী মানুষগুলোর কাছে পেটের ক্ষুধায় শেষ কথা। দিন শেষে উদরপূর্তি করতে পারলে আর কিছু চাইনা কেউ। কে জানে হয়তো এ মুহেই কেউ কেউ কন্যা সম্প্রদান করতে পারে বিরুর হাতে। চেষ্টা করতে দোষ কি?
বারুইল গ্রামের ধলাই শেখ সম্পর্কে স ভাই হবিরন বিবির। একই বাবার দ্বিতীয় ঘরের সন্তান সে। ঘরে বউ ছাড়াও একটা মেয়ে আছে তার। নানকি। আহ ! কি ভাল দেখতে মেয়েটা। যেমন স্বভাবে তেমন সৌন্দর্যে। বিরু যখন শৈশবে তখন ওকে ঘরের বউ করতে চেয়েছিল হবিরন বিবি। এরপর কত বছর পার হয়েছে সাহস করে ভাইকে সত্যিটা বলতে পারেনি সে। ছেলে যে তার অন্য দশটা ছেলের মত নয়, এটা ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিয়েছে সে। ধলাই শেখের আর্থিক অবস্থা ভাল নয় এখন। কে জানে, বোনের প্রস্তাব হয়তো মেনে নিতেও পারে সে। অন্তত একবার চেষ্টা করে দেখতে চায় হবিরন। বুড়ো কলিমুদ্দিন সম্পর্কে চাচাতো ভাই গুনাই মাঝির। একদিন তাকে দিয়েই ভাইয়ের বাড়ী প্রস্তাব পাঠায় হবিরন বিবি। তারপর দিনভর আর দেখা পাওয়া যায়না কলিমুদ্দির। সন্ধ্যায় ফিরে এসে জানায়-
-ভাই তোমার রাজি নয়গো ভাবি, মনোবাঞ্ছা ছাড়ান দেও ।
তবুও আশাহত হয়না হবিরন। মনে মনে ছেলের বউ খোঁজে বেড়ায় সে। পার্শ্ববর্তী কুলকান্দি গ্রামের মতিঘটক বিয়ের কাজে পোক্ত লোক। এ পাড়ায় কতজনেরইতো বিয়ের পাত্রী জোগাড় করে দিয়েছে সে। সে খবর কে না জানে। হবিরন বিবি খবর দিলে একদিন মাঝি বাড়ী দেখা যায় তাকে। হবিরন বলে, হগগল খবর হুনছ মালুম অয় ঘটক?
মতি বলে, , ভরসা কইরো ভাবী চাইলে বাঘের চোখ আইন্যা দিমু।
-হাঁচানি ভাই?
-নিয্যস, মিছা কওনের মানুষনি মুই?
মতি ঘটক দেখতে পটকা মাছের মত মানুষটা, কনে দেখার ছলে মোটা টাকা হাতিয়ে নেয় হবিরন বিবির কাছ থেকে। এক এক করে দিন যায় সহসা কনের সন্ধান মেলেনা কোথাও। একদিন আশাহত হয় হবিরনও। কদিন পরের কথা। জিন্দারপুর গ্রামের মহেশ আলী, সংসারে অসচ্ছল গেরস্ত সে। ঘরে নিদারুণ অভাব। অভুক্ত স্ত্রী সন্তানদের অহর্নিশ আস্ফালন বিচলিত করে তাকে। বড় মেয়ে তিলক পনের বছরে পা দিল এবার। এ বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রচলন গ্রামে। তিলকের বয়সী মেয়েগুলোর বিয়ে হয়েছে কবেই। কারও কারও কূলে সন্তানও আছে এখন। তিলকের বিয়ে হয়নি এখনও। বিয়ের বাজারে ওকে নিয়ে আগ্রহী হতেও দেখেনি কেউ। পাত্রপক্ষের অনীহার কারণ হয়তো মহেশ আলীই। এজন্য গাঁয়ে কত কথাইতো শুনতে হয় তাকে। লোকে বলে, মাইয়্যা নাউয়ের বশ করনি মহেশ, বিয়া দেওনা যে?
লোকে নিন্দা করলে মিথ্যা বলে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করে সে।
সে বলে, দিমুগো মিয়া ভাই, সরেস পুলা পাইন্যা যে। সরেস পাত্রের কিন্তু সন্ধান করেনা মহেশ আলী। মেয়েকে কোন ভাবে পার করার চেষ্টা করে সে । সুযোগ বুঝে মতি ঘটক বিরুর বিয়ের প্রস্তাব দেয় তাকে।
সে বলে, ভালা গেরছ মিয়া ভাই মাইয়্যা দিবানি?
মহেশ বলে, কেডা কও তো?
-মামুদপুর গুনাই মাঝির পুলা বিরু।
সংসারে এ দুঃসময়ে মতির কথা মনে ধরে মহেশ আলীর। এর কদিন পর ইয়ার বন্ধুদের সাথে নিয়ে মেয়ের বিয়ের পাত্র দেখতে যায় সে। কিন্তু ফিরে আসে আশাহত হয়েই। যদিও বিরুর কথা আগেই বলেছিল ঘটক কিন্তু সে সমস্যা যে যসামান্য নয় এটা বুঝেই পিছাতে হয় তাকে। তবে আশা ছাড়ে না মতি ঘটক।
মহেশ বলে, ইতা কেমুন কও ভাই মাইয়ানি গাঙ্গে দিমু । মতি বলে, পুলার মাও দুই বিঘা জমি দিব কয় দিলে বুঝ দেও। তখনও রাজী হয়না মহেশ। তবে এর কদিন পরই হঠা লোক মারফ খবর আসে বিরুর সাথে মেয়ের বিয়েতে রাজী সে। তবে জমি আগেই নিঃশর্ত লিখে দিতে হবে তিলককে। হবিরন বিবি আপত্তি করেনা তাতে। এ সংসারে আল্লাহ অনেক দিছে তাদের। সেখানে দুবিঘা সামান্যই। তাছাড়া বিয়ের পর তিলক তো এখানেই থাকবে। যেখানে ছেলে পাগল তার সেখানে বউয়ের নামে সামান্য সম্পদ থাকলে মন্দ কি?
তিলকের কাছে কিন্তু সত্য প্রকাশ হয়না কখনই। পাত্র কে, কি করে বিবাহ অবধি এগুলো অজানাই থেকে যায়। জানতো, ওর মত মেয়েদের এসব জানার অধিকার থাকেনা। সংসারে পিতা বলে পরিচিত যে মানুষটা তার ইচ্ছেই শেষ এখানে। তারপর বিয়ের দিনই হয়তো জীবনে বড় ধাক্কাটার মুখোমুখি হয় তিলক। স্বামী নামক যে মানুষটার কাছে নিজের সর্বস্ব বিসর্জন দিতে এসেছে সে, সে মানুষটা যে অন্য সবার মত নয় এটা ভেবেই অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। তিলক কিন্তু মেয়ে ভাল, দেখতেও বেশ। পরদিন বউ দেখে ধন্য ধন্য করে গাঁয়ের বউয়েরা।
-হুনছনি বইচির মা বিরুনি বিয়া করছে কাইল।
-হাঁচানি, বউ কেমুন কও তো?
-চান্দের ঢং সরেস কপাল পাগলার।
তারপর এক এক করে দিন যায়। দিনে দিনে হয়তো সংসারে বিতৃষ্ণা বাড়ে তিলকের। দেখতে তো সে মন্দ নয়। বিরু ও হয়তো ভাগ্যের লিখন ওর। তাতে কি, পাগলের সাথে সংসার করা যায় কি? ভালবাসা প্রত্যাশী মেয়েটা রাতে স্বামীর জন্য উতলা হয়। অবুঝ বিরু ভ্রূক্ষেপ করেনা তাতে। হবিরন বিবি হয়তো বোঝতে পারে সবই। তথাপি তিলককে খুশী রাখার চেষ্টা করে সে। মহেশের অসচ্ছল সংসারে আর্থিক সহায়তা দেয় দিনকে দিন। এতে সামান্য সচ্ছলতা আসে মহেশের। মন্দ কি? বিরু পাগল বলেই হয়তো জন দশেক মানুষের উদরপূর্তি হয় এখানে।
হাতে কাজ না থাকলে তিলকের সাথে খোশগল্পে মাতে হবিরন। নানা সুখ দুঃখের গল্প করে দুজন। হবিরন বলে, পুড়া কপালগো বউ । আমি মরলে দেইখো বিরুরে।
সহসা জবাব দেয়না তিলক। এ সংসারে এসে দুবেলা দুমুঠো ভাত ছাড়া বিশেষ কিছুই পায়নি সে। তবু তাকে প্রবোধ দিতে হয়। নিজেকে প্রবোধ দেয় সে নানা কিছু ভেবেই।
এরপর এক জ্যৈষ্ঠের কথা। আম কাঁঠালের মৌসুমে জামাই দাওয়াত করে খাওয়ানোর রীতি আছে গ্রামে। জ্যৈষ্ঠের দাওয়াতে শ্বশুরবাড়ী যাওয়ার ফুরস হয়না বিরুর। এ সবের গুরুত্ব জানা কথা নয় ওর। অবশেষে তিলক একাই যায়। বাপের বাড়ী গেলে পাড়ার মেয়েরা জটলা করে ওকে ঘিরে।
আচ্ছা, মনাইয়ের কথা মনে আছে? জিন্দারপুর গ্রামের হাছন আলীর ছেলে মনাই। সংসারে আপন  বলে কেউ নেই তার। উদরপূর্তির তাড়নায় আগে বারুইল বাজারে দুদু শেখের দোকানে পেট খোরাক মজুরী খাটতো সে। কৈশোরে মনাইয়ের সাথে মন দেওয়া নেওয়া করেছিল তিলক। সম্পর্ক ওদের বিবাহ পর্যন্ত গড়ায়নি। যেখানে নিজের পেটের ভাত জোগানোর সামর্থ্য ছিলনা মনাইয়ের, সেখানে তিলকের ভরণপোষণ অসাধ্য ছিল তার। মহেশ আলীও রাজী হয়নি মেয়ে দিতে। দুদু শেখের দোকানেই কাজ করে এখন মোটা টাকার মালিক হয়েছে মনাই। বাড়ীতে ছনের দুচালা ঘর তুলেছে নতুন । বাপের বাড়ী এলে একদিন মনাইয়ের সাথে দেখা হয় তিলকের। তিলক বলে, ভালা আছ মালুম অয়? মনাই বলে, ভালা, আইছ কবে?
-কাইল।
তারপর সময় ধরে নানা কথা বলে দুজন। মনাইয়ের বিয়ে হয়নি এখনও। ইয়ার বন্ধুদের নিয়ে কনে দেখছে সে। তিলক রাজী থাকলে ওকেই ঘরে নিতে চায় সে। সেদিন রাতে হঠা ভাবনায় পড়ে তিলক। বিরুকে মনে করে অশ্রু বিসর্জন দেয় সে। তারপর আচমকা সিদ্ধান্ত নেয় বিরুর সাথে সংসার করবেনা সে। সত্য প্রকাশিত হলে হুঙ্কার করে মহেশ আলী। মরিয়ম বোঝানোর চেষ্টা করে মেয়েকে। সেবার মামুদপুর এসে আচমকা বদলে যায় তিলক। নানা ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়েও কলহ করে সে। ওকে দেখে অবাক হয় হবিরন বিবিও। তবুও মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে নিজেকে মানানোর চেষ্টা করে সে। বিরুতো কথা বলতে পারেনা। মনের কথা প্রকাশ করতে কেবল অ্যাঁ অ্যাঁ শব্দ করে সে। অবশেষে একদিন সত্য প্রকাশিত হয় হবিরনের কাছে। তিলক বলে, এ সংসার করবার নয়। হামাক ক্ষেমা দেন।
তিলকের ইচ্ছায় অনীহা প্রকাশ করেনা হবিরন বিবি। সম্পর্ক ইচ্ছের বাইরে হয়না কখনই। জগত সংসারে এসে অন্তত এ সত্যি জানা হয়েছে তার। বিরুতো পাগল, তিলক নয়। জিন্দারপুর খবর গেলে মেয়েকে নিতে আসে মহেশ আলী। প্রস্থানে জমিটুকু ফেরত দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে সে। হবিরন বলে, জমিনি, কথাখান ছাড়ান দেন। জমিখান বউয়ের। তিলক ফিরে গেলে সেদিন বিরুকে উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে দেখেছে সবাই। হবিরন বিবি সহসা থামানোর চেষ্টা করেনি তাকে । দিনের শেষে রাতের অন্ধকার ঘনতর হয়। এক এক করে নীরবতা নামে সর্বত্র। ঘুমে আচ্ছন্ন হলে মুখের লালায় বালিশ ভিজে বিরুর । অনাহুত ভবিষ্য ভেবে বিচলিত হয় হবিরন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ মানুষটা যখন প্রস্থান করবে তখন ভবপারে নিজের বলে কেউ থাকবেনা বিরুর। গোত্রের মানুষে ভরসা কি, হবিরন বিবি না থাকলে হয়তো তার সবটুকুই কেড়ে নিবে সবাই। তখন বিরুর ঠায় হবে কোথায়, রাস্তায়?

এর কদিন পরের কথা। তখন মসজিদে ফজরের আযান হয়েছে কেবল। প্রকাণ্ড আমগাছটার মগডালে প্রত্যহ যে কাকের আওয়াজ শুনা যায়, তার কণ্ঠ ধ্বনিত হয়নি তখনও। হবিরন বিবি বড় ঘরের দরজা খুলে দেখে তিলক দাঁড়িয়ে । কি এক অদ্ভুত মুহে পড়ে আবার ফিরে এসেছে মেয়েটা। গাঁয়ে আমাদের ভিটেটা অযত্নে পড়ে আছে আজও। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়া থাকে সেখানে। বছর পাঁচেক পর সেদিন গেছিলাম, আগাছা জন্মে পুরনো কবরগুলো নিশ্চিহ্ন প্রায় । আসার পথে দেখা হল বিরুর সাথে। আমাকে দেখেই অ্যাঁ অ্যাঁ করে এগিয়ে এল সে। তারপর টেনে নিয়ে ভেতরে বসাল যত্নে । ওর মুখে লালা ঝরে না আর। কথাগুলোও স্পষ্ট হচ্ছে দিনকে দিন। ঘরে নতুন মানুষ এসেছে । ওর বউ তিলক, কি এক অদ্ভুত মুহে পড়ে আজও এ অসম্পূর্ণ মানুষটির সাথে সংসার করে চলেছে। সম্পর্কের ভাষা হয়না কখনই। ওর অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে কেবল। বিরুও হয়তো সম্পূর্ণ মানুষ হবে একদিন। কি কথা, কি বুদ্ধিতে। ওর পাশে তিলক আছে তো।   

মুকুল খান





বরুনার সাথে সুবলের প্রেমটা জমল না। সুবলের লাশটা কাঁধে নিতে নিতে আমার এই কথাটিই প্রথম মনে হল। সুবলের যেই বোনটার কাঁধে আমরা আমাদের ব্যাগ গছিয়ে দিয়ে, আমি আর শুবল কাঁধে হাত রেখে শহীদ নবী স্কুল থেকে হেটে হেটে ঋষি পাড়ায় ফিরে আসতাম, সেই বোনটা যেদিন এক মুসলমানের সাথে ভেগে গেল সেদিন সুবলদের ঘরে কোন বাতি জ্বলেনি। ঋষি পাড়ায় নিতেশ কাকার মুচির দোকান সেদিন খুলেনি আর শুবল সেদিন ধানকাট্টীর বোতল মুখে নিতে নিতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলেছিল, "বুজলি দোস্ত, দিদি মুসলমান হইছে আমি বহুত খুশি, আমাগো মতো অর আর মাইনসের পা ধুইয়া খাইতে হইব না"। ঋষি পাড়ায় তিন পুরুষের বাস তুলে দিয়ে সুবলের মেসো যখন ইন্ডিয়া চলে গেল তখনও সুবলকে এত খুশি দেখি নাই। খুশী হবার যথেষ্ট কারন ছিল যদিও, নির্বাচন এলেই আমাদের এই হিন্দু পাড়ায় হামলার আশংকায় সুবলদের চোখে যে ভয় আমি দেখতাম তা আমাকেও সন্ত্রস্ত করে রাখত রাতদিন। আর তাই যেদিন শুনলাম রঞ্জন কাকা ইন্ডিয়া চলে গেছে তখন আমি খুব খুশী হয়েছিলাম।

"হরি বোল, বোল হরি" জিগির তুলতে তুলতে আমরা যখন পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটের দিকে এগিয়ে যাই তখন কি সুবলের লাশটা নড়ে চড়ে উঠল? তবে কি শুবল তার হত্যার প্রতিশোধ নিতে আসমান, দোজখ, বেহেশত ঘুরে ফিরে আসলো? আমি আড় চোখে সুবলের লাশের দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত হবার চেষ্টা করি। শুবল ঘুমায়, নাকি শুবল বুড়িগঙ্গার আঙিনায় এই পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটের জ্বলন্ত চিতার উপর শুয়ে হাজারও শ্মশানবাসী কে তার মৃত্যুর সাতকাহন শুনিয়ে আবার ফিরতি পথ ধরবে আমাদেরই সাথে। তারপর হাটতে হাটতে তার দুই পা ভারী হয়ে এলে জুরাইনের রেল লাইনের স্লিপারের উপর বসে চীকার দিয়ে বলবে "বরুনা, আমি আবার ফিরে এসেছি, তোমাকে বলেছিলাম না আগুন আমাকে পোড়াতে পারবে না"। কিংবা বুড়িগঙ্গার বুকে ছুটে চলা হাজারও জাহাজ, নৌকা আর রুই, কাতলা, মৃগেলের সাথে সুবলও ছুটে চলবে ফতুল্লা, তারপর নারায়ণগঞ্জ কিংবা মুনশিগঞ্জ কিংবা তারওপরে তালতলার আলুর ক্ষেতগুলো কে পিছনে ফেলে শুবল গিয়ে উঠবে তারই কোন এক পূর্ব পুরুষের ভিটায়, যেখানে কোন এক তক্ষক হাজারও বছর ধরে পথ চেয়ে আছে সুবলের ফিরে আসার অপেক্ষায়। কিংবা এমনও হতে পারে শুবল সোজা সদরঘাটের দিকেই গেল, তারপর যেতে যেতে আহসান মঞ্জিলের চূড়ায় বসে ধানকাট্টীর বোতলে চুমুক দিতে দিতে শুবল নবাব সলিমুল্লার মদের গ্লাসে টুং টাং বাজনা বাজাতে বাজাতে পেয়ে গেল বুড়িগঙ্গার শেষ সীমানা। কিংবা আমাদের সাথে ফিরতি পথ ধরে আবার ঋষি পাড়ায় এসে শুবল শুয়ে পড়বে তার খাটিয়ায় আর গভীর রাতে ঋষি পাড়ায় তারই পাশের কোন এক ঘরে সঙ্গমরত কোন নুতন যুগলের শৃঙ্গার শুনে শুবল বরুনার ছোঁয়া পাবার উত্তেজনায় তার যৌবনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে। বরুনা কি সুবলকে ছুঁয়েছিল কোনোদিন?
ব্রাহ্মণ বরুনা কি কোনোদিন  মুচি সুবলকে নিয়ে ঘর বাঁধার কথা ভেবেছিল? ভেবেছিল কি,শুবল মুচির চোখের জলের দিকে তাকিয়ে কোনোদিন সমুদ্র পাড়ি দেবার কথা, জোয়ার ভাঁটা খেলার কথা? না, শুবল আমাকে এই সব কথা বলেনি কোনোদিন। বাংলাদেশের সবচাইতে সুশ্রী মুচির সাথে ভগবান উপহাসের খেলাটা খেলেছিল আমাদের এই ঋষি পাড়ায়। সুবলের গল্প বলার ফাঁকে আমি নিজের কিছু কথা বলি তা নইলে হয়ত শুবল আর বরুনার প্রেমের এই গল্পটা আধুরা থেকে যাবে।

আমরা জীবিত তিন ভাই এক বোন। ওহহো, আমরা যে মুসলমান এই কথাটা বলিনি বোধহয়। আমার যে দুই ভাই ডেমরার টর্নেডোতে মরে গেল তাদের কথা লিখব না এই গল্পে। শুধু লিখব আমার বাবাটা যেদিন মরে গেল সেদিন আমি যে খুব দুঃখ পেয়েছিলাম তা দিব্যি দিয়ে বলতে পারব না। আমার বাবাকে আমি আমাদের দাওয়ায় বসে দূরবর্তী কোন এক হারিয়ে যাওয়া দিনের সাথে কথা বলতে দেখেছি সারাটা জীবন। কথা বলতে বলতে আমার বাবা হয়ত হারিয়ে যেত আমার সেই দুই ভাইয়ের হাত ধরে কোন এক মেলায় যেখানে প্যাপু বাঁশি কেনার আবদারে আমার সেই ভাই দুটি বাবার হাত দুটো জড়িয়ে ধরত, আর সেই বাঁশি না কিনে দিতে পারার কষ্টে আমার বাবা হয়ত হাটতে হাটতে চোখের জল ফেলত। আমার বাবা কি কবরে গিয়ে সুখী হল? নাকি সেখানেও মুনকির আর নাকির কে দেখে বাবার দুই হারিয়ে যাওয়া সন্তানের কথাই সর্বপ্রথম মনে হয়েছিল। কিম্বা কবরের কালো সাপগুলো বাবার কাছে বাঁশি হয়ে ধরা দিয়েছিল? আর বাবা দুই হাতে দুই সাপ ধরে কবরের মুনকির আর নাকির কে বলেছিল " নে, বাজানরা, তোগো লাইগা বাঁশি আনতে বহুত দেরী কইরা ফালাইলাম, রাস্তায় কত জ্যাম, মনের মতো বাঁশি কিনন কি সোজা কথা"।
ছেলে বেলায় সুবলদের বাড়ি গেলে সুবলের মার হাতের নারিকেলের নাড়ু খেয়ে রাতে মাকে কতবার বলেছি" মা, আমার খিদা নাই"। মা কি সেদিন খুশী হতো? আমাদের বাড়ীতে প্রায় রাতেই কিছু থাকত না। আর তাই হয়তো আমার মা আমার বাকি ভাই বোনদের কিছু দিতে পেরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলত। ঘরের দুঃখকে ভুলে থাকতে আমরা দুই দোস্ত সারা দিন একসাথে ঋষি পাড়ায় ঘুরে বেড়াতাম আর  বড়লোক হবার স্বপ্ন দেখতাম। যদিও আমরা বড়লোক হতে পারিনি তবুও আমাদের দোস্তি অটুট ছিল সুবলের মৃত্যু পর্যন্ত।

আমার বয়স যখন নয় তখন আমি শহীদ নবী স্কুলে ভর্তি হলাম। আমার ছোট ভাই আমান আর আমি। ক্লাসে আমি ছিলাম বুড়া ছাত্র। সবাই আমাকে নিয়ে আড়ালে হাসি মস্করা করত তবে ভয়ও পেত আমাকে। শুধু একটা ছেলে যেচে এসে আমার সাথে ভাব জমাতে চাইত। আর সেই হল শুবল যার গল্প আমি আপনাদের সবাইকে বলছি। আমার ছোট ভাই আমান যে কিনা পরবর্তীতে খুব বড় শ্রমিক নেতা হয়ে আমাদের বাঁচিয়ে ছিল সে কিন্তু সুবলের সাথে কথা বলতে চাইত না। ক্লাসে কার সাথে মারামারি করা যায় এটা ছিল তার প্রধান চিন্তা। আর তাই আমার মতো সেও পড়াশুনা শেষ না করে সায়দাবাদ টার্মিনালে শ্রমিকদের খাতায় নাম লিখিয়ে আমার মাকে খুশী করতে উঠেপড়ে লাগে। ধীরে ধীরে সময় যায়, আমরা বড় হই খেয়ে না খেয়ে। শুবল আর আমি ঘুরে বেড়াই ঋষি পাড়ায় আর আমার এই ভাই রাত দিন গরুর মতো খাটে আমাদের উদর পূর্তির জন্য। শুবল খুব সুন্দর ছিল তো আর তাই আমার খুব ভাল লাগত সুবলের সাথে ঘুরে বেড়াতে, মেয়েরা আমাদের দিকে তাকাত আর আমিও এই উসিলায় মেয়েদের দিকে তাকিয়ে নিজের এই অসুন্দর জীবনকে সুন্দরের ছোঁয়া দিতাম।

ঋষি পাড়ার পিছনে যে দিগন্ত জোড়া মাঠ, আমরা যাকে "বন্দে" বলতাম, যেখানে শীতকালে হাজারও ফড়িং আর প্রজাপতির মেলা বসত সেখানে আমরা হারিয়ে যেতাম রোজ বিকেলে। আমাদের মধ্যে কি কখনও সমকামিতা ছিল? এই প্রশ্ন আমি নিজেকে করেছি বহুবার। না, সমকামিতা আমাদের গ্রাস করেনি কোনদিন। তবে ঋষি পাড়ার বহু হাতে পায়ে বেড়ে ওঠা ছেলেকে দেখতাম সন্ধ্যার পর অন্ধকার মাঠের হাজারও জোনাকির আলোকে পিছনে ফেলে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঋষি পাড়ায় ফিরে আসতে। যৌবনে যখন কোনদিন কোন নারী একবার চোখে চোখ রেখে দিগন্তে হারিয়ে যাবার জন্য তাগিদ দিল না, তখন মনে মনে ভালবেসেছি কত কিছুকে। ভালবেসেছি একপেয়ে দোয়েলকে, কিংবা ঝিমোতে ঝিমোতে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া কোন বকের সাদা পালককে, তার সুগন্ধকে, আর ভালবেসেছি সুবলকে। এ এক অন্য ভালবাসা, যেই ভালবাসায় নেই কোন কাম কিংবা কোন চাওয়া পাওয়ার দাবী যেখানে জায়গা করতে পারেনি কোনদিন। সুবলকে আমি এই সব বলেছিলাম বরুনাকে ভালবেসে হারিয়ে যাবার আগে। নাহ, এবার সুবল আর বরুনার প্রেমের কথা কিছু বলি...

দুর্গাপুজা আমাদের এই গরীব মুচির পাড়ায় নিয়ে আসত খুশী আর আনন্দ। মুসলমানদের ঈদ আসলে আমরা কোনোদিন ঘর থেকে বের হতাম না। কারন ঈদ আমার বাবা, মা আর ভাই বোনদের জন্য আসেনি কোনোদিন। আর তাই পূজা আসলে আমি খুব আনন্দ করতাম ঈদ-এর আনন্দকে পুষিয়ে নিতে। দূর থেকে তাকিয়ে দেখতাম দূর্গা নামক সেই ভাগ্যবতী রমণীকে যার প্রতি হিংসায় আমার বুক জ্বলে যেত। আর সেই কষ্টকে ঢাকতে আমি বড় হলে দেবতা হবার স্বপ্ন দেখতাম। সুবলকে একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা দূর্গা কি ব্রাহ্মণ না মুচি আছিল? সুবল হাসতে হাসতে বলেছিল "মনে হয় ব্রাহ্মণ"। "তাইলে তরা অর পূজা করস ক্যা, তগো মুচি গো কোন দেবতা নাই"? শুবল তার অজ্ঞতা ঢাকার জন্য ধানকাট্টীর বোতলে চুমুক দিতে দিতে উদাসীন হবার ভান করতো।

বরুনার সাথে সুবলের দেখা হয়েছিল বিরানব্বইয়ের দূর্গা পূজায়, গোপীবাগ রামকৃষ্ণ মিশনে। আর সেদিন দেবীকে সালাম ঠুকে আমি আর শুবল যখন মিশনের বাইরে এসে দাঁড়াই ঠিক তখনি আমি বরুনাকে সুবলের দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকতে দেখেছিলাম। গোপীবাগের আড়াই লেনের সবচেয়ে বড় যেই বাড়িটা সেই বাড়ির ছোট মেয়ে বরুনা। বরুনা ভট্টাচার্য। চার ভাই এক বোনের মধ্যে বরুনার জন্য এমন কিছু নেই এই দুনিয়ায় যা তার ভাইরা তার জন্য রাখেনি। কিন্তু তারপরও বরুনা প্রেমে পড়ল সুবল নামের এক মুচির ছেলের। কাঁচা হলুদ রং বরুনা যখন সুবলকে চিঠি লিখত সে দিনটিতে আমি সুবলকে ঋষি পাড়ার অলিতে গলিতে উড়তে দেখতাম। ছেলে বেলায় আমরা যেমন নানা রং ফড়িঙের লেজে সূতা বেঁধে দিয়ে তার অসহায় উড়াউড়ি  দেখতাম ঠিক তেমনি যৌবনে আমি সুবলের পাশে থেকে তার অসহায়ত্ব দেখতাম।
এ অসহায়ত্ব কি বরুনাকে ভালবাসার মধ্যে নিহিত ছিল, নাকি ভয়, যা কিনা আমাদের মত সমাজের নিচু স্তরের কিছু মানুষকে প্রতিনিয়ত তার সামাজিক অবস্থান মনে করিয়ে দেবার প্রতিজ্ঞায় আসমান জমিনে ছুটাছুটি করত। কিংবা ভয় আর অসহায়ত্ব পরস্পরের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকে যেমনি কৃষক জড়িয়ে থাকে ফসলের খেতে। ছেলেবেলা থেকেই আমি এক অজানা ভয়ের জীবন যাপন করতাম। মানুষ, কুকুর, বাস, ট্রাক, রিকশা কিংবা অন্ধকার রাতে রিক্সার নিচে হারিকেনের টিম টিম আলো সব কিছুর মধ্যে আমি ভয়ের আনাগোনা দেখতাম। আর তাই শুবল যখন বরুনার প্রেমে পড়ল তখন আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। আর তাই তখন থেকে সুবলকে হারানোর এক অজানা আশঙ্কা আমাকে রাতদিন কাল চাদরের মত জড়িয়ে রাখত। আমি কেন ভয় পেতাম? আমি কিংবা শুবল, আমাদের কি কখনও সাহসী হবার কথা ছিল? আমরা কি পারতাম না সাহসী হতে কিংবা সাহসী হবার ভান করতে। না আমরা কোনটাই পারিনি। আমার আধা পাগল বাপ আমাকে কোনদিন অভয় দিয়ে বলেনি কোন কথা, বলেনি "ভয় কিয়ের রে বাজান, আমি আছি না"। আর তাই কালাম ড্রাইভার যখন কাঠি লজেন্স দিয়ে আমার হাত তার লুঙ্গির ভিতর ঢুকিয়ে দিল সেদিন সারারাত জ্বরের ঘোরে আমি চীকার দিয়ে আমার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলেছি "বড় ভয় করে মা,আমার বড় ভয় করে"। আর আমার মা তার জীবিত বড় সন্তানের মঙ্গল কামনায় জায়নামাজের উপর নিজেকে সঁপে দিয়েছিল সারারাত সেই না দেখা খোদার কাছে যিনি কিনা আমাদের এই টিন শেডের ঘরের ছায়াও মাড়াননি কোনদিন।

বরুনার মেজো ভাই যেদিন সুবলকে গুলি করে মারল সেদিন ঋষি পাড়ায় মুচিরা গোপনে সুবলের লাশ পোড়াতেই চেয়েছিল। পুলিশ এসে যখন সুবলের মাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে মামলা না করার জন্য চাপ দিল তখনই আমরা ঋষি পাড়ার গরিব মুচিরা বুঝে গিয়েছিলাম আমাদের দুর্ভাগ্যের কথা। আমরা বুঝলাম ভগবানের পক্ষপাতিত্ব। ভগবান যে মুচি পাড়ায় কখনও আসবে না এই কথাটি আমি সুবলের মাকে বুঝাতে পারিনি, যদিও ভগবানের এই পাশ কাটান ভাব নতুন কিছু ছিল না এই মুচি পাড়ার মানুষগুলোর কাছে। এই যুগে ভগবান থাকে উঁচু তলায়, যেই সিঁড়ি ভাঙ্গার অধিকার মুচিদের দেয়া হয়নি। তবুও ভগবান বলে কথা। তার সান্নিধ্য পেতে আমরা এগিয়ে যাই পোস্তগোলা শ্মশানের দিকে, সুবলের লাশকে সাঁজাই কেরোসিন কাঠ দিয়ে, কেরোসিন ঢালি সুবলের সারা গায়ে, সুবলের বাবা আগুন দেয় সুবলের মুখে, শুবল দাউ দাউ করে জ্বলে। সুবলের জ্বলন্ত পোড়া লাশ, পোড়া কাঠ, কেরোসিনের তীব্র চোখ জ্বালানো গন্ধ আমাদের সবাইকে পিছনে ফেলে আসমানের দিকে ছুটে চলে, পিছনে পড়ে থাকি আমরা ঋষি পাড়ার মুচিরা, ফিরে যাবার অপেক্ষায়।