27 March 2018

সেবক বিশ্বাসের কাব্য ‘ভাঙা বেহালার অন্ধকার’- আবুল কাইয়ুম।




কবি সেবক বিশ্বাস এই সময়ের একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি। অমর একুশে বইমেলা, ২০১৭ উপলক্ষে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ভাঙা বেহালার অন্ধকার’ প্রকাশ করেছে ঢাকার বিশিষ্ট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দেশ পাবলিকেশন্স। একই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০১৬ সালে বেরিয়েছিল কবির প্রথম কাব্য ‘পেনসিলে আঁকা জীবন’। প্রথম কাব্যেই তিনি একটি স্বতন্ত্র ধারার ঋদ্ধ কাব্য ভাষায় তাঁর মগ্নচৈতন্য, বৌদ্ধিকতা ও সমাজ সংলগ্নতার ছাপ রেখেছিলেন; তা একজন সম্ভাবনাময় কবির আগমন-বার্তাকেই জানান দিয়েছিল। দুশ্চিকিৎস্য অসুস্থ সভ্যতা, যাতাঁর ভাষায় ‘নীলসভ্যতা’, নানা ভাবে চিত্রিত হয়েছিল তাঁর লেখনীর নান্দনিক তুলির আঁচড়ে। সামাজিক-পারিপার্শ্বিক অন্ধকার নিরীক্ষণ করে কবির আন্ত রসত্তায়কী ভাবে বিষন্নতা জনিত শূন্যবোধ চারিয়ে ওঠে আমরা তারও প্রকাশ দেখেছি কাব্যটিতে। আর আলোচ্য ‘ভাঙা বেহালার অন্ধকার’ কাব্যে অন্ধকার ঠিকই রয়ে গেল, শূন্যবোধের জায়গাটি নিয়ে নিল তার মৃত্যুবোধ। এসব থেকে কি আমরা বলবো কবি তাঁর কাব্যদর্শন এক নিদ্রিত তমসায় আবৃত, তিনি এক অনালোকিত ভুবনের দিকে ধাবমান অসহায়যাত্রী? না, পৃথিবী, সমাজ ও পারিপার্শ্বের দখলদার বিপুল অন্যায় ও অপঘাত তাঁর চিত্তে যে প্রচণ্ড দংশন হেনেছে তারই প্রকাশ নিঃসৃত হয়েছে তাঁর লেখনী থেকে। 

প্রকৃত প্রস্তাবে আলোকিত সমাজ ও জনহিতৈষী সভ্যতার জন্য তিনি যে স্বপ্ন দেখেন তা চুরমার হতে দেখে এভাবেই তাঁর দ্রোহগুলো প্রকাশ করেছেন। যে কোন দুঃসময় কবিদের অন্তরকেই বেশি আলোড়িত করে; এ কাব্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটে নি। ধ্বংস ও মৃত্যুর হোলিখেলায় মত্ত কিছু রক্তপিপাসু মানুষের দ্বারা পৃথিবীর অধিকার ছিনে নেওয়া দেখে কবি দারুণ বিচলিত হন এবং এ থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্ব পরিবর্তনের স্বপ্ন তাঁর মধ্যে দানা বেঁধে ওঠে-
তোমরা খাদক-রক্তের মানুষ-
উপরে-নিচে কিছুই রাখোনি বাকি!
পৃথিবী এখন তোমাদেরই অধিকারে।
কিন্ত
এবার বদলে দেব দিন!
(পিঁপড়ে)

পিঁপড়ে প্রতীকের অন্তরালে শোষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির স্বপ্নকে তুলে ধরেছেন কবি। এমনি বেশ কিছু কবিতায় প্রতীকী বর্ণনায় নানা বিষয়ের উপস্থাপন করেছেন তিনি। যেমন‘দাঁড়কাক’ শীর্ষক কবিতায় দেখা গেল-
“হৃৎপিণ্ড-ঠোঁটে উড়ে যায় দাঁড়কাক
ডানায় রাত্রির গাঢ় প্রলেপ,
অন্ধপুচ্ছে হাল ধরে আছে অন্ধকার
বুকে পিঠে কালযুগ,
বিবেকের বাদা মিশাখা দু’পায়ে
খামচে ধরে
লৌহ চঞ্চুতে ঠুকরে নেয় স্বপ্নটুকু।”

এখানে দাঁড়কাক সমাজে বিদ্যমান এমন এক প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রতীক, যার অবলম্বনে কবি মানবিক স্বপ্নগুলোর মৃত্যু ও সামাজিক অন্ধকারের স্বরূপটি উপস্থাপন করেছেন। এমনি মৃত্যু ও অন্ধকার এ কাব্যের বিভিন্ন কবিতায় ঘুরে ফিরে আসে। আরো কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক-
১. মুমূর্ষু পৃথিবীর বুকে/ কেবল শুকিয়ে যাওয়া নদীর স্বরলিপি। (সময়ের জলছাপ)
২. ভেঙেপড়া পাড়ের মতো/ কবিতা এখানে এক মৃত্যুর নাম! (কবিতা এক মৃত্যুর নাম)
৩. সবুজ পাতায় কেমন থোকা থোকা অন্ধকার (অদেখা সকাল)
৪. শ্বাস ফেলে সমাহিত সময়ের পৃষ্ঠাজুড়ে/ ধূসর মলাটের মতো মৃত উপন্যাস (সংক্ষিপ্ত কবিতা)
৫. রাত্রির বুকে পা রেখে/ একটু আলোর আশায় তবু/ স্বপ্নে স্বপ্নঘষি;/ জ্বলে না জলের জোনাক। (কৃষ্ণ পাথর)

তবে একটা ইতি বাচক দিক হলো তমসাবৃত সময় কবির বোধকে স্থবির করে দেয়নি। সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা ও পৃথিবীর মানুষের প্রতি ভালোবাসা থেকে তিনি আঁধার ও তার স্রষ্টা পরাক্রমশীল দানবীয় সত্তা গুলোর পরাভব কামনা করেন। যেমন ‘দ্বিতীয় বিগব্যাং’ শীর্ষক কবিতায় তাঁর প্রত্যাশা, একটি মহাবিস্ফোরণ মহাবেগে ধেয়ে এসে ধ্বংস করে দেবে যত পামর-পাতক এবং এর ফলে তৈরি হবে মানুষের বাসযোগ্য অমরার উদ্যান। অবশ্য এই কল্পস্বর্গ পৃথিবীতে সম্ভব নয়, তবু কবিদের মগ্নচৈতন্য অশুভ শক্তির পূর্ণ বিনাশের মাঝেই সুন্দরতম পৃথিবীর প্রতিষ্ঠার দিশা খোঁজে; কবি সেবক বিশ্বাসের পরাবাস্তব বোধও তার অন্যথা নয়।
কবিতাগুলোর শব্দাবলী সুচয়িত ও সুবিন্যস্ত। এ কাব্যে যথেষ্ট পরোক্ষ কথকতা আছে, বিমূর্ত ও পরাবাস্তব চিত্রকল্পে সমৃদ্ধ কবির ভাষা। বিমূর্ততার মাঝেই মূর্ত হয়েছে তাঁর আক্ষেপ গুলো, হৃদয়ের রক্তপাত এবং ক্লিষ্ট বোধগুলো। কবিতা গুলোর অধিকাংশ এক ধারায়, একই ধ্বনি¯স্পন্দিত ভাষায়, একই অন্ধকার নিয়ে চমৎকার সব চিত্রল উপস্থাপন। তবে তাঁর অন্ধকার এমনটা নয় যে,- তিনি সেখানেই নেতিয়ে পড়ে আছেন এবং মুক্তির দিশায় উজ্জীবিত নয় তাঁর হৃদয়। সুড়ঙ্গের শেষে মিটিমিটি জ্বলা দূরবর্তী বাতির মতো তাঁর স্বপ্নে ঊঁকি মারে একটি সুন্দর আগামির আলো।
শিল্পগুণে এবং দার্শনিকতায় কাব্যটি অনবদ্য। নান্দনিক প্রচ্ছদ, সুশোভন বাঁধাই ও সুন্দর কাগজে ঝকঝকে মুদ্রণ প্রকাশক দেশ পাবলিকেশন্স- এর সুকৃতি ও সুরুচির পরিচয়বহ। গ্রন্থটির ব্যাপক প্রচার ও পঠন কাম্য।

(গ্রন্থ পরিচিতি :‘ভাঙা বেহালার অন্ধকার’ । লেখক : সেবক বিশ্বাস। প্রকাশক : দেশ পাবলিকেশন্স, ঢাকা। প্রচ্ছদ শিল্পী : হিমেল হক।

No comments:

Post a Comment