14 July 2016

রিক্তা চক্রবর্তী




ফিরে আসার কোনও পথ নেই
____
এই যে চেয়ে থাকা
নিভৃতে ছুঁয়ে দেওয়া দূরগামী মেঘ
____
মোহময় জ্যোস্নাতে ঢেকে দেওয়া
স্মৃতিদাগ, ক্ষতস্হানঘর-বাড়ি দুরগামী হাওয়া পালক
____
ফিরে আসার সত্যিই কোনও পথ নেই
____
বৃষ্টিবাদল স্পর্শ-কাতর নদীর মতো বাঁকে
ভাঙচুর, বিষাদ, দুর্যোগ আর অতীত পেরিয়ে হেঁটে যাই
____
এখন বিশ্বাস হয় এই মহাকাশের ও ক্লান্তি আছে
শহরের খাঁজে খাঁজে কত আলো-জ্বলাপথ
____
বেকসুর বিশ্বাসে আজও ফেরি করে শিকড়ের সংলাপ

অশরীরী প্রেম ঘুমের দরজা ঠেলে এভাবেই স্পষ্টতর হয় ধ্বংস অথবা রূপান্তর

নির্ঝর নৈঃশব্দ্য




চন্দ্রমল্লিকার দিন
তুমিও সমকোণ থেকে বেঁকে হয়ে গেলে
পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি সেতুগুলি গুটিয়ে নেয় ছায়া
নদী থেকে
অথবা স্রোতই ভাসিয়ে নেয়
সেইসব ছায়াসুধা তমস দুপুর
জীবন
ভুল জানলার শার্সিতে এঁকেছিলে দীর্ঘশ্বাস
ওপারে ফুরিয়ে যায় চন্দ্রমল্লিকার দিন

 
এই নাও
এসো
মরে যাও
তারপর চলে যাও দূরে
অন্যকোথাও
চন্দ্রপাত তোমাকে ডেকেছিলো
একদিন ছিলে ঝড়েরও আগে
দাঁড়াও
এখানে দাঁড়াও
দ্যাখো আমাকে
আমিই হেঁটে মাড়িয়েছি কুয়াশা
এসো থর থর
আবেষ্টনে মরে যাও
আমি ঋতিময় আনন্দের সারণ
এই নাও আমার চুম্বন


একটি সুধাকর
হারিয়ে যাওয়া সমুদ্রের তৃষ্ণায় চর জাগে
সোমত্ত জোয়ারের বেলা ক্রমশ রক্তকে জাগায়
নোনতা স্বাদ পরিব্যাপ্ত পথের রেখাকে বৃত্ত বানায়
সমুদ্র কি সদেহ হারায়
একটি সুধাকর ঘুরে
ঘুরে ঘুরে খুঁজে মরে রাতনীল শেষ অধ্যায়
কতক্ষণ খুঁজে


এইসব শকল
আর সে বললো নদী
আর ইহা নদীবেষ্টিত
একটি শব্দ গ্রাস করে এইসব শকল
একটি বিশ্বাস নষ্ট হয় দূরাগত রশ্মিতে
শব্দটি তৈরি করে নৈঃশব্দ্যের বিস্তার

নদী চিরদিন খুঁজে তার দেহের আকার  

ফ্লোরা সরকার



নারীর ক্ষমতায়নের প্রথম শর্তই হলো নারীকে শিক্ষিত এবং কর্মক্ষম করে তোলা। অর্থা নারীকে, কর্মে প্রবেশের সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দেয়া। নারীকে পর্দার আড়াল থেকে বের করার পেছনে দীর্ঘ  যে এক সংগ্রামী ইতিহাস আছে সে সম্পর্কে কম-বেশী সবাই আমরা অবগত। যে সংগ্রাম এখনও চলছে। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। তবে আগের চেয়ে নারীরা এখন শুধু এগিয়েই না, নিজের বুঝ নিজে বুঝে নেবার স্বক্ষমতাও অর্জন করেছে এবং করছে অনেক নারী। এই বুঝে নেয়ার ব্যপারটা পাশ্চাত্যে অনেক আগে শুরু হলেও নারীবাদের যে তীব্র স্রোত শুরু হয়েছিলো গত শতাব্দীতে সেই স্রোতের অন্যতম পুরোধা ভার্জিনিয়া উলফ্ (১৮৮২-১৯৪১)। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ব্যক্তিগত ভাবে “নারীবাদ” শব্দটার উপর আমার একটু আপত্তি আছে। কেননা, নারী-পুরুষ সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখা হলে শুধু নারীদের উপর ভিত্তি করে কোনো ধরণের ‘ইজম’ বা ‘বাদ’ মূলক তত্ত্ব থাকা উচিত বলে আমি মনে করিনা। তবে এই লেখায় সেই আপত্তির বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্ভব না। সেটা ভিন্ন বিতর্ক। এখানে ভার্জিনিয়া উলফের বিশেষ একটা লেখার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করার জন্যেই এই লেখার অবতারণা।

১৯৩১ সালে ওমেন্স সার্ভিস লিগ এ, ‘নারীর কর্মস্থল’ শিরোনামে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে সেই বক্তৃতা লিখিত আকারে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা আকারে বের হয়। উলফ গল্পে-উপন্যাসের পাশাপাশি বেশকিছু প্রবন্ধ লিখে গেছেন, যা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে “এ রুম অফ ওয়ানস্ ওয়োন ( ১৯২৯ )”, সর্বাধিক পঠিত এবং পরিচিত। বলা যায়, এই প্রবন্ধের মধ্যে দিয়েই বাইরের পৃথিবীতে উলফ্ নিজেকে সর্বাধিক পরিচিত করে তুলেছিলেন। এখানে তার যে লেখাটা নিয়ে আলোচনা করছি, সেটা “ এ রুম অফ ওয়ানস্ ওয়োন ” লেখার বেশ কিছু বছর পরের ঘটনা। ততদিনে উলফ্ তার অভিজ্ঞতার ঝুলিতে আরো অনেককিছু অর্জন করে ফেলেছেন। এই বক্তৃতার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিলো, কর্মজীবী নারী এবং তাদের অভিজ্ঞতার বিষয়ে কিছু বলা। এটা বলতে যেয়ে উলফ্ তার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরেন। কীভাবে তার লেখার জীবনে আসা এবং আসার পরে কি কি বাঁধার সম্মুখীন হলেন ইত্যাদি ইত্যাদি।

উলফ এখানে শুধু লেখক হবার অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেন নাই, সেই সঙ্গে লিখতে যেয়ে কীভাবে ‘ নারী ’ হিসেবে নিজেকে প্রথমবার আবিষ্কার করেন তার চমকার বর্ণনা দেন। একজন বিখ্যাত লেখকের উপন্যাসের উপর সমালোচনা ছিলো তার প্রথম লেখা। এবং সেই সমালোচনা লিখতে যেয়ে, উলফ্ আবিষ্কার করেন, কীভাবে সেই উপন্যাস এবং অন্যান্য গল্প-উপন্যাসেও নারীদের “পরী বা এনজেল” করে রাখা হয়েছে। এই পরী করে রাখার পেছনের রাজনীতিটা ধরতে সেই সময়েই উলফ্রে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। তখনি তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজেই উপন্যাস লিখবেন এবং যখন লিখবেন তখন, মেয়ে-রূপী সেই পরীর ডানা দুটো কেটে-ছেটে ফেলে দিবেন। 
এই ডানা কেটে ফেলার ভেতর দিয়ে উলফ্ ভেবেছিলেন, নারীর স্বাধীনতা হয়তো আনা যাবে। কেননা, নারীকে পরী হিসেবে উপস্থাপনের মধ্যে দিয়ে, সুন্দরী নারী, লক্ষী নারী, পয়মন্ত নারী ইত্যাদি বলে বলে এই দীর্ঘকাল যেভাবে তাকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী করে রাখা হয়েছে, তার উপন্যাসে তিনি এসব ছেটে ফেলে দিয়ে চার দেয়ালের বাইরে নারীকে নিয়ে আসবেন। কিন্তু যখনি তাকে আনতে গেলেন, দেখলেন আরেকটা সমস্যা এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে। যা লিখতে চান, ঠিক সেভাবে তিনি লিখতে পারছেন না। পুরুষ যেভাবে তার শরীরের কথা বলতে পারে, নারী হিসেবে তিনি বলতে পারছেন না, কোথায় যেন প্রতিবন্ধকতা থেকে যাচ্ছে। উলফ্ তাই সেই বক্তৃতায় বলছেন, “কল্পনার পরীর ডানা ছেটে ফেলে দেয়া যত সহজ, বাস্তবের ডানা ছেটে ফেলা অত সহজ কাজ না।” তার মানে পরিবার, সমাজ এসবের ভেতরেই এমন কিছু বাঁধা-বিপত্তি আছে, যেসব বাঁধার কারণে পুরুষ যা লিখতে পারে অবলীলায় নারী তা পারেনা।
বক্তৃতার একদম শেষে, উলফ্ চমকার কিছু প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, “তুমি একটা ঘর পেয়েছো ঠিক, যদিও সেই ঘরের মালিক পুরুষ, তুমি বছরে পাঁচশ পাউন্ড কামাই করছো ঠিক, কিন্তু এটা তোমার ব্যক্তি-স্বাধীনতার শুরু মাত্র। তোমার ঘর আছে, কিন্তু ছাদ আছে কি? ঘরের আসবাব সাজানো আছে কি? সেসব কি গোছানো হয়েছে ? যার সঙ্গে থাকো সেই অংশীদারের সঙ্গে কতটুকু বোঝাপড়া তোমার আছে? আমার মনে হয় এসব প্রশ্নের উত্তর আমাদের সবার আগে খুঁজে বের করতে হবে।” উলফ্রে বক্তৃতার এই অংশে আমরা শুধু উলফকেই পূর্ণাঙ্গ রূপে পাইনা, পুরো নারী জগতটাকে পূর্ণাঙ্গ রূপে দেখতে পাই। আমরা বুঝে যাই, একজন নারী, সে যে কাজেই নিয়োজিত থাকুক না কেনো, তার পূর্ণ স্বাধীনতা নির্ভর করছে প্রথমে তার ঘরের মানুষ অর্থা স্বামী ও তার পরিবার এবং দ্বিতীয়ত বাইরের মানুষ তথা গোটা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গীর উপর। যতদিন পর্যন্ত নারীর অন্যান্য স্বাধীনতা, যেমন : কথা বলার, লেখার, চলাফেরার ইত্যাদির নিশ্চয়তা দেয়া না যাবে, ততদিন পর্যন্ত একজন নারীকে শুধু তার আর্থিক স্বাধীনতা দিয়ে তার পূর্ণাঙ্গ স্বাধীতার দাবি আমরা করতে পারবনা। ১৯৩১ সালে দেয়া ভার্জিনিয়া উলফ্রে প্রশ্নের উত্তরগুলো আমরা এখনো খুঁজে পাই নাই। পাই নাই বলেই নারী এখনো ধর্ষিতা হয়, খুন হয়, রাস্তা-ঘাটে নানা ধরণের হয়রানির শিকার হয়। নারী স্বাধীনতার যে সমস্যা তিনি আশি-পঁচাশি বছর আগে দেখেছিলেন সেই সমস্যা আজও আমরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। এটা শুধু নারী হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের জন্যে কলঙ্কজনক বিষয়।    

   

অহ নওরোজ




ভাজপত্র
ফাগুনের রোদে ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে প্রসারিত সুবর্ণচিত্র। পাহাড় আর সমুদ্রে সূর্যোদয়ের তুলনা নেই। ঝিলম নদীর তিরে সোয়ান উপত্যকায়ও সূর্যোদয় সুন্দর; অভিজাত মানুষের গল্পের মত মনোরম। 

তবু নিরক্ষর বেশ্যাদের অন্ধকারই প্রিয়; অন্ধকারেই শান্তি। অপলক চোখের তারা ঠেসে বসে থাকা রাগের মত শ্রান্তি।

শৈবালের গল্প মিথ্যা মনে হয়।

জল এবং আলো

অনুরাগ কিংবা হতাশা

কখনো বদলায় না। বদলায় শুধু প্রান্তরবাসীর রমণীয় মুখোশ-নাচ।


________________________________________
________________________________________



আপেলবীথি
দিনের পর দিন কাত হয়ে পড়ে থাকে মদের পিপে, টকটক গন্ধের ভেতর ডুডুক বাজুক কিংবা জয়নদ্বীপ জ্বলুক, কি এসে যায়!

কি খবর তাদের ?

এয়ারকন্ডিশনে যারা ঘুমায়। 
আশ্চর্য সব প্রকোষ্ঠের মতো ঘরে মানুষ ঘুমায়; শহরে, নগরে, সমস্ত পৃথিবীতে। তারা যেন ভাবে নরকের গভীরে একটি মাত্র স্বর্গ; একটি মাত্র অনুরাগ।

আমার মেজাজ নষ্ট হয়। 

ফুল অথবা অশ্রু, হাত অথবা হুর কখনো আলাদা থাকেনা। আলাদা থাকে শুধু মানুষ এবং মানুষ।



বাবুল হোসেইন


গোপন কান্নাটুকু
গোপন কান্নাটুকু গোপনই থাক, অধরা জ্যোস্না ছুঁয়ে করতলে রেখেছি প্রণয়। গহিন দরোজা খুলে দেখেছি এখনো সেখানে আছে কান্নার বুদবুদ। যা কিছু লোকায়ত তার অফুরান দুঃখগাঁথা আহত করে যায় সময়ের দাপট। সময় এক অদ্ভুত খেয়ালি ঘোড়াদৌড়ুচ্ছে ক্রমশ দিগ্বিদিক।
যে নদী হারিয়ে যায় তার দায় নেই উজানের হাহাকার।
 
সেইসব গোপন গোলাপ
দৃশ্যাবলী ফুড়ে উঠে গহিনের ডুবসাঁতার। গোঙানির রঙ রপ্ত করেছি কৈশোরিক উত্তাল দিনে; যুদ্ধের দামামা যখন বেজেছে কেবল। উজানের স্মৃতি ভাটিতেও পুড়িয়ে দেয় যা কিছু সুন্দর, যা কিছু নান্দনিক। আহত ডানা শুধু উড়তেই পারে না, উড়ালের তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে পরাজিতও করে দেয়।
সেইসব গোপন গোলাপ সুবাস ছড়ানোর আগে ঝরে যায়।


কখনো ছুঁয়ে দেখিনি আকাঙ্খার রঙ
কখনো ছুঁয়ে দেখিনি আকাঙ্খার রঙ, কতটা রঙ্গিন হলে দৃশ্যের ভিতরে নতজানু অদৃশ্য অথচ স্পষ্টবাদিতার চিহ্ন সকল। জানালার দৃশ্যান্তরে কখনো কাঠবাদামের পাতারা ঝিরিঝিরি ঝরে যায় হপ্রলয়ের দিন, বিরহের মনস্তাপ। কখনো ছুঁয়ে দেখিনি স্বপ্নের আদিম উস স্মৃতিকূয়া থেকে উঁকি মারে হারানো চোখের জল, বৃষ্টির সন্দিগ্ধ ফোঁটা।

আমার কি কখনো

ভেজা জ্যোস্নার রাতে কাতরতা বিষয়ক হাবিজাবি দৃশ্যবন্দি হয় নিমগ্ন চোখের ক্যানভাসজুড়ে। পোড়াকাল, হারানো জিরাফের গ্রীবা, ফুলের উড়ে যাওয়া পরাগের দুঃখ এইসব ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে ভীষণ। রাত বিষয়ক যাবতীয় বিভ্রম সরল আলোর মত চুঁইয়ে পড়ে দৃষ্টির করিডোরে। এইসব রাতে আমার হারাতে নেই, হারাতে নেই পুরোনো খাদে, কিনারে দাঁড়িয়ে একা ঝুলে থাকা শূন্যসময়, আমার কি কখনো মরে যেতে ইচ্ছে হয়।

আবুল কাইয়ুম





পেনসিলে আঁকা জীবনবৌদ্ধিকতা সংবেদের মিশেলে কবি সেবক বিশ্বাসের এক নান্দনিক কাব্য। মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত এই কবির কাব্যটিতে মুখ্যত যুগযন্ত্রণার নানা প্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। মানবতার মুমূর্ষু দশা তাঁর চোখে ধরা পড়ে, তিনি দেখেন সভ্যতার নামে নষ্টামো, পাশবিকতা পৈশাচিকতা। এখনকার এই সভ্যতাকে তিনি বলেছেন নীল সভ্যতা, যা কোনভাবে প্রাণটি নিয়ে বেঁচে আছে, কিন্তু দারুণ অসুস্থ। তাঁর ভাষায়-
“সভ্যতার ইটে ইটে
নগ্নতার বিদ্যু-ঘর্ষণে
জন্ম হয় মৃত্যু-মশালের।
গ্যাংগ্রিন পায়ে হেঁটে চলে নীল সভ্যতা”

তিনি সমাজ পরিপার্শ্বে দেখতে পানগোলাপের ফসিল তাঁর ভাষায়, সুন্দর সৌকুমার্যে ভরপুর ছিল যে মনুষ্যত্ব তা মরে গিয়ে হয়ে গেছে মিশরের পিরামিড এবং স্বপ্নের জোনাকিগুলোও পুড়ে শেষ। সময়ের নানা অপঘাত, সন্ত্রাস, হত্যা হানাহানিতে শান্তি, সুন্দর ভালোবাসা উজার হতে দেখেই তাঁর মাঝে এই শূণ্যচেতনার জাগরণ। আমরা এর আগে সুধীন দত্ত, জীবনানন্দ শামসুর রাহমানের মাঝেও শূণ্যবোধ প্রত্যক্ষ করেছি। সময়ের বিনষ্টিতে সুধীনের মাঝে এই শূণ্যবোধ এক অনালোকিত মরুভূমি রচনা করেছিল। শূণ্যতা শূষ্কতা একাকার হয়ে সুধীনের রিক্ত, আত্মবৈরী কাব্যমানসে উন্মোচিত হলো, যেমন দেখেছি তাঁরউঠপাখিকবিতায়-
"কোথায় লুকাবে? ধূ ধূ করে মরুভূমি
ক্ষয়ে ক্ষয়ে ছায়া মরে গেছে পদতলে।
আজ দিগন্তে মরীচিকাও যে নেই;
নির্বাক, নীল, নির্মম আকাশ"

জীবনানন্দেও শূণ্যবোধ ছিল, তবে তা তাঁর আত্মনিবিষ্ট মনোভূমিতে লালিত বিষাদ নৈ:সঙ্গ থেকেই উদ্ভূত। তবু তাঁর আত্মগুন্ঠিত, নির্জনতম অবস্থানটিও যে সময়ের বেদনাগুলো চিত্তপটে শুঁষে নেওয়ার ফলে সৃষ্ট তা বলা যায়। তা না হলে তিনি কেন বলবেন, “সবকিছু তুচ্ছ হয়, পণ্ড মনে হয়/ সব চিন্তা প্রার্থনার সকল সময়/ শূণ্য মনে হয় এই শূণ্যবোধেরই আরো ব্যাপ্তি, আরো প্রকোপ লক্ষ্য করা গেল শামসুর রাহমানে এসে। ক্লিষ্ট দুর্দশাগ্রস্ত সমকালে তাঁর উচ্চারণ,- “মুছে গেল দৃশ্যাবলী চারদিকে, অনন্তর একা/ আমি আর অকূল শূণ্যতা” (‘সুন্দরের গাথা’) তিনিএকটি বিনষ্ট নগরের দিকেশীর্ষক কবিতায় লিখেছেন-
বারুদমণ্ডিত কাঠিগুলো একে একে পুড়ে গেল, দেশলাই
খুব শূণ্য থেকে যায়, অনুরূপ শূণ্যতায় ভোগে
মূঢ় শহর সারাবেলা; ট্রাম্বোন দূরের কথা, এমন কি
দিকপ্রিয় পুলিশের বাঁশি যায় না শোনা কোথাও এখন

পূর্বসূরীদের মতো জীবন সমাজের সঙ্কট কবি সেবক বিশ্বাসকেও নিয়ে গেছে এক প্রখর শূণ্যবোধের ভুবনে। কখনো হৃদয়টাকে তাঁর মনে হয় হিরোসিমা বা নাগাসাকির মতো আণবিক আঘাতে মৃত। আবার কখনো শুষ্ক নদী, -“মনটা বুঝিবা শুকিয়ে মরে গেছে/ মধুকবির কপোতাক্ষের মতো তাঁর শূণ্যতা ফের যেন মৃত্যুর অপর নাম-
"হলুদ ধুলোয় গড়াগড়ি দেয় অন্ধ পৃথিবী,

বিমূর্ত বলাকা বাসা বাঁধে বিষন্ন বলয়ে,

বুকের শূণ্যতায় শুয়ে থাকে মৃত ফুসফুস"

তাঁর এই শূণ্যবোধ কেবলই বিষন্নতা দু:খবোধ নিয়ে আবর্তিত, যা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাঁর কবিতার পর কবিতায়। শূণ্যতা অন্ধকার একই বাকপ্রতিমা নিয়ে ধরা দেয়। কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক-


১. শূণ্য সভ্যতার দুর্মর অন্ধকারে/ রাত জ্বলে কৃষ্ণ শিখায়
২. বুঝি, শেষ হয়ে গেছে সব।/ গোলাপ এখন মনে হয় এক একটা রক্তবোম।
৩. উননে শয্যা পাতে কালো রাত,/ আগুন জ্বলে না এককাঠি
৪. পিশাচ বুলেটে বিদীর্ণ হয় বাংলার বুক, সিঁড়িতে শুয়ে থাকে মহাকাল,/ বত্রিশ নম্বরে।
৫. বুকের শ্মশানে খাঁ খাঁ করে বিঁধ্বস্ত ট্রয়।
৬. মনুষ্যত্ব এখন মিশরের পিরামিড;/ এসে গেছে তার ডেথ-সার্টিফিকেট।
৭. হৃপিণ্ডের পিছনে তার চুয়াল্লিশ বছরের চক্রান্ত;/ পুড়ে গেছে সময়ের পাণ্ডুলিপি!

কবির শূন্যবোধক্লিষ্টতার এমনি আরো অনেক দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়। আসলে এই শূণ্যতা থেকে তাঁর মাঝে জাগে পূর্ণতার স্বপ্ন, অন্ধকার ঘুচাবার জন্য আলোর প্রত্যাশা। এমন একটি বিপ্লবের স্বপ্ন তাঁকে তাড়া করে, যা স্বদেশ, সমাজ পৃথিবীকে করে তুলবে অর্থবহ, বিভেদ-বৈষম্যহীন মানুষের বাসযোগ্য। তাই তো তাঁর আহ্বান-
"বন্ধু
জেগে ওঠো,
সূর্যের চোখে চোখ রেখে সূর্য হও;
আলোতেই লেখা থাকে রাত্রির মৃত্যু"

কাব্যে কবির প্রেমের দিকটি একেবারেই গেৌণ প্রেমের কবিতায় দেখি তাঁর এক কল্পদয়িতা, যে রাখিতা নামে সম্বোধিতা, তাকে পেলে তাঁর অন্তরপ্লাবিত হয় উষ্ণপ্লাবণেএবং না পেলে বেদনাভার নিয়ে অপেক্ষার প্রহর কাটান। তেমনি ভালোবাসা এলে তাঁরবুকের বনতল ভরে ওঠে গুচ্ছ গুচ্ছ গোলাপ ফুলেআর তা যখন অধরা তখনবালুর সাহারা চিকচিক করে বুভুক্ষু বুকে ভাবে মিলন বিরহের স্বাভাবিক অনুভূতি নিয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর প্রেমবোধ। তবে তাঁর প্রেমের বর্ণনার মাঝেও যুগযন্ত্রণাক্লিষ্ট সময়ের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বর্ণনা এসে যায়
পেনসিলে আঁকা জীবনকাব্যের আর একটি উল্রেখযোগ্য দিক, আমার মতে, পরাবাস্তব চেতনা। আর শূণ্যবোধ সেই পরাবাস্তব চেতনারই সহযোগী। শুধু তাঁর ক্ষেত্রেই নয়, অনেক পরাবাস্তব কবির বেলাতেই এটা দেখা যায়। তবে একথা আমি বলছি না যে, সেবক বিশ্বাস হাড়েমাংশে পরাবাস্তব কবি। বাস্তব পরাবাস্তবের মিশেলেই তাঁর কবিসত্তা। আর তাঁর শূণ্যবোধও শূণ্যবাদ (nihilism) নয়। শূণ্যবাদী দর্শনে প্রথা প্রচলিত বিশ্বাসগুলোর ব্যাপারে যে সম্পূর্ণ প্রত্যাখান বা নেতিবোধ কাজ করে তা তাঁর কবিতায় দৃষ্ট হয় না। তাঁর শূণ্যবোধ জীবন, সমাজ পরিপার্শ্বের অন্ধকার বা অবস্থাগত রিক্ততা থেকে জাত। এই শূণ্যবোধ কবির পরাবাস্তব চেতনায় কীভাবে ধরা দেয় তার একটি পরিচয় নিম্নে তুলে ধরা হলো-
সময়ের সামিয়ানা তলে
থেমে যায় সেতারের সুর,
হলুদ মগজ ফেড়ে বেরিয়ে আসে দীর্ঘ হাড়

এই যেসময়ের সামিয়ানাভাবা কিংবা মগজ ফেড়ে হাড় বেরুনোর মাঝে যে প্রত্যাশিত সুন্দরকে হারিয়ে শুষ্ক, শূণ্য বা নি:স্ব হয়ে যাওয়ার পরোক্ষ কথা বলা তা পরাবাস্তর কবির পক্ষেই সম্ভব। এখানে সত্যটি কবির মগ্নচৈতন্যের রশ্নিতে বাস্তবের চেয়ে পরম বাস্তব হয়ে বিচ্ছুরিত হয়। এভাবে কল্পনা বাস্তব, স্বপ্ন সত্য তাঁর কবিতায় অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকে। কবির নির্মিত কিছু পরাবাস্তব চিত্রকল্পের দৃষ্টান্ত নিম্নে তুলে ধরা হলো-
. স্খলিত সারঙ্গীর পোড়াপথে ঝরে পড়ে/ মৃত মোমবাতির শেষ স্বরলিপি
. চন্দ্রবিন্দু থেকে নেমে আসে মৃত সূর্য
. গোধূলির তীরে হেঁটে আসে প্রভাত-পথিক,/ পরিযায়ী পায়ে তার ঝরে পড়ে/ নীড়ে ফেরা পাখির ধূসর পালক
. স্বাধীনতার কেৌণিক শরীর জুড়ে/ জাল বোনে অষ্টপদী;/ প্রজাপতি ডানায় ছটফট করে শোকের ডালপালা
. বেঁকে গেছে শাপলার ঘাড়/ সাদা করুণ কান্নায়

কবি যে শুধু পরাবাস্তব চিত্রকল্পই গড়েছেন তা নয়, শিল্পীর তুলিতে নৈসর্গিক ছবি আঁকার মতো অনেক সরল দৃশ্যমান প্রকৃতির চিত্রকল্প (visible image) পাওয়া যাবে তাঁর কবিতায়। আর পাওয়া যাবে অল্পসল্প বিমূর্ত চিত্রকল্পের উঁকি তাঁর প্রতিটি কবিতাই যেন চিত্রকল্পের মালা, সেখানে বিবৃতিধর্মিতা সামান্য। আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে তাঁর উপমাভিত্তিক চিত্রকল্পগুলো, যে গুলোর কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরার আগ্রহ সংবরণ করতে পারছি না-

১. কালো জুতোর মতো কিম্ভূত দাঁত

২. জিওগ্রাফি চ্যানেলে দেখা ক্ষিপ্র হরিণীর মতো/ ছুটে যায় পুরানো পা
৩. প্রিয়ার টিপের মতো ওঠে অভিসারী চাঁদ
৪. বেলুম্বা চারাটি শুকিয়ে গেছে/ বিবেকের মতো
৫. কলাপাতার মতো নত হয় ঋজু মুখ



প্রবহমান গদ্যভঙ্গিতে প্রতিটি শব্দের অপরিহার্যতা নিয়ে গড়া কবির ভাষাবন্ধ। তাঁর কবিতার শব্দ-বিশেষণগুলো দারুণ ব্যঞ্জনাময়। শব্দগুলো কোন রীতিসিদ্ধ ছন্দের শেকলে বাঁধা না পড়েও যেন বিভিন্ন মাপের মুদ্রার ঝরে পড়ার মতো শব্দে ধ্বনিত হয়। এমনই কবির গদ্যছন্দের সুর। আর এই শব্দাবলী, প্রজেক্টিভিষ্ট কবি চার্লস অলসনের ভাষায় বলতে হয়, “জেনারেটরের ব্যাটারির মতোই শক্তিধারণ, শক্তি-সঞ্চালন শক্তিস্রাবের আধার
কবির সাথে আমার পরিচয় নেই, এর আগে তাঁর কবিতা পড়েছি বলে স্মরণ হয় না। একজন কাব্যপিপাসু পাঠক হিসেবে বলছি, প্রথম কাব্যেই কবি সেবক বিশ্বাসের যে পক্ক কাব্যবোধ দৃষ্ট হলো তা নি:সন্দেহে প্রশংসার উপযোগী। তিনি এই ঋদ্ধ বোধটিকে আগলে রাখতে পারলে সমকালীন বাংলা কবিতায় আরো অনেক কিছু অবদান রাখতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস
______________________________________
গ্রন্থ পরিচিতি:পেনসিলে আঁকা জীবন’ (কাব্যগ্রন্থ) লেখক : সেবক বিশ্বাস। প্রকাশক : দেশ পাবলিকেশন্স, নাহার প্লাজা (৩য় তলা), রুম ৩২৭-৩২৮, হাতিরপুল, ঢাকা। প্রচ্ছদ শিল্পী : মোস্তাফিজ কারিগর। মূল্য : ১৫০ টাকা

কবি পরিচিতি : ১৯৭৫ সালে খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার লোহাইডাঙ্গা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী কবি সেবক বিশ্বাস ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে সমাজবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বর্তমানে খুলনার বটিয়াঘাটা ডিগ্রি কলেজে অধ্যাপনা করছেন। এছাড়া তিনিশূণ্যনামের একটি সাহিত্যপত্রের সম্পাদক। কবিতা ছাড়া তিনি গান ছোটগল্প লিখে থাকেন।পেনসিলে আঁকা জীবন’- তাঁর প্রথম কাব্য। কবিতাকর্মে দীর্ঘদিন ব্যাপৃত থাকা সত্বেও একটু বিলম্বেই তিনি তাঁর এই কাব্য প্রকাশ করেছেন